somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপসের গল্প

২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৮ ভোর ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাইফ ইজ ফুল অফ কমপ্রোমাইজেস।

কথাটা আবুল বাশার এমন সিরিয়াস ভঙ্গীতে বলে যে আপাত-সবার-জানা কথাটিকেই আমাদের অমোঘ দার্শনিক উক্তি বলে মনে হয়। যেন বাণী-চিরন্তনীর পরবর্তী সংস্করণে এটি ভুক্তি হতে যাচ্ছে আবুল বাশারের নামে। সেই সূত্রে প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা এনজিওগুলোর বাৎসরিক ডায়েরি কিংবা ক্যালন্ডারের কোনো এক পাতার নিচে এখন থেকে অবশ্যম্ভাবীরূপে লেখা থাকবে 'আপসই জীবন -- আবুল বাশার'। আমাদের কারও কারও এরকম মনে হয় যেন বাশার এইমাত্র ঐশ্বরিক আয়াতপ্রাপ্ত হলো, দীর্ঘণ ধ্যানমগ্ন ছিল কোনো গুহায়।

সেদিনটা বিশেষ কোনো দিন ছিল না, প্রতিদিনের মতোই জ্যামে-ঘামে, জটে-ধূলায় আমাদের দিনটা দুর্বিসহ ছিল, কিন্তু আমরা দিনটিকে বিশেষ বানিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিই। আমরা কয়েকজন তপনের বাড়ির ছাদে মিলিত হই, পানের আসর বসাই। আমরা কয়েকজন, পুরনো বন্ধু, আমরা মাঝে মাঝে এরকম গেট-টুগেদারে বসি। পান করি, গান করি এবং সুযোগ থাকলে জোছনায় স্নান করি। নগরে চাঁদের দেখা কোনোক্রমে মেলে কিন্তু জোছনার দেখা মেলে না। তাই আমরা প্রায়ই জোছনা দেখতে নগরের সামান্য বাইরে যাই। আজকাল নাগরিক রোমান্টিকরা সূর্য দেখতে, পাখি দেখতে, মহাকাশ দেখতে, ঘুড়ি ওড়াতে বহু দূরে যায়। আমাদের জোছনা দেখাটা অতখানি রোমান্টিক হয়ে ওঠে না, কারণ জোছনা দেখতে আমরা চলে যাই আশুলিয়ায় কিংবা শীতল্যায়।

সেদিনটা আমাদের কাছে আরও বিশেষ হয়ে ওঠে আবুল বাশারের ওই মহার্ঘ্য-উক্তির পরে। বাশারের উক্তি আমাদের আচ্ছন্ন করে, আমাদের জীবনে করা আপসগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। আমরাও ধ্যামমগ্ন হয়ে গুহায় ঢুকে পড়ি, গুহার নির্জনতা-শীতলতা-অনালোক আমাদের গ্রাস করে। বিপন্নতা থেকে মুক্ত হতে আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে বাশারকে নিয়ে পড়ি, তার কাছে শুনতে চাই তার কম্প্রোমাইজের কথা। জড়ানো অথচ জোর গলায় কেউ বলে ওঠে, আমার জীবনে কোনো আপস নেই। আমি স্বাধীনচেতা, জীবনের সব ডিসিশন একাই নিছি -- এক্ষেত্রে বাপকেও এলাউ করি নাই।

সিদ্ধান্ত হয়, স্বাধীনচেতা সামাদুলের কাহিনী আমরা আরেকদিন শুনবো, (ওর না-শোনা কোনো কাহিনী বাকি আছে বলে আমরা মনে করিনা) আজ আবুল বাশারের আপসের কাহিনীটি না শুনলে চলছে না। অন্তরের গহীন থেকে যে-বাণী উচ্চারিত হয়, তাকে বিশেষ মূল্য দেবার রীতি আমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। বিশেষত পানের আসরে স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেলে কেউ কেউ গভীর দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়, থলে থেকে কারও কারও বিশেষ বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। সেই বেড়ালকে এমনি এমনি চলে যেতে দেওয়া মানে বিরাট তি। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, আমাদের বন্ধুকূলে বাশার খানিকটা নবাগত, অন্তর্মুখী বাশারের অন্তরের অনেক খবরই আমাদের অজানা। আজ যদি কিছু জানা যায়, সুরার বদৌলতে!

