somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুই সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি এবং ইসরায়েলদরদী মার্কিন মিডিয়া

২৫ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের প্রাক্কালে টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি তাদের প্রতিবেদক পিটার আরনেটকে চাকরিচ্যুত করেছিল, ইরাকি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেবার জন্য ও ইরাকি তথ্য-মন্ত্রণালয়ের প্রশংসা করার জন্য। বিখ্যাত টকশো-উপস্থাপক ফিল ডোনাহুকে এমএসএনবিসি চাকরিচ্যুত করেছিল, তিনি যুদ্ধবিরোধী লোকজনকে তার অনুষ্ঠানে ডেকে আনছিলেন বলে। ওয়েবসাইট ইয়োলোটাইমস-কে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবেদন চালিয়ে যাবার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। টেক্সাসের লিউইসভিল লিডার পত্রিকার কলামিস্ট ব্রেট ফ্লিনের কলাম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, কারণ তিনি যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন।

আমেরিকার মিডিয়াগুলো এরকমই যে, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্য দেশে আগ্রাসন-সংঘাতের উদ্যোগ নেয়া হলে তারা তার আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে, লাগাতার বকবকানির মধ্য দিয়ে। তাদের টকশো এবং সংবাদবিশ্লেষণে হাজির করা হয় সামরিক আমলাদের এবং ‘নিওকন’দের (আমেরিকায় ‘নিওকনজারভেটিভ’ তারাই যারা মনে করেন মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অন্য দেশে উদারনৈতিকতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার), যারা আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেন থাকার কারণে, সাদ্দামের রাসায়নিক অস্ত্র থাকার কারণে কিংবা ইরানে পরমাণু অস্ত্র থাকার কারণে আক্রমণটা করাই উচিত বলে রায় দেন। আর প্যালেস্টাইনে দখলদারী ইসরায়েলের হামলাকে ‘নিজেকে রক্ষা করার’ মতো ন্যায্যতায় নামিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকেন। তাদের আলোচনায় আগ্রাসনের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকেনা, বরং নতুন নতুন লক্ষ্যভেদী অস্ত্রগুলো বেসামরিক মানুষের কোনো ক্ষতি না করে কিরকম সূক্ষতায় কেবল লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানে, তার প্রশংসা করা হয়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে বা উল্টো কিছু ঘটলে সাংবাদিকের চাকরি বরবাদ হয়ে যায়। নিবন্ধের শুরুতেই তার কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে।

ইরাকে আগ্রাসন সমাপ্ত হয়েছে। তাই ঐ ফ্রন্টিয়ারের কোনো সাংবাদিক আর চাকরি হারাচ্ছেন না। কিন্তু প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের হামলা চলছেই। ইসরায়েল-দরদী মার্কিন প্রশাসন ও মার্কিন মিডিয়া স¤প্রতি চাকরি খেয়েছে দু’জন সাংবাদিকের-- দুজনই লেবানিজ-আমেরিকান খ্রিস্টান নারী। একজনের নাম ওক্টাভিও নাসর এবং আরেকজন হলেন হেলেন থমাস। প্রথমজন চাকরি খুইয়েছেন সিএনএন থেকে। তার অপরাধ ছিল তিনি আমেরিকার তালিকায় সন্ত্রাসী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত লেবাননের এক ধর্মীয় নেতার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশের সময় তার প্রশংসা করেছিলেন। দ্বিতীয়জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে হোয়াইট হাউস থেকে। তিনি বলেছিলেন ইসরায়েলিদের প্যালেস্টাইন থেকে সরে পৃথিবীর অন্য যেকোনো জায়গায় চলে আসা উচিত।

