somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রেস ফ্রিডম ডে-র ভাবনা কি একটাই? (১ম অংশ)

২৫ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ১১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। ম্যাস্-লাইন মিডিয়া সেন্টারের আয়োজনই এদেশে দিবসটির প্রধানতম উদ্যাপন-অনুষ্ঠান। মুক্ত সাংবাদিকতা বা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এই আয়োজনের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক করার কোনো অবকাশ নেই। আজ আমি কথা তুলতে চাই এই দিবসে, অন্তঃত বাংলাদেশে, যা আলোচিত হচ্ছেÑ তার টেক্সট্ নিয়ে। আমার আলোচনায় মিলিয়ে দেখতে চাই স্বাধীন সংবাদপত্র/গণমাধ্যম বলতে যা নির্দেশ করে, তা মাত্র কয়েকটি বিষয়ের স্বাধীনতাকে নির্দেশ করে থাকে কিনা। আমার পর্যবেণ হলো, প্রেস ফ্রিডম ডে-র আলোচনায় কয়েকটি নয়, বলতে গেলে কেবল একটি এলাকায় ব্যাপকভাবে আলোকপাত করা হয়ে থাকে, এবং অন্য অনেক ত্রে Ñ যেগুলো প্রেসের স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে Ñ আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পরিশেষে এই নিবন্ধ এটাই আবেদন জানাতে চায় যে, যেসব এলাকায়/বিষয়ে প্রেসের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়, প্রেস ফ্রিডম ডে-র আলোচনায় তার সবগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
সাংবাদিকের নিরাপত্তা: একমাত্র যে টেক্সট্
আমি যে-একটি বিষয়ের কথা বলছি, যা প্রেস-ফ্রিডম ডে-র আলোচ্য, তা হলো সাংবাদিক-নির্যাতন। সাংবাদিক-নির্যাতনের ঘটনা অবশ্যই স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য অন্যতম হুমকি, কারণ এযে একেবারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে যাবার ব্যাপার। বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথিবীর মধ্যে এেেত্র একটি ঝুঁকিপ্রবণ দেশ। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত-নিহত হয়েছেন এরকম একসারি নাম সাংবাদিকতা-জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে পড়বে: শামছুর রহমান, মানিক সাহা, টিপু সুলতান, হুমায়ুন কবীর বালু, প্রবীর শিকদার প্রমুখ। আর এসব হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতনের বিপরীতে প্রশাসনের ব্যর্থতা ও বিচার-ব্যবস্থার নাচার চেহারা আমরা সবাই দেখি।
তবে সাংবাদিক-নির্যাতনের বিষয়টি একেবারে নির্ভেজাল প্রপঞ্চ নয়। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতিত হচ্ছেন, শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, এর অন্তঃত দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত, তিনি একেবারে সাপের খোঁড়লে হাত দিয়েছেন, ফলে দংশনে নীল হতে হয়েছে। স্থানীয় দুর্নীতির পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে মতাবহুলদের মুখোশ উন্মোচন করে ফেলছেন, ফলে সাপের ছোবল খেতে হয়েছে। দ্বিতীয় যে-ব্যাপারটি অনুমান করতে কষ্ট হয়না Ñ কিছু অসমর্থিত তথ্যও ইথারে ভেসে বেড়ায় Ñ যে সাংবাদিক নিজেই ঐসব অর্থকরী, অপরাধপ্রবণ কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন এবং সেসব অপরাধ সামাল দিতে যথেষ্ট দ না হওয়ায় প্রতিপরে আক্রমণের শিকার হন। দেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চলে যেহেতু সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে, তাই সেখানকার আন্ডারগ্রাউন্ডের সশস্ত্র রাজনীতির সঙ্গে এই দুই বিষয় মিলিয়ে নিলে আমাদের কাছে নির্যাতনের প্রপঞ্চটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপরন্তু, স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন, সাংবাদিক, অপরাধী, মতাবানÑ সবাই পরস্পরের কাছে পরিচিত হওয়ায়, হাতের নাগালের মধ্যে সবাই সবাইকে পেয়ে যায় বলে নির্যাতনের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। বলা যায়, নির্যাতিত সব সাংবাদিকই যে সততার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওরকম দুর্ঘটের মুখোমুখি হয়েছেন, তা নয়। দুঃখজনক ও ঘৃণ্য এইসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহই বলছি যে, সাংবাদিক-নির্যাতনের ইস্যুটি আলোচনার সময় আমরা হয়তো নির্মোহ ও নিরাবেগ থাকি না।
বাংলাদেশ সংবাদকর্মী-নির্যাতনের পরিপ্রেেিত একটি অন্যতম ঝুঁকিপ্রবণ দেশ। কিন্তু পরিস্থিতি অবশ্যই দুর্নীতিতে শীর্ষে যাবার মতো ভয়ঙ্কর নয়। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, সাংবাদিককে হত্যার নিরিখে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হলো আলজেরিয়া। দেশটিতে ১০ বছরে মোট ৫১ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এরপরে যথাক্রমে রয়েছে কলম্বিয়া, রাশিয়া, রুয়ান্ডা, ভারত, সিয়ারেলিওন, ইরাক, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, আফগানিস্তান। (মঞ্জু, ২০০৪: ২৮) আর এই ১০ বছরে বাংলাদেশে ১৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। (আলম, ২০০৪: ৫৪) তাহলে কেন আমরা প্রেস ফ্রিডম ডে-তে কেবল এই একটি প্রসঙ্গেই প্রতিবছর ঘুরেফিরে আলোচনা করছি?
