somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রেম

১০ ই অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উৎসর্গ:

আমি যখন মেয়েটির প্রেমে পড়লাম, তখন সে আমাকে এ কাহিনি শুনিয়েছিল। আমি তাকে পেয়েছি কিনা জানি না। কিন্তু তার প্রতি আমার প্রেম চির জাগরুক, প্রথম দিনের চেয়েও অনেক তীব্র।

***

আমার প্রেমিকার কথা

***

আমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছিলাম?

প্রেমের সংজ্ঞা আমি আজও বুঝি না। শুধু বুঝি, প্রেম মানুষকে অস্বাভাবিক অস্থিরতায় ডুবিয়ে রাখে। বুকের ভিতরে সৃষ্টি করে সর্বধ্বংসী দাবদাহ, হদৎপিণ্ড রক্তাক্ত করে, ফালি ফালি করে ছিঁড়ে ফেলে। পাঁজরের হাড়ে হাড়ে অতিশয় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা জড়িয়ে থাকে সারাক্ষণ। প্রেম দুঃসহ বেদনা দেয়।
যেদিন সর্বপ্রথম আমার ভিতরে এরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেদিনও, আজকের মতোই, আমি বুঝি নি এর নাম প্রেম, অথবা অন্য কিছু।
প্রেম। মায়া। ভালোবাসা। ঈর্ষা। অন্তর্দহন। হয়তো সবগুলোর মিলিত অনুভূতিই সেদিন আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল।
অকস্মাৎ যেদিন আমার মধ্যে এ অনুভূতির উন্মেষ ঘটেছিল, আমি বেশ আশ্চর্যও হয়েছিলাম এর অনুসর্গসমূহের দুর্বোধ্যতার জন্য। এই ভেবে আমি ক্রমশ অস্থির বোধ করছিলাম - আমার কী হয়েছে? একাদশ কিংবা দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকার জীবনে যদি প্রেম বলে কোনো কিছু এসে থাকে, তাহলে বোধ হয় সেটিই ছিল সর্বপ্রথম ভালোলাগার প্রেম, ঈর্ষার প্রেম কিবা প্রেমের ঈর্ষা। এবং আরো বলে রাখি, সেদিনই সহসা শুধু মনের দিকে নয়, আপন শরীরের দিকেও দৃষ্টি ফেলে দেখি, আমি সত্যিই আর খুকিটি নই, কারণে-অকারণে লম্ফ-ঝম্ফ যোগে যে-মেয়ে দৌড়ে ছুটতে পারে।
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। তুখোড় মেধাবী ছাত্রী বলতে যা বোঝায় আমি তা ছিলাম না সত্যি, কিন্তু ক্লাসের দেড়-দুইশ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পরীক্ষায় বরাবরই প্রবল প্রতাপে প্রথম স্থান ধরে রাখায় একজন মেধাবী ছাত্রীর যতটুকু খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে, আমার খ্যাতি জুটেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি। কারণটা আমি তখনো বুঝি নি।
মেধাবী ছাত্রী হওয়ার সুবাদেই হয়তো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আদর আমি একটু বেশিই পেয়েছিলাম। এই ‘আদর’ মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে কপালে কিংবা আরেকটু ছোটো বয়সে গালে-ওষ্ঠে চুমো খাওয়া পর্যন্তও হয়ে থাকতো।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে তরুণ বয়সের যে শিক্ষক স্কুলে নতুন এসে যোগদান করলেন তাঁর নাম সফিক স্যার। সফিক স্যারকে আমার দাদিমার রূপকথার রাজপুত্রের মতো মনে হলো। স্যার যখন ক্লাসে পড়াতেন তখন আমি একধ্যানে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আমার কর্ণকুহরে পাঠ্যবইয়ের একটি শব্দও ঢুকতো না। আমি তাঁর কথার মধ্যে ডুবে যেতাম। মনে হতো, স্যারের একটি পঙ্খিরাজ ঘোড়া আছে। তিনি ঘোড়ার পিঠে লাগাম টেনে বসে আছেন, আর তাঁর সামনে আমি বাহুবদ্ধ হয়ে আনন্দোত্তেজনায় চেপে বসে আছি। রাজপুত্র! রাজপুত্রেরা কী করে এতো চৌকষ হয়? রাজপুত্রের পঙ্খিরাজে চড়ে তাঁর সঙ্গে আমি কত্ত আকাশ উড়ে বেড়াতাম, পাহাড়-সাগর-নদ-নদী পেরিয়ে, কত্ত দূরে চলে যেতাম!
‘কী হয়েছে তোমার, মোহনা?’ একদিন ক্লাসে তন্ময় হয়ে স্যারের কথা যখন শুনছিলাম, ঠিক তখনই আমার কাছে এগিয়ে এসে নরম করে মাথায় হাত রেখে স্যার আমাকে খুব বাৎসল্যের স্বরে এ কথাটি জিজ্ঞাসা করেন। আমার ধ্যানভঙ্গ হয়। হতচকিতভাবে দাঁড়াতে উদ্যত হতেই আমার মাথায় মৃদু চাপ দিয়ে বলেন, ‘বসো। কী হয়েছে তোমার, মা?’
