somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্প: নেকাব

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



টেলিফোনটা ক্রমাগত বেজেই চলেছে। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, ঘুমটাও ঠিক মতো হচ্ছে না ইদানীং। সন্ধ্যার পর থেকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমের জন্য অপেক্ষা শুরু হয়। বেশিরভাগ রাতেই সে অপেক্ষার শেষ হয় ফজরের আযানের পর। আজও ফজরের আযানের সময় ঘুম এসেছিল। বয়স তো আর কম হলো না। আর মাত্র ক'টা বছর চাকরি আছে। চাকরির কথা মনে হতেই মনটা বিষিয়ে উঠে। মাঝারি মানের একটা চাকরি করি খাদ্য অধিদপ্তরে। সারাটা জীবন ঢাকার বাইরে পোষ্টিং, আর বউ বাচ্চারা ঢাকায়ই থাকবে! সারা জীবনই ব্যাচেলার কাটালাম। ঢাকায় যে ওরা কী মধুটা পায় কে জানে! বাচ্চারা পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আর বাচ্চার মা বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত। তবে বাচ্চার মা প্রতিদিন নিজে রেঁধে খাওয়াতে না পারলে কী হবে, প্রতি বেলা জসিমকে ফোন করে ইন্সট্রাকশন ঠিকই দেবে আর আমার প্রতি একগাদা উপদেশ। জসিম হলো আমার একমাত্র কাজের লোক। দুইরুমের একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। একরুমে আমি থাকি, আরেক রুমে জসিম। রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তার। এমন কি বাসায় কে এলো, কে গেলো সে খবরটাও আমার স্ত্রীর কানে ঠিক ঠিক চলে যায়।

টেলিফোনটা আরেক দফা বাজতে শুরু করলো। নিশ্চয় আমার স্ত্রী ফোন করেছে। ক'টা যে বাজলো কে জানে! পুরোনো যুগের মানুষ তাই মোবাইল ফোন নামক যন্ত্রটার ব্যবহার এখনো শেখা হয়ে উঠলো না। এই নিয়ে বউ-বাচ্চাদের অভিযোগের অন্ত নেই। আমি তাদের বলি, আমার অফিসে টেলিফোন আছে, বাসায়ও টেলিফোন আছে। আর আমার রুটিন তো তোমরা জানোই, কাজেই যেখানে যখন থাকি সেখানে টেলিফোন করলেই আমাকে পাবে।

টেলিফোনটা থামার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দরজায় টোকা পড়ল। আমার স্ত্রী নির্ঘাত জসিমের মোবাইল ফোনে কল করেছে। আহ, যন্ত্র মানুষকে যতটুকু সাহায্য করে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি যন্ত্রণা দেয়। দরজা খোলাই ছিল। গলা উচিয়ে বললাম, কী হয়েছে জসিম? দরজা খোলা আছে, ভেতরে আয়।
কাঁচুমাচু মুখ করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে জসিম বললো, স্যার, ম্যাডাম মোবাইলে ফোন দিছে, আপনার সাথে কথা বলতে চায়।
- দে মোবাইলটা দে। হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা নিলাম। কানে ছুঁইয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা গেল, এতবার কল করছি, ফোনটা রিসিভ করতে কি হয়?
- হু।
- হু কি? এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি? অফিস ক'টায় মনে আছে?
- উঠছি।
- তোমার নামে পত্রিকায় এসব কি লিখেছে? মান ইজ্জত আর কিছু বাকী রাখলে না।
পত্রিকায় আবার কি লিখলো? কয়েকদিন ধরে একটা সাংবাদিক ছোকরা ঘুরঘুর করছিল। আমি তো ভেবেছিলাম লোকাল পত্রিকার লোক, যেহেতু আমার স্ত্রী পর্যন্ত খবর গিয়েছে তারমানে জাতীয় দৈনিকে ছেপেছে। বললাম, কি লিখেছে? আমি তো জানি না কিছু।
- তুমি তো কিছুই জানবে না। ঘুমাও। নাক ডেকে ঘুমাও।
- আমি কি নাক ডাকি নাকি?
- অসহ্য।
ট্যাট ট্যাট করে ফোনের লাইনটা কেটে গেলো। নতুন যন্ত্রণা শুরু হলো একটা। ক'দিন পর হাবিযাবি লিখে পত্রিকাওয়ালারা তারপর ওদের সামাল দিতে হয়। আজ কী লিখেছে সেটা আগে জানা দরকার। অন্তত অফিসে যাবার আগেই খবরের কাগজটা দরকার। জানি দরজার ওপাশেই জসিম দাঁড়িয়ে আছে তবুও গলা ছেড়ে হাঁক দিলাম, জসিম এই জসিম।
মুহুর্তের মধ্যে জসিম বেরিয়ে এলো, স্যার।
- কোন পত্রিকায় আমার নামে কি লিখেছে খুঁজে নিয়ে আয়।
জসিম দৌড়ে বের হয়ে যাবার জন্য ঘুরতেই আবার ডাকলাম, শোন। নাস্তাটা টেবিলে দিয়ে যা।
জসিম হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। আবার মাথাটা এলিয়ে দিলাম খাটে।

