ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বড় কথা নয়, এই যে এত এত মানুষ আমায় সম্মান করে কংগ্রাট্স করছে এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল । ওটা ছিল একটা ইংলিশ ডিবেট প্রতিযোগিতা তাই অমন সমাদর জুটেছিল কপালে । কয়েকজন মেয়েও আমাকে বলেছিল, ভাইয়া, আপনার পারফরম্যান্স বেশ দেখার মত ছিল । এর মধ্যে অনেক বড় আপুও ছিল । অনেকের শিক্ষক প্লাস সহপাঠীও হয়ে গেলাম নিমিষেই । একদিন সন্ধ্যায়, আঁধার নেমেছে, রাস্তায় গাড়ির হর্ণগুলো উল্লাস শুরু করে দিয়েছে নীড়ে ফেরা যাত্রীগুলোকে টানতে টানতে টানতে । কোচিং এর ক্লাস থেকে বের হব এমন সময় একজন সমবয়সী অপরুপা মানবী সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল, কেমন আছেন ভাইয়া ? কিছুটা সংকোচের সাথেই বললাম ভালো আছি । এবার সে আরেকটু আগালো, সেদিন আপনার ডিবেট শুনলাম, অনেক ভালো বলেছেন কিন্তু । অনেক থ্যাংক্স ! এরপর কথা চালাচালি এবং সেও একসময় আবদার করলো যে তাকে ইংরেজী স্পোকেন শেখাতে হবে এবং কিছু মনে না করলে শুধু এই কারণেই আমার মোবাইল নাম্বারটি তার মোবাইলে ঠাই পাওয়া দরকার । দিলাম, কৃপণতা নাইবা করলাম এমন একটা রুচিশীলা আধুনিকতা সম্পন্ন মেয়ের সঙ্গে । প্রায় সপ্তাহ খানেক তার কোন যোগাযোগ নেই ; আর আমিও প্রায় ভুলতে বসেছি তার কথা এমন একদিন সন্ধ্যারাতে তার ফোন আসলো । শুরু হল স্পোকেন কোর্স ।
যা কিছু হল তা ধীরে ধীরে ইংরেজি ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা ভাষায় দিনকে দিন মধুর থেকে মধুরতর হতে লাগলো । কেননা, প্রথম প্রথম দু এক লাইন ইংলিশ বললেও কিছুক্ষণ পরে বলত, চলেন না অন্য কিছু গল্প করি । আমি এপাশ থেকে তখন উদ্ভ্রান্তের মত মাথা চুলকাই আর বলি, হুম । সারাদিন কী কী করেন ? ক্লাস করি, টিউশনি, সন্ধ্যায় আইইএল্টিএসে কোচিং... ইত্যাদি । কী কী করতে ভালোবাসেন ? আমি ক্রমাগত ভালো ভালো কথা সাজিয়ে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি । একদিন দুম করে বলে ফেলল, কোন মেয়েকে কি ভালোবাসেন ? তাতেই আমার প্রথম নেতিবাচক উত্তর এল – না, বাসিনা । আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, আপনি ? ওরে বাবা, আমি ? যদি কোনদিন কিছু করি আমার ভাইয়া আমাকে মেরেই ফেলবে । আমাদের পরিবার একটু বেশী রক্ষণশীল । উত্তরটা আমার কেমন জানি একটু গরমিল লাগলো । যে মেয়েটা চুল খোলা রেখে, জিন্স পরে, টপ্স গায়ে দিয়ে রোজ ছেলেদের সাথে ক্লাস করে, বাইরে ঘোরাফিরা করে তার পরিবার রক্ষণশীল – ধান্ধা লাগে আমার । কিন্তু মাঝে মাঝে আবার সালোয়ার কামিজে চমৎকার সুন্দরী সেজেও আসতো । কী অপূর্ব লাগতো তখন । একটা শুভ্র কোমল কাশফুল যেন সে তখন । তার কথার মত তার চাহনিতেও তখন রাজ্যের যাদু ভর করতো । একটু আহ্লাদি, আবার সময় সচেতন এবং দায়িত্বপরায়ন । দেখতাম , কোচিং এর অন্য ছেলেরা তার কাছে ভিড়ার চেষ্টা করতো, মোবাইল নাম্বার চাইতো । কৌশলে এড়িয়ে যেত । সকল ভালোর মধ্যেও এক্সট্রা আধুনিকতা আনার কাছে অসহ্যই লাগতো । সে কারণেই সে যখন বলল, আমরা কি ভালো বন্ধু হতে পারিনা ? আমি যেন একটু সাহস পেলাম । রুপসী কন্যা বন্ধু হয়ে থাকলেই ভালো, অন্য কিছু নয় ।
মাস খানেক পরে কোচিং এ ক্লাস শেষ করে দু জনে বাইরের একটা বেঞ্চিতে বসে গল্পে মত্ত । সে হঠাৎ মোবাইলটা বের করে বলল, আসুন, আমার গতবছরের জন্মদিনে ওঠানো কিছু ছবি আপনাকে দেখাই ।
দেখান না !
