আমাদের ক্লাসমেট জাহিদের জন্য আমরা পাত্রী দেখতে গেলাম। অনেক কথা হচ্ছে, হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব হচ্ছে। আড্ডার শেষ পর্যায়ে যেয়ে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে বসলো, ‘আচ্ছা, পাত্র কে?’
***
এক সুদর্শন যুবক নিজের জন্য সুপাত্রী খুঁজছিল।
সে সদাহাস্য, সপ্রতিভ এবং চৌকষ। ৩৮ কিংবা ৪০ বছর বয়স হলেও তাকে ১৮ বছরের টগবগে তরুণের মতো দেখায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বিয়ে করতে পারছিল না। এটা ওর দোষ নয়, মেয়েদের দোষ। বরপ্রার্থিনীকে গান ও সাহিত্যসহ সকল কলায় পারদর্শিনী হতে হবে। এমন কলাবরিষ্ঠা মেয়ের খুব অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
সে ঘরে ঘরে কনে দেখে। কনেদের বড় বোন বা মা-খালারা ‘যুবকের’ প্রকৃত বয়সের কথা জানতে পেরে ঠোঁট উলটালেও ‘কচি’ মেয়েরা ‘ওর বয়স নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই’ বলে তৎক্ষণাৎ ‘কবুল’ বলে ফেলতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সে নিরিখ করে দেখতে পায়, মেয়েটির ‘কলা’ বলতে আসলে কিছুই নেই।
যুবকের মা, বোন ও ভাইয়েরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ‘এরপর সামনে যে-কোনো মেয়েকে পাওয়া মাত্র বিয়ে করতে হবে, অন্যথায় আমরা আর তোমার সাথে নেই’ মর্মে হুঁশিয়ারি ঘোষণা করলে সে শেষবারের মতো পাত্রী নির্বাচনে বের হয়েছিল।
পাত্রী নির্বাচনই বটে। তবে এ গল্পটি কোনো পাঠ্যবইয়ে পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা এটি পাঠ শেষে শিরোনামে নির্ঘাত বানান ভুল হয়েছে মনে করে এটিকে ‘পাত্রী নির্বাচন’ ভেবে নিতেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি- আমি নিজেও গল্পটির নাম শুরুতে ‘পাত্রী নির্বাচন’ই রেখেছিলাম। পরে মনে হয়েছে, ওটি একটা বড় রকমের ভুল হতো।
চলুন, গল্পের ভিতরে যাওয়া যাক।
ঘরে ঘরে কনে দেখার পর আর মাত্র একটি পাত্রী দেখবে বলে গল্পের নায়ক এই শর্তে মনস্থির করে যে, এই মেয়েটি মনের মতো না হলে সে তৎক্ষণাৎ চির-কুমারত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেবে। তার একজন মননশীলা, সংস্কৃতিমনা পাত্রীর প্রয়োজন, যার মধ্যে সমুদয় রমণীয় গুণাবলি বিদ্যমান। রবি ঠাকুরের গান জানতে হবে তাকে, কাব্যকলায়ও তার অসাধারণ দখল থাকতে হবে।
দৈবক্রমে সর্বশেষ কনে দেখার দিন তার এক বাল্যবন্ধুর আবির্ভাব হয়, কোনো এক কালে যে-বন্ধুটি তার অন্তরের একটি অংশ ছিল। যদিও কাল পরিক্রমায় পার্থিব কারণেই তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, তথাপি এই আকস্মিক উপস্থিতিতে দু বন্ধুর মিলন খুব মধুময় হয়েছিল। এ বন্ধুর কনে-ভাগ্য খুব ভালো, তার নিজের জন্যই শুধু নয়, বন্ধুদের জন্যও। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, কেবল তার ভাগ্যেই এ কন্যায় বন্ধুর কপালে বউ জুটবে।
ধরা যাক, ফাহিম আর জামান দু বন্ধুর নাম।
ছিমছাম ড্রইং রুম ভর্তি মেহমান- এক পাশে বরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বর্ষীয়ান আমজাদ খান, সাদা-কালোয় মেশানো শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ, অষ্টাদশ বর্ষীয় কলেজ-গোয়িং কন্যার পঁয়তাল্লিশ বর্ষীয় পিতা; তাঁর চেয়ারের পাশে তদীয় ছোটো ভাই, চল্লিশ বর্ষীয় আরফাজ খান।
