somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পকণিকা - কালের চিহ্ন

০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লোকটা আয়নার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো।

যৌবন প্রাপ্তির পর একদা সে ঘর-সংসার, দারাপুত্রপরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসব্রতে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে চলতে পথের প্রান্তে এক পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে থেমেছিল। তখন আকাশে গনগনে রৌদ্র। নিভৃত গুহায় ক্লান্তি নিবারণে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এভাবে সে কত যুগ, কত শত বছর ঘুমিয়ে ছিল, সে জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো, শরীরের লোম ও মাথার চুল অতিশয় দীর্ঘ, গায়ের চামড়া বিকট ও খসখসে বাকলের মতো দেখতে পেলো। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সূর্য নেমে গেছে। সে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির ঠিকানায় ছুটতে থাকলো।

চলতে চলতে, চলতে চলতে আড়িয়াল বিলের পূর্ব তীরে এসে সে দাঁড়ায়। উদাস চোখে পশ্চিমে তাকিয়ে তার নিজ গ্রাম, জন্মভূমি সুবর্ণছায়াকে খুঁজতে থাকে।

‘কোথায় আমার সুবর্ণছায়া?’
সেই কুঁড়েঘর নেই, তাঁজা খাল মরে গেছে, আড়িয়াল বিলের ভরন্ত বুকে শুকনো চর জেগে উঠেছে। সারি সারি দালানকোঠার নীচে বৃক্ষলতারা হারিয়ে গেছে।

সে দৌড়ে চলে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলে।
‘এই কি সুবর্ণছায়া? এই কি আমার প্রিয় জন্মভূমি সুবর্ণছায়া?’ যাকেই সামনে পায়, ছুটে গিয়ে এ কথা শুধায়। গ্রামের মানুষ এই উদ্ভট, জঙ্গলময় পথিকের প্রশ্ন বুঝতে পারে না।
‘আমার গ্রাম। আমার জন্মভূমি। জন্মের পর আমি পাক্কা ৩০টি বছর এ গ্রামে কাটিয়েছিলাম। এই কি সুবর্ণছায়া নয়?’ কেউ তার ভাষা বোঝে না, ইশারার মানে বুঝতে পারে না। মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, সে কেবল অজানা এক ভাষায় কী যেন অনর্গল বলে চলে। কেউ কেউ হাসে- আজব মানুষটা কোথা থেকে এলো?
গ্রামের পর গ্রাম সে ছুটে চলে। কে তার গ্রামের সন্ধান জানে? কে তার ভাষা বোঝে? কেউ না। সে তার নিজের নাম মনে করতে চেষ্টা করে। না, মনে নেই। পুত্রকন্যা, জায়া-জননীর নাম মনে করতে চেষ্টা করে। স্মৃতি থেকে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। যতদূর পারা যায়, নিবিষ্ট মনে স্মৃতি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ সে পুলকিত হয়ে ওঠে। এই তো পেয়েছি- শেখ আব্বাস আলী। শেখ আব্বাস আলী জমিদার। অতি কষ্টে দাদার নামটি তার মনে পড়ে যায়। সুবর্ণছায়ার দাপুটে জমিদার ছিলেন। গ্রামের নামটা কীভাবে যেন তার স্মৃতিতে আটকে ছিল। গ্রামের খোঁজে, দাদার খোঁজে সে হন্যে হয়ে ছোটে।
‘আব্বাস জমিদারকে তোমরা চিনো না? আমি তাঁর নাতি। আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে চলো।’
আব্বাস জমিদারের নাম এ গাঁয়ের মানুষ কোনোদিনই শোনে নি। সে তন্ন তন্ন করে সুবর্ণছায়াকে খুঁজতে থাকে, আর খুঁজতে থাকে তার পূর্বপুরুষ আব্বাস জমিদারের বংশলতিকা। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সবকিছু।

বিরান চকের মাঝখানে অনেক বছরের পুরোনো একটা বটবৃক্ষের তলায় গিয়ে সে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। তার বুকভরা তৃষ্ণা। ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সামনে একটা কুয়ো দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। উপুড় হয়ে টলটলে পানিতে আঁজলা ফেলতেই সে চিৎকার দিয়ে ওঠে- পানির ভিতরে আয়না, আর সেই আয়নার ভিতরে যার ছবি ভেসে উঠলো সে এক অচেনা মানুষ- তাকে সে চিনে না, কস্মিনকালেও দেখে নি।
‘পাগল!’ গম্ভীর কণ্ঠে বটবৃক্ষ বলে ওঠে। পাগল চমকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজে।
‘তোর সুবর্ণছায়া ডুবে গেছে। আজ থেকে ১৪শ বছর আগে, পদ্মার গহিনে। তার সাক্ষ্য নিয়ে আজও আমি বেঁচে আছি।’
পাগল হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এই সেদিন সুবর্ণছায়ার পথে পথে সে ঘুরে বেড়িয়েছে, খালে-ডোবায় সাঁতার কেটেছে। তারপর পাহাড়ের গুহায় কিছুদিন নিদ্রায় কাটিয়েছিল। এরই মধ্যে ১৪শ বছর কেটে গেলো!
হায় জীবন, হায় বয়স, হায় মহাকাল- তোমার গর্ভে ডুবে গেলো উজ্জ্বল সুবর্ণছায়া, আর তার আব্বাস জমিদার!
নরম নরম পাতা ফেলে ১৪শ বছরের অশীতিপর বটগাছ পাগলের শরীরে পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে। পাগল ঘুমিয়ে পড়ে বয়সের ভারে, মহাকালে যার কোনো সঞ্চয় কিংবা চিহ্ন থাকে না।

৭ আগস্ট ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১০:০৭
৩৯টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×