লেখকের পরশ্রীকাতরতা
১
একবার এক প্রখ্যাত লেখক একজন সাধারণ ব্লগারের গল্পে কোনোরকমে চোখ বুলিয়েই উপহাস করে কমেন্ট লিখলেন - ‘অতিশয় ভালো হয়েছে।’
অনেকদিন পর সেই প্রখ্যাত লেখক কী কারণে যেন ঐ গল্পটি আবার পড়লেন। পড়া শেষে নিজের অজান্তে তাঁর মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে পড়লো - ‘অসাধারণ।’
২
ব্লগে এক সাধারণ মানের কবি অন্য কবিদের কবিতা পড়ে বললেন, ‘অখাদ্য কবিতায় আজকাল ব্লগ ভরে গেছে।’
আমব্লগারদের বিচারে তিনি খুব বাচাল প্রকৃতির লোক; যে-কোনো আসরে একবার মাইক্রোফোন হাতে পেলে মানুষের যন্ত্রণার শেষ থাকে না— তাঁর বকরবকর বকবকানি আর স্বরচিত কবিতা পাঠে শ্রোতাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তিনি যত্রতত্র নিজের নাম ফুটাতে ভালোবাসেন এবং নিজেকে তিনি একজন ‘অসামান্য’ কবি মনে করেন। তাঁর মতে ব্লগের অপরাপর কবিরা ‘ছোটো কবি’ এবং সবাইকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে তা বুঝিয়ে দিতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না।
শহরের বড় বড় কবিদের সাথে নানা কারণে তাঁর ওঠাবসা ছিল। তিনি একদিন এক নামজাদা কবিকে তাঁর বিশাল কাব্যভাণ্ডার দেখাতে নিয়ে গেলেন। গর্বে তাঁর বুক ফুলে-ফেঁপে উঠছে— তাঁর কবিতাগুলো দেখে কবি নিশ্চয়ই পিঠ চাপড়ে বলবেন, ‘বাব্বাহ, তুই তো দেখি আমাকেও ছাড়িয়ে গেছিস!’
কবি পাণ্ডুলিপি খুলে দরদ দিয়ে অনেকগুলো কবিতা পড়লেন, তারপর এই কবিযশোপ্রার্থী নবীন কবিকে বেশ কিছু মূল্যবান পরামর্শ দিলেন।
তিন-চার বছর নিরলস সাধনার পর এই কবি এখন বেশ ভালো মানের কবিতা লিখছেন। ব্লগারগণ তাঁর কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হোন।
তবে আশ্চর্যের বিষয়টি কী তা জানেন? একদিন যেসব কবিতাকে তিনি ‘অখাদ্য’ বলেছিলেন, এখন মাঝে মাঝে তাঁর দু-একটা কবিতা সেই মানে পৌঁছায়, বাকিগুলো পৌঁছায় না।
৯ আগস্ট ২০১৪
শ্রেষ্ঠ কবিতা
একটি বিশেষ সংখ্যার জন্য সম্পাদকের বিশেষ অনুরোধে দেশের প্রধানতম কবির কাছ থেকে একটা কবিতা এলো। খাম থেকে কবিতাটি বের করে তিনি পড়তে শুরু করলেন।
অনন্ত মুখর নদী
কৃষ্ণভ্রমরের বুকে কাঁদে মুমূর্ষু শাবক
ঘড়িতে ঝুলছে দূরের অন্ধকার
হেঁটে যায় শালবনবীথি
পাতালের দিনরাত্রি, বিনম্র অজগর কাঁপে
উড়ন্ত মৈথুনে প্রদীপ ও প্রজাপতি
অরণ্যের ছায়ামেঘ গিলে খায় মৌনবতী চাঁদ
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে পশ্চিমের ‘পাখি’
রাতের নটিনীরা কাঁদতে ভুলে যায়
অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় কবিতা। সম্পাদক অভিভূত হলেন। এতো বাঙ্ময়, সমৃদ্ধ কবিতা তিনি খুব কমই পড়েছেন। কত ছোট্ট এ কবিতাটি- ছোটো ছোটো বাক্য, সহজ-সরল শব্দ। অথচ কী গভীর তত্ত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছেন মামুলি কয়েকটা শব্দের গাঁথুনিতে। বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু। তিনি নিজে একজন কবি। কবিতায় তাঁর একটা সুদৃঢ় অবস্থান রয়েছে এ দেশে। কিন্তু আজও তিনি এ বড় কবির মতো একটা কবিতাও লিখতে পারেন নি। এ নিয়ে তাঁর মনে প্রচুর আক্ষেপ।
সম্পাদকের কক্ষে কয়েকজন সাব-এডিটর ঢুকলেন। তিনি প্রত্যেককে কবিতাটি পাঠ করে এর অন্তর্নিহিত ভাব ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। ব্যাখ্যা শুনে উপবিষ্ট সাব-এডিটরগণ চমৎকৃত হলেন। সবশেষে সম্পাদক মন্তব্য করলেন, আসলে এসব কবিতা ব্যাখ্যার অতীত। আবার সবাই এসব কবিতার মর্মার্থ অনুধাবনে সমর্থ নন। তিনি নিজেও যে কবিতাটি পুরোপুরি বুঝেছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। কারণ, এ কবির কবিতা বুঝবার জন্য রীতিমত গবেষণাগারে বসতে হয়।
সাব-এডিটরগণ চলে যাবার পর সম্পাদক মহোদয় আরো কয়েকবার কবিতাটি পড়ে এর গভীরতম রস আহরণে নিমগ্ন হলেন। তারপর চশমা ঠিক করে কবিতার শিরোনামটি দেখে নিলেন। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা।’ গোটা পৃথিবীটাই হলো একটা কবিতা। মানব-জীবন, বিশ্ব প্রকৃতি, এসব হলো এ কবিতার অনুষঙ্গ। একটা শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য যেসব অনুষঙ্গ অপরিহার্য, কবি নিপুণ শিল্পীর মতো এ কবিতায় তা বিধৃত করেছেন। সম্পাদক ভাবতে থাকলেন।
যথাসময়ে সুদৃশ্য মোড়কে মোড়ানো বিশেষ সংখ্যার সৌজন্য কপিটি কবির হাতে এসে পৌঁছলো। মোড়ক খুলে একঝলক সারা পত্রিকার গায়ে নজর বুলিয়ে নেন কবি। সম্পাদকের স্কিল অসামান্য। পত্রিকার গেট-আপ, মেক-আপ চমৎকার। তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন।
সূচিপত্রে নিজের কবিতা খুঁজতে গিয়ে কবির চোখ কপালে উঠে গেলো। তিনি দ্রুত পৃষ্ঠা উলটে কবিতাটি বের করেন।
হ্যাঁ, সূচিপত্র দেখে তিনি যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই ঘটেছে। গত কিছুদিন ধরেই তিনি কাগজটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পত্রিকার জন্য লেখা কবিতাটি যায় নি। একটা কাগজে তিনি ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র তালিকা করছিলেন, ভুলবশত সেটিই খামে ঢুকিয়ে সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
নিজের নির্বুদ্ধিতা আর আহাম্মকিতে বিস্মিত হয়ে একদৃষ্টিতে কবি ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র দিকে তাকিয়ে রইলেন।
১০ আগস্ট ২০১৪