ফাহিম আর জামান পাশাপাশি বসেছে। ফাহিমের বামপাশে দুটি চেয়ার খালি রাখা হয়েছে, তেমনি জামানের ডান পাশে দুটি চেয়ার কীভাবে বা কেন খালি রয়ে গেছে, তা অজ্ঞাত। আরেক পাশে কনের দুলাভাই, তাঁর পাশ ঘেঁষে কনের বড় মামা।
‘আসসালামুআলাইকুম।’
পুরো ড্রইং রুম আলো করে সে দরজায় এসে দাঁড়ায়। কনে দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে গেলো। এক অপূর্ব স্নিগ্ধ আভা তার সর্বাঙ্গে খলখল করে। ডানহাত উঁচিয়ে রাজকীয় রীতিতে ঈষৎ শির-অবনত ভঙ্গিতে সবার উদ্দেশে সালাম জানালো সম্রাজ্ঞী, সেই সঙ্গে স্মিত হাসির বিচ্ছুরণ, বিধাতার আপন হাতে গড়া সুন্দরী কন্যার আলো-ঝলমল হাস্য আর মধুর কণ্ঠস্বরে সবার প্রাণ ভরে গেলো।
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’ সকলে সমস্বরে প্রত্যুত্তুর করলেও আমজাদ খান বেশ উচ্চস্বরে দীর্ঘক্ষণ টেনে সালামের জবাব দিয়ে কন্যাকে জানিয়ে দিতে সচেষ্ট হলেন, এ ‘পাত্রীনির্বাচন’ সভায় তিনিই সর্বমান্য গুরুজন।
কন্যার একজন সঙ্গিনী আছে, চিরাচরিত ও আধুনিক উভয় প্রথাতেই এর ব্যত্যয় খুব কম দেখা যায়; অর্ধ ঘোমটাবৃত, সলাজ হাসি ঝরে তার বদনে, কন্যার পাশ ঘেঁষে খুব কাঁচুমাচু হয়ে বার বার পড়নোন্মুখ ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে।
ফাহিমের মনে সহসা এক অবান্তর প্রশ্নের উদয় হলো- পাত্রী কে? সামান্য ভ্রম হবার অবকাশ আছে বটে। নির্বাচনী সভায় পাত্রীর লম্বা একখানি ঘোমটা থাকে, চিকনলতার মতো তার বাঁকা দেহবল্লরী সামনে নুয়ে পড়ে। পুরো নয়, এর সামান্য আভাস পেছনের ‘লজ্জাবতী’র মাঝে ফুটে আছে। কিন্তু পাত্রী সে নয়। সে তার সম্মুখের সহচরিণীকে পেছন থেকে দু হাতে জড়িয়ে। আগের যুগে পেছনের লজ্জাবতীকেই সবাই পাত্রী জ্ঞানে সুনিশ্চিত হতো। ফাহিম কিছুটা আগের যুগের ধারণাবাহক, তার ভুল হতেই পারে। তবে জামান নিশ্চিত, এদের যে কোনো একজনই যে-কোনো সভায় ‘পাত্রী’ হবার জন্য ঢের যোগ্যতা সম্পন্না।
‘ভিতরে আসবো?’ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, অত্যাধুনিকা কোকিলকণ্ঠীর গলা থেকে মধু ঝরে পড়লো।
লাবণ্য দর্শনে মুহূর্তকালের জন্য বাকরহিত সভার ভিতর থেকে হঠাৎ ‘জি হ্যাঁ, অবশ্যই আসবেন, অবশ্যই, আসুন ভিতরে, বসুন’ বলে ওঠেন আমজাদ খান। সুদর্শনা মিষ্টি হেসে গৃহপ্রবেশ করে।
আমজাদ খান হাসিমুখ করে সামনে উপবিষ্টা কন্যাগণের দিকে চোখ রাখেন। তিনি ওদিকে তাকাতেই দুটি মেয়ে একসঙ্গে তাঁকে উদ্দেশ্য করে পুনর্বার বলে উঠলো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ আমজাদ খান স্বভাবসুলভ উচ্চ-গম্ভীর স্বরে সালামের জবাব দিয়ে বলেন, ‘আপনারা ভালো আছেন তো?’
‘জি ভাইয়া। আপনি ভালো?’
‘আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানি।’ একটু বিরতি দিয়ে আমজাদ খান বলেন, ‘ফাহিম, জামান, তোমরা কথা বলো। টেক দেয়ার ইন্টারভিউ।’
জামান অবাক হয়। ‘টেক দেয়ার ইন্টারভিউ’ মানে কী? পাত্রী কি তাহলে দুজন? দু পাত্রী কি তাহলে দু জনের জন্য নাকি? এমন তো কথা ছিল না।
ফাহিম জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনাদের নাম?’
