লোকটা আয়নার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো।
যৌবন প্রাপ্তির পর একদা সে ঘর-সংসার, দারাপুত্রপরিবার ছেড়ে সন্ন্যাসব্রতে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে চলতে পথের প্রান্তে এক পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে থেমেছিল। তখন আকাশে গনগনে রৌদ্র। নিভৃত গুহায় ক্লান্তি নিবারণে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
এভাবে সে কত যুগ, কত শত বছর ঘুমিয়ে ছিল, সে জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো, শরীরের লোম ও মাথার চুল অতিশয় দীর্ঘ, গায়ের চামড়া বিকট ও খসখসে বাকলের মতো দেখতে পেলো। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সূর্য নেমে গেছে। সে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির ঠিকানায় ছুটতে থাকলো।
চলতে চলতে, চলতে চলতে আড়িয়াল বিলের পূর্ব তীরে এসে সে দাঁড়ায়। উদাস চোখে পশ্চিমে তাকিয়ে তার নিজ গ্রাম, জন্মভূমি সুবর্ণছায়াকে খুঁজতে থাকে।
‘কোথায় আমার সুবর্ণছায়া?’
সেই কুঁড়েঘর নেই, তাঁজা খাল মরে গেছে, আড়িয়াল বিলের ভরন্ত বুকে শুকনো চর জেগে উঠেছে। সারি সারি দালানকোঠার নীচে বৃক্ষলতারা হারিয়ে গেছে।
সে দৌড়ে চলে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলে।
‘এই কি সুবর্ণছায়া? এই কি আমার প্রিয় জন্মভূমি সুবর্ণছায়া?’ যাকেই সামনে পায়, ছুটে গিয়ে এ কথা শুধায়। গ্রামের মানুষ এই উদ্ভট, জঙ্গলময় পথিকের প্রশ্ন বুঝতে পারে না।
‘আমার গ্রাম। আমার জন্মভূমি। জন্মের পর আমি পাক্কা ৩০টি বছর এ গ্রামে কাটিয়েছিলাম। এই কি সুবর্ণছায়া নয়?’ কেউ তার ভাষা বোঝে না, ইশারার মানে বুঝতে পারে না। মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, সে কেবল অজানা এক ভাষায় কী যেন অনর্গল বলে চলে। কেউ কেউ হাসে- আজব মানুষটা কোথা থেকে এলো?
গ্রামের পর গ্রাম সে ছুটে চলে। কে তার গ্রামের সন্ধান জানে? কে তার ভাষা বোঝে? কেউ না। সে তার নিজের নাম মনে করতে চেষ্টা করে। না, মনে নেই। পুত্রকন্যা, জায়া-জননীর নাম মনে করতে চেষ্টা করে। স্মৃতি থেকে সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। যতদূর পারা যায়, নিবিষ্ট মনে স্মৃতি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ সে পুলকিত হয়ে ওঠে। এই তো পেয়েছি- শেখ আব্বাস আলী। শেখ আব্বাস আলী জমিদার। অতি কষ্টে দাদার নামটি তার মনে পড়ে যায়। সুবর্ণছায়ার দাপুটে জমিদার ছিলেন। গ্রামের নামটা কীভাবে যেন তার স্মৃতিতে আটকে ছিল। গ্রামের খোঁজে, দাদার খোঁজে সে হন্যে হয়ে ছোটে।
‘আব্বাস জমিদারকে তোমরা চিনো না? আমি তাঁর নাতি। আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে চলো।’
আব্বাস জমিদারের নাম এ গাঁয়ের মানুষ কোনোদিনই শোনে নি। সে তন্ন তন্ন করে সুবর্ণছায়াকে খুঁজতে থাকে, আর খুঁজতে থাকে তার পূর্বপুরুষ আব্বাস জমিদারের বংশলতিকা। কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সবকিছু।
বিরান চকের মাঝখানে অনেক বছরের পুরোনো একটা বটবৃক্ষের তলায় গিয়ে সে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। তার বুকভরা তৃষ্ণা। ছাতি ফেটে যাচ্ছে। সামনে একটা কুয়ো দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। উপুড় হয়ে টলটলে পানিতে আঁজলা ফেলতেই সে চিৎকার দিয়ে ওঠে- পানির ভিতরে আয়না, আর সেই আয়নার ভিতরে যার ছবি ভেসে উঠলো সে এক অচেনা মানুষ- তাকে সে চিনে না, কস্মিনকালেও দেখে নি।
‘পাগল!’ গম্ভীর কণ্ঠে বটবৃক্ষ বলে ওঠে। পাগল চমকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজে।
‘তোর সুবর্ণছায়া ডুবে গেছে। আজ থেকে ১৪শ বছর আগে, পদ্মার গহিনে। তার সাক্ষ্য নিয়ে আজও আমি বেঁচে আছি।’
পাগল হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এই সেদিন সুবর্ণছায়ার পথে পথে সে ঘুরে বেড়িয়েছে, খালে-ডোবায় সাঁতার কেটেছে। তারপর পাহাড়ের গুহায় কিছুদিন নিদ্রায় কাটিয়েছিল। এরই মধ্যে ১৪শ বছর কেটে গেলো!
হায় জীবন, হায় বয়স, হায় মহাকাল- তোমার গর্ভে ডুবে গেলো উজ্জ্বল সুবর্ণছায়া, আর তার আব্বাস জমিদার!
নরম নরম পাতা ফেলে ১৪শ বছরের অশীতিপর বটগাছ পাগলের শরীরে পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে। পাগল ঘুমিয়ে পড়ে বয়সের ভারে, মহাকালে যার কোনো সঞ্চয় কিংবা চিহ্ন থাকে না।
৭ আগস্ট ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১০:০৭