প্রতিক্রিয়াঃ
""ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আকবর উদ্দিন বলেন, 'এই রায়কে আমরা মর্যাদা দিচ্ছি। রায়টি খুঁটিয়ে পড়ার এবং রায়ের তাত্পর্য ঠিক কী, সেটা বোঝার প্রক্রিয়া এখনো চলছে।"
আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ গণকে রায়ের বিস্তারিত খুঁটিয়ে পড়ার এবং রায়ের তাত্পর্য অনুধাবন করার সময় না দিয়েই, গলাবাজি শুরু হয়ে গেসে। বিজয় মিছিল শুরু হয়ে গেসে দিকে দিকে। ভারত রায়ের কপি তাঁর বিশেষজ্ঞ দের দিয়ে মূল্যায়ন করছে, আমাদের এখানে কাউকে রায়ের কপি হস্তান্তর করা হয়েছে কিনা জানা যায় নি।
ব্যক্তিগত মূল্যায়নঃ
ভারতের সাথে মেরিটাইম সী বর্ডার মামলায় জয়ের সুস্পষ্ট ইন্ডিকেটর ছিল দক্ষিণ তালপট্রি। মানে হোল দক্ষিণ তালপট্রি পেলেই আমাদের জয়। তারপরেও বলব দক্ষিণ তালপট্রি এবং আশে পাশের অঞ্চল হারালেও, মন্দের ভালো এবং মোটামুটি মন্দের ভালো রায় এসেছে বলেই মনে করি। আনক্লস এর মূল নিয়ম মেনে, ২০০ নটিক্যাল মাইল এর বাধ্যতামূলক এলাকা ধর্তব্যে রেখে রায় দিয়েছে আদালত। ২০০ নটিক্যাল মাইল এর বাইরে ক্ষুদ্র অংশই এসেছে আমাদের ভাগে। এটা জয় বা পরাজয় নয়, বরং বৃহৎ রাষ্ট্রের আবদারের কাছে আমাদের যা পাবার কথা তার চেয়ে কম পেয়ে সেটা মেনে নিয়ে কিছুটা সন্তুষ্ট।
বঙ্গোপসাগর ও ভূমির মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রি বরাবর রেখা টানতে বাংলাদেশের দাবির বিপরীতে চার বিচারক ১৭৭ দশমিক ৫ ডিগ্রী বরাবর রেখা টানার সিদ্ধান্ত দেন। ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে আদালত বিরোধপূর্ণ (!) ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশকে প্রদান করেছে। (এখানে বলে রাখা ভালো এই মামলায় ভারত অযৌক্তিক দাবীর কারনে আইনগত দিক দিয়ে ব্যাকফুটে ছিল, কারন তারা ১৯৪৭ সালে রেডক্লিড প্রণীত সীমানা মানচিত্র না মেনে বাংলাদেশের ভিরতে এসে সীমা দাবী করেছে । বাংলাদেশের সীমা দাবী ন্যায় সঙ্গত, বাংলাদেশ কখনই ভারতীয় সীমায় কোন এলাকা দাবী করেনি)।
২০১২ সালের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১১টি পেয়েছিল বাংলাদেশ। আর ভারতের দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই কিছু অংশ হারিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে।
এই রায়ে সমুদ্রসীমানার মহিসোপান ও এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে ভারত তাদের বর্ধিত কর্তৃত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশের মহীসোপান এলাকা অনেক দীর্ঘ হওয়ায় পরেও এই সুবিধাটি বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে পায়নি। ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের মাথায় এটি সরু প্যাসেজ পেয়েছে। তাছাড়া এর ফলে ১, ৫, ৯, ১৮, ১৯ এবং ২৪ এই ব্লক সমূহের কিছু অংশ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেসে। হ্রাসক্রিত এই সব ব্লক সীমা পুনরায় নির্ধারণ করে, তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করতে হবে।
পিছনের কথাঃ