-- আমি তখন স্মাগলিং করতাম।
আমরা সচকিত হয়ে, ঝিমুনিমগ্ন মাথা তুলে সবাই তাকাই বাশারের দিকে।
-- আমি যে-এলাকায় জন্মেছি ও বড়ো হয়েছি সেই অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা একসময় ছিলো স্মাগলিং। নদীর এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত। এপারে কাজকর্ম নেই, নদী পেরুলেই কর্মসংস্থান। কারও কোনও নৈতিকতার বালাই ছিলো না, সবাই একে স্বাভাবিক বলেই মানতো। আমাদের মসজিদের ইমামও এই ব্যবসা করতো। তার যুক্তি অবশ্য বেশ ধারালো ছিলো: এটা তার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ব্যবসা। সাতচল্লিশের আগেও তার বাপ নদীর ওপারে গিয়ে মাল এনে এপারে বিক্রি করতো। পাকিস্তান আমলেও করতো। এখন সে করে। এরমধ্যে এক দেশ দুই হয়ে গেলে তার কী করার আছে। সে বা তার বাপ তো আর দেশভাগ করে নাই।
-- মারাত্মক যুক্তি, তপন বলে।
-- এখন বৈধ বাণিজ্য বেড়েছে, ওখানকার প্রধান পেশা আর চোরাচালান নেই, মানুষ অন্য পেশা খুঁজে নিয়েছে, কিংবা বেকার হয়েছে কিংবা যমুনা সেতুর কল্যাণে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করছে।
-- কী স্মাগলিং করতি?
-- এপারে যখন যেটার ক্রাইসিস হতো -- চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। তবে সার্বণিক পণ্য ছিলো প্রিন্টের শাড়ি। মহিলারা খুব পছন্দ করতো ইন্ডিয়ান প্রিন্ট শাড়ি, একশো থেকে দেড়শোর মধ্যে তখন ভালো শাড়ি পাওয়া যেত; দামি শাড়িও থাকতো। এখন তো প্রাইড এসেছে, টাঙ্গাইলের শাড়ি সস্তা হয়েছে, আরও কত কিছু। শীতের সময়ে শালও আনতাম, সব শালকেই কাশ্মিরি শাল বলে চালিয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে সামান্য কিছু উপদ্রব ছাড়া নির্বিঘেœই কাজ চলতো। বিডিআর-বিএসএফ-পুলিশ সবার সঙ্গেই মাসিক ভিত্তিতে ব্যবস্থা থাকতো। সন্ধ্যার পরে নদীর ধারে আইনুলের নৌকা থাকতো, তিরিশ মিনিটে ওপারে, এক ঘণ্টার মধ্যে বিপিনের গোডাউনে, যখন যেটা চাইতাম পেয়ে যেতাম, মাথায় করে আইনুলের নৌকায় করে আড়াই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি।
-- কবেকার ঘটনা?
-- আমি তখন কলেজে পড়ি। বাপ হলো কৃষক, পড়ার খরচ দেবে কোত্থেকে? সায়েন্সের সাবজেক্টগুলো প্রাইভেট পড়তে হতো কলেজেরই স্যারের কাছে, নয়তো ভালো করা খুব মুশকিল ছিলো, ম্যাথস্ আমার মাথায় একদম ঢুকতো না। বাংলা-ইংরেজিতে আমি ভালো ছিলাম, বেশ ভালোই বলতে হবে। ইংরেজিতে লেটার ছিলো, ম্যাট্রিকে। তাহলে, এই ব্যবস্থা না-থাকলে পড়াশুনা হতো না, আর রাজধানীতে এগারোতলার ছাদে বসে মদ্যপান হতো না।
বাশারের বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয়, আমাদের আগ্রহ ধরে রাখে। তার সরল স্বীকারোক্তি আমাদের হয়তো মুগ্ধও করে।
-- সবকিছু গতানুগতিক চলছিলো, সপ্তাহে দু-তিনদিন ওপারে যাই, পড়াশুনাও চলছে মোটামুটি। কিন্তু ইন্ডিয়ান মেয়েটা আমাকে আউলাইয়া দিলো।
-- হ্যাঁ মামা, এইতো, আমি এতণ ওয়েট করতেছি, এই ক্যারেক্টারটা কখন আসে।
বায়িং হাউজ ব্যবসায়ী সামাদুল ইসলাম হাত নেড়ে নেড়ে কথাটি বলে। তার মতে, যে-গল্পে কোনো নারী নেই সেই গল্প কোনো গল্পই না। আমরা সামাদুলের এই তত্ত্বটি জানি বলে সবাই হো হো করে হেসে উঠি।
-- এই তপন, আরেক রাউন্ড হোক। বাশার বল, তোর ইন্ডিয়ান বিউটির কাহিনী বল। সামাদুলকে অত্যন্ত উৎসাহী দেখায়।
গ্রামীণ ফোন এক্সিকিউটিভ তপন আমাদের পানের আসরের সাকী, সুরাবিতরণে তার দতা তাকে ঐ পদে বসিয়েছে।