আমি লজ্জাবনত হয়ে বসি। কিন্তু আমার মন খুব খারাপ হয়। স্যার আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। তা না হলে আমার নামটা তিনি কী করে ভুল করলেন? আমার নাম কি মোহনা? কেন স্যার আমাকে ভুল নামে ডেকে এতোখানি কষ্ট দিলেন? আমার খুব খারাপ লাগতে থাকে। খুব খারাপ লাগতে থাকে। খুব। কিন্তু তবুও স্যারের প্রতি আমার ভালোলাগার বোধ তীব্র হতে থাকে। আমি স্যারের বর্তমানে-অবর্তমানে তাঁকে কেবল পঙ্খিরাজের চৌকষ সওয়ারি ভাবতে থাকি, যাঁর সঙ্গে আমিও থাকি।
আরেকদিন। স্যার পড়াচ্ছেন। আমি কত্তসব ভাবছি মনে মনে। সামনে কী হচ্ছে, কে আছে, আমি কোথায় আছি, তা আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখতে পাচ্ছি আমি এক রাজপুত্রের সঙ্গে পঙ্খিরাজে চড়ে মেঘমালার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, স্বপ্নের মতো উড়ে যাচ্ছি অজানা-অচেনা পরীর রাজ্যে। কত রহস্য সেই রাজ্যে, রাজপুত্র আজ সে-সব রহস্যের দ্বার খুলে জীবনের অনির্বচনীয় সুখ উপহার দিবেন।
আচমকা কে যেন আমার ভিতর থেকে নিগূঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘স্যার, আপনি এতো ভালো কেন?’
‘মোহনা, মা মোহনা, ওঠো, ক্লাসে ঘুমোতে নেই। ওঠো।’
আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখি স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে মৃদু ঝাঁকুনিতে ডাকছেন। আমার মনে পড়ে, স্যারের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বেঞ্চির ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আমি উঠে দাঁড়াই।
‘স্যার!’
‘বেশি রাত জেগো না, কেমন?’ স্যার তাঁর জায়গায় চলে যান।
‘স্যার।’ আমি ডাকি।
স্যার ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকান। বলেন, ‘কিছু বলবে?’
‘স্যার, আপনি আমাকে আর মোহনা বলে ডাকবেন না প্লিজ। আমার নাম মোহনা না?’
স্যারের মুখখানা মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। পরে বুঝেছি, আমার কথায় স্যার এতোখানি আহত না হলেও পারতেন।

একবার জ্বরের জন্য আমার তিনদিন স্কুল কামাই হয়। স্কুলে গিয়ে শুনি হঠাৎ করেই সফিক স্যার বদলি হয়ে স্কুল থেকে চলে গেছেন। সেদিন আমার কতখানি খারাপ লেগেছিল তা কোনোদিন কাউকে বোঝাতে পারি নি। ক্লাসে আমার মন বসতো না। সফিক স্যারের ক্লাসটা অন্য স্যার পড়াতেন, আমার বুকটা তখন স্যারের জন্য হুহু করতো। আমি খেতে পারতাম না। কী একটা শূন্যতা, কী একটা হাহাকার, সারাক্ষণ আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণা দিত। আমার চোখে সব সময় অশ্রু টলমল করতো। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিতে আমার বুক ভেঙে যেতো। আমার প্রচণ্ড কান্না পেতো। চারদিকে তাকিয়ে আমি সফিক স্যারকে খুঁজতাম।
একদিন গভীর রাতে কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙবার পরও আমি আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না। কান্নার শব্দ পেয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে আব্বু ঘরে ঢোকেন। আলো জ্বেলে দেন। আমি আব্বুর উপস্থিতি টের পেয়ে বালিশে মুখ গুঁজে আরো গুমড়ে কাঁদতে থাকি। আব্বু বাহুতে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ও মা অহনা, ভয় পেয়েছো? ভয় পেয়েছো? ওঠো তো দেখি কী হয়েছে?’
আমার ডুকরে কান্না কিছুটা কমে। আমি উপুড় হয়ে মাথা গুঁজে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আব্বু আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘ স্বপ্নে কিছু দেখেছো?’
বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।
‘কী দেখেছো?’
‘আব্বু, আমি ঘুমালেই শুধু সফিক স্যারকে স্বপ্নে দেখি।’ বলে আমি অনবরত কাঁদতে থাকি। আব্বু কিছু না ভেবেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী দেখো?’
‘দেখি কী, সফিক স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন, কিন্তু আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না।’
‘ধূর পাগলি।’ আব্বু হেসে দেন। ‘তোমার সফিক স্যার কি অমন যে তোমার দিকে তাকাবেন না? ওটা স্বপ্ন। স্বপ্ন স্বপ্নই। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীর দিকে সব স্যারেরাই তাকাবেন।’ আব্বু কী ভেবে এই কথা বলেছিলেন তার সরল অর্থ থাকলেও অন্যরকম অর্থও যে থাকতে পারে তা তখন বুঝি নি।
একদিন টিফিন পিরিয়ডে, যখন সবাই ক্লাসের বাইরে চলে গিয়ে ছুটোছুটি, হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে, যে যার মতো টিফিন খেতে ব্যস্ত, আমি তখন ভীষণ মনখারাপ করে চুপটি মেরে বেঞ্চিতে বসে আছি ক্লাসে।
‘অহনা না?’
