বিসিএস ৩৪তম তে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিরা ৫০ থেকে ৫৫ পেয়েই টিকেছেন আর আমরা যারা সার্টিফিকেট ধারী নই তারা ৭৯ পেয়েও টিকতে পারিনি। এর অর্থ হচ্ছে ওদের থেকে আমাদের মেধা কম! এর পূর্বের বিসিএস গুলোতে কখনোই ৩০% কোটা পূরণ হত না। কোটাধারীরা প্রিলিমিনারি বৈতরণী পার হতে না পারার কারণ ছিল এখানে সবাই সমানভাবে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে টিকতে হত। এবার মাননীয় পিএসসি কে বা কার পরামর্শে আলাদাভাবে প্রিলিতে টিকিয়ে নেবার ব্যবস্থা করেছেন। ধিক্কার জানাই এই ৩৪তম নিয়োগ ব্যবস্থাকে।
বিসিএস এর গ্রুপে দেখলাম অনেকেই এই সুযোগ পেয়ে বাবা-দাদা যুদ্ধকরেছেন বলে বেশ গর্ব করছেন এই বৈষম্য স্পষ্ট জেনেও। তাদের জন্য ছোট্ট একটা বাস্তবতা তুলে ধরছি...
আমার কাকা মুক্তিযোদ্ধা। বাবা ছোট ছিল তাই যুদ্ধ করেনাই কিন্তু কাকা করেছে। কাকা যুদ্ধ করেও সার্টিফিকেট নেয়নাই, জিগ্যেস করতাম কেন নেন নাই সে বলত যুদ্ধ করছি দেশের জন্য, সার্টিফিকেটের জন্য না। চাচাত ভাই এত সহজে বুঝে নাই, চাচার উপর একদিন রাগ করে বলে কেন সার্টিফিকেট নাও নাই, নিলে তো আমার সহজে চাকরি হইত। চাচা সবার সামনে চাচাত ভাইকে বলল "নিজের ধোন দিয়ে মুতবা, ঠিকাছে?"
বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, ঢাকায় থাকার মত জায়গা ছিলনা। হলে উঠার জন্য ছাত্রদলের সাথে আমাকে মিশতে হয়েছে। তত্ত্বাবধারক সরকার এলে আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাত্রলীগে যোগদান করি। গত নির্বাচনের সাথে দুটো ঈদ জড়িত ছিল, বাড়িতে যেতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হল ছিল শিবির এবং ছাত্রদলের শক্ত ঘাঁটি। বাড়ি না গিয়ে ঈদের ছুটিতে হল পাহারা দিয়েছি দখলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। নির্বাচনের আগের রাতে ৪০০ শিবিরের সাথে আমরা বিশজন নানা উপায়ে সংঘর্ষ করে দখল টিকিয়ে রেখেছি। এলাকায় ভোটার হয়েও ঢাকায় রাশেদ খান মেনন এবং ফজলে নুর তাপসের হয়ে নৌকায় ভোট চেয়েছি। তারপর ... অনেক ইতিহাস!
টানাা চারবছর সক্রিয় রাজনীতি করে জীবন ও জীবিকার জন্য সরে এসেছি ছাত্ররাজনীতি থেকে। সরকারের নানা কাজে বিরক্ত হয়েছি তবুও মন থেকে ভালোবাসা চলে যায়নি। সত্যিকথা যেকোন কিছুকে একবার ভালোবাসলে সেটা ঘৃণা করা যায়না। আমি জানি সরকার কোন একটা বিষয়ে বুদ্ধিহীনতায় ভুগছে। অনেক কিছু করার ছিল কিন্তু সেটা করতে পারেনি। শুধু কাগজের গ্রাফ দিয়ে উন্নয়নের হিসেব হয়না। একটা দেশের উন্নয়ন হচ্ছে সেই দেশের জনগণের প্রকৃত সুখ অর্জন সেটা আসেনি।
পদ্মাসেতু নিয়ে আমি অসুখী, শেয়ারবাজার নিয়ে আমি ক্ষুব্ধ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে আমি বিচলিত, গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আমি শংকিত। আমার ভয় হয় দেশ নিয়ে আওয়ামীলীগ নিয়ে নয়। দেশটাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে আমার জন্ম, রাজনীতি দিয়ে সবথেকে বেশি দেশের উপকার করা যায়। অনেক স্বপ্ন ছিল এই পাচঁটি বছর নিয়ে কোন স্বপ্নই পূরণ হয়নি।
ঘুম থেকে যখন উঠার কথা তখন আমি ঘুমাতে যাই, শুয়ে থাকি ঘুম আসেনা। স্বপ্ন দেখতাম প্রত্যেকটা রাজাকারের ফাঁসি হবে। কিন্তু এ স্বপ্ন আমার পূরণ হবার নয়। রাজাকারের গলার সামনে ফাঁসির দড়ি ঝুলছে এ অবস্থায় আওয়ামীলীগ কে ভোট চাইতে হবে আমি ভাবিনি।
বিসিএস আমার সর্বশেষ স্বপ্ন। এ স্বপ্নের দরজায় সবচেয়ে বড় আঘাত গতকাল পেয়েছি। যোগ্যতা প্রমাণের যুদ্ধে কোটার কাছে হেরে গেছি। স্বপ্নিল সুখের পথে আবার একটা দাগ পেলাম। এ দাগ অনেকদিন থাকবে। আশা করছি ক্ষতটা শুকিয়ে যাবে দ্রুতই তবে নতুন কোন স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছেনা।