-- বিপিনের গোডাউনে মেয়েটি আসে প্রিন্টেড শাড়ি নিয়ে, সাপ্লাইয়ের কাজ করে সে। একদিন দেখা হয়ে গেল, দু’জনেরই কম বয়েস, চোখাচোখি হতেই কত কথা হয়ে গেল। আমি সেদিনই বুঝলাম এই মেয়ের সঙ্গে অনেক কথা বলা যাবে, উপো সে করবে না। বাই দি ওয়ে, ততদিন পর্যন্ত আমার কোনো নারীসংসর্গ হয়নি, কোএড কলেজের বান্ধবীদের কাছ থেকে আমি কোনো ধরনের পাত্তা পাইনি। দুএকবার কথা বলতে গিয়ে উপোর শিকার হয়েছি। কৃষকের ছেলের গেটআপে শহুরে মেয়েরা আকৃষ্ট কেনই বা হবে? কিন্তু ঐ মেয়েটির দৃষ্টি বলে দিলো সে আমাকে পাত্তা দেবে, আমি একদম নিশ্চিত ছিলাম। রাতে ফিরে আমি অনেককিছু ভাবা শুরু করলাম। ইন্ডিয়ান মেয়ে, ভাব জমিয়ে লাভ নেই বাবা, ঝামেলাই বাড়বে কেবল। আবার ভাবি, এক অর্থে তো সে আমার সহকর্মী। সে যে-জিনিস সাপ্লাই দেয় সেটাই তো আমি কিনে দেশে এনে বিক্রি করি। সহপাঠীর সঙ্গ কামনা করি, সহকর্মীর করতে দোষ কী? ঠিক পরদিনই তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। মানে আমিই দেখা করলাম। মেয়েটি মাল দিয়ে ফিরছে, আমি পথে অপো করছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম?
-- রানি।
-- হিন্দু না মুসলমান?
-- প্রথমেই ধর্ম জিজ্ঞেস করো, কেমন লোক তুমি?
হালকা ধাক্কা খেলাম। বুঝলাম এই মেয়ে একটু আলাদা।
তারপর প্রায়ই যাওয়া শুরু করলাম। কাজ না থাকলেও যেতাম। ব্যবসা ও পড়াশুনা দুইই লাটে ওঠার অবস্থা। কিন্তু ঐ বয়সে প্রথম প্রেমে কী দশা হয়, যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই কেবল বুঝতে পারে।
-- তারপর কী হলো? মানে কোথায় প্রেম করতি তোরা? দেখতে কেমন ছিলো মেয়েটা?
-- দেখতে সুন্দরী না, কিন্তু মনে ধরে গেল আমার। শ্যামলা, চোখে কী-যেন আছে, খানিক নেশা নেশা চাহনি। তবে হাসিটা যেকেউ ভালো বলতে বাধ্য। কণ্ঠটা ছিলো মারাত্মক, একটা হাস্কি ভাব ছিলো। নদীর ধারে, বালুচরে গিয়ে আমরা বসতাম। একেবারে নির্জন, একেবারে অন্ধকার। কেবল আমরা দু’জন। তখন আমার মনে হতো এই দুনিয়াতেই আর কেউ নেই, কেবল আমি আর রানি। ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতো, লতার গান শোনাতো। হিন্দু মেয়েরা যেমন হয়, গানবাজনায় খুব ভালো। তখন আমরা কত গল্প যে করতাম, ছোটবেলার গল্প, আমার কলেজের গল্প, ওর স্কুলের গল্প, বাংলাদেশের গল্প, ভারতের গল্প। রানিও বাংলাদেশের গল্প বলতো, ওর দাদার কাছ থেকে শোনা। ওর দাদার বাড়ি ছিলো বরিশাল, দেশবিভাগের সময় ওর দাদা কলাকাতায় চলে যায়। কিন্তু কলকাতায় কিছু করে উঠতে না-পেরে সীমান্তের গ্রামে চলে আসে। রানির বাবাও দাঁড়াতে পারেনি, স্কুলের পরে রানির পড়াশুনা বন্ধ। এভাবে জানা গেল ও আমার দু’বছরের বড়ো। ... রানি ওর দাদার কাছে শুনেছে, ওর দাদা বলতো, সীমান্তের গ্রামে আসার কারণ ছিলো, যাতে নদীর পাড়ে দাঁড়ালে ওপারে নিজের দেশের দিগন্তরেখা দেখা যায়। ... দেশবিভাগ, ব্লাডি দেশবিভাগ!
রানির দাদার দেশবিভাগের যন্ত্রণা বাশারের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এবারে বাশার একটা বিরতি দেয়। আনমনা তাকিয়ে থাকে হাতে-ধরা শূন্য গ্লাসের দিকে, যেন গ্লাসের গভীরে সব কাহিনী লেখা, সে পাঠ করছে কেবল।
-- বল মামা, ইহার পরে কী হইলো, বল। পাশে বসে থাকা সামাদুল অসংলগ্ন হাতে বাশারের জানুতে চাপড় দেয়।
-- আর কী? আর কিছু না। বাশার যেন গল্পটার সমাপ্তি ঘোষণা করে।
-- আপসের ব্যাপারটা তো বোঝা গেল না। রানি এখন কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করি।
-- আর ঐটা হইলো না? সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত দুইজন তরুণ-তরুণী, নির্জন চরে ... অন্ধকারে ... ঐটা হইলো না? সেক্স হইলো না?
