সামাজিক সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুক ও ব্লগে কিছুদিন পর পর একেকটা ইস্যু সৃষ্টি হয়, যাতে বাকবিতণ্ডায় ফেইসবুকার ও ব্লগারদের ঘুম হারাম হয়ে যায়, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, যাদের লো-প্রেশার তাঁদের ব্লাড প্রেশার কমে যায়, পাল্স হারিয়ে যায়।
এবারের কোরবানি ইদ ও হজের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল কোরবানি না দিয়ে ও হজ্জে না গিয়ে সেই টাকা বন্যার্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মহতী প্রচারণা। শেষে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী। ফেইসবুক এ বিষয়ের স্টেটাসে ছেয়ে গিয়েছিল।
কোরবানি ইদ চলে গেছে, হজ্জও চলে গেছে। কিন্তু দেশে এখনো বন্যা আছে, আর প্রকট আকার ধারণ করছে রোহিঙ্গা ইস্যু। ঠিক এই সময়ে সারা দেশে মহান দূর্গা পূজার প্রস্তুতি চলছে, যা প্রায় শেষের পথে। এবং কোরবানি ইদ বা হজ্জের মতোই এবার আরেক ইস্যু বের হয়েছে- দূর্গা পূজায় ব্যয়িতব্য অর্থ বন্যার্ত ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য দান করার প্রচারণা। গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে ফেইসবুক আর ব্লগে একের পর এক স্টেটাস ও পোস্ট পাবলিশ করা হচ্ছে। আজ সকালের দিকে ফেইসবুকে আমি এ বিষয়ে একটা স্টেটাস দিই, এবং আশ্চর্য, স্টেটাস দেয়ার স্বল্পকালের মধ্যেই একটা পজিটিভ ফলাফল দেখতে পাই, যা নীচে 'আপডেট' আকারে দেয়া হলো।
ফেইসবুক স্টেটাস - যাঁরা পূজার টাকা বন্যার্ত ও রোহিঙ্গাদের জন্য দান করতে বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে
সারা দেশে শারদীয় দূর্গা পূজার উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি শেষের পথে। বারো মাসে বারো বা তেরটি পূজার মধ্যে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে এ পূজাটি উদ্যাপন করা হয়। আমরা সারা বছর এ মহান উৎসবটির জন্য অপেক্ষায় থাকি।
একই সাথে সারা দেশ আজ দুটি প্রধান সমস্যায় আক্রান্ত- দক্ষিণ-পূর্বে রোহিঙ্গা সমস্যা, উত্তর-পশ্চিমসহ প্রায় সারা দেশে বন্যা সমস্যা। এবারের বন্যায় আগের যে-কোনো বন্যার চেয়ে সরকার, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এনজিওগুলো অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, ফলে যতখানি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়েছে এবার। এর কৃতিত্ব সরকারসহ সব সংগঠনের উপরই বর্তায়। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যও সরকারসহ দেশি-বিদেশি অনেক সংগঠন সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করছেন।
তো, এই অবস্থায় যে-সব ধর্মহীন বা অধর্মপ্রাণ ভাই-বেরাদরগণ দূর্গা পূজার জন্য এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় বা অপচয় না করে আমাদেরকে অতি-মানবিক হয়ে, মানবতার সেবায় এগিয়ে এসে বন্যার্ত ও রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে দান করার জন্য কু-পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সাড়ম্বরে ও মহাসমারোহে পূজা উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আমরা মহান ভগবানের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো, এ দ্বারা আমাদের স্বর্গলাভ হবে; পূজা না করলে ভগবান বেজায় অসন্তুষ্ট হবেন, আমাদের ধর্ম ছুটে যাবে। আর এই অর্থ বন্যার্ত বা রোহিঙ্গাদের দিলে 'মানবতা' নামের যে-কচকচানির কথা বলছেন, তা দিয়ে কি আমাদের স্বর্গলাভ হবে? কক্ষনোই না। 'মানবতা' একটা ফালতু টার্ম। বারো মাসে মাত্র তেরটা পূজাই তো। ভগবানের নির্দেশে এগুলো অবশ্য পালনীয়। তা না হলে ধর্ম বাঁচানো যাবে না।