আঙ্গুল চলতেছে না। রোজা রাখছি, শুয়েই পড়ছিলাম তখন মনে হল কিছু কথা না লিখে ঘুমালে রোজা হবেনা। সারারাত হুদাই জেগে সকালে নাস্তা করে পরে ঘুমাইছিলাম, বিকাল চারটায় ঘুম ভাঙছিল গতদিন। অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বাদপড়া একদল শিক্ষার্থী রাজধানীর শাহবাগে অবরোধ করেছে। আমি ফ্রেস না হয়ে কোন রকম চোখে মুখে পানি দিয়ে শাহবাগ রওনা হলাম।
রাস্তা চারদিক দিয়েই বন্ধ, মাঝখানে স্লোগান হচ্ছে। শাদা শার্ট পরা একলোক (পরে জানলাম নাম শাহীন) মাইকে বলছিলেন আমরা রিট করবো তাই আমাদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও ৩৪তম বিসিএস এর প্রবেশপত্রের কপি লাগবে। আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম; আমার ভাব ভঙ্গি দেখে সে মনে করলো তার মাইক মনে হয় কেড়ে নিবো তাই কনুই দিয়ে আগলে রাখলো। তার কথা বলা শেষ হলে তারে বললাম ভাই অনেকেই তো দূরে থাকে তাহলে একটা মেইল আইডি খুলেন সেখানে সবাই পাঠাতে পারবে। সে আমাকে বলে হ্যা ল্যাপটপ আনানোর ব্যবস্থা করছি দেখছি।
আমি মোবাইলেই [email protected] আইডি খুলে তারে কই একটা আইডি বানাইছি সেটা সবাইকে মাইকে বলে দেন। পরে আমি নিজেই মাইক নিয়ে ঘোষণা দিয়ে দিলাম। এই মুহুর্তে হলের এক ছোটভাই এসে বলে কাকে যেন শাহবাগ থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি ওসিকে প্রথমে কল করে না পেয়ে এক ভাইকে বললাম যেন ছেলেটাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ধীরে ধীরে লোক আসছে। ভিড় ঠেলে সবাই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আমি পেছনে চলে এলাম।
পূবালি ব্যাংকের ওখান থেকে বিড়ি খেতে খেতে দেখি আমার চেনা অনেক শিবির করে এমন ছাত্র এসেছে। হ্যা তারাও পরীক্ষা দিয়েছে ওরা আসতেই পারে। ক্ষুধা লাগছিল পাবলিক লাইব্রেরিরে খাইতে গেলাম পরিচিত কয়েকজন মিলে। খাওয়া শেষে শাহবাগ এসে দেখি মানুষ আর মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে হল। মাইকে শ্লোগান দিচ্ছে 'সকল কোটা বাতিল চাই'। আমি এটা চাইনা, কোটা কি এবং কেন সেটা বিশ্লেষণ যে না জানে সেই শুধু চাইতে পারে সকল কোটা বাতিল চাই।
ভিড় ঠেলে সকলের মাঝে গিয়ে ঐ শাহীন ভাইকে বললাম মেইল এসেছে অনেক। সেগুলোর তখন হয়ত আর প্রয়োজন ছিলনা তাই আমাকে সে এমন ভাবছে দেখছে যেন প্রথম দেখল, 'ভাই বসেন, বসেন'। সে মাইক তুলে দিল এক আপুর হাতে। আপু শ্লোগান দিচ্ছে আমি শুনতে শুনতে ভিড় এড়িয়ে চলে আসলাম। অনেক দূরে চলে এসে কিছুক্ষণ দেখলাম, ভাবছিলাম থাকবো ওখানে কিন্তু ভালো লাগলো না, চলে এলাম।
রাতে রুমে ফিরে দেখি নতুন নামকরণ করা হয়েছে শাহবাগের, 'মেধা উন্নয়ন মঞ্চ'। নতুন ব্যবসা চালু হয়েছে কিছু হলেই কমিটি করে দেয়া হয়। কমিটিও হয়েছে, একজন আহ্বায়ক হয়েছেন তারা বলছেন 'কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে'। যা আশঙ্কা করছি, এই আন্দোলন ভিন্নখাতে পরিচালিত হবে। যিনি আহ্বায়ক হয়েছেন তার সম্পর্কে কিছু খোজ নিলেই বেড়িয়ে যাবে ঘটনা। বেশি কিছু আর বলতে চাইনা। কথাগুলো হারিয়ে যেত তাই খসড়ার মত করে লিখে ফেললাম।
আমি এই 'মেধা উন্নয়ন মঞ্চ' মানিনা। আমার ইচ্ছে ছিল 'Reform Quota' তাই ইমেলটাও সেই নামেই খুলেছিলাম। অনেক মেইল আসছে, এটার পাসোয়ার্ড শুধু আমিই জানি। মেইলে কি আসে সেগুলো অন্য একদিন লিখব।
সবাইকে রমজানের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৩ ভোর ৬:৩৪