somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রেফতারের পর নিজামী - শেষ পর্ব

২৯ শে মে, ২০০৮ রাত ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪


মনসুর কাকা অতীতে ফিরে গেলেন। অন্ধকারের মহাউৎসবে মইত্যার সাথী তিনিও ছিলেন! ভুল, ভীষণ বড় ভুল। ইসলামের নামে যে পাপ তিনি করেছিলেন সেদিন, তার প্রায়শ্চিত্ত তিনি আজো করছেন। নেতা ছিল মইত্যা। নেতার কথামত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করেছেন, ধরিয়ে দিয়েছেন। যেসব পরিবার থেকে যুবকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করতে গেছে, সেসব পরিবারের যুবতী মেয়েদের ধরে ধরে পাকিস্তানী মিলিটারী ক্যাম্পে দিয়ে এসেছেন। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিবাদ করেছিলেন। “শত্রু সম্পত্তি ভোগ করা ইসলাম সম্মত” এ কথা বলে তাকে বুঝ দেয়া হয়েছিল। মানুষ খুন, পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাতে নিজের দেশের মানুষ ভোগের জন্য তুলে দিতে হাত কাঁপলেও ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার কথা ভেবে চুপ থেকেছেন। ‘ইসলাম’ রক্ষায় নিরলস কাজ করে গেছেন। মইত্যার নির্দেশ পালন করেছেন। ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় প্রায়ই সুনিশ্চিত মনে হচ্ছে। করণীয় কি? আল-বদর নেতা মইত্যা সবাইরে ডেকে বলে – দেশের জ্ঞানপাপীদের একটা শিক্ষা দিতে হবে। তাদের ভয় দেখাতে হবে। মনসুর কাকা তখনো বুঝে উঠেন নি কি সেই শিক্ষা। মইত্যার দেয়া তালিকা অনুযায়ী বাসা থেকে জ্ঞানপাপীদের ধরে নিয়ে গেছেন। তারপর তাদের পরিণতি দেখেছেন। শিউরে উঠেছেন। প্রতিবাদ করেছিলেন। “পাকিস্তান রক্ষা করে ইসলামী ঝান্ডা তুলে ধরতে হলে শত্রুদের এইভাবেই শায়েস্তা করতে হবে” এই বলে তাকে বুঝ দেয়া হয়েছে, যদিও মনের মাঝে বরাবরই একটা খচখচ রয়েই যায়। যুদ্ধ শেষ হল। তার মত কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হল, রাঘব বোয়ালগুলো বেঁচে গেল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিল যে দল, সেই দল রাজাকার পার্টির সাথে আন্দোলনে গেল। যে দলটা একটা সেক্টর কমান্ডারের হাতে গড়া, সেই দল ক্ষমতায় এসে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে প্রেসিডেন্ট বানাল। হা হা হা হা... মনসুর কাকা আপন মনে হেসে উঠেন। কি বিচিত্র!

শুরুর দিকে জেলে এসে মনসুর কাকা করার মত তেমন কিছুই পান না। একসময় জেলখানার জরাজীর্ণ লাইব্রেরীটা তাঁর চোখে পড়ে। বই নেড়েচেড়ে দেখেন। অপরাধীদের সংশোধনের জন্য ধর্মীয় বই এর সংগ্রহ বেশি। তিনি সেসব পড়ে ফেলেন। তাঁর বই পড়াস আগ্রহ দেখে জেলার সাহেব তাঁকে নিজের কিছু ইসলামী বই পড়তে দেন। মনসুর কাকা গোগ্রাসে পড়ে ফেলেন একের পর এক চোখ খুলে দেয়া বই, এতদিনের চেনা ধর্মটাকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। অনুভব করেন - যে ধর্ম শান্তির কথা বলে, শত্রুর প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন যে ধর্মে, সে ধর্ম কিছুতেই ৭১ এর নির্যাতন, ত্রাস সৃষ্টি, হত্যা, ধর্ষণ অনুমোদন করতে পারে না। ইসলামের কথা বলে তার মত অসংখ্য মানুষকে ব্যবহার করা হয়েছে। অবশেষে মনসুর কাকা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। সেই থেকে তিনি আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। মাঝে মাঝেই তিনি ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, “সবাই আমারে মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও!” মসজিদে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সেজদায় পড়ে থাকেন। অঝোরে কাঁদেন। কারারক্ষীরা তাঁকে রুমে নিয়ে আসে। তিনি কাঁদতে থাকেন, কিছুতেই থামে না তাঁর কান্না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

সবুজ তখনো গান গেয়ে চলেছে –

যদি বুকটা চিড়ে দেখাতে পারি
কতটা হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছি!
কি যে আর্তনাদে একাকার আমি।
একলা স্মৃতির খোলা মাঠে, অন্ধকারের মহাউৎসবে
হারানো দীর্ঘসময়, খুঁজে বেড়াই আমি....
স্মৃতি! সময়! আর কিছু অন্ধকার, আরো ঘোর অন্ধকার।

মনসুর কাকা ডুকরে কেঁদে উঠেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন – “আমারে তোমরা সবাই মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও, মাফ কইরা দাও!” সবুজ তার গান থামিয়ে দেয়। সে অভ্যস্ত কাকার এ ব্যাপারটায়। তাই অবাক হয় না। কিন্তু নিজামী অবাক হয়। কৌতূহলী নিজামী মনসুর কাকার সামনে এসে দাঁড়ায়। আরো অবাক হয় – মনসুর কাকার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে দেখে।

- বিষয়টা কি? নিজামী প্রশ্ন করে।

মনসুর কাকা প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছেন নিজামীর দিকে। এই সেই লোক যে তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল, ইসলাম রক্ষার নামে অমোচনীয় পাপ করিয়ে নিয়েছিল। ইসলামের লেবাসধারী এইসব ভন্ডরাই ইসলামের প্রধান শত্রু, দেশের শত্রু।

ঘৃণায় মনসুর কাকার গা গুলিয়ে উঠে। তিনি আর পারছেন না। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা নিজামীর মুখে সমস্ত শক্তি নিয়ে একদলা থুথু মেরে চিৎকার করে বলে উঠেন – তুই রাজাকার!

চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত রাজাকারকে দেখে সহজ সরল ছেলে সবুজের চোখেও আগুন জ্বলে উঠে। সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিজামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘৃণাভরে নিজামীর মুখে ছুঁড়ে মারে একদলা থুথু!

মনসুর কাকার সাথে সবুজও বলে উঠল – তুই রাজাকার!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৮ রাত ১১:৫৮
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×