আমি মাথা তুলে ঝাপসা চোখে সামনের দিকে তাকাই।
‘কী আশ্চর্য! শরীর খারাপ?’
আমি মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠি আনন্দে। আমার সফিক স্যার, প্রাণপ্রিয় সফিক স্যার তাহলে ফিরে এসেছেন? কবে এলেন ফিরে? আমি দেখি নি কেন? কেউ আমাকে বলে নি কেন যে, সফিক স্যার ফিরে এসেছেন, তাঁর এক পাগলি ছাত্রীর মায়ার টানে ফিরে এসেছেন?
স্যার একেবারে সামনে এগিয়ে আসেন। হাইবেঞ্চির উপর দু হাতে ভর করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে স্যার বলেন, ‘কী হয়েছে, শরীর খারাপ?’
আমি তন্ময় হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি, এতো আহ্লাদিতভাবে, ঘাড়খানি ঈষৎ কাত করে তাঁর চোখের উপর চোখ রেখে তাকিয়ে আছি, সৌজন্যবশত উঠে দাঁড়াতে হয়, আমি তাও ভুলে গেছি।
‘কাঁদছো কেন, অহনা? বাসায় যাবে? নাকি সত্যি তোমার অসুখ করেছে?’ বলে সফিক স্যার আমার কপালে হাত রাখেন।
আমার বিলকুল ভুল হয়ে গেছে। আমি চমকে উঠে দাঁড়াই। এ সফিক স্যার নন, আনাম স্যার। আনাম স্যারকে আমি খুব ভয় পাই। আনাম স্যার অংক করান। অংক না পারলে তিনি পিঠে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় দিয়ে থাকেন। সচরাচর অংকে আমি বেশ ভালো। কদাচিৎ ভুল করি। তারপরও নানা অজুহাতে, বানান ভুল, হাতের লেখা বিশ্রী, আরো বেশি ভালো করার জন্য অন্যান্যদের চেয়ে আমার প্রতি এরূপ নিষ্ঠুর আদর প্রদর্শন করে থাকেন।
এরপর স্যার একটা কুৎসিত হাসি ছড়ালেন মুখে। তারপর বললেন, ‘সফিক সাহেব কি দেখতে আমার চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম?’
আমি জড়তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলি, ‘স্যার, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।’
‘তুমি নাকি সফিক সাহেবের প্রেমে পড়েছো?’
আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকলো। আনাম স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি, কিন্তু আমার বুকে সমুদ্রের উথাল-পাথাল ঢেউ, কষ্টে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।
‘এই দেখো, এতে কান্নার কী আছে? কান্নার কী আছে?’ আনাম স্যার ভয়ে বিব্রত হয়ে দ্রুত ক্লাস ত্যাগ করেন। কিন্তু আমার মনের মধ্যে তিনি একটি কঠিন শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রেম। প্রেম।
আমি কি সফিক স্যারের প্রেমে পড়েছিলাম? প্রেম কী? মনের কোন অবস্থাকে প্রেমাবস্থা বলা হয় তা আমি তখন কেন, আজও বুঝি না। শুধু বুঝি যে, সফিক স্যারকে দেখার জন্য আমার মনটা প্রচণ্ড আনচান করতো। শুধু মনে হতো, একটা সুন্দর সুদর্শন পুতুলের মতো আমার সফিক স্যার ঠিক সামনে বসে আছেন, আর আমি একধ্যানে, পৃথিবীর আর সবকিছু ভুলে গিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি।

ভাবলে কী যে অবাক লাগে, মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে আমি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। সফিক স্যারের কথা আমার মনে পড়ে না। আমার মন তাঁর কথা ভেবে বিষণ্ণ হয় না। আমি চঞ্চলা হরিণীর মতো ছুটে চলি, মেয়েদের সাথে বউচি খেলি, ছেলেদের সাথেও পাল্লা দিয়ে দাঁড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট খেলি। আগের মতো লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে চলি। কিন্তু কথাটা মনে হয় ঠিকমতো প্রকাশ করা গেলো না। সফিক স্যারের কথা মনে পড়ে ঠিকই, তবে তাঁর জন্য চোখে পানি আসে না, একধ্যানে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ জাগে না। তাঁকে দেখবার তীব্রতা নেই একবিন্দু। চলে যাওয়া অন্য যে কোনো স্যারের মতোই সফিক স্যার খুব সাধারণ একজন হয়ে গেলেন, অন্য যে কোনো স্যারের কথা যেমনটি মনে পড়ে কখনো-সখনো, সফিক স্যারের কথাও তেমনি মনে পড়ে। তবে এই কথাটা স্বীকার করি, একসময়, যদিও খুব অল্প সময়ের জন্য, সফিক স্যার আমার মনে একটা ঝড় তুলেছিলেন। সেই ঝড়ে ভয়াবহ তাণ্ডব হতে পারতো, হয় নি, এটাই রক্ষা।