নাস্তার টেবিলে বসে বিরক্ত লাগছে। দু'টা শুকনো রুটি আর ডাল ভুনা। সাথে একটা ডিম ওমলেট থাকলেও হতো। এই বিরক্তিকর খাবার আর ভাল লাগে না। লোকাল একটা পত্রিকা রাখা আছে টেবিলে, প্রথম পাতা জুড়ে সব রাজনৈতিক খবর। বাইরের দরজায় খুট করে শব্দ হলো। জসিম এলো মনে হয়।

গতবছর পত্রিকায় ঘুষ নেবার অভিযোগ নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছিল। ভুয়া রিপোর্ট করেছিল, কাজেই ঝামেলা মেটাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ঘুষ যে একবারে নিই না তা নয়, তবে সব কিছুর নিশ্চয়ই একটা মাত্রা আছে। মনে আছে, চাকুরীর প্রথম দিকে কারো কাছে এক কাপ চা পর্যন্ত খেতাম না। তখন বিবেক নামক একটা বস্তু কোত্থেকে যেন আমার মধ্যে জুড়ে বসেছিল, দু’একবার চাকরী ছাড়ার সিদ্ধান্তও নিলাম। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হিসেবে সে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলাম না। বিয়ের প্রথম বছরটা বউকে গ্রামের বাড়িতেই রেখে আসতে হয়েছিল অর্থাভাবে। তারপর ধীরে ধীরে সব সয়ে গেছে। বিবেক নামক অদ্ভুত শব্দটা কোথায় হারিয়ে গেছে। তারপরেও অন্যদের থেকে অনেক গরীবীহালে থাকি। আমার গরীব অবস্থা দেখে আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই মনে করে আমি একজন সৎ মানুষ। আমার সততা নিয়ে আমার পরিবারের কারো মনে কোনো সংশয় নেই। আর থাকবেই বা কেনো? আমার সহকর্মীদের অনেকেরই যেখানে ঢাকায় বাড়ি-গাড়ী আছে, ছেলে মেয়েরা দামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেখানে আমার ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলোজিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে আর মেয়েটা ভিকারুন নিসায় পড়ছে। গাড়ী তো দূরের কথা তিন রুমের ভাড়া একটা ফ্ল্যাটে থাকে ওরা, লিফট-জেনারেটর নেই। এই নিয়ে ওদের অভিযোগের অন্ত নেই। তবে ছেলে মেয়ে দু’জনই বাবার সততা নিয়ে গর্ব বোধ করে। এমনকি গত বছর যখন পত্রিকায় রিপোর্টটা বেরোলো তখন মেয়েটা অভিমান নিয়ে বলেছিল, বাবা, আমি সবাইকে গর্ব করে বলি আমার বাবা একজন সৎ মানুষ, আমার এই গর্বের জায়গাটা তুমি কখনো নষ্ট করো না কিন্তু।
আমি বলি, না মা, এসব ভাবিস না। তোরা পড়াশুনা করে মানুষ হ, তোরাই তো আমার সব। টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে!
ছেলেটার অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে তেমন কিছু বলে না, বাপের টাকায় খাচ্ছে দাচ্ছে, পড়ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই তো। তবে স্ত্রী বরাবরই একরোখা, তার টাকা চাই কিন্তু অসৎ হওয়া চলবে না। তাহলে আমি কী করতে পারি? সৎ পথে আর কত টাকাই রোজগার করা সম্ভব সেটা ওকে বোঝাতে পারি না। ফলাফল হলো আমি আমার মতো থাকি আর ওরা ওদের মতো থাকে। ওদিকে আবার আমার একমাত্র শ্যালক বাবু আমার সম্পর্কে ভাল খোঁজখবর রাখে, মাঝে মধ্যে টাকা পয়সার দরকার হলে আমার কাছে আসে। আমি অবশ্য তার কাছে কিছু লুকাই না কিন্তু তার বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নির থেকে সাবধানে চলতে বলি। সে একজন উঠতি রাজনীতিবিদ কাজেই নগদ নারায়ণের দরকার তার মাঝে মধ্যেই হয়।

