বেসরকারী খাতকে গতিশীল, স্মার্ট প্রমাণ করা একটি অন্যতম এজেন্ডা।
সংবাদ-মাধ্যমের ল্য-উদ্দেশ্য-এজেন্ডা পরিবর্তিত হয়ে যাবার পরিপ্রেেিত এইসব সীমাবদ্ধতা, পরাধীনতার কথা কি আমরা প্রেস ফ্রিডম ডে-তে আলোচনা করবো না? এই বিজ্ঞাপনদাতা, বেসরকারী খাতের কবল থেকে মিডিয়াকে আরও স্বাধীন কীভাবে করে তোলা যায়, তার দিক-নির্দেশনা কি আমরা প্রেস ফ্রিডম ডে-তে খোঁজার চেষ্ট করবো না?
শ্রেণী/লিঙ্গ/গোত্র: ‘অপর’-উপোর খতিয়ান
স্বাধীন মিডিয়া বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? যে নির্ভয়ে সবকিছু বলতে পারে, কোনো শক্তি যাতে তাকে সত্যপ্রকাশে বাধা দিতে না পারে। কিন্তু আমরা দেখছি মিডিয়ার ওপরে সরকারী নিয়ন্ত্রণ আছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছেও সে পরাধীন। তবে কি এই দুই খাতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলেই মিডিয়া পুরোপুরি স্বাধীন হয়?
যখন মিডিয়া গ্রামকে উপো করে, শহরকে বেশি গুরুত্ব দেয়Ñ দিতে বাধ্য হয়, তখনও কি সে পুরোপুরি স্বাধীন থাকছে? নাগরিক জীবনের খবরাখবর, সমস্যা, অর্জন প্রথম পাতা ও চ্যানেলের শিরোনাম জুড়ে থাকে। আর গ্রামীণ জীবন পড়ে থাকে ‘মফস্বল পাতা’য় অথবা ‘জনপদের খবর’-এ, অনাদরে। সংবাদ গ্রহণ-বর্জন কিংবা ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে গ্রাম-শহরকে নিয়ে মিডিয়ার মনোভাব কী তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। আর মিডিয়া যেন বড়োলোকদের জন্যই, গরীব লোকদের তাতে স্থান নেই যদিও টেলিভিশন-দর্শকদের বিরাট অংশই হলো গরীব মানুষেরা। টেলিফিল্ম কিংবা মেগাসিরিয়ালে আমরা যে চোখ ধাঁধাঁনো ড্রয়িংরুম, প্রাসাদোপম বাড়ি দেখি তা সব শ্রেণীকে অনুমোদন করে না। নিঃসন্দেহে এগুলো গরীব কিংবা মধ্যবিত্তের গল্প নয়। কিংবা পত্রিকার ফিচার পাতায় যে ইন্টেরিয়রের ছবি ছাপা হয়, যে ফ্যাশন-আইটেমের, যে নতুন খাবারের দোকানের সন্ধান দেয়া হয় তার সবই তো সাধারণ মানুষের ক্রয়মতার বাইরে। সেলিম রেজা নিউটন বলছেন:
আপনি দেখবেন প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, জনকণ্ঠ বা যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠাÑ এটা বড়োলোকদের ড্রয়িংরুম। বড়োলোকদের ড্রয়িংরুমে দেশ নিয়ে তাদের যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে, আলোচনার মধ্যে আড্ডার মধ্যে আসে, সেই উদ্বেগ সেই উৎকণ্ঠা সেই এজেন্ডাই এই পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতার এজেন্ডা। এখানে যদি আমি গ্রামকে আশা করে থাকি তাহলে সেই আশা পূর্ণ হবে না। (নিউটন, ২০০৩: ১৪০-১৪১)
তাহলে এই যে মিডিয়া গ্রামকে আনতে পারছে না, এেেত্রও মিডিয়াকে কি আমরা স্বাধীন বলতে পারি?
