শেষ পর্যন্ত সে যখন বুঝতেই পারল সে মারা যাচ্ছে, শুন্য হয়ে গেল ভিতরটা। আক্ষরিক অর্থেই কেমন যেন খালি লাগছে সব। কতক্ষন ধরে মারা যাচ্ছে সে? এটা কী এক সেকেন্ড, এক মিনিট, নাকি এক ঘন্টা? এখন কী দিন নাকি রাত? মা বলত, মানুষ মারা যাওয়ার সময় একসেকেন্ডে পুরো জীবন দেখতে পায়! কিন্তু সে কেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা? ওহ, চোখের পাতা খুলতেও এত শক্তি লাগে!
ঐতো আবছা আকাশ।
আবছা নীল।
আবছা জীবন।
একটু একটু করে বুঝতে পারে, এখন ভোর।ভোর বলেই কেমন আবছা আলো। নাকি সে মারা যাচ্ছে বলেই সব আবছা দেখছে? মৃত্যুর সময় সে জীবন না দেখে বরং ঐ আবছা আকাশে দেখতে পাচ্ছে বাবার মুখ। ওহ্ বাবা, এভাবে আমার মরে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা। তোমার এনে দেয়া সেই নতুন মোটা বইটা ধরাই হলনা। আর তোমার ছাতাটা প্রতিদিন বের হওয়ার পথে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমি যখন থাকবনা বাবা, তুমি কি খুব কাঁদবে?
চোখের সামনে থেকে আবছা আলোটুকুও হারিয়ে যায়। মনে হয় চোখে পানি চলে এসেছে। পৃথিবীতে সত্যিকার লড়াকু মানুষ বলতে সে তার বাবাকেই দেখেছে।শেকড় গ্রামে হলেও, মা’র কাছে শুনেছিল, বাবা শহরে পড়ালেখা করে শহরেই মানুষ। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল, এক রোখা বাবা তার সব ছেড়ে চলে এলেন বাপের ভিটায়, গ্রামে।তারপরও জীবন সহজ হয়নি। গ্রাম্য পলিটিক্স ছিঁড়ে খুবলে খেয়েছে।কিন্তু হাল ছাড়েন নি বাবা।স্কুলের হেডমাষ্টারি করে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সাথে। বাবার কারনেই গ্রামের মেয়ে হয়েও সে পড়েছে গোর্কি, মারিয়া রেমার্ক, ওরিয়ানা ফালাচি, হুগো। বইয়ের ভিতর দিয়ে সে জীবনের বিভিন্ন রংকে ছুঁয়েছে, হাতে রংতুলি তুলে দিয়েছে বাবাই।
বাবা কি বড় বেশী দুঃখ পাবে? মা’তো নেইই। কবেই চলে গেছেন ওপারে। মা কি দেখছেন তাকে? দেখছেন তার রেখে যাওয়া একমাত্র মেয়ে সদ্য ভোরে ধানক্ষেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে? মা তুমি এভাবে চলে না গেলেও পারতে।
তাহলে হয়তো পুকুরঘাটে যাওয়ার সময় মেয়ের সাথে তুমিও যেতে।
তাহলে হয়তো এভাবে আমি মরে যেতাম না।
তাহলে হয়তো আমার স্বপ্নগুলো সত্যি হত।
তুমি যখন মরে গেলে মা, তখনি স্বপ্ন দেখা ছেঁড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার নিত্যনতুন বইগুলো, আর সেই মানুষটা! ওরা যে আমাকে আবার স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছিল। প্রথম যেদিন মানুষটা এলো বাড়িতে, বাবার সেকি হাঁকডাক!
‘আরে দেখে যা মামণি, জসিমের ছেলে এসেছে! আহা, জসিম আর আমি কত মারামারি করেছি ছেলেবেলায়। ওহ্, তুমিতো একদম সুপুরুষ হয়েছ! হাহাহা! যোগ্য বাপের যোগ্য পুত্র হয়েছ একেবারে। ইকোনোমিক্সে ঢুকেছ? বাহ্, বেশ তো। আজকালকার ছেলেরাতো লেখাপড়ার লাইন ছেড়েই দিচ্ছে। আহা, ছুটি কাটাতে তোমার বাবা তোমাকে পাঠিয়েছে আমারই অনুরোধে। তারতো সময় নেই, অন্ততঃ তার ছেলেকে দেখি। তোমার খালাম্মা বেঁচে নেই, থাকলে দেখতে তোমায় মাথায় করে রাখত, কত কী যে বানাতো তোমার জন্যে! আহ অমন সংকোচ করোনা। এটা এখন তোমারই বাড়ি।কোথায় গেলে মামনি?’