একটা ছেলে আর একটা মেয়েতে তফাৎ কতটুকু তা আমি বহু পরে বুঝতে পেরেছি। সফিক স্যারের ঘোরের মধ্যেও যে এই তফাতটুকু আমি বুঝতে পারি নি, তা ভেবে আজও আমি বিস্মিত হই।
স্কুল ছুটির পর আমরা একদল ছেলেমেয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। কলকল হাস্যচ্ছন্দে হেলেদুলে হাঁটছিলাম। চলতে চলতেই দেখি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বাবলু। বাবলু মোটামুটি মেধাবী ছাত্র। তবে খুব জেদী এবং একরোখা। প্রতিবারই সে ঘোষণা দেয়- এবার তার রোল নম্বর এক না হয়ে যায় না। কিন্তু শেষমেষ তার অবস্থান দশম-এর চারপাশেই ঘোরাঘুরি করে।
বাবলুর চোখমুখ গম্ভীর। সে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সামান্য বাঁকা হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে। ও নিশ্চয়ই অনেক আগে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিল। কী মতলব ওর মনে কে জানে? ওকে দেখে আমার বেশ কৌতুকবোধ হলো। ওর কাছাকাছি আসতেই হেসে দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী রে, এতো বেজার-কুজার কেন রে তুই? তোর কি বউ মরেছে?’
বাবলু আমার হাসিতে যোগ দিল না। গম্ভীর অথচ স্থির কণ্ঠে বললো, ‘অহনা শোন।’
ওর কণ্ঠে কী শক্তি ছিল জানি না। আমি আর একপা এগোতে পারলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর নরম করে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী?’
‘শোন, তুই এখন থেকে জাগুকে আর একটি নোটও দিবি না। তুই কি বুঝেছিস আমার কথা?’
ক্লাসে আমার পরের অবস্থানটা সচরাচর যার হয়ে থাকে সে হলো জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরকে ছেলেরা ব্যঙ্গ করে ‘জাগু’ বলে ডাকে। প্রত্যেকটা ছেলেরই এরকম একটা করে বিকৃত ডাকনাম আছে। জাহাঙ্গীরকে আদতে আমি কোনো নোট দেই না, জাহাঙ্গীরই আমাকে দিয়ে থাকে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাকে নোট দেয়ার জন্য শুধু ছেলেরা নয়, অনেক স্যারও প্রচুর উৎসাহ প্রদর্শন করে থাকেন। তখনো আমি গূঢ় রহস্য বুঝি না এতোখানি।
বাবলুকে বিনীতভাবে বলি, ‘তোর কি নোটের দরকার?’
হঠাৎ বাবলু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একটা বিশ্রী শব্দ উচ্চারণ করে বলে, ‘তোর নোট দিয়ে আমি...? তুই আর কোনোদিন জাগু শালার...এর সাথে কথা বলবি না। তুই কি বুঝেছিস আমার কথা?’
আমি ভয় পেয়ে যাই। কাঁপা স্বরে বলি, ‘তোর কী হয়েছে?’
ও গলা আরো চড়া করে বলে ওঠে, ‘শালায় বলে কী জানিস, বলে অহনা নাকি ওর ডার্লিং। জাগুর বাচ্চা জাগু। ডার্লিং আমি ওর..... দিয়া ভইরা দিমু না।’
আমি অশ্রাব্য গালির সামনে থাকতে না পেরে হাঁটতে উদ্যত হই। ও আমার হাত টেনে ধরে। বলে, ‘শোন অহনা, এই দেখ....’। বলেই ওর শার্টের বোতামগুলো খোলে। দুহাতে ফাঁক করে ধরে।
‘দেখ। দেখ। চাইয়া দেখ।’
আমি ওর বুকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। চামড়ার ওপর সুন্দর করে লেখা- ‘অহনা ডার্লিং’।
আমার বেশ আনন্দ লাগে। আমার নামটা কত সুন্দর করে ওর বুকের মাঝখানে লিখে রেখেছে। কীভাবে চামড়া কেটে লিখলো? আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকি। কিন্তু একটা শব্দ আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হলো- ‘ডার্লিং’। কী অর্থ এই শব্দটার?
ঐদিনের ডামাডোলে সব উলটপালট হয়ে গেলো। পরের দিন প্রথম পিরিয়ডের পর আবার মাথার মধ্যে ‘ডার্লিং’ শব্দটা এসে ঢুকে পড়ে। ক্লাস শেষ হলে যার কাছে এই শব্দটার অর্থ জানতে চাই সে হলো জাহাঙ্গীর।
‘এই, ডার্লিং শব্দটার অর্থ কী রে?’