কিংবা ধরা যাক, আমাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর কী চিত্র মিডিয়ায় দেখছি? মিডিয়ায় নারীর রূপায়ণ যেমন অবমাননাকর, তেমনি এই প্রতিষ্ঠানে তার অংশগ্রহণও পুরুষের তুলনায় খুবই কম। সংবাদে নারীকে উপস্থাপন করা হয় অসহায়, দুর্বল হিসেবে। সংবাদে তাই প্রায়ই ল করা যায় ‘নারী ও শিশুসহ ... জন নিহত’-ধরনের শিরোনাম। সংবাদপত্রে নারী প্রধানত ঘটনার শিকার হিসেবেই উপস্থাপিত হয়ে থাকে। সক্রিয় সংবাদ-উপাদান হিসেবে তাকে খুব একটা দেখা যায় না। নারী-নির্যাতনের সংবাদ, অপরাধবিষয়ক সংবাদ, গসিপ ফ্যাশন ইত্যাদি সংবাদ পত্রিকায় বেশি বেশি ছাপা হয় এবং নারীকে সেখানে যৌনবস্তু ও প্রদর্শনযোগ্য সৌন্দর্যের আধার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে নারী-সংশ্লিষ্ট খবর, ফিচার প্রকাশের চাইতে নারীর ছবি পত্রিকায় বেশি হয়ে থাকে। প্রদর্শনী, পাবলিক পরীা, মেলা ইত্যাদি আইটেমে অবধারিতভাবে নারীর ছবি ছাপা হয়ে থাকে। আর সংবাদমাধ্যমগুলোতে নারীর অংশগ্রহণও খুব কম। বাংলাদেশের অন্য অনেক েেত্র নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও মিডিয়ায় সে-হারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে নি। একটি পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে “ঢাকা শহরে কর্মরত ১৫০০ সাংবাদিকের মধ্যে নারী সাংবাদিকের সংখ্যা প্রায় ৬০ জন। অর্থাৎ মোট সাংবাদিকের চার শতাংশ নারী।” (রাজী, ২০০৩) মিডিয়ার সিদ্ধান্তগ্রহণ স্তরে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। টেলিভিশন-সংবাদে অনেক নারীকে দেখা গেলেও তাদের বেশিরভাগের ভূমিকাই নিউজ-প্রেজেন্টারের, রিপোর্টিংয়ে তাদের কমই দেখা যায়। আবার নিউজ-প্রেজেন্টারদের মধ্যে পুরুষের চাইতে নারীর সংখা অনেক বেশি হয়ে থাকে। এটা প্রমাণ করে যে, টেলিভিশনের সংবাদ-বিভাগে নারীর সৌন্দর্যকে বেশি মূল্য দেয়া হচ্ছে। মুদ্রণমাধ্যমের তুলনায় ভিস্যুয়ালমাধ্যমে তাকে খানিকটা বেশি মাত্রায় দেখা যাবার কারণ হলো সে ‘নারী’।
এই যে মিডিয়ার নারীকে সৌন্দর্যসামগ্রী হিসেবে, দুর্বল হিসেবে, নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরছে, তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছেÑ এেেত্রও তো মিডিয়া স্বাধীনভাবে আচরণ করতে পারছে না। কারণ সমাজ নারীকে এইরূপে দেখে থাকে, আর মিডিয়া তার চরিত্রগত ও ব্যবসায়িক কারণে সমাজে বিদ্যমান শক্তিশালী বিশ্বাসগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করে না।
আবার সমাজের সব গোত্রের প্রতি মিডিয়া সমান ও সংবেদনশীল আচরণ করে না। আদিবাসীদের নিয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্টিরিওটিপিক্যাল’Ñ সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখ দিয়ে ‘অপর’ আদিবাসীদের সে দেখে। স¤প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা রাঙামাটিতে এক সংবাদ-সম্মেলনে, যেখানে লেখকও উপস্থিত ছিলেন, এক প্রশ্নের জবাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুতে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে তার মন্তব্য করেন। তার সংপ্তি মন্তব্য ছিল: ‘ভালো না’। অনেক সংঘাতের ঘটনা ঠিকমতো যাচাই না করেই, ঘটনাস্থলে না গিয়ে, রাঙামাটি শহরে বসে, অনেক সময়ে প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর বিবৃতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন রচনা করা হয়। সংঘাতের অকুস্থল যদি হয় গহীন অঞ্চল, তবে প্রায় সময়ই রিপোর্টগুলো এরকমই হয়ে থাকে। আর আলোকচিত্রীরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে আদিবাসীদের কেবল খণ্ডিত জীবন দেখেন। তাদের দৈহিক সৌন্দর্য, তাদের উৎসবকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, তাদের জীবনযাত্রার সহজলভ্য ও ধরাবাঁধা কিছু বিষয়ই আলোকচিত্রে ঘুরেফিরে আসে। ‘‘বাঙালি ক্যামেরার দৌড় কেবল ‘আদিবাসী’র মাথা থেকে পা পর্যন্তই। কিন্তু তার পায়ের তলার মাটি ও মাথার উপরে আকাশ ও স্বপ্ন কী করে নিরন্তর রাষ্ট্রের দাপুটে তাণ্ডবে দখল-নিশ্চিহ্ন-গুম-নিরুদ্দেশ-জখম হয়ে যায় সে বিষয়ে গর্জে ওঠার মতন মেরুদণ্ড আমাদের বাঙালি ক্যামেরাগুলার হয়ে ওঠেনি।” (পার্থ, ২০০৪: ৪৫)
সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের নিয়ে মিডিয়ার এই যে খণ্ডিত চিত্রায়ণ, এেেত্রও কি মিডিয়া স্বাধীন থাকতে পারছে? কারণ তার মেকানিজমের মধ্যে সমস্যা আছে। তার প্রধান সমস্যা হলো সে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘুরা তার কাছে ‘অপর’-ই থেকে যাচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে শ্রেণী, লিঙ্গ, গোত্র বিচারেও মিডিয়া পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তার অন্তর্নিহিত চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে একদিকে ব্যবসা করতে চায় তাই এমন কিছু সে করতে পারে না যাতে তার ব্যবসা তিগ্রস্ত হয়। ফলে সমাজে বিদ্যমান ধ্যানধ্যারণার বিপরীতে সে অনেকেেত্র যেতে পারে না। অন্যদিকে ঐতিহাসিক কারণে তাকে সমাজের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতে হয়, অন্তঃত মানুষ এখনও মিডিয়ার কাছ থেকে সেরকমই প্রত্যাশা করে। এই দুই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের দুই ল্য পূরণ করতে গিয়ে সে অনেক আপস করে, অনেক সময় তার অপভূমিকা প্রকট হয়ে ওঠে। সর্বোপরি সে প্রকাশ্যে বলে স্বাধীনভাবে সমাজের জন্য অবদান রাখতে চায়, কিন্তু পদে পদে সে থাকে পরাধীনতায় শৃঙ্খলাবদ্ধ।
শেষ কথা
আমার আলোচনায় আমি এটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছি যে, বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-র আলোচনায় সাংবাদিকের নিরাপত্তার দিকে বেশি আলোকপাত করা হয়, কিন্তু অন্য অনেক ত্রে যেগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত করে কিংবা যে যে েেত্র সে স্বাধীনভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছেÑ সেই বিষয়গুলোও আলোচনায় আসা উচিত। সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অন্য বিষয়গুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তথ্যসূত্র
মঞ্জু, কামরুল আহসান (২০০৪); ‘বিশ্ব পরিসরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক নির্যাতন ২০০৩’, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে ২০০৪; এমএমসি; ঢাকা।
আলম, মীর সাহিদুল (২০০৪); ‘স্থানীয় প্রেপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে ২০০৪; এমএমসি; ঢাকা।
গধঃংঁঁৎধ, কড়রপযরৎড় (২০০৪); ‘গবংংধমব’, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে ২০০৪; এমএমসি; ঢাকা।
গধৎয়ঁবু, এধনৎরবষ এধৎপরধ (২০০১); ‘এধনৎরবষ এধৎপরধ গধৎয়ঁবু ড়হ খধঃরহ অসবৎরপধ’, গরপৎড়ংড়ভঃ ঊহপধৎঃধ ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ; গরপৎড়ংড়ভঃ ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃরড়হ.
নিউটন, সেলিম রেজা (২০০৩); ‘নতুন ধারার সাংবাদিকতার সন্ধানে’, প্রান্তজন; ম্যাস্-লাইন মিডিয়া সেন্টার; ঢাকা।
পার্থ, পাভেল (২০০৪); ‘বাঙালির ক্যামেরাগিরিতে অপর আলোকচিত্র’, কাউন্টার ফটো; দৃক আলোকচিত্র গ্রন্থাগার ও কাউন্টার ফটো-এ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন; ঢাকা।
রাজী, খ আলী আর (২০০৩); ‘নারী সাংবাদিক: ৩০ বছরের চালচিত্র’; নিরীা; ডিসেম্বর ২০০৩; ১১৭তম সংখ্যা; পিআইবি; ঢাকা।
এমএমসি আয়োজিত প্রেস ফ্রিডম ডে, ২০০৫ উপলে প্রকাশিত স্যুভেনির-এ প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০০৭ রাত ১২:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