টাচ স্ক্রীনে প্রথম যে ছবিটা এল তা আমার হৃদয় , মন আর সত্তা সব ওলট-পালট করে দিল পলকের মধ্যেই । মুখটা সাদা গোলাপের মত, ঠোটে একটা লুকোচুরি স্বভাবের মন-জুড়ানো মুচকি হাসি তার । কয়েক গোছা চুল দু কানের পাশে এসে লম্বা লম্বা কানের দুলের সাথে আরো অন্যমাত্রার আলংকারিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে যেন । চিকন পাড়ের হালকা রঙের কারুকার্য-খচিত শাড়ি তার গায়ে জড়ানো । হাতে সোনালী, ম্যাজেন্ডা আর ছাই রঙা চুড়ি পরা, হাতের মুঠোয় দু চারটা রজনীগন্ধা আর চারটি লাল গোলাপ শোভা পাচ্ছে তার । যেন মনে হচ্ছে, গোলাপের হাতে শোভা পাচ্ছে আরও কিছু গোলাপ । পাশে রয়েছে সবুজ ধানক্ষেত । খোলা চুলে, শাড়িতে, চুড়িতে আর ভুবনজয়ী হাসিতে কোন বাঙালি মেয়ে এত অপরুপা হয়ে উঠতে পারে আমার কল্পনার একেবারেই বাইরে ছিল । যেন পরী, বেহেশত থেকে নেমে আসা হুরপরী । আমি হেঁয়ালিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, এরপরে আরো কিছুদিন । এরপর হঠাৎ একদিন ফোনে বললাম, তোমার সাথে আমার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় !
- কেন ?
- আমি আর তোমাকে বন্ধু ভাবতে পারছি না ! আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।
- কেন, কী দোষ করলাম আমি ?
- মাথাটাই যে নষ্ট করেছো আমার !
- কীভাবে ?
- ঐ যে শাড়ি পরে তোলা তোমার ঐ ছবি দেখিয়ে । আমি তোমাকে শাড়ি পরে জীবনভরই দেখতে চাই । এরপরে দুদিন অন্যরকম নাটক হয়েছিল । শেষমেশ উনি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে আর বলে, জ্বলজ্যান্ত মানুষটা সামনে থেকেও তুমি কিছুই বলোনি, আর শাড়ি পরা একটা ছবি দেখেই তুমি পুরা উথাল পাতাল ! আমি বলি হুম , তুমি অপ্সরা ! তবে সেটা সবচেয়ে বেশী শাড়িতে , খোলা চুলে আর চুড়িতে । আজও আমার ইচ্ছে হলেই বলি, এই, আজ শাড়ি পরো না ? কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় – সেই হুরপরী আমার সামনে রহস্যময়ী হাসি নিয়ে হাজির ! তারপর ? দুজনে বেহেশতে চলে যাই কিছু সময়ের জন্য !
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:০৭