তোমাকে কী সুন্দর পুতুলের মত লাগছিলো!
তুমি চুপ করে বসে ছিলে জড়সড় হয়ে।
আমাকে দূর থেকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলে। কাছে গেলাম। ধমক দিয়ে আস্তে করে বললে ‘স্টেজে উঠো!’
ভীষন অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলাম।
তুমি তোমার ছড়ানো বিয়ের শাড়ী আর ভারী ওড়নার নীচে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরলে আমার ডান হাত। ধরেই থাকলে।
বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল।তোমাকে কিন্তু দারুন লাগছে!’
‘শাড়ীটা এত ভারী!’ তোমার অভিযোগ, ‘আর অর্নামেন্টসগুলোও কেমন খোঁচা লাগছে!’
আমি আশ্বস্ত হই।
যাক, সব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছ।
স্টেজ থেকেই দেখি তোমার মা শুন্য চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আমি তোমার হাত ছাড়িয়ে নেমে যেতে চাই। তুমি ছাড়লেনা। ‘বসনা আপু, এমন করছ কেন? প্লীজ বসে থাকো আমার সাথে’।'
আমি তোমার মায়ের চোখ থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে নেই।
তোমার বান্ধবীরা তোমার ছবি তুলতে ভীড় জমায়। এবং ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে হঠাত খেয়াল করি, তোমার চোখে চিকচিকে পানি!
আমি হাতে চাপ দেই। ‘কাঁদছ?’
তুমি কেমন চোখে যেন আমার দিকে তাকাও।‘কাঁদব কেন? অনেক কেঁদেছি, আর কাঁদবনা’।'
বলতে বলতেই কেঁদে ফেললে!
বিয়ের দিন, বউ কাঁদবেই, তাই কেউ খেয়ালই করেনা। আমার বুকের ভিতর টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ে তোমার প্রতিটা চোখের ফোঁটা। আমি বলি, ‘হাত ছাড়ো, আমি চলে যাই। তোমার কান্না দেখতে ইচ্ছা করছেনা’।'
তুমি এমন শক্ত কখন হলে? বললে ‘না। আমি কাঁদব। এতটুকুও দেখতে পারবেনা? অন্তত একজন দেখুক আমার সত্যিকারের কান্না। যাবা না, বসে থাকো’।'
আমি অসহায় বসে থাকি তোমার পাশে।
তোমাকে যেদিন প্রথম পড়াতে যাই, তুমি এত ছটফটে!লাস্ট এক্সামের রেজাল্ট বের করে দিয়েই বললে, ‘টীচার, আমি হচ্ছি গোল্লা। আই মিন আমার রেজাল্ট হচ্ছে গোল্লা! আমি মিন……’
আমি শব্দ করে হেসে ফেলতেই তুমি অবাক হয়ে বললে, ‘হাসছেন কেনো?’
আমি উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘টীচার না, আমাকে আপু ডেকো’।'
একসময় তোমার অনেক কাছের আপু হয়ে গেলাম।
ছোট্ট তুমি, ছটফটে তুমি একদিন জোড় করে আমার হলে চলে এলে। আমার রুমে ঢুকে তোমার চোখ কপালে! ‘এতো রুম না, লাইব্রেরী!’
আমি হাসি।
কিন্তু তখন যদি ঘুনাক্ষরেও জানতাম, আমার এ রুমটাই তোমার জন্যে খুলে দিবে জীবনের নতুন দরজা, এবং সে দরজা দিয়ে আসবে কালবৈশাখী, আমি ভুলেও হাসতাম না।তুমি একগাদা বই বগলদাবা করে নিয়ে গেলে। প্রমিজ করলে ক্লাসের পড়া শেষ করেই পড়বে।
এরপর পড়তে পড়তেই কখন যেন তোমাকে পড়ার নেশা পেয়ে গেল। আর আমাকে পড়ানোর নেশা। তোমাকে পড়িয়ে মজা পেতাম। কারন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে তোমার সাথে সাথে আমাকেও পড়তে হত।
এরপর তুমি স্বপ্ন দেখা শুরু করলে।
কিছু করার স্বপ্ন।
জীবনের স্বপ্ন।
মানুষের স্বপ্ন।
কিন্তু তোমার স্বপ্নের মাঝখানেই তোমার মা তোমাকে ভাল পাত্রস্থ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন।
ইন্টারের একটা মেয়ে তুমি, এখনি বিয়ে!!
তুমি আমার কাছে কেঁদে কেটে একসা’ হলে। আমি তোমার মাকে তোমার পক্ষ হয়ে কিছু বলতে গেলাম। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে গেল। তোমার বাবা আমাকে বলে দিলেন- ঐসব মোটা মোটা বই গিলে একটু খানি মেয়েটা এত বড় বড় কথা শিখেছে। ওকে তুমি আর কোনো বই দিবানা। ক্লাসের পড়ার বাইরে আবার কীসের পড়া?
আমি তোমাকে বই দেয়া বন্ধ করলাম। কিন্তু স্বপ্ন দেখানো কি বন্ধ করা যায়? তোমার সপ্ন আর বাস্তবতার সংঘাত শুরু হয়ে গেল।
আমি তখন অসহায় দর্শক।
এরপর জানো, কতদিন নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি তোমাকে স্বপ্ন দেখানো শিখিয়েছি বলে। কী দরকার ছিল? আমার তো দায় ছিল ক্লাসের পড়া পড়ানোর। কেন আমি জীবনের পড়া পড়াতে গেলাম?
আমি প্রতিদিন দেখতাম তোমার আর তোমার মায়ের যুদ্ধ।
পুরাতন সুরের সাথে একটা নতুন রিমিক্সের দ্বন্দ।
চিরায়ত জেনারেশন গ্যাপ, এই সেই।
আমার খারাপ লাগা আমাকে টিকতে দিচ্ছিলনা। আমি পালিয়েছিলাম।
নিজের পড়ালেখার অজুহাতে আমি তোমার টিউশনী ছেড়ে দিলাম।
বেশ অনেকদিন পর তোমার ফোন এল, ‘আপু, আমার বিয়ে!’
ছেলে ব্যবসায়ী।
তোমার মা আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিলেন তুমি সুখেই থাকবে, টাকার অভাব হবেনা যে!
কেবল তুমিই আমার হাত ছাড়লেনা।
আর না পারতে বললাম, ‘ছাড়ো, এবার আমি যাই’।'
তুমি হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলে। তারপর ফিসফিসিয়ে বললে, ‘চিন্তা করোনা আপু, আমি ভাল থাকব। ব্যাবসায়ীতো!’
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ সকাল ৭:১৪