‘প্রগতিশীলা’ হেসে জানায়, ‘আমি নির্ঝর।’
‘বা বা, চমৎকার।’ আমজাদ খান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘একেবারে রাবিন্দ্রিক নেইম। জানো বোন, নির্ঝরকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে?’
‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, তারই রথ নিত্যই উধাও...’ আরফাজ খান খুব দরদ দিয়ে আবৃত্তি করে উঠতেই আমজাদ খান বাধা দিয়ে বলেন, ‘একটু ভুল করে ফেললে তুমি।’ কথা শেষ না হতেই জামান বলে উঠলো, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর...।’ আমজাদ খান হাতে তুড়ি মেরে বলেন, ‘দ্যাটস্ ইট। দ্যাটস্ ইট।’ আরফাজ খান লজ্জিত ও বিব্রত হলেন।
জামান বললো, ‘আপনাদের ‘প্রিয় সঙ্গীত’ কোনটা? রবীন্দ্রসঙ্গীত, নাকি নজরুল?’
কন্যারা কিছুটা হোঁচট খায়। নির্ঝর বলে, ‘আসলে বাংলা গান অনেকদিন আমাদের শোনা হয় না। তবে, আমার কাছে হিন্দি ভার্সন রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা সিডি আছে। মাঝে মাঝেই শোনা হয়।’
‘আসলে হিন্দি গানের কোনো তুলনা হয় না। গানের জন্য হিন্দি...।’ কন্যার দুলাভাই বলে ওঠেন। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আরফাজ খান বলেন, ‘যুদ্ধের জন্য ইংলিশ মুভি।’
‘আসলেই। এখনো অড্রে হেপবার্ন আমার স্বপ্নের নায়িকা। জানেন, ‘রোমান হলি ডে’ দেখার পর...।’ আমজাদ খানকে থামিয়ে দিয়ে আরফাজ খান বলে ওঠেন, ‘ওহ..., তুমি একটু ব্যাকডেটেড। অড্রে হেপবার্ন মরে ভূত হয়ে গেছে সেই কবে... এখন হলো ব্রুকশিল্ড-ম্যাডোনাদের যুগ।’
‘ব্রুকশিল্ড আর ম্যাডোনাদের যুগও পার হয়ে গেছে এক ডিকেড আগে। এখন হলো অ্যাঞ্জেলিনা জোলি আর জেনিফার লোপেজদের যুগ।’ জামান বললো।
কোথা থেকে যেন তাঁদের আলোচনা শুরু হয়েছিল? হ্যাঁ, কন্যাদের নামপরিচয় থেকে- ‘নির্ঝর।’ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ‘ক্রিয়েশন অব আর্থ’, তারপর ‘চূড়ান্ত’ ও বিতর্কিত বিষয- ‘দ্য এক্সিসটেন্স অব গড’-এ গিয়ে তা পৌঁছলো। তবে তাদের এই ‘জমজমাট’ আলোচনায় ‘হ্যাঁ-হুঁ’ বলে কাউকে ‘সায়’ দেয়া, প্রয়োজনমতো হাসি-উপহার প্রদান ছাড়া ‘বরপ্রত্যাশিনীদের’ বড় কোনো কাজ ছিল না। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছুটা বিরক্ত বোধের জন্ম হলো, কারণ, তারা লক্ষ করে দেখে- সুদর্শনাদের কাছে নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রমাণের জন্য প্রত্যেকের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা প্রতিযোগিতা চলছে। তবে এটা তারা দুজনেই খুব উপভোগ করছিল তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
‘তোমরা কিছু বলো।’ আমজাদ খান বললেন।
‘মেয়েরা’ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। নির্ঝর বলে, ‘আপনারাই বলুন। আপনাদের আলোচনায় আমরা খুব মজা পাচ্ছি।’
দ্বিতীয় কন্যার উদ্দেশে আরফাজ খান বললেন, ‘আপনার নামটি কি জানতে পারি?’ দ্বিতীয় কন্যা ঝটপট জবাব দেয়, ‘আমার নাম শিমলা। আমি ওর ছোটো আন্টি হই।’
