somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধ শুরু হয়েছে: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ২১

০৪ ঠা জুন, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[২০ পর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগের রিপোর্টগুলো পোস্ট করা হয়েছে, যাতে ২০ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। আজ থেকে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরের রিপোর্টগুলো। রিপোর্টগুলো শুরু হবে ২ জুন, ১৯৭১ থেকে।]

বাংলাদেশের নির্বাসিত নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে শেষ-দেখে-নেয়া-যুদ্ধের কথা বলছেন

দি টাইমস্, ২ জুন, ১৯৭১।

কলকাতা, ১ জুন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এবং বিধ্বস্ত দেশটির বামপন্থী বিরোধীদলসমূহ আজ পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে যেকোনো প্রকার সমঝোতার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি এ. এম. কামরুজ্জামান এবং প্রধান বিরাধীদলীয় নেতা মাওলানা ভাসানী উভয়েই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ মার সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংবাদপত্রসমূহকে দেয়া তথ্যবিবরণীতে তারা বলেছেন এটা হলো শেষ-দেখার-যুদ্ধ। কামরুজ্জামান বলেছেন, ২৫ মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর হত্যালীলার পর প্রেসিডেন্টের কোনো কথাই পূর্ব-পাকিস্তানে আর বিশ্বাস করা হবে না। এই বাঙালি নেতার মতে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগের দিনই প্রকৃত অর্থে বাঙালিদের দাবিকে মেনে নিয়েছিলেন এবং বেতারে তা ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

কামরুজ্জামান বলেন, 'কিন্তু তা না-করে তিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে উৎপাটনের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে আমাদের কাছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নামটি মানুষের পদবাচ্য কিছু মনে করা হয় না। নামটি একজন রক্তপিপাসু খুনী, একজন বিশ্বাসঘাতক এবং একজন পাকিস্তান-বিচ্ছিন্নকারীর প্রতীক হিসেবে পরিচিত। নিরীহ নাগরিক ও শিশুদের হত্যা করার পর আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক-পাকিস্তানের ছাদের নিচে থাকা সম্ভব নয়'। অতি-বাম বাঙালি-নেতা মাওলানা ভাসানী আজ সাংবাদিকেদের বলেন বামপন্থী বা ডানপন্থী কোনো বাঙালিই পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতায় যাবে না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ভাসানী পূর্ব-পাকিস্তানকে সহায়তা দানে ব্যর্থ হবার জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমালোচনা করেন।

কয়েক সপ্তাহের নিরবতার পর আজ আন্ডারগ্রাউন্ড-রেডিও-স্টেশন ''স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" জানিয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা-গেরিলারা পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে পরাজিত করেছে। ৫৫০-রও বেশি নিয়মিত সৈনিক নিহত হয়েছে এবং একটি গানবোটকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। বেতার-কেন্দ্র জানিয়েছে উত্তর-পূর্ব-অঞ্চল সিলেট স্বাধীন হয়েছে, তিনটি প্রধান রেলওয়ে-ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, সহজ প্রতারণা ও সহজ উত্তেজনাসাধ্য বাঙালিদের নায়কোচিত যুদ্ধ এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পিছু-হটানো ও পরাজিত করার কাহিনী হলো, সম্ভবত, আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের মতোই -- উর্বর-কল্পনাপ্রসূত সংবাদ। বাঙালিদের প্রত্যাশাকে ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে খাটো মনে না করেই আমি আজ সকালে একটি রেডিও-সিগনাল-এর দিক খোঁজার কয়েল দিয়ে 'বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে প্রচারিত হচ্ছে' দাবি-করা রেডিও-স্টেশনটির দিক খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আমাকে বিস্মিত করে দিক-খোঁজার কয়েলটি জানালো যে শক্তিশালী, স্পষ্ট বেতার-সম্প্রচারটি বাংলাদেশের দিক থেকে আসছিল না, আসছিল উত্তর দিক থেকে, যে-একই দিক থেকে অল-ইন্ডিয়া-রেডিও সম্প্রচারিত হচ্ছে। কলকাতা শহরের অন্যান্য স্থান থেকে ব্যাপারটি পরীক্ষা করা হলে বারবার উত্তর দিককেই খুঁজে পাওয়া গেল, যেদিকে চিনসুরা এবং মাগরা অবস্থান করছে এবং যেখান থেকে অল-ইন্ডিয়া-রেডিও সম্প্রচার করা হয়।

অবশ্য এখানে এটা বলা হচ্ছে না যে, মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঘাঁটিসমূহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কোনো ধরনের আক্রমণ করছে না। তবে এটা বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি সীমান্তে বাংলাদেশ-ধারণাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারতীয় সরকার। প্রায় প্রত্যেক বাঙালি রাজনৈতিক নেতা ভারতে পালিয়ে গেছেন। মাওলানা ভাসানী সম্ভবত কলকাতায় নিরাপত্তা-হেফাজতে রয়েছেন, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রি তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তার পরিবারও ভারতীয় কোনো অঞ্চলে অবস্থান করছেন। আঁতুড়ঘরেই মৃত জাতীয় সংসদের সদস্যরা ব্যস্তসমস্তভাবে কলকাতা-দিল্লী করছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন উপদেষ্টা, আইনজীবী, ডাক্তার ও শিকদের একটি দল এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পূর্ব-বাংলার ৭ কোটি অধিবাসী এখন নেতৃত্ববিহীন ও হতোদ্যম হয়ে পড়েছে।

এ-পরিস্থিতিতে, এতে কোনো সন্দেহ থাকে না বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা লাভ করে ও যখন স্বাধীনতা লাভ করবে, এর কার্যকর নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্স্-এর সাবেক অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে যাবে। বর্তমানে ভারতীয় প্রশিকদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা সীমান্তের ৩০টি ক্যাম্পে ৩০,০০০ আগ্রহী যোদ্ধাদের প্রশিণ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে ভারতীয় সেনা-বিশেষজ্ঞেদের পরামর্শক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের আঘাত করছে।

সব সীমান্তেই গেরিলারা সৈন্যদের বেশ ভালোভাবেই হেনস্থা করছে বলে ক্রমশ জানা যাচ্ছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তারা পশ্চিম-বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরার সীমান্তে অবস্থিত ছোট ছোট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পসমূহে ঝটিকা আঘাত করে ফিরে আসছে। তৎক্ষণাৎ বা পরবর্তী সময়ে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের গেরিলাদের সীমান্ত বরাবর তাড়া করছে, শেষ পর্যন্ত তাদের ভারতীয় সৈন্যদের মুখোমুখি হচ্ছে।

আমাদের দিল্লী-প্রতিনিধি জানাচ্ছেন: ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রি স্মরণ সিং আজ সংসদে বলেছেন, ভারত ব্রিটেনসহ বিভিন্ন বিদেশী সরকারদের চাপ প্রয়োগ করছে এই বলে যে পাকিস্তানের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনর্বাসিত করার জন্য যেকোনো সাহায্য 'বাংলাদেশে বিরাজ-করা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা হবে'। সদস্যরা যখন মি. সিংকে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকারের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভঙ্গিকে অসম্মত করার জন্য জোরপ্রয়োগ করার উদ্যোগ নেন, তিনি কেবল ব্রিটিশদের কথাটিরই পুনরাবৃত্তি করেন: 'দেশটির জাতীয় বিষয় নিয়ে নয়, কেবল সাহায্যের নীতিই এখানে নেয়া হয়েছে'।

৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×