জাহাঙ্গীর হো হো শব্দে হেসে ওঠে। ছেলেমেয়েরা ওর দিকে তাকায়।
আমি জাহাঙ্গীরকে বলি, ‘জানিস, বাবলু ওর বুকের মধ্যে চামড়া কেটে আমার নাম লিখেছে।’
আমার এই কথায় ক্লাসের সবাই একযোগে হেসে ওঠে, দুটি প্রাণী ছাড়া- একটি আমি, আরেকটি বাবলু। কিন্তু মুহূর্তেই ছেলেমেয়েরা বাবলুর কাছে গিয়ে ভিড় করে। কয়েকটা ছেলে ওকে জোর করে বেঞ্চি থেকে বের করে এনে ক্লাসের মাঝখানে দাঁড় করায়। বাবলু, একাকী, অসহায়ভাবে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে থাকে। পটপট করে ওর বোতামগুলে ছিঁড়ে ফেলে, শ্যামলা বুকটা উদোম হলে ক্লাসময় ছাত্রছাত্রীরা অবাক হয়ে দেখলো, কত সুন্দর হরফে সেখানে চামড়া কেটে লিখা হয়েছে- ‘অহনা ডার্লিং’।
বাবলুর কাঁদ কাঁদ চেহারা। লজ্জা, অপমান আর ধ্বস্তাধস্তিতে সে বিপর্যস্ত হয়ে বেঞ্চিতে নিজ জায়গায় গিয়ে বসে।
ডামাডোল থামলে জাহাঙ্গীর একটু গম্ভীর হয়। বাবলুর দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে, ‘পোলা সেয়ানা হইয়া গেছে। এই সেদিনের পোলা, নাক টিপলে দুধ বাইর হয়। সে আবার ডার্লিং বানাইতে চায়।’
আমি মাঝখানে জিজ্ঞাসা করি, ‘ডার্লিং অর্থ কী রে?’
জাহাঙ্গীর আমার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘যা না, বাবলু শালারেই জিজ্ঞাসা কর।’
আমি কৌতুকপূর্ণ এবং জিজ্ঞাসু চোখে বাবলুর দিকে তাকাই। বাবলুর চোখে আগুন ঠিকরে পড়ে। কিন্তু ওর প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি বা সমবেদনা হয় না।
জাহাঙ্গীর আমার সামনে এগিয়ে আসে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘ডার্লিং অর্থ জানিস না? তুই আমার ডার্লিং এইটা জাইন্যা রাখ!’
কানে সুড়সুড়ি লাগলে আমি খিলখিল করে হেসে উঠি।
এমন সময় ক্লাসে স্যারের প্রবেশ। হঠাৎ করেই ক্লাস এতো শান্ত হয়ে গেলো যে, কেউ বলতেই পারবে না এই ক্লাসে মাত্র কিছুক্ষণ আগেও প্রচণ্ড হট্টগোল হচ্ছিল।
স্যার চেয়ারে বসামাত্র আমি কথাটা বলে বসলাম।
স্যার আমার দিকে তাকান। আমি হেসে হেসে বলি, ‘স্যার, জাহাঙ্গীর আমাকে ডার্লিং বলেছে।’
‘বটে!’ স্যার দাঁত কটমট করে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকান। ‘এদিকে আয়।’ জাহাঙ্গীরকে ডাকেন। জাহাঙ্গীর ভয়ে ভয়ে স্যারের দিকে যায়।
জাহাঙ্গীরের মতো চঞ্চল ছেলে ক্লাসে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। ওর মতো এতো হাসিখুশিও আমি আর কাউকে দেখি নি। এতো দুষ্টুও অবশ্য ছিল না আর কেউ। স্যারের বেতের আঘাতে জাহাঙ্গীর যেভাবে গলা ছেড়ে কেঁদেছিল তা দেখে আমি আমার অজান্তেই কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর ও প্রায় এক সপ্তাহ ক্লাসে এলো না। আমার কী হয়েছিল আমি জানি না। ওর বসার জায়গাটায় অন্য ছেলেরা বসতো ওর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু ওকে না দেখতে পেয়ে আমার খুব কান্না পেতো। একদিন এমন কান্না পেলো যে ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে কেঁদে উঠলাম। সালেহা ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছিলেন। আমি পেট চেপে ধরে উপুড় হয়ে কাঁদছিলাম। আমার পেটে ব্যথা মনে করে ম্যাডাম কয়েকটা মেয়েকে দিয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর যেদিন জাহাঙ্গীর ক্লাসে এলো ওকে দেখে আমার বুক ভরে গেলো। আমার ধারনা ছিল ও আর কোনোদিনই হয়তো আমার সাথে কথা বলবে না। ও এতো ভালো কেন? এতো সুবোধ হলো কেন? আমার সামনে এসে খুব মিষ্টি করে হাসলো। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। চোখ আমার টলমল করে উঠলো। জাহাঙ্গীর আমার চোখের উপর চোখ রাখে। তারপর ধীর শান্ত স্বরে বলে, ‘তুই খুব সুন্দর রে। তাই তুই আমার ডার্লিং হইতে পারবি না।’
আমি ওর হাত চেপে ধরি। ‘তোর পায়ে পড়ি। আমাকে মাফ করে দে।’
‘ধূর। মাফ করার কী হইলো?’