আমার হাতে রয়েছে ২০০৪ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-র স্যুভেনিরটি। এখানে মোট ১৬টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে দু’টি ছিল সেই দিবসের সেমিনারের মূল প্রবন্ধ। একটি প্রবন্ধ ছিল ড. শাহদীন মালিকের, সেমিনারটির শিরোনাম ছিল ‘জরমযঃ ঃড় ওহভড়ৎসধঃরড়হ—জবপবহঃ ঞৎবহফ রহ ঝড়ঁঃয অংরধ’. আরেকটি প্রবন্ধ ছিল মনজুরুল আহসান বুলবুলের, প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘তবুও এগিয়ে যেতে হবে’। ড. মালিকের প্রবন্ধটি ছিল তথ্য পাবার অধিকার-সংক্রান্ত আইন ও এই অধিকার অর্জন ও চর্চার েেত্র দণি এশিয়ায় কী-পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার বিশ্লেষণ, যা প্রেসের স্বাধীনতার সঙ্গে পরোভাবে সংশ্লিষ্ট। আর মনজুরুল আহসান বুলবুলের লেখাটির মূল আলোকপাত ছিল সাংবাদিকের নিরাপত্তা, এবং কিছু সুপারিশমালা; সুপারিশমালায় ছিল দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায় তার পরামর্শ। আর প্রেস ফ্রিডম ডে-কে সামনে রেখে অন্যান্য মোট ৮টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি প্রবন্ধই ছিল সাংবাদিক-নির্যাতন প্রসঙ্গে। অন্য তিনটি প্রবন্ধের একটি ছিল ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেলের বার্তা। আরেক লেখক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার লেখায় প্রেসের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মুদ্রণ ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের স্বাধীনতার তুলনা, কলামিস্ট-লেখকের রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর লেখাগুলো সেন্সর হয়ে যাওয়া বা ছাপা না হওয়া ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। সহিদ উল্যাহ লিপনের প্রবন্ধে লেখক নির্যাতনের বাইরে কিছু ত্রে চিহ্নিত করেছেন যেগুলোর কারণে প্রেসের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। ত্রেগুলো হলো: আইনী বাধা, বেতন ও নিয়োগের বৈষম্য, সংবাদপত্রে পুঁজির ও বিজ্ঞাপনদাতাদের আধিপত্য, সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বিভক্তি এবং দলীয় সংবাদপত্র। এই লেখাগুলোর বাইরে আরও ৭টি লেখা স্যুভেনিরে ছাপা হয়েছে, যা মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট কিন্তু প্রেস ফ্রিডম ডে-সংশ্লিষ্ট নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রেস ফ্রিডম ডে-র আলোচনায়, লেখালেখিতে প্রাধান্য পাচ্ছে সাংবাদিক-নির্যাতনের ব্যাপারটি, আয়োজক ও লেখকদের ঝোঁকও এখানেই।
এখন দেখা যাক ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-র উদ্যোক্তা ইউনেস্কো দিবসটিকে কীভাবে দেখে। এমএমসির স্যুভেনিরে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কোইশিরো মাৎসুরা বলছেন, বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মুক্ত, স্বাধীন ও বহুমাত্রিক মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলি। ... আমরা যখন ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উদ্যাপন করবো তখন টেকসই শান্তি, গণতন্ত্র ও উন্নয়নে মিডিয়ার জোরালো ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য সব সরকার ও কর্তৃপরে দৃষ্টি আকর্ষণ করার দিকে আলোকপাত করবো। ((Matsuura, 2004: 1) দেখা যাচ্ছে ইউনেস্কো আলাদা করে সাংবাদিকের নিরাপত্তা বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিলেও আমাদের দেশে আলোচ্য একমাত্র বিষয় বলে একে গুরুত্ব দিচ্ছি। মহাপরিচালকের বার্তা থেকে এটাও জানা যায় যে গত বছর এই দিবসের থিম ছিল ‘যুদ্ধ-সংঘাতে আক্রান্ত ও সংঘাত-পরবর্তী ঘটনাবলীতে পূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চলে মিডিয়া’। ((Matsuura, 2004: 2) কিন্তু বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-তে আলোচনা হয়েছে সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিয়ে।
আমি সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টিকে মোটেও খাটো করে দেখছি না, স্বাধীন সাংবাদিকতার সঙ্গে বিষয়টি সরাসরি জড়িত। এই রচনাকে সেভাবে ভুল বুঝলে লেখাটির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। আমার অবস্থান হলো, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ব্যাহত করে এরকম সবগুলো বিষয়কে এই দিবসে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। নিচে তেমন কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হলো।
সরকারী নিয়ন্ত্রণ: প্রচলিত টেক্সট্
প্রেস ফ্রিডম ডে-তে আলোচিত না হোক, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ যে-বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ইতোমধ্যে আলোচিত তা হলো প্রেসের ওপরে সরকারের বা মতাসীনের নিয়ন্ত্রণ। ঐতিহাসিকভাবেই প্রেসের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। পাকিস্তান আমলে প্রেসের রাজনৈতিক ভূমিকার কথা এবং মুক্তিযুদ্ধকালে বেতার, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের সাহসিকতার কথাও আমরা জানি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে মাত্র ৪টি পত্রিকা বাদে বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করার সিদ্ধান্তের কথাও খুব আলোচিত। আর সবচাইতে বেশি আলোচিত স্বৈরাচারী এরশাদ-সরকারের ‘প্রেস অ্যাডভাইস’-এর কথা। বর্তামানের ‘গণতান্ত্রিক’ সময়েও মিডিয়া পুরোপুরি স্বাধীন নয়। মুদ্রণ মাধ্যমকে ছাড় দিলেও সরকার ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমকে কুগিত করে রেখেছে। কলম্বীয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এক সাাৎকারে বলেছিলেন, ক্যাস্ট্রোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের ‘পর্নোগ্রাফিক অবসেশন’ রয়েছে। (গধৎয়ঁবু, ২০০১) টেলিভিশনকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের, তা যে-সরকারই হোক, মনোভাব খানিকটা সেরকমই। বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চলে আসার পরে কেবল নিরুপায় দর্শকেরাই Ñ যাদের কেবল-সংযোগ নেই Ñ বিটিভি দেখে থাকেন। কিন্তু বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদ দেখেও মনে হয় তা যেন বিটিভিরই পরিমার্জিত সংস্করণ। উপস্থাপনা ও আঙ্গিকের কুশলতা রয়েছে কিন্তু আধেয়তে সেই প্রধানমন্ত্রীর স্লট, কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর মুখে কেবিনেট-মিটিঙের সিদ্ধান্তের বয়ান। মুদ্রণ-মাধ্যমে আমরা কেবিনেট-মিটিঙের সিদ্ধান্তসমূহ নিয়ে সংবাদ হতে দেখি না, কিন্তু ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে তা রীতিমতো শিরোনাম আকারে হাজির হয়। ইদানীং মন্ত্রীদের চাইতেও সরকারী দলের যুগ্ম মহাসচিবের সংবাদ বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। সংবাদ হবার েেত্র তার অন্যতম যোগ্যতা সম্ভবত তিনি প্রধানমন্ত্রীর বড়ো সন্তান এবং সরকারী দলটির মূল মতা ভবিষ্যতে তার হাতেই যাবে। বোঝাই যায়, বেসরকারী টিভি-চ্যানেলগুলোর ওপরে, অন্তঃত সংবাদের ওপরে, কড়া-রকমের নিয়ন্ত্রণ সরকারের রয়েছে। এর আগে বিটিভির স্বায়ত্তশাসন নিয়ে লুকোচুরি ও ধাপ্পাবাজি আমরা দেখেছি।