আপনারা যাঁরা হজ্জ ও কোরবানির সময় হজ্জে না গিয়ে ও কোরবানি না দিয়ে সেই টাকা বন্যার্তদের দিয়েছেন, তাঁরা প্রকৃত মানবতা দেখিয়েছেন। সারা বছর তো মাত্র দুটো ইদ, ও একটা হজ্জ তাই না? দুটো ইদ পালন না করলে কিছু হয় না, জীবনে হজ্জ না করলেই বা কী? কিন্তু তেরটা পূজা উৎসবের থেকে একটাও বাদ দেয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মের গুরুত্ব কতখানি তা এই পূজার সংখ্যা থেকেই বোঝা যায়। ইদের গুরুত্ব কম বলেই মাত্র দুটো করা হয়েছে। হজ্জের গুরুত্বও কম বলেই মাত্র একবার হজ্জ করার হুকুম আছে। অন্যদিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বছরে মাত্র একটা বড়োদিন; একটা বড়োদিন বাদ দিলে আর থাকেই বা কী? ওটা পালন করা অবশ্য কর্তব্য।
যাঁরা পূজা না করে এর বিপুল অর্থ বন্যার্ত ও রোহিঙ্গাদের দান করতে বলছেন, সেই ধর্মহীন পাপিষ্ঠ ভাইয়েরা, বোনেরা, শ্রদ্ধেয়, শ্রদ্ধেয়ারা আশা করি নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং এই পোস্টে এসে নিজেদের মুখটা সবাইকে দেখাবেন। আপনাদের ভুল ভাঙবে এটাই আমাদের ধর্মপ্রাণ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রত্যাশা থাকলো।
ফেইসবুক স্টেটাসের আপডেট
পাপিষ্ঠ ভাই-বেরাদরগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। আমার এই স্টেটাস পাবলিশ করার সাথে সাথে তাঁরা নিজেদের সবগুলো পোস্ট ডিলিট করে ফেলেছেন; সারা ফেইসবুক বা ব্লগ জুড়ে একটা পোস্টও এখন দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে খুব কৃতার্থ মনে হচ্ছে। ধর্ম বাঁচানোর এই ঐতিহাসিক অবদান রাখতে পারায় নিজের নাম আজই স্বর্ণাক্ষরে লিখে ফেলবো।
এরপরও কোনাকাঞ্চিতে দু-একটা ধর্মবিরোধী পোস্ট পাওয়া গেলে সহৃদয় ভাইবোনেরা আমাকে তার লিংক দিয়ে বাধিত করবেন। অগ্রিম কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ থাকলো।
***
***
***
অফ টপিক
ইদ ও হজ্জের আগে ফেইসবুক/ব্লগ ভরে গিয়েছিল কোরবানি না দিয়ে এবং হজ্জে না গিয়ে সেই অর্থ বন্যার্তদের মধ্যে দান করার জন্য। এ প্রচারণায় সোচ্চার ছিলেন আমাদের তথাকথিত মানবতাবাদীরা। বর্তমানে সারাদেশে মহাসমারোহে দূর্গা পূজা হতে যাচ্ছে, কত অর্থ ব্যয় হচ্ছে এতে, অথচ সেই প্রগতিশীলরা এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন - কোথাও কাউকে এই মর্মে একটা পোস্টও দিতে দেখলাম না - 'হে ভাইয়েরা, আপনারা আসুন, আমরা এবার পূজা না করে বা পূজার খরচ কমিয়ে ঐ টাকা বন্যার্ত বা রোহিঙ্গাদের দান করি'। এঁদের আপনারা কী বলবেন? আমার তো তাঁদের মুখে থুথু ছিটাতে ইচ্ছে করছে। আপনি যদি প্রকৃতই মানবতাবাদী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার মন সব মানুষের জন্যই কাঁদবে। আর যদি ইসলাম ও মুসলমানবিদ্বেষী, ভণ্ড চেতনাবাজ, হিংসাপরায়ন ও একচোখা হয়ে থাকেন, ভণ্ডামি বা হিপোক্রেসি যদি আপনার জন্মগত স্বভাব হয়ে থাকে, তাহলে ইদ বা হজ্জের সময় আপনার মানবতা সর্বাঙ্গ বেয়ে উপচে পড়বে, আর পূজা বা বড়োদিনের উৎসবে আপনি বন্যার্ত বা রোহিঙ্গাদের কথা বেমালুম ভুলে যাবেন।