‘আমাকে মাফ করে দে। আমি জীবনেও আর এমন করবো না। আমার জন্য তোর মায়া হয় না? দেখিস না আমি কী হয়ে গেছি?’
‘ডার্লিং অর্থ হলো বউ। তুই একদিন রাজরানি হবি। রাজার বউ। আমি তো গরীবের ছেলে। তোকে বউ বানাইবার ক্ষমতা আমার কি আর আছে?’
‘আমি কি জানতাম ডার্লিং অর্থ বউ? জানলে তো আর স্যারের কাছে নালিশ করতাম না।’
‘সত্যি নালিশ করতি না?’
আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। কারো বউ হওয়া কতখানি সুখের, কিংবা দুঃখের তা আমি যদিও বুঝতাম না, কিন্তু জাহাঙ্গীরের বউ হতে পারলে আমি সুখী হবো- আমার মনে এই কথা বার বার বাজতে থাকলো।
হঠাৎ জাহাঙ্গীর যে কথাটা বলে ফেললো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ও বললো, ‘তুই যে এখন বড় হয়েছিস এটা কি জানিস না?’
আমি চোখ সরু করে না বোঝার মতো করে ওর দিকে তাকাই। ও বলে, ‘এখন থেকে ওড়না পরবি, বুঝলি বুড়ি?’
আমি সহসা নিজেকে আবিষ্কার করি। নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাই। আমি দ্রুত ওর সামনে থেকে সরে যাই, এবং কাউকে না বলেই বাসায় ফিরে আসি।
জীবন থেমে থাকে না। আবেগ খুবই ক্ষণস্থায়ী। জাহাঙ্গীরের জন্য আমার মনের মধ্যে এমন একটা জায়গা ছিল, যা অন্যরকম, ঐ বয়সে যা দুর্বোধ্য। আজ বুঝি যে, ওটাই হয়তো আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল। সেই ভালোবাসাও স্থায়ী হলো না। একদিন জাহাঙ্গীরও সফিক স্যারের মতোই এ স্কুল ছেড়ে চলে গেলো। কোথায়, কোন স্কুলে গেলো, যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলো না, বলে সে গেলো না- ‘আবার দেখা হবে।’
মন ভালো না থাকাটা খুবই ক্ষণস্থায়ী একটা ব্যাপার। জাহাঙ্গীরের জন্য মন খারাপ থাকতে থাকতে একদিন দেখি আমি আবার সেই চপলা হরিণীর মতো হয়ে গেছি।
ছেলেরা এতো পাষণ্ড হয় কী করে? ওদের শরীরে কি মায়াদয়া নেই একটুও? মেয়েদেরকে কষ্ট দিয়ে ওরা কত সুখ পায়?
ক্লাস শুরুর আগে স্কুলের মাঠে সেদিন সবাই মিলে চোরকাঁটা তুলছিল। রোদ আমার একদম গায়ে সয় না। আমি অস্থির হয়ে উঠি। সালেহা ম্যাডাম আমার অবস্থা দেখে আমাকে ক্লাসে চলে যেতে বলেন।
খুব অলস ভঙ্গিতে আয়েশ করে বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। আমার শরীর থেকে গরম বেরুচ্ছিল। ক্লাসে কোনো বৈদ্যুতিক পাখা নেই। জানালার পাশে বসে কামিজ নেড়ে বাতাস খাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি বাবলু। আমি একটু বিব্রত ও লজ্জিত হই। কামিজ ঠিক করে নড়েচড়ে বসি। বাবলু মিটিমিটি হাসে। আমি কিছু বলি না। ও বলে, ‘আজ খুব গরম পড়েছে রে।’ আমি ওর কথায় যোগ দিই না। ও আবার বলে, ‘খুব গরম পড়েছে না আজ?’
আমি চুপ না থাকতে পেরে ছোটো শব্দে বলি, ‘হ্যাঁ।’
বাবলু আমার দিকে এগিয়ে আসে। ওর চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করি। সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘শোনো।’
আমি একটু ভয় পাই। ‘তুমি’ সম্বোধন ক্রোধ প্রকাশের পূর্বাভাস। বাবলু বলে, ‘আমার বুকের দিকে তাকাও।’
আমি তাকাই। ওর বুকের মাঝখানে শব্দ দুটো ফুটে আছে। ও বলে, ‘আমার চামড়ায় এই দাগ মুছে যাবে। তুমি কি মনে করো আমার মন থেকেও এটা মুছতে পারবে?’
কেন যেন আমার মায়া হয়। আমি বলি, ‘তোরা এমন করিস কেন?’