বাবাটা না এমন, এত্ত সোজা, যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। আরে বাবা, বন্ধুর ছেলে শখের বসে গ্রাম দেখতে এসেছে তাতে এমন সমাদরের কী হল? তাই সে প্রথম প্রথম সামনেই যায়নি।রেহানার মা’ই মেহমানের যত্নআত্তি করত। মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই দূর সম্পর্কের বিধবা ফুপুই আগলে রেখেছে সব। তার নিজের মেয়ে বিয়ের পর বাচ্চা হওয়ার সময় মরেছে। বন্ধনহীন এ মহিলাই বেঁধে রেখেছে এই ঘর।
কিন্তু মেহমানটা কেমন যেন। যেচে এসে কথা বলতে চায়। শহুরে এসব ঢং বইয়ে সে অনেক পড়েছে। অতএব এড়িয়ে চলা। কিন্তু একদিন শেষবিকেলে এই পুকুরঘাটেই কোলের উপর দস্তয়ভস্কি রেখে পা দুলিয়ে দুলিয়ে বড়ই আচার খাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায় সে। আর মানুষটা এত কথাও যে বলতে পারে!
এরপর?
ইকোনোমিক্সের এক সদ্য লেকচারারের সাথে ধুমধাড়াক্কা বন্ধুত্বের গর্তে পড়ে যায় ইন্টার পরীক্ষার্থী বইপোকা।
এরপর?
চাঁদের আলোয় বাবা, মেয়ে আর বন্ধুর ছেলের সেকি গপ্প!
এরপর?
বন্ধ শেষে লেকচারার ফিরে যায়, কিন্তু বন্ধু হয়ে যায়।বাবার অভিজ্ঞ চোখ বুঝে সব। হাসে। অবশেষে কীভাবে যে বিয়েটা ঠিক হয়ে যায়! কিন্তু হেডমাষ্টার বাবার সোজা কথা- পরীক্ষার পরে বিয়ে।
পরীক্ষার আর ক’দিন বাকী? চারদিন। তাইতো সে ভোরে উঠেছিল পড়তে। আর একমাসের মধ্যেই সে কাছে পেত প্রিয় মানুষটাকে। হাত দিয়ে যাকে কখনো স্পর্শ করেনি ঠিক, কিন্তু মন দিয়ে যাকে ছুঁয়েছে প্রানপনে। জীবন সংগীর চে’ও বন্ধু হতে যে ছিল বেশী আগ্রহী। অসম বয়সেও তাই ভাল লেগেছিল তাকে।
গাছের পাতাগুলোকে তখন মনে হত একটু বেশী সবুজ।
পুকুরের পানি মনে হত একটু বেশী নীল।
ভোরের আকাশ মনে হত একটু বেশী কমলা।
হাতের মেহেদী মনে হত একটু বেশী লাল।
হাতের আংগুল পর্যন্ত কেমন অবশ হয়ে আছে। নাড়াতে পারেনা।কেমন যেন চ্যাট চ্যাটে লাগছে। নিজের রক্তে নিজেই ডুবে আছে সে।
স্বপ্নে ডুবে থাকা বালিকা এখন ডুবে আছে রক্তে। অদম্য আক্রোশে সে আবার চোখ খুলে তাকায়। স্বপ্নই যদি দিবি প্রভূ, স্বপ্ন রক্ষার শক্তি দিলিনা কেনো? চারটা পশু যখন তাকে ঝাপটে ধরেছে কিছুই যে করতে পারেনি সে। একটা চিৎকারও না। অক্ষম কষ্টে ঢুকড়ে কেঁদে উঠতে চায় সে। পারেনা। গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কান্নারা তাই আটকে থাকে বুকের ভিতর। তীব্র ছুরি মারা কষ্টটা ফিরে আসছে!
উহ্!
মৃত্যুর আগের এক সেকেন্ড মানে কী একটা মহাকাল?
আটকে থাকা কান্নাটা কাল না মহাকাল তা ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো মেঘ হয়ে যায়। তারপর ভেসে যায় আকাশে। স্থির মাটির শরীর পড়ে থাকে মাটিতেই।
অনেক অনেকদিন পর।
গ্রামের পাগলা মজিদের ঘরের উপর ভেসে আসে এক খন্ড মেঘ। এ বাড়িতে কেউ থাকেনা। বাড়ির মালিক মজিদ সাহেব একসময় গ্রামের স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। কিন্তু তার একমাত্র মেয়ের ধর্ষিতা লাশ যেদিন ধানক্ষেতে পাওয়া যায়, লাশ দেখে পাগল হয়ে যান তিনি। মজিদ সাহেব থেকে হয়ে যান পাগলা মজিদ। অযত্নে অবহেলায় বাড়িটা হয়ে গেছে পরিত্যাক্ত। কিন্তু সেদিন হঠাৎ গ্রামের সবাই অবাক হয়ে দেখে, কোথাও বৃষ্টি হচ্ছেনা, অথচ সেই একখন্ড মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে ভেসে যাচ্ছে মজিদ পাগলার বাড়ির উঠান!