আরফাজ খান খুব ছোটো শব্দে ‘স্যরি’ বললেন। তিনি ‘শিমলা আন্টিকে’ কন্যার ‘বোন’ ভেবেছিলেন।
‘শিমলা আন্টি কি এখনো স্টুডেন্ট?’ জামান জিজ্ঞাসা করে।
‘কেন, আমার কি লেখাপড়ার বয়স পার হয়ে গেছে?’ মিটিমিটি হেসে শিমলা জবাব দিয়ে মাথা নিচু করে।
‘না, মানে আপনি কোন কলেজে পড়েন তা জানতে ইচ্ছে করছে।’ ফাহিম বলে।
‘আমি কলেজে পড়ি না।’
‘নেভার মাইন্ড,’ আরফাজ খান বলেন, ‘অনেকে বুড়ো বয়সেও স্কুলে ভর্তি হয়। আসলে পড়ালেখার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।’
মেয়েরা মিটিমিটি হাসতে থাকে।
কনের বড়মামা আর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারছিলেন না। তিনি গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘শিমলা এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে।’
বরপক্ষের মাথা হেঁট হবার জো হলো।
‘দাদা, আমি উনাদের একটা প্রশ্ন করি।’ শক কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে মেয়েদের লক্ষ করে ফাহিম বলে, ‘এবার আপনাদের কথা বলুন।’
‘আমাদের সবার কথা বলবো কেন? এখানে পাত্রী মাত্র একজন। পাত্রী সম্বন্ধে আপনাদের কিছু জানার থাকলে বলুন।’ নির্ঝর বলে।
‘স্যরি, আমাদের ভুল হয়ে গেছে’, জামান বলে, ‘নির্ঝর, আপনাকেই একটা প্রশ্ন করি।’
‘অসংকোচে বলুন। আমি আপনাদের ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত।’ নির্ঝরের কণ্ঠে ঠাণ্ডা কৌতুক।
‘আমরা এটাকে ইন্টারভিউ না বলে একাডেমিক ডিসকাশন বলতে পারি।’ জামান বলে।
‘তা হবে কেন?’ নির্ঝর কিছুটা রূঢ় স্বরে বলে, ‘এটা কোনো মতবিনিময় সভা নয়। এটা এটা পাত্রীনির্বাচনী সভা। আমার কাছ থেকে আপনাদের অনেক কিছুই জানার থাকতে পারে। পারে না?’
‘আলবত পারে। কিন্তু আপনিও প্রশ্ন করতে পারেন, যে কোনো প্রশ্ন। আমরা প্রস্তুত।’ জামান বলে।
রমণীরা মুখ টিপে হাসতে থাকে, যার অর্থ সবাইকে প্রশ্ন করে লাভ নেই, পাত্র তো একজনই।
একটা বেফাঁস প্রশ্ন করে বসলো ফাহিম, ‘আচ্ছা, আপনাদের বয়স কত?’
শিমলার মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠলো, যদিও নির্ঝরের চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। কন্যাদের জবাবের আগেই আমজাদ খান স্বগতোক্তি করে বলেন, ‘মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে নেই।’
‘আমার এখন বাইশ বছর।’ নির্ঝর বলে।
‘এ পারফেক্ট এইজ ফর দ্য ম্যারিজ।’ জামান উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে।
‘যদিও আমি নিশ্চিত নই এ বয়সেই আমার বিয়ে হবে কিনা।’ নির্ঝর হাসতে হাসতে বলে।
আমজাদ খান আদম-হাওয়ার উল্লেখ করে বললেন, ‘বিয়ের জোড়া আল্লাহ্ তা'য়ালা আগেই নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। পুরুষের বাম পাঁজরের হাড় থেকে নারীর সৃষ্টি।’ যদিও তাঁর এ তত্ত্ব দ্বারা প্রমাণিত হলো না যে, এ বছরই নির্ঝরের বিয়ে হবে, একেবারে মোক্ষম বয়সে।
ফাহিম সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের একটা প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি নারীর সম-অধিকার চান?’