- স্যার পেপার।
জসিম পেপার নিয়ে ফিরেছে। বললাম, বারান্দার চেয়ারে রাখ আর চা’টা বানিয়ে ফেল।
নাস্তা শেষ করতে অনেক সময় লাগলো, পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ বিরক্ত হলাম। একই খাবার আর কত খাওয়া যায়। আমি যাই বলি না কেন আমার স্ত্রীর অর্ডার মানতে জসিম বাধ্য। কাজেই এখন আর কিছু বলি না। বারান্দায় এসে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসলাম। না, প্রথম পাতায় কিছু নেই। পাতা ওল্টাতে থাকি, ওল্টাতে ওল্টাতে শেষের পাতায় খবরটা পেলাম। লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা “ফুড কর্মকর্তার সামান্য চাকরী, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি”! হেডলাইন দেখেই তো মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

চা খেতে খেতে সময় নিয়ে রিপোর্টটার আদ্যোপান্ত পড়লাম। প্রথম এবং প্রধানতম অভিযোগ হলো, ঘুষ ছাড়া আমার টেবিলে কোনো কাজ হয় না। ঘুষের নাকি রেট নির্ধারণ করা আছে। ঘুষ বিষয়ক একটা গল্পও ফেঁদে বসেছে। হাহ, ভাবটা এমন যেন আমি একাই ঘুষ নিই আর আমার অফিসের বাকীরা সব সাধু-মহাপুরুষ! এরপরে আমার সম্পত্তির বিবরণ দিয়েছে, আমার নিজের নামে দুইটা বাড়ি আছে, ধানমন্ডিতে একটা আর বনশ্রীতে একটা, তিনটা প্রাইভেটকার আর একটা মাইক্রোবাস রেন্ট এ কার কোম্পানীর কাছে ভাড়ায় চলে, ব্যাংকে ফিক্সড করে রাখা আছে চল্লিশ লক্ষটাকা, এছাড়াও নামে-বেনামে ষাট বিঘা আবাদী জমি আছে। সাব্বাস, সবই লিখেছে, কিছুই বাকী রাখেনি দেখি। কিন্তু এত তথ্য ঐ ব্যাটা পুচকে সাংবাদিক পেলো কোথায়! রীতিমতো গবেষণা করেছে আমাকে নিয়ে। সম্ভব হলে একটা পিএইচডি ডিগ্রী দিয়ে দিতাম ব্যাটাকে।

এবার মনে হয় আর সহজে বের হয়ে আসা যাবে না। ঠান্ডা মাথায় বসে আগে ছক কষতে হবে কিভাবে এগোবো। তারআগে একটা সিগারেট পেলে মন্দ হতো না। স্ত্রীর কড়া নির্দেশে বিড়ি সিগারেট নিষিদ্ধ। ভালকথা, জসিমকে বলতে হবে বাসার ফোন ছাড়া অন্য কারো ফোন যেন আমাকে না দেয়। হাঁক দিলাম, জসিম।
মুহুর্তে উপস্থিত, স্যার।
- বাসার বাইরের অন্য কেউ টেলিফোন করলে বলবি আমি বাসায় নেই।
- জী স্যার।
- আর যা, আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।
আমার অর্ডার শুনে জসিম একটু ইতস্তত বোধ করতে লাগলো, দাঁড়িয়ে রইলো। ঠান্ডা গলায় বললাম, আজকে মেজাজটা ভয়াবহ খারাপ...
- যাইতেছি স্যার।
জসিম দৌড়ে পালালো মনে হলো।

সবকিছু ঠিক মতো সামাল দেয়া যাবে কিনা জানি না। দুদকের বাবাজিরা এরই মধ্যে নিশ্চয়ই আমার খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছে। তবে পরিবারের লোকজনদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তাটা একটু অন্যরকম। এটা ঠিক যে, একদিন না একদিন ওরা বিষয়গুলো জানতে পারতোই, ধরেই নিয়েছিলাম চাকুরী জীবন শেষ করার পরে ওরা এসব জানলেও খুব একটা ঝামেলা হয়তো হবে না কিংবা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি ইত্যাদি বাবদ কোটি খানেক টাকা দেখিয়ে ওদের বুঝিয়ে ফেলতাম। কিন্তু এখন ওরা যখন জানবে যে আমি সত্যিকার অর্থে একজন ঘুষখোর মানুষ, আমার সকল সম্পত্তিই অবৈধ টাকায় গড়া তখন তাদের একেকজনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা আসলে বুঝতে পারছি না। ছেলেটা হয়তো খুব একটা ঝামেলা করবে না, কিন্তু মেয়েটা হয়তো কথা বলাই বন্ধ করে দেবে, স্ত্রী হয়তো রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবে কিছুদিন (রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারে না)। আর এদিকে থানা পুলিশ, কোর্ট কাচারি করতে করতে বাকী জীবনটা পার করতে হবে, সবকিছু ঠিকঠাক মতো না হলে হয়তো জেলও হতে পারে।