সামাদুলের সরাসরি প্রশ্ন শুনে বাকিরা সবাই ঝট করে বাশারের দিকে তাকাই। আমরা ভাবি সে হয়তো রিএ্যাক্ট করবে, সামাদুলের ওপরে বিরক্তও হই। অতীতের কোনো দুঃখজনক কাহিনীই হয়তো বাশার বলছে, এরমধ্যে সেক্স বিষয়ে প্রশ্ন, সামাদুলের পেটে সোমরস পড়লে সবসময়ই সে সিন ক্রিয়েট করে।
কিন্তু বাশার সেভাবে রিএ্যাক্ট করে না। কেবল আরও নিরব হয়ে পড়ে। গ্লাসের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। তপন বাশারের গ্লাসে আরও এক পেগ ঢালে।
-- সেক্স হইলো।
-- হইলো, হইলো, সেক্স হইলো। সামাদুল চিৎকার করে ওঠে।
-- সামাদুল, তুই বেশি লাফাইতেছিস। চুপ থাক। তপন ধমক দেয়।
বাশার এই কাহিনী আজ শেষ করবেই, সব কথাই বলবে, একটু বিরতি দিয়ে হলেও। আমরা জানি, কেবল ব্যাক্কল সামাদুলই বোঝেনা।
-- সেই অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। আজও সব স্পষ্ট মনে আছে। বিবাহপূর্ব, ভিন্ন ধর্মের মেয়ে, সব অর্থেই অবৈধ। কিন্তু শরীরবিনিময়ের সেই ণকে আমার তখন এত পবিত্র, এত কাম্য মনে হয়েছিলো! খোলা আকাশের নিচে শরীরবিনিময়, পদ্মার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আমাদের পাহারা দেয় -- কী এক অনির্বাচনীয় অনুভূতি সেটা।
-- দোস্ত, শব্দটা হবে অনির্বচনীয়।
সামাদুলের ফোড়নের কারণে সেক্সপর্ব সম্পর্কে আর কিছু জানা গেল না।
-- এরপর আপসের দিনটি এলো। কাপুরুষতার দিন সেটা, যন্ত্রণার দিন, লজ্জার দিন।
বাশার তার দু’চোখ বুজে মাথা ঝাঁকাতে থাকে, যেন সে প্রাণপণে চাইছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে দিনটাকে মুছে ফেলতে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না, আরও গনগনিয়ে জ্বলছে, দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলছে দিনটি।
-- সেদিনও আমরা চরে বসে কথা বলছি। একটু বিরতি দিয়ে আবার শুরু করে বাশার। আকাশের দ্বিতীয়ার চাঁদ ণটাকে আরও মোহময় করে তুলেছে। হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি দুই বিএসএফ।
-- কী নাম তোর?
-- বাশার।
-- ঐপার থেকে?
-- হ্যাঁ। বিপিনের লোক আমি।
-- কীসের বিপিন? কে বিপিন?
-- কেন, রমেন দারোগা সব জানে। তোমরাও সব জেনে না-জানার ভাণ করছো কেন?
-- গত তিনমাস বিপিনের কোনো খবর নাই। খবর দিলেও আসে না। দারোগা বাবু বলেছে সব কটাকে হাজতে পুরতে। চল, হাজতে চল।
-- এরকম করছো কেন? আমি তো গত তিনমাসেই বিপিনকে টাকা দিয়েছি। তোমাদের আরও লাগলে নাও।
-- না, আজ আর টাকায় হবে না। সঙ্গের মাগীটি কে?
-- খারাপ কথা বলবে না। ভালো হবে না। রানির সঙ্গে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক।
-- ও, বাংলাদেশী ছোঁড়া, ভারতের মেয়েকে ভাগাতে চাস?
-- এই তোমরা কিন্তু খুব অন্যায় করছো। দারোগাবাবু আমাকে চেনে। নরেন কনস্টেবল, হারু কনস্টেবলও আমার চেনা।
-- ওসব চেনাচেনি দিয়ে আজ চলছে না। দারোগাবাবু বলেছে সবাইকে ধরতে, কলকাতা নয়, কেন্দ্র থেকে কড়াকড়ি। তোমাদের মন্ত্রীর সঙ্গে কাল মিটিং হয়েছে জানো না? তারওপর আবার এই ফষ্টিনষ্টি।
-- ঠিক আছে, চলো আমরা থানায় গিয়ে রিপোর্ট করবো, চলো। রানি এই প্রথম কথা বলে।
-- থানায় গেলে তোমার প্রেমিকচাঁদের কী হবে জানো? সোজা চালান, কলকাতা, বর্ধমান না বিহার কেউ বলতে পারে না। ঠিক আছে, তোমার খাতিরে ওকে ছেড়ে দিচ্ছি। ওকে এখুনি ওপারে চলে যেতে বলো, আর তুমি আমাদের মেয়ে, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
বিএসএফের এই প্রস্তাবে আমি ও রানি দুজনেই খানিণ চুপ করে রইলাম।
রানি জিজ্ঞেস করলো, বাশার, তুমি চলে যাবে?
-- কাল আবার আসবো, বিপিনের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। তুমি চিন্তা করো না।
-- খবরদার এদিকে আর আসার চেষ্টা করবি না বাঙাল। বিএসএফ বলে।

