somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টুকরো হয়ে যাবার আশংকা, পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ১৪

৩০ শে মে, ২০০৮ রাত ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জেড. এইচ. জাইদি
দি টাইমস্, ১০ মার্চ, ১৯৭১।

পাকিস্তানের দু-অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কি অবশ্যম্ভাবী? আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে অনেক পর্যালোচকের মনেই এখন এই প্রশ্ন। ভুট্টোর আইনসভার অধিবেশন বয়কটের অবিচণ হুমকি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা পূর্বে তৎপরবর্তী বিক্ষোভ-আন্দোলনের ফলেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

দুই অংশের বৈরিতা নতুন কিছু নয়। দেশভাগের পর থেকেই বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ভাষা থেকে তারা এর শক্তি পেয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিরোধে যারা আত্মত্যাগ করেন তাদের স্মরণ এই জাতীয়তাবাদের শক্তির উৎস। শেষ পর্যন্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়, কিন্তু তা অর্জিত হয় রক্তপাতের মাধ্যমে। বিলম্বে প্রদান করা অধিকার বাঙালিদের ক্ষোভ খুব কমই প্রশমিত করতে সমর্থ হয়।

ভাষা-বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে ওঠা অনুভবের নির্দেশক। তারা মনে করেছে আগে তারা মাড়োয়াড়ী ও পশ্চিমবঙ্গের জোয়াল কাঁধে নিয়েছে, এখন নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের। দেশভাগের সময়ে অবিভক্ত ভারতে পুরো বেসামরিক প্রশাসনে মাত্র একজন পূর্ব বাংলার মুসলমান কর্মকর্তা ছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের পর থেকে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনে কঠোর কোটা-পদ্ধতিতে লোক নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের তিনজন যুগ্ম সচিব, ১০ জন উপ-সচিব এবং ৩৮ জন নিম্ন সচিব রয়েছেন। এর বিপরীতে ঐ পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮, ১২৩ ও ৫১০। বিভাগপূর্ব সময়েই সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবী ও পাঠানদের প্রাধান্য ছিল, বিভাগপরবর্তী সময়ে তাদের প্রাধান্য আগের চাইতে আরও বেড়েছে। ১৯৫৬ সালের পর থেকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে কিন্তু বৈষম্য থেকেই গেছে।

বেসামরিক, রাজনৈতিক ও সামরিক -- ক্ষমতার এই তিন হাতিয়ারের সমাবেশ ঘটেছে পাকিস্তানের তিনটি শহরে, কিন্তু শহর তিনটিই পাঞ্জাব রাজ্যে অবস্থিত। এতে আন্তঃঅংশ বিরোধ বেড়েছে। ১৯৫৫ সালে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মিলে একটি অংশের সৃষ্টি হবার পর লাহোর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে নিয়ে আসেন। এতে দেশের রাজধানী হয় পাঞ্জাবেরই একটি শহর। রাওয়ালাপিন্ডি তো সশস্ত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিলই।

আইনসভায় এক ইউনিট ব্যবস্থা কেবল আন্তঃপ্রদেশ বিরোধ বাড়িয়েই তোলে নি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন করে ফেলেছে। দেশভাগের পরপরই যে-আইনসভা গঠিত হয়েছিল সেখানে ৬৯টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিল ৪৪টি। নতুন পদ্ধতিতে এই প্রতিনিধিত্ব পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা নির্ধারিত হতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি এই ইউনিট পদ্ধতি ভেঙ্গে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগ মোতাবেক প্রতিটি প্রদেশ তার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করবে। এভাবে ৩১৩টি আসনের জাতীয় আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের কিছু যথার্থ কারণ আছে। কিন্তু এর সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে হয় নি। ইতিহাস ও ভূগোল সেখানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এনে দিয়েছে। ভারত বিভাগের পূর্বে পূর্ব বাংলা ছিল সবচেয়ে অনুন্নত এলাকার একটি। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়িত অঞ্চলের জন্য কাঁচামালের যোগানদার-ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পূর্ব বাংলার রফতানি-কেন্দ্র চট্টগ্রামকে প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতার কারণে অনুন্নত রাখা হয়েছে। পূর্বের জেলাগুলো পুরোপুরিভাবে অবহেলা করা হয়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থা দূর করতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়। কিন্তু এই বিভাগ স্বল্পস্থায়ী হয়। বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং ১৯১১ সালে আবার বাংলা এক হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার তারা পৃথক হয়ে যায়। আজ দু-অংশই উত্তাল। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের একটি অংশ হতে এর কোনো ইচ্ছা নেই। ঐধরনের একত্রীকরণের অসুবিধা কী তা স্পষ্ট। পাকিস্তানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু ভারতে তারা হবে সাত ভাগের এক ভাগ। পাকিস্তানে তারা অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড়ো অংশের ভাগ পেতে পারে, কিন্তু ভারতে সম্পদের ভাগ পেতে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এর নতুন পাটকলগুলোকে কলকাতার কলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, কলকাতা বন্দরের সঙ্গে উন্নয়নশীল চট্টগ্রাম বন্দরকে মোকাবেলা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত বাংলার আত্মপ্রকাশও একটা ফলাফল হিসেবে কেউ ভাবতে পারেন, কিন্তু তা হবার সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৪৭ সালে শরৎ চন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দি এরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। কিন্তু পূর্ব বাংলা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে লীন না হবার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর এধরনের একত্রীকরণ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে পৃথক হতে হবে -- কিন্তু এধরনের যেকোনো উদ্যোগ ভারত শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল ফেডারেশন। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব স্বাধীনতার ক্ষেত্রে খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ব্যাকুলভাবে যেটা চাচ্ছে সেটা হলো তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে -- তারা চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। নিজ শাসন বা স্বরাজ যাই বলুন না কেন, তারা তাই করতে চায়, যদি সম্ভব হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই। যদি পূর্ব পাকিস্তানীদের নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে তাদের ঘরের তারাই প্রভু, তবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় অংশ নেবে। সেখানে দুর্বল কেন্দ্র থাকতে হবে এবং কেন্দ্র তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তপে করবে না। ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু একটি সংবদ্ধ ভূখণ্ড। পাকিস্তান একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু বিভক্ত ভূখণ্ড। এই দুই রাষ্ট্রেরই ভবিষ্যত হলো শিথিল ফেডারেল কাঠামোর। উভয় দেশকেই আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক চেতনাকে সত্যিকারের মর্যাদা দিতে হবে এবং দু-দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দেশবিভাগ হয়েছিল মুসলমান-অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর ওপরে হিন্দু আধিপত্যের ভয় থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য একইভাবে অমীমাংসিত প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালের পূর্বের পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দাবির মিল রয়েছে। হিন্দির আধিপত্যের বিপরীতে উর্দুকে রক্ষা, আইনসভায় ও চাকরিতে মুসলমানদের অংশভাগ, কংগ্রেসের শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে মতের বিপরীতে মুসলমানদের ফেডারেল কাঠামোর দাবি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরও ক্ষমতার দাবিসহ অনান্য কিছু কারণই ছিল ভারতবিভাগের কারণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ আইনসভা বয়কট করেছিল। ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?

[ড. জাইদ লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্য ও আফ্রিকা অধ্যয়ন স্কুলের ইতিহাসের প্রভাষক।]

৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×