‘অবশ্যই চাই,’ নির্ঝর বলে, ‘তবে কথা হলো, ‘আপনাদের’ পুরুষ-শাষিত সমাজে নারীর সম-অধিকারের প্রশ্নটি বাতুলতা মাত্র।’
‘এ কথা কেন বললেন?’ জামান বলে।
‘নারীরা কি কোনো অধিকার ভোগ করতে পারছে? আমাদের চলার কোনো স্বাধীনতা নেই। বোরখা না পরে বের হবার কোনো উপায় নেই।’
‘একজন সুশিক্ষিতা মেয়ে হিসাবে আপনার এ কথাটি বেমানান। বোরখা পরার বিধান সমাজ আপনার ওপর চাপিয়ে দেয় নি, এটা আপনি নিজেই আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছেন।’
‘এটা আপনি ঠিক বলেন নি। এই বিধানটা সমাজেরই চাপিয়ে দেয়া। সমাজই বিধান করে দিয়েছে, হে নারীরা, তোমরা পর্দা করো। এ কথাটা পুরুষকে কেন বলা হলো না? এখানেই কিন্তু নারীদের অধিকার খর্ব করার বিষয়টা ধরা পড়ে। নারীরা পর্দার আড়ালে গৃহবন্দি থাকবে, পুরুষরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করবে। সমাজ যদি নারীদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো তাহলে নারীর স্বাধীনতার কথাটিই সবার আগে ভাবতো।’
‘আপনি কিন্তু এখানে পরোক্ষভাবে পুরুষের অধিকারের পাল্লাটাই ভারী করে দিলেন। সমাজপতি যদি হয় পুরুষেরা, তাহলে নারীরা কেন পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে পুরুষের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রত্যাশা করবে? নারীরা কেন শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে না?’ জামান বলতে থাকে।
ফাহিম জামানের পক্ষ নিয়ে বলে, ‘নারীরা কোনোদিন শৃঙ্খল ভাঙতে পারবে না। শৃঙ্খল ভাঙতে পেশিশক্তির প্রয়োজন, যা নারীদের নেই। নারীরা প্রকৃতিগতভাবেই দুর্বলমতি এবং কাপুরুষোচিত এবং ভীরুও বটে।’
‘মানলাম না।’ নির্ঝর বলে।
‘সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, মানা আর না মানা। কিন্তু দিস ইজ দ্য রিয়েলিটি, ছেলেরাই মেয়েদেরকে ইভটিজিং করে থাকে, মেয়েরা ছেলেদেরকে নয়।’ জামান বলে।
‘দ্যটস দ্য পয়েন্ট।’ নির্ঝর বলতে থাকে, ‘পুরুষরা কতখানি বর্বরোচিত সেটা চিন্তা করুন। এই বর্বর পুরুষ-সমাজে নারীরা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে? কীভাবে?’
‘কিন্তু আমার প্রশ্নও এখানেই।’ জামান বলে, ‘স্বাধীনতা ভোগ করবার প্রশ্নটা আসছে কেন? কেন বলা হচ্ছে না যে, নারীরা পুরুষদেরকে স্বাধীনতা দিচ্ছে না? নারীদের কেউ হাত-পা বেঁধে রাখে নি। তারাও পুরুষের মতোই বন্ধনহীন। পুরুষরা কি কখনো বলেছে, আমরা নারীদের মতো সমান অধিকার চাই? অধিকার একটা অদৃশ্য ভাববাচক শব্দ মাত্র, যা কেউ কোনো প্রকোষ্ঠে আটকে রাখে নি। এটার ফল যে কেউ ইচ্ছেমতো ভোগ করতে পারে। এক বাটি দুধ চাওয়ার মতো কেউ যদি বলে আমাকে একটুখানি অধিকার দাও, তা নিতান্তই হাস্যকর শোনায়।’
‘সমাজ কিন্তু পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করছে...’ নির্ঝর কথা শেষ করবার আগেই জামান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমিও তো তাই বলছি। কিন্তু নারীরা কেন পুরুষের হাতে সেই নিয়ন্ত্রণের ভারটা তুলে দিল? নারীরা কি পারছে না সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতে?’
‘কীভাবে পারবে? ইভটিজিংয়ের কথা বলছিলেন...’ এবারও নির্ঝরের কথায় বাধা দিয়ে জামান বলে, ‘হ্যাঁ, ঐ কাজটা মেয়েরা করতে পারে না? মেয়েরা কেন দু-চারজন সুদর্শন যুবককে অপহরণ করে সপ্তাহ খানেক আটকে রাখে না?’
‘তা করতেই পারে মেয়েরা। কিন্তু আপনি চিন্তা করুন ঐ মেয়েগুলো তখন কোন মুখে সমাজে বের হবে?’
