৫৭তম দেশ হিসেবে ৩ হাজার কোটি টাকায় কেনা স্যাটেলাইটের গর্বিত মালিক হচ্ছে বাংলাদেশ।
১। প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৯০২ কোটি টাকা। ১৫৪৪ কোটি টাকা জনগনের ট্যাক্সের, বাকি ১৩৫৮ কোটি টাকা বিডার্স ফিনান্সিং এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে (মূলত এইচএসবিসি'র লোন)। যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান 'স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল' পরামর্শক, এতে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব স্পেস কমিউনিকেশনের অরবিটল স্লট ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারে কেনা হয়।
তবে প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য দেশ এর চেয়ে অর্ধেক কম দামেই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে (ছোট স্যাটলাইটের ডিজাইন ম্যানুফ্যাকচারিং উৎক্ষেপণের কষ্ট গুলো স্টান্ডার্ড, মোট আনুমানিক ১২০ মিলিয়ন ডলার, বিপরীতে বাংলদেশের ২৮৩ মিলিয়ন ডলার লেগেছে )।
এখানে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার, যার ২০টি দেশীয় ব্যবহারের জন্য রেখে বাকি ২০টি বিদেশে বিক্রি করা হবে বলে যানা গেছে। এই স্যাটেলাইট অপারেশন, মার্কেটিং, রেগুলেটরি ইত্যাদি কাজ করার জন্য সরকার একটা পাবলিক লি: কোম্পানী করেছে।
২। ২০ টা ট্রান্সপন্ডার দ্রুত বিক্রি হয়ে গেলে ৭/৮ বছরেই টাকা উঠে আসার কথা। ১৫ বছরের লাইফ সাইকেলের অর্ধেকে ব্রেক ইভেনে গিয়ে পরবর্তি ৬-৭ বছরে প্রভিট মেইকিং স্ট্রাটেজি নিতে হবে। শুরুতেই খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বিজনেইজ কেইস ঝুকিপুর্ণ হয়েছে। তবে বিক্রির জন্য চাই সঠিক ও যোগ্য আন্তর্জাতিক মার্কেটিং কোম্পানি। এখানে বিদেশী এজেন্সি নিয়োগ করা লাগবে। এই ফিল্ডে যেহেতু বাংলাদেশের একেবারেই অভিজ্ঞতা নাই তাই কিছু সময় বিদেশী এজেন্সি লাগবে কিন্তু কথা হচ্ছে একটি নির্দিস্ট সময়ের মধ্যে দ্রুত নিজেদের মার্কেটিং টিম ডেভেলোপ করতে হবে। অর্থাৎ মার্কেটিং এজেন্সির কন্ট্রাক্টেও যৌথ প্রয়াস রাখা চাই যাতে মার্কেইং মেথড, টুল এবং কমিউনিকেশন চ্যানেল সম্পর্কে লোকালরা সম্যক অবগত হয়ে দ্রুত ডেভেলপ করে ফেলেন।
তদুপরি বাংলাদেশের পক্ষে সাউথ এশিয়ান বাজার পাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে, যদি না তারা এক্সট্রিম্লি লো রেইটে বা লার্জ ডিস্কাউট অফারে কাউকে ম্যানেইজ করতে পারে। কারণ এই স্যাটেলাইটের কাভারেইজ এই অঞ্চলে অপটিমাম না। কাভারেইজ
অপটিমাম হোল ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইন এই এলাকায় আবার ঐ এলাকায় "এশিয়া স্যাট-৯" কমার্শিয়াল অপারেশন করছে। ফলে খুব সহজ হবে না বিদেশী কাস্টমার খুঁজে আনা। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রেইট থেকে ডিস্কাউট দিয়ে হলেও ফার ইস্ট এলাকার কাস্টমার খুঁজতে হবে।
৩। এখন দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচারে আছে যারা চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে একটি চ্যানেলের ভাড়া বাবদ গুনতে হয় তিন থেকে ছয় হাজার মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে এই স্যাটেলাইট ভাড়া কিছু কমতে পারে। কিন্তু এই জন্য দেশীয় কাস্টমার মাইগ্রেইট করা দরকার দ্রুত। আবার যেহেতু স্যাটেলাইটের অপটিমাম কভারেইজে বাংলাদেশই নেই তাই দেশীয় টিভি ও অন্য সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান এটি কারিগরি কারণে নাও ব্যবহার করতে পারেন। (১১৯.২ পুর্ব, যা ১০২ পুর্ব হলে বা এর কিছু কম হলে এই এলাকার জন্য ভালো হত)। অন্যদিকে চাইলে যখন তখন দেশীয় কাস্টমারদের ( টিভি ব্রডকাস্টিং, ভিস্যাট, ডিটিএইচ) মাইগ্রেইট করা যাবে না, কেননা তারা বিদেশী পার্টনারদের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিতে আবদ্ধ। তবে ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) এর নতুন বিজনেইস দাঁড়াবে।
সব মিলে দ্রুত কিভাবে বিদেশী কাস্টমার পাওয়া যায় তার দুর্নীতি হীন সঠিক চেষ্টা থাকতে হবে।
৪। ৩০ জন টেকনিক্যাল এক্সপার্টকে স্যাটেলাইট অপারেট করার জন্য ফ্রান্স থেকে ট্রেনিং দিয়ে আনা হয়েছে। সেটা একটা সঠিক পদক্ষেপ। তবে ট্রান্সপন্ডার ও তরঙ্গ (ফ্রিকুয়েন্সি) বিক্রি না হলে এই রিসোর্স নষ্ট হবে।
উল্লেখ্য, কয়েকটি বিষয়ে উপর নজর দিতে হবে!
