[টেলিভিশনের নাটক বা চলচ্চিত্রে সংলাপের ভাষা কেবল প্রমিতই হবে না অনানুষ্ঠানিক বা শহুরে কথ্য ভাষাও চলবে, তা নিয়ে একটা ভালো বিতর্ক হচ্ছিল প্রথম আলোর পাতায়। আমিও সেই বিতর্ক অংশ নেবার বাসনায় একটা লেখা লিখি। কিন্তু সিডর-ঝড়ে সে বিতর্ক ভেসে গেছে। আমার প্রতিক্রিয়াটি ছাপার আগেই তা থেমে যায়। অপ্রকাশিত লেখাটি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।]
প্রথম আলোর পাতায় সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে ও বিশেষত টেলিভিশনের নাটকে কীরকম ভাষা ব্যবহৃত হবে তা নিয়ে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ও জরুরি একটা আলোচনা বা বিতর্ক হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেহতাব খানম এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটান, ৬ নভেম্বরে, তার কলামে। এই বিতর্কের আপাতভাবে দুইটি দিক দৃশ্যমান হলেও মোটমাট তিনটি পক্ষ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
এক পক্ষ মনে করেন (মেহতাব খানম, সৌমিত্র শেখর, উম্মে মুসলিমা) টেলিফিল্ম বা ড্রামা সিরিয়ালের পাত্র-পাত্রীদের মুখের সংলাপ প্রমিত বাংলায় হওয়া উচিত, যেমনটি এতদিন হয়ে আসছিল। কিন্তু কিছু কিছু নির্মাতার টেলিফিল্মে বা সিরিয়ালে পাত্র-পাত্রীরা অ-প্রমিত বাংলায় (তথাকথিত কথ্য বা আঞ্চলিক) কথা বলছেন। এতে মান বাংলার বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে, বিশেষত ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমপ্রিয় এযুগের শিশু-কিশোরদের প্রমিত বাংলা না-শেখার এবং ভাষা নিয়ে বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে যাবার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় পে রয়েছেন এই 'কিছু কিছু নির্মাতা' দের মধ্যে অন্যতম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি মনে করেন তার চলচ্চিত্রে বা ড্রামা সিরিয়ালে তিনি যা করছেন তার চলচ্চিত্রের পারফেকশনের খাতিরে করছেন, ঐসব নাগরিক পাত্র-পাত্রীরা যে-কথ্যভাষা ব্যবহার করেন, ডিটেইলের খাতিরে ঐ কথ্যভাষাকেই তিনি চলচ্চিত্রে তুলে আনছেন (এতদিন কেউই এটা করতেন না)। ভাষাবিজ্ঞানী সৌরভ সিকদার, চলচ্চিত্রকর্মী হুমায়ূন সাধু প্রমুখ ব্যক্তি ফারুকীর পক্ষাবলম্বন করেন। আর তৃতীয় পক্ষের কেউ এখন পর্যন্ত আলোচনায় অংশ নেননি, কিন্তু তারা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের থেকে পূর্ববঙ্গের পৃথক একটি বাংলারূপ রয়েছে। এই ভাষার প্রয়োগ কেবল পাত্র-পাত্রীর সংলাপে সীমিত রাখলে চলবে না, গল্পের মূল বর্ণনায় এমনকি কবিতার রসসৃজনে একে ব্যবহার করতে হবে (উম্মে মুসলিমা উদ্ধৃত 'বিল্লাল হালিম খাইতাছে' শিরোনামের কবিতার কথা স্মরণীয়)। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রতিভাবন কিছু লেখক-সম্পাদক এই পক্ষে রয়েছেন। তারা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে আধিপত্যশীল সাহিত্য বা ভাষার বিপরীতে সেই ভাষাই হবে আমাদের পৃথক আত্মপরিচয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার আনিসুল হকের দ্বিতীয় পরে পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষের প্রতিও অনুমোদন আছে কিনা, তা আমার স্পষ্ট জানা নেই; কিন্তু এই আলোচনায় আমি ফারুকীকেই সমর্থন জানাতে চাই। আর বলতে চাই কোনো কোনো আলোচক দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষকে গুলিয়ে ফেলছেন, ফলে এই চমৎকার আলোচনাটি একটি পূর্ণতার দিকে যেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জনাব ফারুকী তার লেখায় স্পষ্ট করেছেন ভাষার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ব্যবহার সম্পর্কে। তিনি বলতে চেয়েছেন সংবাদপাঠের মতো অনুষ্ঠানগুলো প্রমিত বাংলাতেই করতে হবে। কিন্তু টেলিফিল্মে চরিত্রানুযায়ী অনানুষ্ঠানিক বা কথ্যভাষার ব্যবহার হওয়াটা দোষের কিছু হতে পারেনা। তার যুক্তিকেই আমি একটু বিশদ করতে চাই। ধরা যাক একটি গ্রামের গল্প, উপন্যাসে গল্পটি বর্ণিত হচ্ছে প্রমিত ভাষায়। কিন্তু পাত্র-পাত্রীর সংলাপগুলো লেখক উল্লেখ করছেন আঞ্চলিক ভাষায়। আমরা সেটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছি। গ্রামের করিম শেখের মুখে প্রমিত বাংলা বসালে অনেক পাঠকই, পরের সংলাপ আসার আগেই, ঐ উপন্যাসটি পড়া বন্ধ করে দেবেন। এখন ধরি সেই উপন্যাসটিরই চলচ্চিত্রায়ন হচ্ছে। করিম শেখ কথা বলছেন তার স্ত্রীর সঙ্গে সংসারের অনটন নিয়ে, জোতদারের কাছে ঋণ চাচ্ছেন, জোতদার আগের সুদ-আসল শোধ হয়নি বলে নতুন ঋণ দিতে চাচ্ছেন না ... শুধুই সংলাপ, পুরোটাই আঞ্চলিক। লেখকের প্রমিত বর্ণনা উধাও। কারণ তার বর্ণনার কাজটি ক্যামেরা করছে, প্রমিত স্টাইলে। এবার ধরা যাক ঢাকা শহরের গল্প। লেখক বর্ণনা করছেন প্রমিত বাংলায়। মেয়েটি ছেলেটির জন্য অপো করছে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে, ছেলেটি আসছে না। মেয়েটি সেলফোনে ছেলেটিকে ধরে, 'তুমি কই?' ছেলেটি বলে, 'আধা ঘণ্টা মহাখালীর জ্যামে আটকা আছি ...।' এখানে মেয়েটি বলতে পারতো -- 'তুমি কোথায়'; কিন্তু 'তুমি কই' বলাটাও দোষের কিছু হতে পারেনা। কারণ অনেক নাগরিক তরুণ-তরুণী 'কোথায়' না বলে 'কই' বলে থাকেন। এখন এই গল্পটা নিয়ে যদি চলচ্চিত্র হয়, তাহলেও তো প্রমিত কিছুই পাওয়া যাবে না। কারণ লেখকের বর্ণনা বা ন্যারেশনের দায়িত্ব নিয়েছে ক্যামেরা, অপোরত মেয়েটিকে দেখানোর আগে জাদুঘরের নেমপ্লেটের শটটা সেই নিয়েছে। কিন্তু আমরা করিম শেখের কাহিনীটা মেনে নিতে পারছি, নাগরিক ছেলে-মেয়েদের কথ্যভাষার সংলাপ কেন মেনে নিতে পারছি না? আমাদের এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, বাস্তবানুগতার দাবি গল্প-উপন্যাসের চাইতে চলচ্চিত্রে আরও বেশি। নয়তো দর্শক ধরে ফেলে, বলে, 'কইলো শাহবাগ, দেখাইলো স্বামীবাগ।'