এটা হয়ত একটা সাম্প্রদায়িক পোস্ট। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে 'অসাম্প্রদায়িক' বা 'সেকিয়্যুর' বলে কিছু/কেউ নেই। সবাই একটা না একটা ধর্ম নিয়ে আছেন। যার যার ধর্ম তার তার কাছে বড়ো, এমনকি নাস্তিকেরও ধর্ম আছে, নাস্তিক্যবাদ। পাশাপাশি একটা মসজিদ আর মন্দির থাকতে পারে না কেন? মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় কেন? মন্দিরই বা ভেঙে ফেলা হয় কেন? আমার ধর্মে শূকর খাওয়া হারাম, আমাকে শূকর খাওয়াতে পারবেন না। আপনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকলে বলুন, গরুর মাংস খাবেন? আপনার সামনে গরু জবাই করা হলে সেটা কীভাবে নেবেন? পাশের দেশে গরুর মাংস বহন করে নাই, শুধু সন্দেহের বশবতী হয়ে দুটো মুসলমান তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেললো হিন্দু মানুষেরা। অসাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু থাকলে পাশের দেশে গরু কোরবানি দিলে মানুষ কোরবানি হয়ে যেতো না। তারপর দেখুন, ইউকে-র মতো দেশে হিজাব-পরা মুসলিম নারীদের উপর অমুসলিমরা কিছুদিন আগে কী তাণ্ডব চালালো। আমেরিকাতেও মুসলিম নারীদের উপর অত্যাচার করা হলো। ফ্রান্সে প্রকাশ্যে কোনো মুসলমান 'আল্লাহু আকবর' বললে তাকে গুলি করে মারার আদেশ জারি হয়েছে। উন্নত বিশ্বেই হলো 'অসাম্প্রদায়িকতা'র নমুনা এই রকম, আর আমরা তথাকথিত মুসলমানরা সেকিয়্যুলারিজম ও প্রগতিশীলতার নামে গলা ফাটিয়ে ফেলছি।
আসলে মুসলমানদের শত্রু হলো মুসলমানরাই। বাংলাদেশ হলো অতি প্রগতিশীলতা আর অতি মানবিকতার দেশ- আর এই অতি প্রগতিশীলতা বা অতিমানবিকতা হলো খোদ মুসলমানদের মধ্যেই। কোরবানি না দিয়ে সেই টাকা বন্যার্তদের দেয়ার কথা সবার আগে মুসলমানরাই বলেছেন; কোরবানিতে এত নিরীহ গরু জবাই না করার জন্য মুসলমানরাই বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠেন। মুসলমানদের মধ্যে একতা বা সংঘপ্রীতির অভাব প্রকট। পাশের দেশে কোনো মুসলমানকে কোনো অমুসলিম মেরে ফেললে অমুসলিমরা ঐ হত্যাকারীর বিরুদ্ধে একটা কথাও বলবে না (কিছু ব্যতিক্রম থাকবে, কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়)। অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরও দেখবেন, নিজেদের দেশ বা গোত্রের পরিপন্থি কোনো কিছু তারা করবেন না, বলবেনও না। আর বাংলাদেশে? বাংলাদেশে কোনো অমুসলিমের গায়ে একটা টোকা পড়লে সবার আগে মুসলমানরা হায় হায় করে ওঠেন- হায়, সংখ্যালঘুরা ধ্বংস হয়ে গেলো। এরা হলেন চরম সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানী, ধাপ্পাবাজ লোক। কোনো একটা গোষ্ঠি বা গোত্র বা দেশের নেকনজরে থাকার একটা প্রয়াস মাত্র। এরা ভণ্ড, হিপোক্রেট। এসব ভণ্ড মানবতাবাদী ও সুযোগসন্ধানী চেতনাবাজরা নিপাত যাক।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৪