"বিগত শতকের শেষার্ধে বহুজাতিক পেট্রোলিয়াম কোম্পানীগুলো সমূদ্রে পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান শুরু করলে মূলত: আন্তর্জাতিক সমূদ্রে অর্থনৈতিক এলাকা নির্ধারণের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘ সমুদ্র কনভেনশন আইন (আনক্লস) প্রনীত হয়। ১৯৯৫ সালে ভারত এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে, মিয়ানমার স্বাক্ষর করে ১৯৯৬ সালে এবং বাংলাদেশ ২০০১ সালে।কনভেনশনের নিয়ম অনুসারে স্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যে একটি দেশকে তার ঘোষিত সমূদ্রসীমার দাবী উত্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে আবেদন করে এই সময় আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করার বিধানও রয়েছে। ভারত এবং মিয়ানমার ২০০৮ সালে তাদের সমূদ্রসীমা আনক্লসে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশ করে অক্টোবর ৮, ২০০৯ এ"
"এই আইন অনুযায়ী একটি দেশ তার বেজলাইন হতে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমূদ্রসীমা এবং আরো ১৮৮ নটিক্যাল মাইলসহ মোট ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সমূদ্রসীমা হিসেবে ঘোষনা করতে পারবে। মহীসোপানের আরো ১৫০ নটিক্যাল মাইল যোগ করে (২০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহীসোপান) সম্প্রসারিত অর্থনৈতিক সমূদ্রসীমা সর্বোচ্য ৩৫০ নটিক্যাল মাইল এর বেশি হবে না। বাংলাদেশের মহীসোপান এলাকা অনেক দীর্ঘ হওয়ায় এই সুবিধাটি বাংলাদেশের পাবার কথা।"
আন্তর্জাতিক আদালত সমতা এবং ন্যায্যতা ভিত্তিক সমুদ্র সীমা নির্ধারণে কাজ করে। একটি রাষ্ট্রই শুধু এর বাদী বিবাদী হতে পারেন।
প্রস্তুতিঃ
নিমজ্জিত দক্ষিণ তালপট্রি দ্বীপ এর অস্তিত্ব চাক্ষুষ থাকলে মামলা লড়ার ধরন ভিন্ন হোত বৈকি! হাঁড়িয়া ভাঙ্গা নদীর পানি্র মধ্য প্রবাহে সীমানা নির্ধারণ, নদীর পলি পতন জনিত চর হিসেবে দক্ষিণ তালপট্রি কে দেখানে যেত যা নদীর মধ্য প্রবাহের বামে, সুতরাং বাংলাদেশের দাবীনামার সাথে সামাঞ্জস্য পূর্ণ। রায়মঙ্গল নদীর মধ্য প্রবাহের ডানে (ভারতের দিকে) দেখিয়ে ভারত দক্ষিণ তালপট্রি হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ভারতের সীমানা রায়মঙ্গল নদী নয়, বরং ১৯৪৭ এর রেডক্লিফ ম্যাপ অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা র মধ্য প্রবাহ। ভারতের মিথ্যা দাবীর (হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মুখ থেকে আন্দামান-নিকোবর পর্যন্ত সরল রেখা) বিপরীতে যুক্তি উপস্থাপন করার জন্য পর্যাপ্ত সার্ভে উপাত্ত ছিল না, হাড়িয়াভাঙ্গা র নদি প্রবাহ ভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন ছিল না এবং সেই মানের প্রিপারেশন ও নেয়া ছিল না কোন সরকারের এবং সার্ভে বিভাগের। কয়েকজন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নদী গবেষক / বিজ্ঞানী কে ল স্যুট এ অন্তর্ভুক্ত দরকার ছিল এবং নিউট্রালিটির জন্য ভারতের বাইরে অন্য দেশের ল ফার্ম কে নিয়োগ দেয়ার উচিত ছিল। একজন রাজনিতিক টিম কে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা স্ট্র্যাটিজিক্যাল ভুল ছিল।
১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর তালপট্রি দ্বীপটি জেগেছিল। ১৯৮৫ সালে উড়িরচরে যে ঝড় হয়, তার পর থেকে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি আর নেই। ২০০৯ এ আদালতে যাবার পর ২০১০ এ একটি মানচিত্র করে চরটি দেখানোর চেষ্টা করেছি আমরা যা গ্রহণযোগ্য হয় নি। ১৯৭০ থেকে ২০১০, ৪০ বৎসর লেগেছে আমাদের একটি মান সম্পন্ন সার্ভে করে মানচিত্র আপডেট করতে। কি অসম্ভভ রকম অক্ষম জাতি আমরা!