জসিম ফিরেছে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি বারান্দায়। আজ অফিসে অবশ্যই যেতে হবে, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হতে দেয়া যাবে না। এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যেন এসব ভূয়া রিপোর্ট করে আমার কিছুই করা যাবে না। পাশাপাশি পুচকে সাংবাদিকের একটা খোঁজ বের করতে হবে। দফারফার শুরুটা তাকে দিয়েই করতে হবে।

ক্রিং ক্রিং ক্রিং। আবারো টেলিফোন বাজতে শুরু করলো। জসিম ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে টেলিফোনটা ধরার জন্য। কে হতে পারে? হতে পারে আমার স্ত্রী কিংবা অফিসের সামাদ সাহেব। বছরখানেক হলো সামাদ সাহেব জয়েন করেছেন। সব বিষয়ে তার অসীম কৌতুহল আর অসীম ভয়। একটা স্বাক্ষর করার আগে একশোবার ভাববে, তারপর কেউ অভয় দিলে স্বাক্ষর করবে। আরে ব্যাটা এতো ভয় থাকলে খাদ্য অধিদপ্তরে এসেছিল কেন, গ্রামে গিয়ে প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করলেই তো পারিস।

জসীম দৌড়ে এলো, স্যার আপামনি ফোন করছে।
আপামনি হলো আমার মেয়ে। বললাম, লাইনটা এখানে দিয়ে যা।
টেলিফোনের তারটা বেশ লম্বা। বারান্দা পর্যন্ত অনায়াসে চলে আসে। জসিম টেলিফোনটা দিয়ে গেল বারান্দায়। জানিনা, অভিমানী মেয়েটা সত্যটা জানলে কী করবে, নাকি অভিমানী এখনি গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সবকিছু সহজভাবে স্বীকার করে নেয়াটা ঠিক হবে কি না এখনো বুঝতে পারছি না। বললাম, হ্যালো।
- নাস্তা করেছো বাবা?
মেয়ের কন্ঠটা স্বাভাবিক মনে হলো যেন সকালে কোন কিছুই ঘটেনি। আমিও স্বাভাবিক কন্ঠেই বললাম, হ্যাঁ মা, নাস্তা করেছি। তোর আজ ক্লাস নেই? যাবি না?
- না বাবা, যাবো না। আম্মু প্রচন্ড মেজাজ খারাপ করে বসে আছে, ভাইয়াও ভার্সিটি যায় নি।
- পত্রিকা পড়েছিস? তোর মন খারাপ হয়নি?
- পড়েছি। মন খারাপ হয়েছে কি না এখন বলবো না। আগে তুমি বলো, যা লিখেছে তা কি সত্যি নাকি গতবারের মতো ভূয়া?
কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম। সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুব কঠিন মনে হচ্ছে। একসাথে দু’কূল সামলানো খুব কঠিন, স্রোতস্বিনী নদী, এক কূল তো ভাঙ্গবেই। বড় একটা দম নিয়ে বললাম, সত্যি।
- ওয়াও বাবা। আসলেই তোমার এতো কিছু আছে?
- হ্যাঁ মা।
- আমি ভাইয়ার সাথে পাঁচশো টাকার বাজি ধরেছিলাম, যাক পাঁচশো টাকা বোনাস পেলাম। তবে বাবা, আম্মু কিন্তু তোমার ওপর প্রচন্ড রেগে আছে, তোমার যে আজ কী হবে জানি না।
কিছু বললাম না। যাক মেয়েটা তাহলে সহজভাবেই নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
- বাবা শোনো, তোমাকে একটা ট্রিক শিখিয়ে দিচ্ছি। আম্মুকে বলবা, শাহানা, ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটা আর দুইটা গাড়ি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা, ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটা কত স্কোয়ার ফিট?
- কত স্কোয়ার ফিট তা তো মনে নেই। তবে বড় বাসা, চারটা বেডরুম আছে, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার আছে।
- আম্মু আসছে। নাও আম্মুর সাথে কথা বলো।
আট-দশ সেকেন্ডের বিরতি চলছে। স্ত্রী কী পরিমাণ রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না। দুরুদুরু বুক নিয়ে হ্যালো শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।
- হ্যালো। ওপাশ থেকে বরাবরের মতোই ঝাঁঝালো কন্ঠ শোনা গেল।
আমিও বরাবরের মতই বললাম, হু।