ক। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে ইন্দোনেশিয়া ফিলিপাইনে সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটির সেবা দেওয়া যাবে কারন এই স্যাটেলাইটের অরবিটাল পজিশন অনুযায়ী ওই দেশগুলা সুপার কোয়ালিটির সিগনাল পাবে। কেন এই বেস্ট সার্ভিং তালিকায় বাংলাদেশ নেই, তা নিয়ে উত্তর খুঁজতে হবে, বৈকি!
তবে হতে পারে,
অর্বিটাল স্লট অকুপাইড হয়ে গেছে, কেননা বাংলাদেশ এই ব্যবসায় ৫৭ তম! সময়ের কাজ সময়ে করার বোধ ও দুরদর্শিতা না থাকলে বাংলাদেশকে এভাবেই সর্বত্র পিছিয়ে পড়তে হবে।
খ। বেক্সিমকো এবং বায়ার মিডিয়া/সামিটের মত দেশীয় কোম্পানি ট্রান্সপন্ডারের ফ্রিকুয়েন্সি কিনবে বলেছে। তারা বেশ উচ্ছ্বসিত। এক্ষেত্রে নজর দিতে হবে যাতে তারা যেন কোন ধরণের অনৈতিক সুবিধা না পায়। অর্থাৎ দলীয় ব্যবসায়ীরা যাতে জনগণের ট্যাক্স ও বৈদেশিক ঋণে নির্মিত প্রকল্পে অন্যদের চেয়ে সস্তায় বা বিনা টাকায় তরঙ্গ বরাদ্দ না পায়। সেবা ও তরঙ্গ বরাদ্দে দেশীয় ব্যবসায়ীদের সবার সমান এক্সসেস নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু এর আগেই, ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) লাইসেন্স (যেখানে নতুন বিজনেইসের সম্ভাবনা আছে) বিষয়ে ইতিমধ্যেই মহা দুর্নীতির আভাষ পাওয়া যাচ্ছে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বেক্সিমকো এবং বায়ার মিডিয়া ডিটিএইচ লাইসেন্স নাকি ভিতরে ভিতরে হাতিয়ে নেয়ার চুক্তি করে ফেলেছে। বিটিয়ারসি নয় বরং বেক্সিমকো এবং সামিটের এই দুই দুর্বিত্ত গ্রুপ থেকেই বাংলাদেশী টিভি ও অন্য সম্প্রচার কোম্পানী গুলোর স্যাটেলাইট সার্ভিস কিনতে হবে বলে খোদ বিটিয়ারসি এবং স্যাটেলাইট প্রজেক্টের মুখপাত্র নিশ্চিত করছেন। যদি এটাই সত্য হয় তাইলে এই গোপন লাইসেন্সিং চুক্তি বাতিল চাই। ঠিক কি দামে তারা লাইসেন্স নিয়েছে, কিভাবে লাইসেন্স অকশন হয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবী করি। ঠিক কি দামে কি পরিমাণ ব্যান্ডউইথ/ডিটিএইচ লাইসেন্স তাদের দেয়া হয়েছে, কিধরণের বিডীং হয়েছে তার সুস্পষ্টতা বের করতে আদালতকে সক্রিয়া হতে হবে। Click This Link
গ। বিদেশী মার্কেটিং এজেন্সি খোঁজা ও নিয়োগের নাম করে কমিশনের অর্থ হাতানোর যে কোন দুর্বিত্ত চেষ্টা থাকবে। এইসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। বিদেশী কাস্টমারের অভাবে এটি আরেকটি "দোয়াল ল্যাপটপ" টাইপ প্রকল্প না হয়ে উঠুক তার জন্য সবার দুর্নীতি মুক্ত চেষ্টা থাক চাই।
ঘ। ইউজ কেইস হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিকম ও ইন্টারনেট সেবার যে কথা বলা হচ্ছে তা ভ্যালিড না। স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কষ্ট এবং সময় দৈর্ঘ্য লোকাল টেলিকম সেবার অনুকুলে নয়। ফলে নন ভ্যালিড ইউজকেইসে যাতে সময় ও অর্থ নষ্ট না হয়। তবে ফার ইস্টের দেশ গুলোর সাথে ইন্টেলস্যাটের মাধ্যমে বর্তনামে যে আন্তঃ রাষ্ট্র ভয়েস আদান প্রদাণ হয় তাকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মাইগ্রেইট করা যায় কিনা সেটা বিজনেইস ইউজ কেইস দেখা যেতে পারে।
পরিশেষে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে সম্ভাব্য টেকনিক্যাল টিমের জন্য শুভকামনা। এই স্যাটেলাইট প্রকল্প সব দিক থেকে সফল হয়ে উঠুক।
ছবি, প্রথম আলো থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৫