ওক্টাভিও নাসর বিগত ২০ বছর ধরে সিএনএন-এ কাজ করছিলেন। তিনি ছিলেন সংবাদনেটওয়ার্কটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একজন সিনিয়র সম্পাদক। তিনি লেবাননের ধর্মীয় নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ হুসেন ফাদলাল্লাহর মৃত্যুতে, সিএনএন-এ নয়, নিজস্ব টুইটার পোস্টে লিখেছিলেন, “সৈয়দ মোহাম্মদ হুসেন ফাদলাল্লাহর মৃত্যুতে আমি দুঃখভারাক্রান্ত ...। তিনি একজন বড় হিজবুল্লাহ, যাকে আমি শ্রদ্ধা করি।” ব্যস, তীব্র প্রতিক্রিয়া ধেয়ে আসে তার দিকে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকভুক্ত ‘সন্ত্রাসী’র মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করা সিএনএন-এর একজন সাংবাদিকের জন্য গর্হিত অপরাধ! ভড়কে গিয়ে নাসর দুঃখপ্রকাশ করেন। তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন যে, ফাদলাল্লাহকে তিনি শ্রদ্ধা করেন, এর কারণ হলো তিনি নারীদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলে থাকেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। চাকরিচ্যুতি এড়ানো যায়নি। ২০ বছরের সেবা, এক টুইটে শেষ।

লেবানিজ-আমেরিকান হিসেবে লেবাননের একজন নেতার মৃত্যু নাসরকে ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী করে তুলেছিল। অথচ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিবৃতি বা সংবাদপরিবেশন না হবার পরও, ব্যক্তিগত টুইটে প্রকাশিত একটি শোকবার্তা প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল বয়ে আনলো। হিজবুল্লাহ নেতা ফাদলাল্লাহ নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর লোক ছিল তাহলে। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত লন্ডনভিত্তিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক (ফিস্ক, ২০১০) জানাচ্ছেন, ফাদলাল্লাহ আদতে হিজবুল্লাহর লোকই নন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তিনি নিঃসন্দেহে একজন বড় মানুষ। তিনি একজন লেখাপড়া জানা অসাধারণ এবং ন্যাপরায়ণ মানুষ। তিনি নারীর অধিকারে বিশ্বাস করেন, ‘পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে নারী হত্যা’কে (অনার কিলিং) ঘৃণা করেন। ইরানের ধর্মীয় সমাজব্যবস্থার সমালোচক তিনি। শিয়া হবার পরেও, তিনি শিয়াদের রক্তাক্ত আশুরা পালন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এসব সদউদ্যোগের বিপরীতে তার সন্ত্রাসী আচরণ বলতে গেলে-- তিনি পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের মতোই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির বিরোধী ছিলেন। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন দখলের সময়ে লেবাননের প্রতিরোধকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে বৈরুতে অবস্থি আমেরিকার মেরিন ঘাঁটিতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৪১ জন নিহত হয়েছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে আমেরিকা বলেছিল যে হামলাকারীদের ওপর ফাদালাল্লাহর আশীর্বাদ আছে। ফিস্ক বলছেন (ফিস্ক, ২০১০), বিষয়টি ফাদালাল্লাহ আমার কাছে সবসময় অস্বীকার করেছেন এবং আমি তার কথা বিশ্বাস করি। আমরা জানি, আত্মঘাতী হামলাকারীরা উন্মাদের মতো থাকে, তাদের কারো আশীর্বাদের প্রয়োজন পড়েনা। তারা ভাবে, তারা আল্লাহর কর্তব্যপালন করছে, ফাদলাল্লাহর মতো মানুষদের কোনো সাহায্য তাদের দরকার নেই। কিন্তু তার পরও ১৯৮৫ সালে ওয়াশিংটন সৌদি আরবের অর্থ খরচ করে গাড়িবোমা হামলা করে ফাদলাল্লাহকে হত্যার চেষ্টা করে। ফাদলাল্লাহ সে আক্রমণ থেকে বেঁচে যান, কিন্তু ৮০ জন নিরীহ মানুষ সে হামলায় নিহত হয়।

