সতীপর্দা
২৭৬ জন কিশোরীকে তারা অপহরণ করলো। ওরা সে-সময়ে স্কুলে পরীক্ষা দিচ্ছিল। অপহৃতদের কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও প্রায় ২০০ জন কিশোরী অপহরণকারীদের কব্জায় রয়ে গেলো।
দেশের শীর্ষ পপ-তারকা, লাবণ্যময়ী সুন্দরী ঘোষণা করলেন, ‘আমি আমার ২৩ বছরের ভার্জিনিটি উৎসর্গ করবো এই ২০০ কিশোরীর মুক্তির বিনিময়ে। ওদের ছেড়ে দিন। ওরা অবুঝ কিশোরী। ওদের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর। আমি পরিণত এবং অভিজ্ঞ। আপনারা প্রতিরাতে ১০ থেকে ১২জন আমাকে ভোগ করুন, কিচ্ছু যায় আসে না। এরপরও ওদের ছেড়ে দিন, ওরা ওদের প্রিয় মা-বাবার কাছে ফিরে যাক।’
অপহরণকারীরা রাজি হলো। উর্বশী গায়িকা সুরম্য প্রাসাদে সতীত্ব বিসর্জেনর জন্য অপেক্ষায় থাকলেন। রাত পার হয়ে যায়। শুরু হলো আরব্য রজনির আধুনিক ইতিহাস।
অপহরণকারীদের শীর্ষ নেতা খুন হলেন প্রথম রাতেই। সতীত্ব ছেদনের লোভ যুদ্ধ জয়ের চেয়েও বড়। নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে নিজেরাই একে একে খুন হতে থাকলেন।
১৪ জুলাই ২০১৪
মাতৃপক্ষ
আমার সোনার সংসারে দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে সারাক্ষণ ঘর আর মন আলোকিত করে রাখে। ওদের চঞ্চলতা আমাকে প্রভূত আনন্দ দেয়। যে-কোনো বিষয়ে ওদের বিস্ময় আর উচ্ছ্বাস আমাকে উদ্বেলিত করে। ওরা যখন ছোটো ছিল, আমার বুকের উপর চড়ে লাফাতো, কাঁধে বসে চুল ধরে সজোরে মাথা ঝাঁকাতো। ঘরের এক কোনা থেকে আরেক কোনায় গেলে ওরা দৌড়ে আমার পিছে-পিছে, আগে-আগে ছুটতো। আমি বাসা থেকে বাইরে গেলে ‘আমিও যাবো’ বলে ভীষণ গোঁ ধরতো। ওদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটতো আমাকে নিয়ে।
আমি যেদিন বাসা থেকে বাইরে থাকতাম, ওদের মা বলতো, সারা ওরা সারা দিনমান আমার জন্য মনমরা হয়ে ঘরের এখানে-সেখানে অনাথের মতো পড়ে থাকতো, আমার জন্য ঘুরে-ফিরে কাঁদতো। আমার কাছে ওদের নিয়ে আসার জন্য ওদের মায়ের সাথে ওরা খুব জিদ করতো। তারপর যখন বাসায় ফিরতাম, যেন অনেক যুগ পর ওরা আমায় ফিরে পেয়েছে, এভাবে ছুটে এসে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো। গলা ধরে ঝুলে থাকতো। কখনোবা অতি আবেগে কেঁদে ফেলতো। এরপর আমার অনুপস্থিতিতে বাসায় যা যা ঘটে গেছে, যেমন, ওদের মা ওদের কখন-কখন, কী কী কারণে বকা দিয়েছে, কতবার জোর করে খাবার খাইয়েছে, কতবার ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দেখতে না দিয়ে ধমকাধমকি করে ঘুম পাড়িয়েছে, প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে আমাকে বুঝিয়ে দিত যে, আমার অনুপস্থিতিতে ওদের সময়টা মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমি অতিশয় মনোযোগ সহকারে সবকিছু শুনে যখন বলতাম ‘এবার আমি এসে পড়েছি না? দেখে নিব কে তোমাদের জ্বালাতন করে’, ওরা তখন স্বস্তিতে আমার বুকে লেপ্টে পড়তো।
ওরা বড় হবার পর ওদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলাম আমি। খাবার টেবিলে, পড়ার টেবিলে, টিভি দেখার সময়ে আমাদের আড্ডা সবচেয়ে বেশি জমতো। ওরা স্কুল বা কলেজ থেকে বাসায় ফিরে এসে অধীরভাবে অপেক্ষা করতো আমি কখন অফিস থেকে ফিরবো। ওদের কোন টিচার আজ খুব ভালো অঙ্ক করিয়েছে, কোন টিচার কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, কোন ক্লাসমেট পা পিছলে আছাড় খেয়ে পায়ের গোড়ালি মচকেছে- এসব ওদের পেটের ভিতর আটকে থাকতো, আর আমাকে পাওয়ামাত্র উপযুক্ত রসযোগে তা আমার কাছে পরিবেশন করতো। কখনোবা একযোগে হাসতে হাসতে আমাদের চোখ গলে পানি বেরিয়ে পড়তো।