অকস্মাৎ কী যেন ঘটে গেলো। মনে হলো বাঘের দুটি হিংস্র থাবা দ্রুত আমার দুই বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো- খুবই দ্রুত, কিন্তু এতোই তীব্র সেই থাবা যে মনে হলো প্রস্ফুটনোন্মুখ দুই দলা ক্ষুদ্র মাংসপিণ্ড যেন আমার বুক থেকে খাবলে ছিঁড়ে বের করে নিয়ে গেলো, এবং প্রচণ্ড ব্যথায় আমি শুধু উচ্চারণ করতে পারলাম- ‘ও মা গো...।’
ছেলেরা এমন কেন? এতো বিধ্বংসী ওরা কী করে হয়? আমাকে আক্রমণের আগে কি বাবলুর মনে একটুও মমতা হয় নি?
ব্যথায় সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে গেলো। বাসায় চলে যাই। এই কথা কাউকে বলা যায় না। মাকে না। বাবাকে না। ভাইবোনকে না। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে? হ্যাঁ। এমন কাউকে তো অবশ্যই বলা যায়। তানিয়াকে বলার পর ও আমাকে আরো অনেক মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার বলে-বুঝিয়ে দেয়। ও আমার সহপাঠিনী বান্ধবী হলেও আমার চেয়ে দু-এক বছরের বড়; ওর আছে বড় দু বোন, যাদের কাছে এসব বিষয়-আশয় ও বহু আগেই জানতে এবং শিখতে পেরেছে।
ছেলেদের সাথে যে অকপটে মেশা যাবে না, গোল্লাছুট আর দাঁড়িয়াবাঁধা খেলার বয়সও আমার যে আর নেই, ওদের সাথে ঢলাঢলি, গড়াগড়ি, মাখামাখির সময় যে ফুরিয়ে গেছে, তা তানিয়া আমাকে ঢের বুঝিয়ে দিল। যে জিনিসটা ও আমার মধ্যে বেশি করে ঢুকিয়ে দিল সেটাই হলো নারী জীবনের সর্ব-মূল রহস্য, যা জেনে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও ভীত হতে থাকি।

এভাবেই আমার মন ও শরীরে পরিবর্তন আসতে থাকে, যার কিছুটা আমি বুঝি, আর অনেক কিছুই বুঝি না। মেয়েরা বরাবরই আমার ভালো বন্ধু। ওদের সাথে আমার খুব মজার সময় কাটে। গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতে শিখি। অনেক গল্প হয় আমাদের। পুতুল খেলার গল্প সেগুলো নয়। বছর দুয়েক আগে পুতুলখেলার গল্প হতো বেশি। ফুল কুড়ানো, আম কুড়ানো ইত্যাদি থাকতো সেই আড্ডার বিষয়বস্তু। কিন্তু আমি লক্ষ করে দেখি, আমার মুখের ভাষা অনেক বদলে গেছে। কথায় কথায় ছেলেদের কথা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- আমার, আমার বান্ধবীদের, আমাদের সবার। কোন ছেলেটা কীভাবে হাঁটে, কীভাবে কথা বলে, কীভাবে হাসে, পুরুষালি পৌরুষ কার মধ্যে বেশি, কার গোঁফ উঠেছে, মেয়েদের দিকে কোন ছেলেটা একটু বেশি তাকায়, মিটিমিটি হাসে- এসব। বয়সের তুলনায় এসব বিষয়ের আড্ডা নিতান্তই ইঁচড়েপাকামি সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ছাড়া অন্য বিষয়েও যে আমাদের আলোচনা হতে পারে তা কে শিখিয়ে দিবে? আর এটা তো উঠতি বয়সের দাবি। স্বতঃসিদ্ধভাবেই এসব বিষয় আমাদের ভাবনায় চলে আসে। আড্ডার বিষয় হয়ে ওঠে।

স্কুলের বাৎসরিক বনভোজন। শহর থেকে দূরে। কিন্তু খুব দূরে নয়। রাজেন্দ্রপুরের শাল-গজারির বন। আমার আনন্দ আর ধরে না।
একদিন সকালে ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকারা মিলে বাসযোগে রওনা দিলাম বনভোজনের উদ্দেশ্যে। পুরো বাসে অর্ধেকের কিছু কম মেয়েরা। মেয়েরা সামনের সিটগুলোতে বসেছে। তারও সামনে এক স্যার এবং এক ম্যাডাম। বাইরে বেড়ানোর স্বাদ জীবনে এই প্রথম। ঘণ্টা খানেকের পথ শেষে বাস এসে থামলো পিকনিক স্পটে। বিশাল শালবন- সারি সারি বৃক্ষ- কী যে সুন্দর! কী যে সুন্দর! বাস থেকে নেমে সবাই প্রথমে এক জায়গায় জড়ো হলো। একধারে খোলা মতো জায়গায় তাঁবু টাঙ্গানো হলো। স্যার আর ম্যাডাম তার নিচে পায়ের ওপর পা তুলে আনন্দোচ্ছল আড্ডায় মত্ত। ছেলেরা, মেয়েরা দল বেঁধে চলে যাচ্ছে শালবনের ফাঁক গলে দূরে কোথাও, বহুদূরে কোথাও। কিছু পরে স্যার আর ম্যাডামরাও আর তাঁবুর নিচে থাকলেন না, শালবনের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে, অচিহ্ন পথ ধরে তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন। আর আমি? নিজের কথা ভুলে গিয়ে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলাম বহুক্ষণ। আর তখনই তানিয়া পেছন দিক থেকে এসে দেয় ধাক্কা। একটা অশোভন শব্দ উচ্চারণ করে বলে, ‘সব্বাই ফিল্ডিং মারছে। তুই এখানে কী করছিস? চল যাই।’
‘চল যাই’ বলে তানিয়া আমাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকলো। যেতে যেতে আমার মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মনে হয় ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।’ হাওয়ায় হাওয়ায় আমার মন ভাসতে থাকে, উড়তে থাকে।
তানিয়া যেতে যেতে বলে, ‘আজ কিন্তু খুব মজা করবো আমরা।’
আমি বলি, ‘আমার কিন্তু সত্যি খুব মজা লাগছে। জীবনে এই প্রথম তো!’