এহেন ফাদলাল্লাহ, আপনি যদি তাকে ঠিকমতো জানেন, তাহলে তার মুত্যুতে আপনার মনও ভারাক্রান্ত হবে। নাসর একজন লেবানিজ হিসেবে, মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে, ঠিক তাই করেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেল, নাসর কোনোকালেই ঠিক প্যালেস্টাইন-দরদী বা ইসরায়েল-বিদ্বেষী ছিলেন না। মার্কিন এক প্রাধান্যশীল মিডিয়াতে টিকে থাকার জন্য যতটুকু বিশ্বস্ততা দরকার, নাসরের তা পুরোমাত্রায়ই ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত মানসিক আর্দ্রভাব তার জন্য পেশাগত বিপর্যয় ডেকে আনলো। এখানে একটা নিরীহ প্রশ্ন তুলে রাখি: মার্কিন প্রশাসন যাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে, তার মৃত্যুতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে শোকপ্রকাশের কারণে কেন সিএনএন-এর সাংবাদিক চাকরি হারাবেন? মার্কিন নীতি আর সিএনএন-এর নীতিতে কি কোনো ফারাক নাই? গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চূড়ায় যাদের বসতবাড়ি, তারা কোন নীতিতে মধ্যপ্রাচ্যনীতি নির্ধারণ করে রেখেছেন?

জুলাই, ২০১০ মাসে যদি নাসর চাকরি হারান, তবে জুন মাসে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে হেলেন থমাসকে। তিনি একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক (জন্ম ১৯২০), ছিলেন হার্স্ট নিউজপেপার-এর কলামিস্ট এবং হোয়াইট হাউস-এর সংবাদদাতা। কিন্তু এর আগে ৫৭ বছর তিনি সংবাদ-এজেন্সি ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এর (ইউপিআই) এর সংবাদপ্রতিনিধি ও হোয়াইট হাউসের ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আইজেনহাউয়ার থেকে ওবামা সব প্রেসিডেন্টকে কাভার করেছেন। জুনিয়র বুশকে প্রশ্নবাণে বিরক্ত করার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। একবার তিনি ওবামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার কি মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আদৌ পারমাণবিক অস্ত্র আছে? ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সা¤প্রতিক তৎপরতার বিপরীতে উত্তর হতো, অন্তঃত একটি দেশের তো আছেই, আর তা হলো ইসরায়েল। কিন্তু ওবামা এই প্রশ্নের উত্তর দেননি। কিন্তু উত্তর তো সবার জানাই। ওবামাকে প্রশ্নটি ভালোই বিব্রত করেছিল। এভাবেই হোয়াইট হাউসের ব্যতিক্রমী সাংবাদিক হিসেবে হেলেন তার দায়িত্ব পালন করছিলেন, স্রোতের উজানে বৈঠা ঠেলে টিকেও ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি গোলমাল করে ফেললেন। সেদিন একটু বেশিই বলে ফেললেন তিনি ।

২৭ মে, ২০১০ তারিখে, হোয়াইট হাউসে, ইহুদি ঐতিহ্য পালন দিবসে ডেভিড নেসেনঅফ হেলেন থমাসের সাক্ষাৎকার নিলেন:
নেসেনঅফ: ইসরায়েল নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? আজ আমরা সবাইকে ইসরায়েল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছি।
হেলেন: তাদের প্যালেস্টাইন থেকে সরে যেতে বলো।
নেসেনঅফ: উউউ! ইসরায়েল নিয়ে কোনো ভালো কথা?
হেলেন: মনে রেখ, ওটা ওদের ভূমি এবং ওটা দখল করা হয়েছে। ওটা জার্মানি নয়, পোল্যান্ডও নয় ...।
নেসেনঅফ: তাহলে তারা কোথায় যাবে? তারা কী করবে?
হেলেন: ওদের নিজের বাড়ি যেতে বলো।
নেসেনঅফ: বাড়ি কোথায় ওদের?
হেলেন: পোল্যান্ড, জার্মানি।
নেসেনঅফ: আপনি বলছেন ইহুদিদের পোল্যান্ড বা জার্মানিতে চলে যেতে হবে?
হেলেন: আমেরিকাতেও যেতে পারে, বা অন্য যেকোনো জায়গায়। শত শত বছর ধরে ওখানে যারা বাস করছে, তাদের ঠেল কেন বাবা? ভেবে দেখ।

