যে পথ মাড়িয়ে আমি আমার নানা বাড়ি, ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম তা ছিল মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ । বেশ প্রশস্ত । উপজেলার উত্তর থেকে দক্ষিণের শেষ পর্যন্ত লম্বা । বাঁধের দু ধারে ঘন বসতি । নদী সিকস্তি নিঃস্ব মাটির মানুষের । এখন আর তেমন একটা মাটির মানুষ নেই । সবখানেই আবেগশূন্য প্রযুক্তি মানুষগুলোকে অন্যরকম বানিয়ে ফেলেছে । গ্রাম্য পুচকু ছেলেরা তখন নিজ বাড়ি হোক বা আত্মীয় বাড়ি হোক, সবখানেই হাফ-প্যান্ট পরেই যেত । হাটু পরিমাণ ধূলোর পথ মাড়িয়ে যেতে যেতে দু পা ধবধবে সাদা হয়ে যেত । লজ্জা আর সংকোচে আত্মীয়বাড়ির টিউবয়েলের পাড় আগে খুঁজে নিতে হত আমাদের । তো পুরো পথটা যেন ছিল একটা সাজানো উপন্যাস বা দীর্ঘ গল্প । পথের সমস্ত দৃশ্য আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল । কোন্ জায়গার পরে কোন্ জায়গা আসবে, কোন্ কোন্ জায়গায় সম্ভাব্য কোন্ কোন্ মানুষের দেখা পাব – এর সবকিছুই । এই পথে পথে পরিচিত প্রত্যেকটি মানুষ যেন একেকটা মহামায়ার জীবন চরিত্র । কত উথান পতন তাদের জীবনে, কত ছিন্ন ভিন্ন ঠাঁই, টেনে বেড়ানো এক অসহায় ইতিহাস তাদের – আমি মানুষটা তখন ছোট, কিন্তু সবকিছুই যেন ভাবতাম বৃদ্ধের মত । সবার কথা বলতে চাই না, শুধু একটি চরিত্রের গল্পই আজ বলা যেতে পারে ।
দেবডাঙ্গা নামের গ্রামটি এই পথের প্রায় মাঝামাঝি একটা জায়গায় । নদী থেকে একটা গ্রোয়েন বাঁধের রাস্তা এসে মিলে তিন মাথা হয়েছে । তিন মাথার তিনদিকে কিছু মুদির দোকান , চা স্টল, মোবাইলের দোকান । পাশে দু একটা মুড়ি চানাচুরওয়ালা বা জলপাইয়ের আচার বিক্রেতার ভিড় থাকতো । এর একটু পরেই শিমুল পাগলীকে দেখতে পেতাম । পাগলীর মাথায় জটা চুল, পরনে সালোয়ার কামিজ, হাতের নখে সবসময়ই নেল পালিশ মাখা, কিন্তু মুখে রুক্ষতা, শুষ্কতা আর উদাসীনতা ভর করে থাকত দিনভর । একদিন ফুফুর বাড়ি যাওয়ার পথে প্রথম দেখি পাগলীকে । দেখে অনেকটা ভয়ই পেয়ে যায় । কারণ তখন পর্যন্ত আমি জটা চুল পুরুষের মাথাতেই দেখেছি, কোন মেয়ে মানুষের নয় । ঐটুকু পথ দাদীর হাত শক্ত করে ধরে যেতাম পাগলীকে ভয় পেয়ে । দাদী অভয় দিত যে, ও কিছুই বলবে না, কিন্তু আমার মন তবুও সাহস পেতনা । সেই প্রথম দিনেই দাদীর মুখে পথ চলতে চলতে পাগলীর করুণ কাহিনী শুনতে পাই । খুব বনেদী আর শিক্ষিত বংশের মেয়ে সেই শিমুল পাগলী । ওর বাবা তখন ওখানকার নামকরা হাইস্কুলের মাস্টার । সম্ভবত ওর বংশের মধ্যে আর ঐ গ্রামের মধ্যে তখন ওর মত সুন্দরী মেয়ে আর ছিলনা । সুতরাং ছেলেরা যেমন ওকে নিয়ে সিনেমার নায়ক বনে যেতে চাইত, মেয়েরা হিংসায় হয়ে যেত ঘষেটি বেগম । কিন্তু ও ব্যবহারের দিক দিয়েও ছিল যেমন অমায়িক তেমন বাবা মার একদম বাধ্য সন্তান । ক্লাস নাইনে উঠতে না উঠতেই নিজ গ্রাম, পাশের গ্রাম, পাশের উপজেলার নানা প্রভাবশালী বংশের ছেলেদের সাথে ওর সম্বন্ধ আসতে থাকে । কিন্তু বাবা শিক্ষক হওয়াতে মেয়েকে পুরোপুরি শিক্ষিত না বানিয়ে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি তাই ভেস্তে যেতে থাকে । শিমুল পড়াশুনায়ও যথেষ্ট ভালো । বরাবরই ক্লাসে প্রথম হত ।
শিমুল চুলে বেণী গেঁথে স্কুল ড্রেস পড়ে রাস্তায় হাটলে ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগতো । হাসলে আরো বেশী সুন্দর লাগতো । ছেলেরা পিছু পিছু হাটতো । সিনেমার অনেক ডায়ালগ বলে, গান বলে মাতিয়ে রাখতো পুরোটা পথ । শিমুল তখন মাথা নিচু করে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলত । একসময় স্কুলে, বাড়িতে শিমুলের নামে অনেক চিঠি আসতে শুরু হল । চিঠির মধ্যে শিমুলের নামে প্রেম উথলিয়ে উঠতো, ভালোবাসায় সুগন্ধি ছড়াতো । কেউ আবার হাত কেটে তাজা রক্তেও চিঠি পাঠাত । শিমুল সব চিঠি ফেলে দিত, প্রেরকের নামগুলে দেখে নিত যাতে রাস্তায় চলার পথে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়া যায় । আয়নায় দাঁড়িয়ে শিমুল নিজেকে দেখে অবাক হত আর ভাবত, আমি কি এতই সুন্দর ! এই যে এত ছেলেরা যে পাগলামি করে আমার জন্য । তাহলে আমার রাজকুমারটা কোথায় ? যে রানী করে নিয়ে যাবে আমায় । খোঁপায় গেঁথে দিবে লাল গোলাপ । দোলনায় পাশে নিয়ে দোল খাবে, আমার মাথা থাকবে তার কাঁধে, চোখ দুটো পরম আনন্দে বন্ধ করে থাকবো আমি । হঠাৎ শিমুলের খেয়াল আসে । লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে । যাহ্ , কী যে আবোল তাবোল ভাবি আমি !