- হু কি? তুমি খুবই খারাপ কাজ করেছো। তোমার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
- জানি।
- না তুমি জানো না। তুমি ঘুষ খাবে কি খাবে না সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। ঘুষের ব্যাপারে তোমার যে শাস্তি হবে সেটা তো পরকালে তুমি পাবেই, ইহকালেও পেতে পারো।
- তাহলে তুমি অতো ক্ষেপছো কেনো?
- ওমা বলে কী? আমি ক্ষেপবো না তো কে ক্ষেপবে। দীর্ঘ পঁচিশটা বছর তোমার সংসারে চুলায় আগুন ঠেলছি, ফকির-মিসকিনের জীবন, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা আর উনি ওদিকে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
- হু।
- কথায় কথায় হু বলবে না তো। তোমার এতো সম্পত্তি কার জন্য করেছো বলো? তোমার ছেলে-মেয়ের জন্যই তো নাকি? তাহলে এতদিন আমাদের বঞ্চিত রাখলে কেন? নাকি আমরা ভোগ করলে তোমার সম্পদ কমে যেতো? কী ভাবো তুমি নিজেকে?
- না সেরকম নয়, আসলে-
- তাহলে কী? ঘুপচি ঘুপচি তিনটা ঘরে থাকি, লিফট-জেনারেটর নেই, বাসার বাইরে গেলে সিএনজিতে ওঠার আগে দশটা হিসাব করতে হয়-
- আহা থামো না বাবা। শোনো, ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটা সত্যিই তোমার নামে কেনা, তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে বলিনি আগে। গতমাসে হ্যান্ডওভার দিয়েছে। এখনো ভাড়া দেয়া হয়নি, চাইলে আজই উঠতে পারবে। আর আমি ফোন করে দিচ্ছি, এখনি বাসার সামনে একটা গাড়ি চলে আসবে।
ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। মেয়ের ট্রিক তাহলে কাজে দিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত নরম স্বররে বললাম, আমি তো তোমাদের বলার সাহসই পাইনি এতদিন। তোমরা সবাই যেভাবে সততা-সতা করো, তাতে সাহসটা পাই কোথায় বলো।
- রাখো তোমার সততা। ছেলে-মেয়েদের না বললেও আমাকে অন্তত জানাতে পারতে। নাও তোমার মেয়ে তোমার সাথে কথা বলবে, কথা বলো।
ওপাশ থেকে মেয়ের কন্ঠ শোনা গেল, বাবা, ভাইয়া খুব মন খারাপ করেছে।
- কেনো?
- ভাইয়া বলছে, বাবা সবার জন্য সবকিছু করেছে আমার জন্য কিছু করে নাই। গাড়ি, বাড়ি, জমি সব কিনেছে কিন্তু একটা বাইক কিনেনি। বাবা, ভাইয়াকে একটা বাইক কিনে দিও কিন্তু।
- ও এই কথা, সে না হয় দিলাম। কিন্তু মা, আমার সামনে তো ভয়াবহ বিপদ। পুলিশ এসে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, দুদক মামলা করবে। বাকী জীবনটা জেলেই কাটাতে হতে পারে।
- সে নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেবো না বাবা। আমার বান্ধবী আছে না মলি, ওর বাবা দুদকের অনেক বড় অফিসার। আর আমরা ভাল ল’ইয়ারের ব্যবস্থা করবো। মামা আছে, আমরা আছি তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর তাছাড়া আম্মু বলেছে, তুমি নাকি নিজেই সব মিটিয়ে ফেলতে পারবে। বাবা, ভাইয়াকে একটা বাইক কিনে দেবে প্লিজ।
- আচ্ছা দেবো।
- ঠিক আছে বাবা। এবার তাহলে ছাড়ছি। তুমি ওদিকের কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে এসো।
খুট করে লাইনটা কেটে গেলো।

যাহ্ বাবা, কী ভেবেছিলাম আর কী হলো! বুকের ওপর থেকে একটা বড় পাথর সরে গেল আজ। কিন্তু বুঝলাম না, যারা এতদিন সততা-সততা, বিবেক-বিবেক বলে মুখে ফেনা তুলতো, আজ রাতারাতি তাদের হলোটা কী! নাকি সারা জীবন টানাটানির সংসারে হঠাৎ করে এতো কিছু পেয়ে ভালো মানুষের মুখোশগুলো খুলে পড়লো। যাই হোক, ঘরের সমস্যা তো মিটলো এবার বাইরেরটা নিয়ে ভাবতে হবে।

ছবি: গুগলমামা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:৪১
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×