এরকম বিধ্বংসী মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দ্রুতই দেখতে পেলেন হেলেন। ফলে দ্রুত ক্ষমাও চাইলেন: গত সপ্তাহে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন সম্পর্কে আমি যা বলেছি তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। আমি আসলে যা মনে করি, ঐ মন্তব্যে তা প্রতিফলিত হয়নি। আমি মনে করি, মধ্যপ্রাচ্যে তখনই শান্তি আসবে যখন জড়িত পক্ষগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের চাহিদা অনুভব করবে। সেই দিন শিগগীরই আসুক। কিন্তু এতে শেষরক্ষা হয়নি। হেলেনের এজেন্সি নাইন স্পিকার্স ইনকর্পোরেটেড ক্লায়েন্ট হিসেবে তাকে বাদ দিয়ে দেয়। ক্রেইগ কফোর্ড হেলেনের সঙ্গে লিসেন আপ মিস্টার প্রেসিডেন্ট শীর্ষক যে গ্রন্থ-প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন, তা থেকে হেলেনকে বাদ দিয়ে দেন। মেরিল্যান্ডের এক স্কুলে তার বক্তৃতা দেবার কথা ছিল, তা বাতিল করা হয়। ৭ জুন, ২০১০ তারিখে বর্তমান কর্মস্থল হার্স্ট নিউজপেপার থেকে তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। ইস্তফা দিতে বাধ্য হন হোয়াইট হাউস সংবাদদাতার পদ থেকেও। প্রেসিডেন্ট ওবামা হেলেনের বক্তব্যকে ‘আক্রমণাত্মক’ ও ‘সীমালঙ্ঘনকারী’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং তার বাধ্যতামূলক অবসরকে ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ বলে রায় দেন। ঐ ঘটনার পর হেলেনকে তিরস্কৃত করা এবং তার বক্তব্যের প্রতি নিন্দাজ্ঞাপনকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক। হিজবুল্লাহ ও হামাস অবশ্য হেলেনের ঐ বক্তব্যের প্রশংসা করে বিবৃতি দেয়। রালফ নাদের, জেমস জগবি এবং পল জে-র মতো দীর্ঘদিনের ইসরায়েল-সমালোচকরা হেলেনের বক্তব্যকে সমর্থন জানান।

এই দুই নারী-সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি আবারো প্রমাণ করলো যে, ইহুদি-লবি প্রভাবিত মার্কিন প্রশাসন এবং পশ্চিমা মিডিয়ার, ইসরায়েলের অন্যায় আগ্রাসনের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে, এবং প্যালেস্টাইনিদের প্রতিরোধের প্রতি একধরনের বিরাগ রয়েছে। ‘সন্ত্রাসী’, ‘জঙ্গি’, ‘চরমপন্থী’ ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিযুক্ত করে প্যালেস্টাইনি মুসলমানদের ন্যায্য প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটকে আড়াল করে ফেলা হয়। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই কাজটি লাগাতারভাবে চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব মিডিয়াগুলো ভালোভাবেই পালন করছে।

পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে ‘সন্ত্রাসী’ হলো তারাই যারা সরকার ও মিডিয়া চিহ্নিত শত্র“। আরেক ধরনের লোক সরকার ও মিডিয়ার কাছে শত্র“। এরা হলো তাদের বন্ধুদের শত্র“। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের যুগ যুগ ধরে চালিয়ে যাবার সংগ্রামের সংবাদে প্যালস্টাইনিরা মিডিয়ার দিক থেকে ‘বন্ধুর শত্র“’ ট্রিটমেন্ট পেয়েছে। প্রথমত পশ্চিমা মিডিয়ায় প্যালেস্টাইন-ইসরাইল সংঘাত সবসময় মধ্যপ্রাচ্য-সংকট হিসেবে ‘নিরপেক্ষ’ ট্রিটমেন্ট পেয়েছে। এ যে আগ্রাসনকারীদের হাত থেকে অধিকৃত ভূমি ফিরিয়ে আনার ও স্বাধীনতার লড়াই -- সংকটের সেরকম মর্যাদা কখনোই দেয়া হয় না। তাই হিজবুল্লাহ এবং হামাসের লড়াই-প্রতিরোধ-হামলা সবসময়ই ‘জঙ্গী’ ও ‘সন্ত্রাসী’। ইসরাইলিরা মারা গেলে সেটা হয় ‘হত্যা’, আর ফিলিস্তিনিরা মারা গেলে সেটাকে বলা হয় ‘সংঘাত’-এ মৃত। কেবল রবার্ট ফিস্কের প্রতিবেদনেই আমরা ঘটনাবলীর ভিন্ন ভাষ্য পেয়ে থাকি। ফিস্ক (ফিস্ক, ২০০৩) বলেন, হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ইসরাইলের দায়দায়িত্ব শনাক্ত করার একটা সহজ উপায় হলো সেটাকে যদি ‘ক্রস-ফায়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলে। বিশেষত যখন কোনো শিশু ইসরাইলি সৈন্যের হাতে মারা যায় এবং সেটা আলোচনায় চলে আসে তখন ব্যাপারটাকে ‘ক্রসফায়ারে নিহত’ বলে চালানো হয়। প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধের কাভারেজ জুড়ে, প্রচারণার বিভিন্ন কায়দা অনুসরণ করে, ‘নেম কলিং’ আর ‘ওয়ার্ড গেমস্’ চলতে থাকে। ফিস্ক যথার্থই বলেন, যুদ্ধ সবসময় বাচনিক ছলনার জন্ম দেয়। বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতিকে তাই বলা হয়ে থাকে ‘পরোক্ষ ক্ষতি’, ইসরাইল কর্তৃক কোনো শহর অবরোধের ঘটনাকে বলা হয় ‘বন্ধ করে দেয়া’, ইসরাইলের মূল ভূখণ্ড এবং তাদের অধিকৃত ভূখণ্ডের মধ্যকার আইনী সীমারেখা হয়ে ওঠে ‘মিলন রেখা’, ফিলিস্তিনি রাজাকারদের বলা হয় ‘সহযোগী’, ইসরাইলী-অধিকৃত ভূখণ্ড হয়ে ওঠে ‘বিতর্কিত’ আর আরব ভূখণ্ডে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ইহুদি বসতিকে বলা হয় ‘প্রতিবেশী এলাকা’। এই প্রতিবেশী এলাকা আবার ফিলিস্তিনি ‘জঙ্গী’ দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইসরাইল কর্তৃপক্ষ বা তার বন্ধু মার্কিন-প্রশাসন ব্যাপারগুলোকে এভাবেই দেখেন এবং মুশকিল হলো মিডিয়া প্রতিবেদনগুলোতে তাদের কথাগুলোই সরাসরি ‘কোট’ করে থাকে। সংবাদ-ভাষ্যেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না।

সংবাদের ট্রিটমেন্ট, এজেন্ডা সেটিং এবং ভাষিক কুশলতার মাধ্যমে এই কাজটি পরোক্ষভাবে চলছে। কিন্তু ইসরায়েলপক্ষপাত এবং প্যালেস্টাইনবিরোধিতা মাঝে মাঝে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। অক্টাভিও নাসর ও হেলেন থমাসের চাকরিচ্যুতি তার প্রমাণ।


তথ্যসূত্র
রবার্ট ফিস্ক (২০১০)। আয়াতুল্লাহ ফাদলাল্লাহর ব্যাপারে সিএনএনের ধারণা ভুল (মহসীন হাবিব অনূদিত)। কালের কণ্ঠ, ১৪ জুলাই, ২০১০।
রবার্ট ফিস্ক (২০০৩)। যখন সাংবাদিকরা ভুলে যান যে হত্যা হত্যাই (উদিসা ইসলাম অনূদিত)। মানুষ: সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যা। সেলিম রেজা নিউটন সম্পাদিত। ঢাকা: সমাবেশ, ২০০৩।
http://en.wikipedia.org/wiki/Octavia_Nasr.
http://en.wikipedia.org/wiki/Helen_Thomas.

প্রথম প্রকাশ: খালেদ মুহিউদ্দিন সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'মিডিয়াওয়াচ'।
১১টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×