somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নগুলো তুলে রেখে গেলাম।

১২ ই এপ্রিল, ২০০৮ রাত ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

………টিউব অনেক আগেই নিষিদ্ধ। শেষ ভরসা ছিল ফোম। প্রথমে প্রমান সাইজ। তারপর একটু ছোট। তারপর আরেকটু ছোট। শেষে যা দেওয়া হল তা নামমাত্র, সাহস থাকার জন্যে। আজ সেই ছোট সাহসের টুকরোটাও কেড়ে নিলেন আন্টি।………আমি পানির দিকে তাকাই। গাঢ় নীল পানি। ঈজিপশিয়ান ফাওজী স্যার শুধু ইস্কান্দারিয়ার নীল স্বচ্ছ পানির গল্প করতেন। ইস্কান্দারিয়া দেখিনি। আমি বংগোপসাগরের ঘোলা পানি দেখেছি। ক্লিফটনের তারচে ঘোলা পানি দেখেছি।…… নীল দেখলাম পুলে এসে। তাইবা খারাপ কীসে… আমি তাই নীল পানিতে ডুবে যাওয়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করে দু’হাত সামনে দিয়ে পুরো শরীর ভাসিয়ে দেই। নিমিষেই পানির তলে। বুদবুদ উঠে। আমি নিজেই নিজের নিঃশ্বাসের বুদবুদ দেখি… এবং একসময় কীভাবে যেন ভেসে উঠি। জানিনা। ভাসতে ভাসতেই দেখি সামনে যাচ্ছি… পুলের উপরের নীল ছাউনি দেখি…ছিটকে উঠা পানিতে চোখের সামনে তারার ঝিলিমিলি দেখি… এবং দেখতে দেখতেই হঠাত দেখি আমার হাত রড ছুঁয়েছে!!...... দ্রুত ঘুরে পরম অবিশ্বাসে আন্টির দিকে তাকাই! আন্টী হাসছে!
………ছোট ছোট শখ… ছোট ছোট স্বপ্ন… কী অদ্ভূদ আনন্দ এইসব ছোট ছোট অনুভুতিগুলোতেই! আন্টির গমগম গলা, ‘প্র্যাক্টিস করো, নাহলে মাত্র শিখেছো তো, ভুলে যাবে’। একবার পুলের প্রস্থ বরাবর সাঁতার কেটেই আনন্দে আত্নহারা আমি না বোধক মাথা নাড়ি। অবাধ্য ছাত্রী… প্রথম সাঁতার কাটার আনন্দে বিভোর! ‘আন্টি, কাল! কাল মনের মত সাঁতার কাঁটবো’।'

উঠে আসি নীল পানি থেকে। কালকের স্বপ্ন নিয়ে। কাল আমি মাছ হব। কাল আমি নীল পানির বন্ধু হব। কাল আমি ডুব দিয়ে পানির নীচ ছুঁয়ে আসবো। কাল আমি একটা স্বপ্নের পরিপূর্ণ মালিক হব। আমি তাই কালকের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরি।

তারপর?

ডক আম্মুকে বললেন, ‘এখনি এই পরীক্ষাগুলো করান। কাল কেবিন পান কিনা দেখেন। সব ঠিক থাকলে রাতে অপারেশন। আর শোনো মা, একমাস কমপ্লিট বেডে থাকার প্রিপারেশান নাও’।'

ঘোলা চোখে ডকের ভাবলেশহীন মুখ দেখি। বায়োলজি ক্লাসে স্যার যখন জীবন্ত ব্যাংগটাকে কাটার আয়োজন করছিলেন, তীব্র প্রতিবাদে স্যারকে হতভম্ব করে দিয়েছিলাম। ‘এই ব্যাংটারো একটা প্রান আছে স্যার। ওরও অনুভূতি আছে। কষ্ট আছে। এভাবে কাটাটা অমানবিক স্যার’।'…… প্রিয় ছাত্রী বলেই হয়তো স্যার কৌতুক বোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘শোনো মেয়ে, যখন ডক হবা, জীবন্ত মানুষ কাটবা… জীবন্ত মানুষগুলাকে তখন মনে হবে গাছের পাতার মত….’ …… আমার কখনো মানুষকে পাতা মনে হয়নি। তাই ডাক্তারও হওয়া হয়নি…… এখন এই ডকের কাছে কি আমাকে একটা পাতা মনে হচ্ছে? হয়তো তাই। নাহলে ওনি অমন ভাবলেশহীনভাবে কীভাবে বলছেন ‘মানসিক প্রিপারেশান থাকা ভাল, কষ্ট হবে’।' ডকের মুখের ‘কষ্ট’ কে আমি অনুবাদ করি ‘মহাকষ্টে’। ……… আম্মু এখানে ওখানে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে।চারপাশে মানুষের প্রচন্ড ভীড়।…… মানুষের ফাঁক দিয়ে জানালা খুঁজি। আকাশ দেখার জন্যে মনটা হাঁসফাঁস করে।