‘আসলে আপনারা কিন্তু ঐ এক জায়গা থেকেই বের হতে পারছেন না। এর উলটোটার কথা কেন না ভাবছেন যে, ঐ ছেলেগুলো তখন কীভাবে সমাজে মুখ দেখাবে? আপনারা নিজেরাই পুরুষের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে, ঠেলে দিয়ে ফিরে পাবার জন্য হা-হুতাশ করছেন।’ জামান এ কথা বলে থামলো।
নির্ঝর বোধ হয় গুছিয়ে উঠছিল কিছু একটা বলবে বলে। এই ফাঁকে আরফাজ খান মুখ খুললেন, ‘মেয়েরা অধিকার দিয়ে কী করবে আমি তো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। স্বামীর সংসারে তারা থকেবে। রান্না-বান্না ঘরকন্না তাদের কাজ। এখানে অধিকার-অধিকার করে গলা ফাটানোর সময় কোথায়?’
আরফাজ খানের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
আমজাদ খান নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘তোমাদের এই আলোচনা এখন আমার একদম পানসে মনে হচ্ছে। ধান ভানতে শীবের গীত। তোমরা মেয়ে দেখো।’
মেয়ের দুলাভাই বললেন, ‘মেয়ে সম্পর্কে আরো কিছু জানবার থাকলে বলুন।’ এমন সময় বাইরে থেকে একজন লোক এসে দুলাভাই মহোদয়ের কানে কানে কী যেন বলে গেলো। দুলাভাই ‘স্যরি’ বলে শুরু করলেন, ‘আমরা কি একটু ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতে পারি?’
‘তার আগে’, আরফাজ খান বলেন, ‘আরেকটা কাজ বাকি আছে। নির্ঝর, আপনি একটু হাঁটুন তো দেখি আমাদের সামনে।’
‘আমার শ্যালিকাটি কিন্তু ন্যাংড়া কিংবা খুঁড়া নয়’, দুলাভাই অতিথিদের উদ্দেশে কৌতুক করে বলেন। তারপর বললেন, ‘নির্ঝর, একটু হেঁটে দেখাও তো!’
নির্ঝর বিনা প্রতিবাদে উঠে ঘরময় একপাক হাঁটলো।
‘ইটস ওকে। ইটস ওকে।’ বলে আমজাদ খান নির্ঝরকে সোফায় বসতে বললেন।
‘একটু ক্যাটওয়াক করে দেখাবো?’ বসতে বসতে এ কথা বলে নির্ঝর ফিক করে হেসে ফেললো। পাত্রপক্ষ নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় লজ্জিত হয়ে মাথা নীচু করে নীরব থাকলেন।
‘ক্যাটওয়াক আমার দারুণ পছন্দ।’ আবহ স্বাভাবিক করার জন্য জামান উদ্যোগী হলো। সে হাসতে হাসতে বলতে থাকে, ‘একটা মেয়ের সবটুকু আর্ট তার ক্যাটওয়াকের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।’ মেয়েরা হাসতে থাকলে জামান কৌতুকের মাত্রা বাড়ানোর জন্য আরো যোগ করলো, ‘আসলে এটাকে ক্যাটওয়াক না বলে টাইগার-ওয়াক বললে শিল্পটায় একটু ভারী ভারী ভাব জাগে।'
‘আপনার কথাগুলো কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে।’ জামানের উদ্দেশে নির্ঝর বলে উঠলো, ‘আপনি খুব জলি-গুড-ফেলো। আপনার কথাগুলো সিরিয়াস, কিন্তু খুব সহজেই বলে ফেলেন। ‘প্রাঞ্জল’ আর কী!’
আমজাদ খান বলেন, ‘জামানের কিন্তু বড় একটা পরিচয় আছে।’ মেয়েপক্ষের চোখ বড় হতে থাকে। তিনি বলেন, ‘ও একজন প্রতিভাবান লেখক। ওর নাম শোনেন নি?’
এ বাড়ির মেহমানরা নড়েচড়ে বসেন। নির্ঝর জিজ্ঞাসা করে, ‘স্যরি, উনার নামটা শোনা হয় নি।’
‘কার লেখা বেশি পড়েন?’ জামান জিজ্ঞাসা করে।
‘স্পেসিফিক কেউ নেই।’ নির্ঝর জবাব দেয়, ‘সমরেশ মজুমদারের লেখা অবশ্য একটু বেশিই পড়ি।’
‘তাঁর অবশ্য দু বাংলা জুড়ে নামডাক। হালে তাঁর পাঠকসংখ্যাই সর্বাধিক বলে আমার ধারণা।’
‘আপনি সাতকাহন পড়েছেন?’