তবে মুদ্রণ মাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণের েেত্র সরকারী বিজ্ঞাপন বণ্টনের কথাও আমরা ভালোভাবেই জানি। প্রতিটি সরকারের কিছু পছন্দের পত্রিকা থাকে, কিছু অপছন্দের পত্রিকা থাকে। যে সরকার মতায় থাকে তখন তার পছন্দের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, অপছন্দের পত্রিকা বাদ পড়ে যায়। পত্রিকার সার্কুলেশনের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন বণ্টনের কথা থাকলেও তা কখনোই কোনো বিবেচ্য বিষয় হয় না। এতে মুশকিলে পড়ে মাঝারি ও ছোট সার্কুলেশনের পত্রিকাগুলো, বড়ো পত্রিকাগুলো অবশ্য আজকাল সরকারী বিজ্ঞাপনের ওপরে একেবারেই নির্ভরশীল নয়, যদিও সরকারী বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির আলোচনায় তারাও যথেষ্ট সোচ্চার। বিশ্বায়নের কারণে গত দেড় দশকে বাংলাদেশেও বেসরকারী খাতের একটা বিকাশ হয়েছে। বেসরকারী বিজ্ঞাপনদাতারাই বড়ো পত্রিকাকেগুলোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা স¤প্রতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন ডিএফপি-র বিশাল অঙ্কের বিজ্ঞাপন কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে নামসর্বস্ব কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড প্রেসের কাছে চলে যাচ্ছে।
সরকারী নিয়ন্ত্রণের এই নানা দিককেও প্রেস ফ্রিডম ডে-র আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
বেসরকারী খাতের নিয়ন্ত্রণ: অপ্রচল কাহিনী
বাংলাদেশের সরকারী খাত যদি দুর্নীতিপরায়ণ হয়, তাহলে বিগত দেড় দশকে বিশ্বায়নের কারণে যে-বেসরকারী খাত বিকশিত হয়েছে তা হলো দুর্বৃত্ত। সংবাদমাধ্যমের ওপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের কথা এদেশে খুব আলোচিত ও চর্বিত বিষয় হলেও বেসরকারী খাতের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি একেবারেই আলোচিত নয়। সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রায় সবগুলোই ঐ ‘দুর্বৃত্ত’ বেসরকারী খাতের মালিকানাধীন হবার কারণে এগুলো নিয়ে তারা একেবারেই আলোচনা করে না; সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মিডিয়া-লেখক ও একাডেমিশিয়ানদের মধ্যেও সেই ধারায় আলোচনা করার চল কম। তাই বেসরকারী খাতের নিয়ন্ত্রণ, যা সরকারী খাতের নিয়ন্ত্রণের চাইতে ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, তা এমনকি প্রেস ফ্রিডম ডে-তে অনালোচিত থেকে যায়।
বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপের ভেতরে থেকে যে-সাংবাদিকতা, তা কীভাবে মুক্ত হতে পারে? তাদের প্রত্য চাপ, পণ্যের খবরাখবর দেবার নানা আব্দারের কথাটি নাই বা ধরলাম, যে-বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিনিয়ত পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন দেয়, তার কোনো ‘দুর্বৃত্তায়ন’-এর খবর একটি পত্রিকা কীভাবে ছাপবে? ছাপছেও না। একটা উদাহরণ দিই। আমার বিভাগের ওপরের কাসের এক ছাত্র, তার কাছ থেকেই গল্পটা শোনা। তবে এ-কিন্তু ‘গল্প’ নয়, নির্জলা