তানিয়া মুখ টিপে হাসে। বলে, ‘জীবনের প্রথম মজাটাই কিন্তু আসল মজা। ওটাই সারাজীবন বেশি করে মনে থাকে।’ বলতে বলতে আমরা শালবনের ভিতর দিয়ে চলতে থাকি। চলতে চলতে আমার মনে হলো আমরা বুঝি একটু বেশি গভীরে চলে এসেছি। তানিয়াকে ডাকি, ‘কিন্তু এদিকে তো কাউকে দেখছি না। এদিকে কী আছে?’
তানিয়া বলে, ‘আরেকটু দূর। তারপরই একটা পুকুরপাড় আছে। যা সুন্দর না পুকুরটা!’

পুকুরপাড়টা সত্যিই খুব মনোরম। পাড় থেকে বাঁকা হয়ে গাছগুলো পুকুরের উপর অনেকখানি হেলে পড়েছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো তানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে একটা গাছে উঠি। ছোটোবেলায় গাছের মগডালে গিয়ে পাতায় জড়িয়ে লুকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগতো। আমাদের ছেলেগুলোকে কেন যেন সহসা ভেড়া মনে হতে লাগলো। ওরা পুকুরের পাড়ে জোড়ায় জোড়ায়, কেউ বা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, শরীরে শরীর ঘেঁষে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ছেলেরা এমন মেয়েলি স্বভাবের হবে কেন? হবে সফিক স্যারের মতো পৌরুষদীপ্ত। সফিক স্যার! সফিক স্যারের কথা মনে পড়তেই রাজ্যের বিষণ্ণতা এসে ভর করে আমার সারা মন ও দেহে। সফিক স্যারকে কতদিন দেখি না! কতদিন তাঁর কথা মনেও পড়ে নি আমার। মানুষ কত নিষ্ঠুরই না হতে পারে! কিন্তু সহসা সফিক স্যারের কথা মনে পড়াটা আমার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকলো। আর তাঁর পৌরুষদীপ্ততা? তাও। কারণ পুরুষের পৌরুষ বলতে কী বোঝায় তা যেমন সেদিন বুঝি নি, আজও বুঝি না। তবে সাধারণ একটা ধারনা আছে। কিন্তু সফিক স্যারের যে বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমি ইঙ্গিত দিচ্ছি তা হয়তো তাঁর পৌরুষদীপ্ততা নয়, তাঁর চৌকষত্ব।
‘চল না মজা করি!’ তানিয়ার কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে। ও মিটিমিটি হাসছে, ওর চোখ জুড়ে চাতুর্য খেলা করছে। ও একটু গাঢ় স্বরে বলে, ‘সুযোগ কি সব সময় পাব?’
‘নাহহহহহ!’ তীব্র স্বরে এমন ভাবে কথাটা বলে উঠি যে তানিয়া ভয় পেয়ে গেলো। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি তানিয়ার ইঙ্গিত। আমার মাথা ঘুরতে থাকে। আমি হয়তো ধপাস করে মাটিতে পড়ে যেতে পারি।
হ্যাঁ, আমি বসে পড়লাম। একটু সময় নিয়ে উঠে পুকুরের একপাশে গিয়ে একলা নির্জনে বসে পড়ি। তানিয়া আমাকে খুব ভয় পেয়েছে, ও আমার পিছে পিছে আসে নি।
এরপর মেয়েদের সাথে নাতিশীতোষ্ণ আনন্দে আমার সময় কাটতে লাগলো পিকনিক স্পটের বিভিন্ন স্পট ঘুরে ঘুরে।
আরো অনেক পরে, বালক-বালিকারা যখন পুকুরের চারপাশে মনোরম ঘাসের গালিচায় জোড়ায় জোড়ায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থেকে গল্প করছিল, তাদের মধ্যে নিবিড় হয়ে বসে থাকা বাবলু এবং তানিয়াকে দেখে মনে হয়েছিল, প্রেম এমনই। আমি যদি প্রেম বলে কিছু বুঝে বা শিখে থাকি, সে প্রেম এমনই, যা এক পাত্র অপূর্ণ রাখে, অন্য পাত্র পরিপূর্ণ করে।

২৫ জুন ২০০৬
৩২টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×