‘শুরু করেছিলাম। বিখ্যাত উপন্যাস। তবে আমি খুব কষ্ট করে ৮৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছিলাম।’
‘উহ্হু, এটা কিন্তু ঠিক করেন নি। পুরোটা পড়া আপনার উচিত ছিল।’ নির্ঝর বলে।
‘বইটি আমার কাছে আহামরি গোছের কিছু মনে হয় নি।’ জামান বললো।
নির্ঝর আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘বলেন কী! আপনার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। স্যরি। দুঃখিত। সাতকাহন একটা অসাধারণ উপন্যাস।’
জামান দৃঢ়তার সাথে বলে, ‘তা মানছি। গল্প অসাধারণ হলেই উপন্যাসটা যে অসাধারণ হবে তা কিন্তু নয়। একটা অতি সাধারণ গল্প লেখকের বর্ণনায় উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠতে পারে। আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, সমরেশ বাবুর গল্প বলার ঢংটা আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। তাঁর সংলাপগুলো মনে হয় আর্টিফিশিয়াল। হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনা এবং সংলাপগুলো যেমন বুকের ভেতরে গিয়ে গেঁথে যায়, তাঁর বেলায় তা হয় না, বড্ড নীরস মনে হয়। অবশ্য, এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত।’
‘আমিও জামানের সাথে একমত হতে পারলাম না। আই এ্যাম স্যরি মাই ফ্রেন্ড।’ ফাহিম মুখ খুললো।
শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলে না গিয়ে তাঁদের হলো না। খেতে খেতে আবারও শুরু হলো জম্পেশ গল্প।
এই ‘এন্ডলেস’ আড্ডা বহুরাত অব্দি চলেছিল। কনে-দেখার মতো একটা গম্ভীর আবহে ম্যারিজ সেটেলমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার চেয়ে বহির্বিধ বিষয়াদিতে তাদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। কন্যাপক্ষীয় মাতুল বা ভগ্নিপতিগণ কিছুটা বিরক্তবোধ করছিলেন বৈকি, কিন্তু মেয়েদের কাছে এসব বাস্তবিকই বিপুল রসময় ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।
জামান আর ফাহিম রমণীযুগলের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠেছিল। কৌতুকরঙ্গ থেকে শুরু করে গান, সাহিত্য, খেলাধুলা, কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স, ইত্যাদি সব বিষয়ে তাদের তুখোড় মিল হলো।
জামান এককালে কবিতা লিখতো, তার অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে জেনে নির্ঝরের মুখ ভীষণ উজ্জ্বল হয়েছিল। সে জানিয়েছিল, কবিতা আবৃত্তিতে ভার্সিটি জুড়ে তার খ্যাতি রয়েছে। সে হিন্দি সিরিয়াল, কিংবা স্টার জলসা দেখে না। তবে, স্টার মুভিজ, এইচবিও চ্যানেল তার ফেভারিট এবং সিনেপ্লেক্সে সে নিয়মিত ছবি দেখে। সর্বশেষ ‘ফ্রোজেন’ আর ‘স্কাইফল’ দেখেছে শুনে জামান প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল; কারণ, সেও এসব ছবি দেখেছে।
ফাহিম একটা গান গেয়েছিল। ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে...’
এভাবে অনেক সময় ধরে মজা করতে করতে তারা ভুলে গিয়েছিল যে, তারা এ বাসায় পাত্রী নির্বাচনের উদ্দেশ্যে এসেছিল।
আড্ডা শেষ হবার খানিক আগে প্রয়োজনীয় কথাটা পাড়া হলো। মেয়ের আন্টি মুখ খুললো, ‘বললেন না যে, পাত্রী পছন্দ হলো কিনা?’