সত্যি ঘটনা। ছাত্রটি পড়াশুনার পাশাপাশি একটি প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকে কাজ করে। সে জানতে পারে গভীর রাতে কারা যেন ট্রাকভর্তি করে মাটি এনে গুলশান লেকে ফেলছে। সে কয়েকদিন পর্যবেণ করে, আশপাশের দোকানদারের কাছ থেকে জানতে পারে একটি বিরাট কোম্পানি, যার মালিক মতাসীন দলের এমপি, এই দখলের পেছনে রয়েছে। আবিষ্কারের উত্তেজনায় কমবয়েসী, অনভিজ্ঞ সেই রিপোর্টার বেশ ধারালো একটি প্রতিবেদন লেখে, অফিসে জমা দেয়। কিন্তু তার চিফ রিপোর্টার/নিউজ এডিটর তাকে ধমকে দেন: “ওই মিয়া জানো, এই কোম্পানি প্রতিদিন আমাদের কতো বিজ্ঞাপন দেয়? এই রিপোর্ট যাবে না।” চিফ রিপোর্টার না বললেও রিপোর্টার মেসেজ পেয়ে যান, এধরনের প্রতিবেদন আর রচনা করা যাবে না।
আমি সাংবাদিকতার চর্চায় নেই, এধরনের গল্প আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন ইন-হাউস রিপোর্টার ও সহ-সম্পাদকরা। তবে মিডিয়ার চরিত্র-লণ দেখে আমাদের কাছে সব জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। ‘বাজারে এসেছে নতুন পণ্য’-জাতীয় সংবাদগুলো, যার অর্থমূল্য থাকলেও সংবাদমূল্য সামান্যও নেই, বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপেই যে প্রকাশ করতে হয়, তা আর বলার অপো রাখে না। বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই, কিন্তু সংবাদের ছদ্মবেশে সে হাজির হলো তা অনেক কার্যকর হয়। তো এরকম একটি পরিস্থিতিতে মুক্ত সাংবাদিকতা কি আদৌ সম্ভব। এই প্রশ্নগুলো প্রেস ফ্রিডম ডে-তে কেন উত্থাপিত হবে না?
সেলফোন-কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিডিয়া-হাউসগুলোর সম্পর্ক বা লেন-দেন নিয়ে মহাকাব্য হতে পারে। আমি নিশ্চিত জানি অনেক অনেক পাঠক চিঠিপত্র পাতায় সেলফোন-কোম্পানিগুলোর প্রতারণা, ভুল বিল, বিলের উচ্চহার, প্যাকেজ/অফারের নামে ধাপ্পাবাজি নিয়ে প্রচুর, সুপ্রচুর চিঠি লিখেছেনÑ তাদের চিঠিগুলো ছাপা হয় নি। এইসব অন্যায় নিয়ে শক্ত কোনো রিপোর্ট, কোনো সম্পাদকীয় পত্রিকাগুলো লিখে নি, চ্যানেলগুলো কোনো আইটেম প্রচার করে নি। যদিওবা কোনো সংবাদ হয়, নিশ্চয়ই নিয়মিত হয়, তা প্রোমোশনাল: কোন্ নতুন প্যাকেজ আসলো ইত্যাদি। যদি সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ স্লটের স্পন্সর হয়ে সংবাদের শিরোনামসমূহের শিরোনাম হয় ‘সিটিসেল সংবাদ-শিরোনাম’ কিংবা ‘গ্রামীণ ফোন খেলার খবর’ তাহলে চ্যানেলগুলোর আর উপায় থাকে না এদের ব্যাপারে ক্রিটিকাল হওয়া। আজকাল ভোক্তারা লেখার মাধ্যমে সমস্যা জানানোর সুযোগই পাচ্ছে না, তাই তারা মাঠে নেমেছেন, প্রতিবাদ-সমাবেশ করছেন। মিডিয়াগুলো বাধ্য হয়ে ভেতরের পাতায় এক-কলামে নিউজ করছে। মোবাইল ফোনের এই ভোক্তারা আবার পত্রিকার পাঠকও তো, তাদেরও হারালে চলে না।
বেসরকারী খাতের এইসব দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে কোনো ক্রিটিকাল রিপোর্ট সংবাদ-মাধ্যমে পাওয়া যায় না। যদি কখনো পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ঐ পত্রিকার মালিকপরে যাকে নিয়ে রিপোর্ট করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। নইলে সংবাদমাধ্যগুলো বেসরকারী খাতের দ্রুত বিকাশের পইে কাজ করে থাকে। সরকারী খাতের দুর্নীতি অব্যবস্থা তুলে ধরা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ১২:৩৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×