ফেরার পথে আম্মুকে বলি ‘রিকশা নাও'’। রিকশাকে বলি- ‘আস্তে চালান’। যথারীতি জ্যামে পড়ি। জ্যামটাও খুব বেশী ভাল লাগে। মনে মনে প্রার্থনা করি জ্যাম যেন দীর্ঘজীবি হয়…… বসে বসে মানুষ দেখি। ঝাপসা চোখে মানুষগুলোর চেহারা অস্পষ্ট ঠেকে।…… ‘তুই এভাবে ভেংগে পড়লে হবে? আমার পেট থেকে তুই এমন ভীতু হলি কী করে? তোকে না বলছিলাম একাত্তরে দুইবার কীভাবে মিলিটারীদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালাইছি?......’ আম্মু নিজ জীবনের শতবার বলে ফেলা কাহিনী নতুন করে শোনায়। আমি রিকশা থেকে আকাশ দেখি। নিকষ কালো অন্ধকার। ঢাকার আকাশে আমি কখনো পূর্ণিমা দেখিনি।……… ‘কথা বলছিস না যে?’ ……… আমার কথা বলতে ইচ্ছা করেনা……… চোখের সামনে ভাসে হস্পিটালের সাদা বিছানা, সাদা চাদর আর সাদা রুম।

তুমি এখন কী করছ? এখন তোমার ওখানে মধ্যরাত। ডকের কাছে যাচ্ছি শুনে তুমিও জেগে আছো নিশ্চিত।… আম্মু বিড়বিড় করে। ‘তোর কপালটাই ফাটা। ক’দিন আগে মাত্র হাসপাতাল থেকে আসলি। এখন আবার…যেটাকে তুই সবচে বেশী ভয় পাস, সেটাই সবচে বেশী টানে তোকে’।'…… ট্রাফিক জ্যামের অন্ধকারে আমার কপালে হাত বুলাই। মসৃণ ত্বকে ফেটে যাওয়ার ভাঁজ খুঁজি…… তুমি কেমন আছো? আমি ভাল নেই। না, কাল হস্পিটাল যাবো সেজন্যে না, তুমি নেই সেজন্যে। পাশে আম্মু বসে। অথচ তারপরও বুকের ভিতর কেমন দলা পাকানো অনুভূতি। ঠিক বুকের মাঝখানে।… প্রচন্ড কান্না পেতে থাকে…… তুমি সবসময় পাশে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলে। কিন্তু দেখো, জীবন কেমন! তোমাকে চলে যেতে হল…… এয়ারপোর্টের ঐ কাঁচের ওপাশে তোমার চলে যাওয়া ভাসতে থাকে ঝাপসা চোখে। তুমি বার বার ফিরে ফিরে দেখছিলে।……দলা পাকানো কষ্টটা আরো শক্ত হয়। একেই কী বলে বুকের ভিতর মোচড় মারা? বাস্তবতা বুঝেও আমি অবুঝের মত তোমাকে প্রার্থনা করি। তোমার উপস্থিতি প্রার্থনা করি। প্রার্থনাগুলো উলটো ঘাই মারে বুকের ভিতর।...... নিঃশ্বাস নিতে আর কান্নার আওয়াজ চাপতে আমি হা করে বাতাস টানি…… অন্ধকার আমার চোখের পানিকে আড়াল করে রাখে।

বাসায় ফিরি। ফোনের পর ফোন। নানা জনের নানা মত, নানা পরামর্শ, নানা সিদ্ধান্ত…… আমি নতুন করে আমার চারপাশের মানুষগুলোকে চিনি। আমি চুপ হয়ে যেতে থাকি। এনেস্থেশিয়ার সেই হঠাত সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকি। আমার আবার পালাতে ইচ্ছা করে। আম্মু থেকে, চারপাশের এইসব অসহ্য ভালবাসার চাপ থেকে, সামাজিক কুটচাল আর মানুষের হাজার রকম মানসিকতা থেকে…… এমনকি তোমার উতকন্ঠা থেকেও!

কাল আর সাঁতারে যাওয়া হবেনা। আমি আবার ভুলে যাবো পানির সাথে বন্ধুত্বতা।নীল পানি বাদ…… সেই পুরানো মেঘের বন্ধুত্বই সই। নতুন কেবিনে কি পুরানোটার মত বিছানার পাশে বিশাল একটা জানালা থাকবে?...... যদি থাকে, আমি তোমাকে মনে মনে চিঠি লিখবো সারাদিন। মেঘের খামে ভরে পাঠিয়ে দেব তোমার ঠিকানায়। তুমি নিজ থেকে অনুবাদ করে নিও পছন্দসই ভাষায়…… ভালো থেকো। আমি ভালো থাকবো।……… কালকের স্বপ্ন অনেক কাল পরের জন্যে তোলা রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ ভোর ৬:৩৬
৭০টি মন্তব্য ২২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×