কথা শেষ হবার আগেই আমজাদ খান ‘মাশা’ল্লাহ, মাশা’ল্লাহ’ বলে আওয়াজ তুলে বললেন, ‘পাত্রী আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আন্টিও হাসিমুখে জানালো, ‘আমাদেরও মাশা’ল্লাহ পাত্র খুব পছন্দ হয়েছে।’
ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো। হাতে মাত্র সপ্তাহ খানেকের মতো সময় আছে। এর মধ্যেই সমুদয় প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। তবে জামান একটা কার্যকরী পরামর্শ দিয়ে বললো, ‘এতো দেরি করে লাভ কী? কালই বিয়ে পড়ালে কোনো ক্ষতি দেখি না।’
পরদিন খুব অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফাহিমের বিয়ে পড়ানো হলো।
সেবার একুশে বইমেলায় জামানের গোটা তিনেক নভেল বের হয়েছিল। সে প্রায় দিনরাত বইমেলায় পড়ে থাকে। বটতলায় আড্ডা দেয়, পাবলিশারের বুকস্টলে বসে ‘অটোগ্রাফ’ দেয়। আর মাঝে মাঝেই ফাহিম ওর বউকে নিয়ে বাইক চালিয়ে ঝড়ের বেগে বইমেলায় এসে হানা দেয়। একজোড়া কপোত-কপোতীর মতো, দেখলেই মনে হয় সদ্য প্রেমে পড়েছে, হাবুডুবু খেতে খেতে গভীর জলে ডুবে যাবে যে-কোনো মুহূর্তে। জামান ওর নিজের লেখা নভেল, অন্য লেখকের বই কিনে ওদের গিফ্ট করে। বই পেয়ে নির্ঝরের আনন্দ আকাশ ছুঁয়ে যায়।
বইমেলা শেষ হলে জামান ঢাকার বাইরে চলে গেলো বহুদিনের জন্য। ফাহিমের সাথেও আর কোনো যোগাযোগ থাকলো না। এভাবে কতদিন বা কত বছর চলে গেলো জামান বা ফাহিম কেউই তার হিসাব রাখে নি।
ফুটনোট
প্রায় ৮ বছর পর দৈবক্রমে ঢাকার এক রাজপথে নির্ঝরের সাথে জামানের দেখা হয়ে গেলো।
রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে তারা বসলো। চা-নাস্তা খেতে খেতে তাদের কথা হচ্ছিল। জামানের কিছুই জানা ছিল না- কথা বলার মাঝ পর্যায়ে এসে নির্ঝর সেই অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক ঘটনাটা জানালো। অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনার জের ধরে মাত্র এক বছরের মাথায় তাদের বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। ফাহিম এক যাযাবার পাখি। পৃথিবীর কত দেশ কত নারী তার। নির্ঝরকে তার বেশিদিন ভালো লাগে নি, নির্ঝরেরও যায় নি ওর সাথে। তবে একটা গভীর দুঃখ বোধহয় ওর মনে চিরদিনই কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে।
জামান যারপরনাই ব্যথিত হলো। এই আকস্মিক সাক্ষাৎকার পর্বটি এক বেদনাঘন নীরবতায় ছেয়ে যেতে থাকলো। তারপর টুকিটাকি আরও কিছু কথা সেরে বিদায় নেবার জন্য উঠে দাঁড়ালো জামান। নির্ঝর ইতস্তত করে কী যেন বলতে চাইল। জামান জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকায়। মাথা নীচু করে চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো নির্ঝর। তারপর নরম স্বরে বললো, ‘কিছু মনে করবেন না ভাইয়া, আর কোনোদিন হয়তো আমাদের দেখা হবে না। একটা কথা বলি আপনাকে।’ জামান উদগ্রীব হলো। নির্ঝর মনে মনে কথাটা গুছিয়ে নিল। তারপর বলেই ফেললো, ‘প্রথম দিনের কথাগুলো কি আপনার মনে আছে, ভাইয়া, যেদিন আপনারা আমাকে দেখতে এসেছিলেন? আমাদের কত কথা হলো। কত হাসিঠাট্টা। তাই না?’ বলতে বলতে তার গলা খানিকটা ধরে আসে। ‘...পাত্র নির্বাচনে আমার একটুখানি ভুল হয়েছিল... অনেক দাম দিয়ে আমাকে সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে।’
জামান তার কথা ধরতে পারে না। নির্ঝর বললো, ‘বর সেজে যে আমাদের বাসায় এসেছিল, তাকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। যার সাথে আমাকে সংসার বাঁধতে হবে, আমি তাকে চিনতে পারি নি।’
তারপর তার চোখমুখ বিষাদগ্রস্ত রহস্যের অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। মাথা অবনত করে সে যখন যেতে থাকলো, তখন দুপুরের নির্মল আকাশে গনগনে সূর্য, বৃক্ষবীথির পত্রপল্লবে নরম বাতাসের আছড়ে পড়ার শো-শো শব্দ, রাস্তার পিচগলা তীব্র ভাঁপ এসে শরীরে বিঁধছিল।
আর জামানের বুকটা তখন হু-হু করছিল।
২৬ মে ২০০৫