ফুটবল বিশ্বকাপে আমরা রাত জেগে খেলা দেখেছি। প্রিয় দল ও প্রিয় খেলোয়াড়দের প্রতিটা খেলা আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতাম। আমাদের হাড্ডাহাড্ডি ডিবেট হতো। খেলা দেখতে দেখতে কোনো কারণে আমি মুহূর্তকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়লে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে আলোচনায় মশগুল হতো। আমার উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া ওদের সব আনন্দ মাটি হয়ে যায়।
আমার সংসারটা সত্যিই একটা চাঁদের হাট। এমন সংসারে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে সাধ হয়।
কিন্তু এমন সংসারে হঠাৎ করেই ঝড় শুরু হয়ে গেলো একদিন। ওদের মা খুব নগণ্য একটা কারণে আমার সাথে বিতণ্ডায় লিপ্ত হলেন। সেই বিতণ্ডায় আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি নি, এবং আমি শতভাগ নিশ্চিত, এ অনাকঙ্ক্ষিত বিতণ্ডার মূল কারণ আমি নই, ওদের মা। ওদের মা ক্রমশ অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলেন। আমার সংসার একটা দুর্বিষহ বন্দিশালা, আমার মতো অমানুষ এ পৃথিবীতে আর একটিও নেই, ইত্যাকার অভিধায় আমাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেললেন।
আমি যখন পরাজিত ও পর্যুদস্ত হয়ে মনের ফাঁপর খালাস করার জন্য ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্য কামনা করছিলাম, সেই মুহূর্তে ওরা তিন ভাইবোন আমার কক্ষে প্রবেশ করলো। কিন্তু ওরা আমার পাশে এসে বসে পড়ে আমাকে কোনো সান্ত্বনা দিল না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওরা কঠোর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি একটা পশু। আপনি আমাদের মাকে কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। আমরা আর আপনার সাথে কোনো কথা বলবো না।’
ওদের অভিযোগ অসত্য। আমি গালিগালাজ করতে পারি না। রেগে গেলে বড়জোর বলতে পারি- ‘আমার চোখের সামনে থেকে সরো।’ আমি যে এসব পারি না তা আমার চেয়ে ওরাই ভালো জানে।
ওদের আচরণ আমাকে মর্মাহত করলো। ওরা কোনোদিন আমার সাথে কটু ভাষায় কথা বলতে পারে এটা আমি সাত জনমেও ভাবি নি। ওরা আমাকে ‘পশু’ বলতে পারে, আমার মধ্যে যেমন এ স্বভাব আছে বলে আমি মনে করি না, তেমনি ওরা এত সহজে এ শব্দটা উচ্চারণ করবে, এমন শিক্ষাও ওরা পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
ওদের আচরণে সত্যিই আমি মুষড়ে পড়লাম। আশৈশব ওদের প্রাণের বন্ধু, সারাবেলার খেলার সাথি, আর ভাব বিনিময়ের একমাত্র ব্যক্তি আমি। ওদের মা কেবল নীরব দর্শকের মতো পাশে বসে এসব দেখেছে, হাসিতে যোগ দিয়েছে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওদের সাথে আমার যে ভাব, ওদের মাকে যদি আমি কেটে ৭ টুকরো করে নদীতে ভাসিয়েও দিই, আমার বিপক্ষে ওরা কথা বলবে কোনোদিনই আমার এমনটা মনে হয় নি।
এই যে ওদের অন্তরের গভীরে এতদিন আমার জন্য এত বড় একটা জায়গা ছিল, আজ মুহূর্তে তা দপ করে বন্ধ হয়ে গেলো! আমি ওদের কেউ না!
‘আপনি একটা জঘন্য মানুষ। আপনাকে বাবা বলতেও খুব ঘৃণা হচ্ছে।’ খুব তীক্ষ্ণ ও কর্কস স্বরে এ কথাগুলো বলে ওরা একযোগে আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো।
আমার মাথায় তখন ঘাম। চোখে অন্ধকার। পৃথিবীতে আত্মীয়তার বন্ধন খুব ঠুনকো। বেডে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোক, কিংবা কষ্ট। চোখ মুদে আসছে। এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে মাকে খুব মনে পড়লো। কবে যেন মাকে হারিয়েছি! হ্যাঁ, আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন আমার মা মারা যায়। মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো। যে-কোনো মুহূর্তে মায়ের মুখটাই হলো সকল প্রশান্তির মূল। সকল আগুনে শেষ আশ্রয়ের নাম মা।
মা, আমাকে একটু কোলে নে, মা...
১৬ জুলাই ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৫২