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুরাতন নির্ভর জোগ্য আন্তর্জাতিক সার্ভে সংগ্রহ, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং নিজস্ব সার্ভে না থাকা, সব মিলিয়ে চরটির পক্ষে উপাত্ত উপস্থাপন এ প্রস্তুতি কম থাকায় বিষয়টা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আবার যেহেতু, ২০১০ সালের আগে বাংলাদেশের নিজস্ব কোন অফিশিয়াল মানচিত্রে তালপট্রি দ্বীপ এর অস্তিত্বকে জানান দেয়া হয়নি, আদালতে বাংলাদেশের মানচিত্র গ্রহণ না করার কারন সঙ্গতই। বরং ভারতের ছিল তালপট্রি দ্বীপ ভিত্তিক সার্ভে সংক্রান্ত তথ্য প্রমান। এই ব্যর্থতা স্বাধীনতার পরের সকল সরকারের। এখানে অন্য সরকার বাদী হলেও একই সমস্যায় পড়তো। মোট কথা তালপট্রি দ্বীপ নিয়ে আমাদের কোন নদি এবং নদি প্রবাহ ভিত্তিক গবেষণা, টেকনলজি বেইজড রিপোর্ট , সার্ভে ব্যাকড উপাত্ত , আন্তর্জাতিক ম্যাপ, স্যাটেলাইট ইমেজ কিংবা সামরিক স্ট্র্যাটেজিক দলিল ছিল না, এটা একটা দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তার নিদারুন অবহেলা কে লজ্জা জনক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
(এই অংশ আপডেটেড)
সামনের দিন, আমাদের আশাঃ
সাগরের বিতর্কিত অঞ্চলে তেল বা গ্যাস অনুসন্ধানে বড় কোম্পানি সমূহ রাজি থাকে না। সেক্ষেত্রে এই রায়ের মাধ্যমে বহু পুরোনো একটি দ্বিপক্ষীয় বিরোধের নিষ্পত্তি হলো যা বাণিজ্যিক তত্পরতার পথ প্রশস্ত করবে। সালিশ ট্রাইব্যুনালের রায়ের ফলে গভীর সমুদ্রে ৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় অবাধে মাছ ধরতে পারবে বাংলাদেশিরা। পাশাপাশি হাড়িয়াভাঙ্গা নদী থেকে শুরু করে রায়মঙ্গল নদীতে বাংলাদেশি জাহাজ চলাচল করতে পারবে। ৭০ এর দশকের পর বাংলাদেশী এনফোর্স এসব অঞ্চলে অবরুদ্ধ থাকত এবং জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি পড়ত ভারতীয় নেভীর অন্যায় আচরনে। এখন রায় অনুযায়ী দ্রুত নৌবাহিনীকে কাজ করতে হবে। মৎস্য আহরণ, জাহাজ চলাচল এবং তেল গ্যাস উত্তোলন এর সুফল বাংলাদেশ যথাশীগ্র যথাসম্ভভ দ্রুত কার্যকর করার উদ্যোগ নিবে এটাই কামনা।
ভয়ঃ
বাংলাদেশ তেল গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে নিজের সামর্থ্য বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দেয়নি, কোন কালেই। এক্সপ্লোরেশন কোম্পানির ঘুষ এই অনিচ্ছা কে প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, লুটপাটকারি অপ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বিদেশি গোলামি পনা মানুষিকতা সম্পন্ন দেশে এই অভিযোগ বাস্তবতার কাছাকাছি।
সুতরাং পেট্রো বাংলা / বাপেক্স এর অনুসন্ধান এবং উত্তোলন সক্ষমতা কে পছনে ফেলে ছোট হয়ে যাওয়া এই মীমাংসিত ব্লক সমূহের( ১, ৫, ৯, ১৮, ১৯ এবং ২৪) ইজারা যদি আবারো নিন্ম মানের চুক্তিতে কনোক ফিলিফস কিংবা ভারতের ও এন জি সি কে দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় আদতে বাংলাদেশের জন্য লাভের কিছু বয়ে আনবে না।
সম্পদ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আসুক আমাদের, এই কামনায়।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৭