একদিন পাশের কোন এক গ্রামের এক সাধারণ ছেলে শিমুলকে রাস্তায় তার ভালোবাসার প্রস্তাব করে , খুব জোরালো প্রস্তাব । শিমুলকে ছেলেটি বলে
- ‘তুমি আমাকে ভালো না বাসলে আমি মরে যাব, শিমুল ।
- তাতে আমার কী করার আছে ? আমি বাবা মা’র অমতে কাউকেই ভালবাসতে পারবোনা ।
- দেখ শিমুল, তোমার বাবা মাকে আমি রাজি করাব, যদি তুমি রাজি থাক ।
- না, আগে বাবা মাকে রাজি করান ।
- শিমুল, আমি তোমাকে যতটা ভালবাসতে পারব, পৃথিবীর অন্য কেউ ততটা ভালবাসতে পারবেনা ।
- বুঝলাম, কিন্তু কিছুই করার নেই আমার । আমি আমার বাব মাকে এক বিন্দু পরিমাণও কষ্ট দিতে পারবো না ।
- শিমুল, তুমি আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা কর ।
- আপনিও আমাকে একবার বুঝার চেষ্টা করেন না ?
শিমুল জোরে জোরে পা ফেলে সেদিনের মত রক্ষা পায় । বাড়িতে এসে বাবার বুকে হুমড়ি খেয়ে পরে কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু খুলে বলে । বাবা খুব দুশ্চিন্তায় পড়েন । পরের দিন ছেলেটির বাড়িতে চলে যান । ছেলেকে , তার বাবা মাকে খুব ভালো করে বুঝান । এর পরেও ছেলেটি পথে তাকে বিরক্ত করতে শুরু করে ।
প্রায় সপ্তাহখানেক পরে একদিন গভীর রাত্রে কেউ একজন শিমুলের বাবার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে থাকে । চাচা, তাড়াতাড়ি বের হন, সর্বনাশ হয়ে গেল ! হুড়মুড় করে বাড়ির সবাই উঠে পরে । ঘরের বাইরে আসলে লোকটি বলে , চাচা , সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, শিমুল কোথায় ? সবাই শিমুলের ঘরে গিয়ে দেখে শিমুল নাই । সে, বলে শিমুলের মত কেউ একজন বাতাসের গতিতে নদীর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে । পরে আমাদের বাড়ির কয়েকজন ওর পিছে পিছে নদীর দিকে দৌড়ে গেছে আর আমি আসলাম আপনাকে খবর দিতে । নদী পাড়ের অনতিদূর থেকে শিমুলকে সে রাতেই উদ্ধার করা হয় জীবিত অবস্থায় । তবে এর পরে সে হয়ে যায় জীবন্মৃত ! কারো সাথে কথা বলত না, খেত না, চুলগুলো টেনে টেনে ছিড়ে ফেলতে চাইত । বাড়িতে থাকত না, রাস্তায় উঠে এসে এদিক সেদিক হাটতো । একসময় মুখটা হালকা বিকৃত হয়ে যায় ওর , চুলে ধরে যায় জট । পরে শোনা যায় এক কবিরাজের মুখে, ওকে কেউ একজন শয়তানী জাদুটোনা বা ব্ল্যাক ম্যাজিক করেছে ! আমার পক্ষে এটা ভালো করা সম্ভব নয় । পরে আর কোন কবিরাজই পারেনি । শিমুল পাগলী আজও তাই রাস্তায় হাটে আর বলে, রাজকুমার, তুমি আসবে না ? খোঁপায় আমার গোলাপ গুঁজে দিবে না ? বাসবে না ভালো আমায় ? আমি আছি তোমারই অপেক্ষায় !