এখন এটা সঙ্গে যদি 'কথ্যভাষার কবিতা'কে মিলিয়ে ফেলি, তবে অন্যায় হবে। ফারুকীর চলচ্চিত্র-সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার অন্য কী কী কারণ আছে আমি ভালো জানিনা, তবে চরিত্রগুলোর বাস্তবানুগ ভাষা ব্যবহার এবং অনানুষ্ঠানিক অভিনয়রীতি যে অন্যতম, সেটা বুঝি। কারণ এতে চরিত্রগুলো অধিক বিশ্বস্ত হয়ে উঠে। দর্শকের কাছে চরিত্রগুলোকে চেনা মনে হয়। এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ যেমন নেই, তেমনি নেই প্রমিত বাংলাকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্র। শিল্পীর স্বাধীনতা নামক দাবিকে নিছক স্বার্থপরতা বলা তাই ভুলই হবে। চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রীদের সংলাপনির্ভর এই ভাষা এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর বিজ্ঞাপনের খিচুড়ি ভাষার সঙ্গেও কিন্তু এর স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞাপন ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে নতুন একটি খিচুড়ি রাঁধতে চাইছে, সে কথ্য বা প্রমিত সবকিছুকেই পদানত করতে চাইছে। একে নাশকতাই বলতে হবে।
আর কবিতায় বিল্লাল এখনও হয়তো হালিম খাইতাছে, তা থেকে হাস্যরসও সঞ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু কাব্যরস কতটুকু জারিত হচ্ছে, বলা মুশকিল। সাহিত্যের বিচিত্রতার ভাণ্ডারে এও হয়তো একটি সংযোজনী, কিন্তু এই নিরীক্ষা কতটুক সফল হবে তা সময়ই বলে দেবে।
কিন্তু মেহতাব খানমের উদ্বেগটাকে এখনও দূর করা যাচ্ছে না। কারণ হলো, শিশু-কিশোরদের ভাষা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেবার উদ্বেগটি যথাযথ। কিন্তু প্রমিত বাংলা শেখানোর দায়িত্বটি কি কেবল চলচ্চিত্রের এবং সিরিয়ালের? আর কয়টি টেলিফিল্মই বা ঐ ভাষা ব্যবহার করছে? এত এত সংবাদ, এত টকশো, ব্যাকরণ বই, স্কুল, পরিবারÑ এদের সবার অবদান কি ফারুকীর সিরিয়ালের কাছে ভেসে যাবে? বাচ্চারা ফারুকীর সিরিয়ালের চাইতে অনেক বেশি প্রভাবিত হয় ফারুকীর বিজ্ঞাপন দেখে। আমাদের বরং দেখা দরকার বিজ্ঞাপনে ফারুকী কী কী অন্যায় করছেন। আরেকটি বিষয় হলো, আপনি যতই প্রমিত শেখান না কেন, বাচ্চারা বড়ো হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কি শেষপর্যন্ত 'করতেছি', 'পড়তেছি' বলে না? বাসের মধ্যে কনডাক্টরকে 'ভাড়া দিতেছি' বলে না? সামাজিক প্রতিটি সংসর্গে যারা প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতে পারেন তাদের সাধুবাদ জানাই, কিন্তু তা করতে পারা কি এতই সহজ? সর্বত্র মান ভাষা ব্যবহার করলে বরং খানিক বিড়ম্বনাই কপালে জুটতে পারে। যে-শিক কাসে প্রমিত ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ পড়ান, স্কুলের গেট থেকে বের হয়ে তিনিই বলেন, 'এই রিকশা, যা(ই)বা?' এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতাই ফারুকীর ফিল্মে ধরা পড়ে। তিনি কেবল শিল্পীর স্বাধীনতাকেই প্রশ্রয় দেননি, চলচ্চিত্রকে অধিক বিশ্বস্ত করে তোলার দায়িত্বও পালন করেছেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