মাঝনদীতে যাবার পরে, আমাকে চুপচাপ দেখে, আইনুল রানির কথা জিজ্ঞেস করলো। সব শুনে আইনুল বললো, দুই শিয়ালের হাতে তুই এক মুরগী রাখি চলি আসলি?
আমি বললাম, আইনুল নৌকা ঘুরা।

চরে পৌঁছে দেখি রানির সংজ্ঞাহীন দেহ পড়ে আছে, এলোমেলো। চাঁদের স্বল্প আলোয় তার অনাবৃত ঊরুতে রক্তের ধারা দেখি। চর থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রানিকে নিতে নিতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেউ ছিলো না, বাসা থেকে ডাক্তারকে ধরে আনতে হয়। বেশ রাত তখন। ডাক্তার এসে জানায় রানির মৃৃত্যুর কথা। ... অনেক ব্লিডিং হয়েছিলো।

তোমরা একটু দাঁড়াও। প্রাথমিক একটা রিপোর্ট রেডি করে দিচ্ছিÑ একথা বলে ডাক্তার ভেতরে ঢোকে। আইনুল ফিসফিস করে বলে, পালানোর সময় আর পাওয়া যাবে না।

রানির মৃতদেহ ফেলে আমরা সেই রাতেই পালিয়ে আসি। সেই আমার শেষ ভারতে যাওয়া।

অনেকণ নিরবতার পরে সামাদুল বলে, সরি দোস্ত। আমি সত্যি এতটা ভাবিনি। ... বাট নেভার মাইন্ড, দিস ইজ নো ক¤েপ্রামাইজ। তোর হাতে তো কিছুই ছিলো না।
-- না, না, না! বাশার চিৎকার করে ওঠে। বিএসএফ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছিলো হয় আমাকে জেলে ঢুকতে হবে নয়তো রানিকে রেপড্ হতে হবে। ... ওরা এসেইছিলো রানিকে রেপ করতে। ... আমি যদি হাজতবাস মেনে নিতাম, তবে রানিকে হয়তো রেপড্ হতে হতো না, অন্তঃত নির্জন চর থেকে বেরুনোর একটা উপায় হতো। ... দিস ওয়াজ অল ক¤েপ্রামাইজ, রানিকে নাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি ভিনদেশী কারাগারে পচতে পারবো না। আমার নিজের দেশ আছে, বাপ-মা-ভাই-বোন আছে, ভবিষ্যত আছে। রানিকে নাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও ...।

বাশার প্রাণখুলে কাঁদতে থাকে।

...

রচনাকাল: ২০ আগস্ট ২০০৬।
প্রথম প্রকাশ: ২৫ আগস্ট, ২০০৬; প্রথম আলো
৩০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×