০১.০১.১৪২১ বঙ্গাব্দ ।
আমি গনী মিয়া । বাংলা ১৩৫২ সালে জন্ম যমুনার পাড়ের এক অজপাড়াগাঁয়ে । কাঁচা আর ভেজা মাটির গন্ধে শ্বাস প্রশ্বাসের যোগান ছিল বেশ খাটি, নির্মল আর প্রাণবন্ত ।সেই গন্ধমাখা বায়ুতে এই শরীর হয়েছে কালের যাত্রায় হৃষ্টপুষ্ট । মা, মাটি, নদী, জল সবারই আদুরে ছেলে ছিলাম আমাদের মত গেঁয়ো বালকেরা । উচ্ছ্বাসভরা আমাদের সে জীবন এখন যেন বেশ দুস্প্রাপ্য । জীবন এখন জটিলতার ঘুর্ণিস্রোতে আটকা পড়ে আছে । কেমন জানি নিষ্প্রাণ, নিরানন্দ, আর অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকা । বেশ ক’দিন হল আমার শরীরটা বেজায় দুর্বল লাগছে । আজ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন । আমার ছেলেটা তার স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে গেছে ঘুরতে । সাথে যায়নি তার সাত বছরের ছেলে আন্দালিব । খুব একটা বয়স হয়নি ওর । কিন্তু বেশ চটপটে, যেন আমি সেই সাত বছরের গনি মিয়া । ওর বন্ধুরা বলেছিল, সবাই অনেক আনন্দ করবে, তুই যাবি না? না, যাবনা । আমি দাদুর সাথে গল্প করব ! এ সময়ে যেমন পালকিতে কনের শ্বশুর বাড়ি গমন অকল্পনীয়, ঠিক তেমনি এ রকম একটা দিনে দাদুর পাশে তার নাতির সহাবস্থান, শুধু গল্প শুনার জন্য । বউমাকে দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল । কী বিস্তর তফাৎ ! শাড়ী পরলেও বউমার চেহারায় কেন জানি মেকি মেকি ভাব উঁকি দেয় । যেন এ শাড়ী আর এ মানুষ দু’জন বড্ড বিপরীত । বউমারা সারা বছর কী সব জামা কাপড় পড়ে, এ যুগে নাকি আগেকার ওসব চলেনা । আন্দালিব বলে “ ঐ সবের বেল নাই’’ । ‘বেল্ট’ শব্দটার নাম শুনেছি, কিন্তু ‘বেল’ তো শুনিনি । পরে অবশ্য ও বলেছিল ‘টাইম নাই’ ।
০৫.০৩.১৪২১ বঙ্গাব্দ ।
প্রায় মাস তিনেক পার হয়ে গেছে । শরীরটা বড্ড বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে । আজকাল বুঝি মানুষ মিথ্যেকে মিথ্যেই মনে করে না । বাজারে গিয়েছিলাম, ওষুধ কিনতে । কতবার বললাম কাগজে ডাক্তার যে নাম লিখেছে, ঐ কোম্পানিরটাই দিয়েন । তবুও অন্য কোম্পানিরটা দিয়েছে । কী যে করি, ছেলেটা আজকাল অফিস নিয়ে এত ব্যস্ত যে ফেরার সময় নাকি আমার ওষুধ নিতে ভুলে যায় । মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখি- কত ভেজাল ওষুধ খেয়ে কতজন মরে যাচ্ছে, আর আমি তো অচল পয়সা । ভেজালের ব্যবসা করেই মানুষ আজকাল কত টাকার মালিক বনে যাচ্ছে রাতারাতি । ঐ যে সামনের কলোনীর ডাবলু ডাকাত । আজ পাঁচতলা বাড়ির মালিক । ওরে যখন প্রথম দেখি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকত । পরে নাকি মদেরই ব্যবসা শুরু করেছিল । তারপর আরও কত কী, আজকাল শুনি ‘ইয়াবা’ ট্যাবলেট । দু’ টাকার ডাবলু পরে নাম নিল দবিবর চৌধুরী । এখন কোটি কোটি টাকার মালিক । সেই সাথে পৌরসভার মেয়র । এর পরে হয়তো একদিন এম. পি হবে, তারপর মন্ত্রী । ওর জন্য মনে হয় ওর মায়ে অনেক দোয়া করে গেছিল, অনেক টাকার আর খ্যাতির মালিক হওয়ার জন্য, কিন্তু ‘সৎ পথে’ এইটুকু মনে হয় দোয়ায় তার মা উল্লেখ করেনি ।
০৪.০৫.১৪২১ বঙ্গাব্দঃ
অনেক দিন পরে আজ একটু বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম ।তরুণ সকালের এই সময়টাতে প্রতিদিন নদীর পাড়ে হেটে আসতাম ফজরের নামাজ পরে । কি সুন্দর খোলা মিষ্টি বাতাস ! আর এই শহুরে রাস্তায় কী বিকট গন্ধ আসে ডাস্টবিনগুলো থেকে । তার পাশেই আবার কত বাস্তুহারা শিশু, পাগল, অসহায় মানুষ নামক দু’পায়া প্রাণী গায়ে ছেড়া বস্তা গায়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে । যেন নরকের মধ্যে বেহেশ্তী স্বপ্ন দেখছে , পেটে ক্ষুধা আর গায়ে মানুষের লাথির চিহ্ন নিয়ে । বেশীক্ষণ টিকতে পারলাম না । চলে আসলাম বাসায়, বাড়িতে নয় । বাড়ি তো আমার গাঁয়ে । গাঁয়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা কেমন হু হু করে উঠে ।
১৮.০৬.১৪২১ বঙ্গাব্দঃ
মানুষের মাঝে দয়া মায়া, সম্মান, ভক্তি, নীতি, আদর্শ, সততা সব যেন বিলুপ্ত প্রায় । আজকাল এত মানুষ খুন হয় কেন । যেখানে সেখানে মানুষ খুন । স্বামী স্ত্রীর খুন কত বাজে। পরনারী বা পরপুরুষে আসক্ত হয়ে ফেরেশতা সমতুল্য নিজের ফুটফুটে বাচ্চাকে মেরে ফেলছে স্বামী বা স্ত্রী । কখনও সেই সাথে একে অন্যকেও। সামান্য টাকার লোভে হাসপাতাল থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছে অন্যের সন্তানকে । প্রতিদিন পাঁচটা পত্রিকায় অন্তত পৃথক পৃথকভাবে একটি খুনের সংবাদ তো থাকেই । তাহলে বছরে এক হাজার আটশ মানুষ খুন হয় । ইশ! চিন্তা করা যায় । ক্ষমতার জন্য একজন আরেকজনকে, একদল আরেকদলকে নির্বিচারে হত্যা করে । যেন এসব ডাল ভাত । রাতের বেলায় পুরো পরিবার খুন হয় নিজ বাড়িতে । সবাই জানে পরের দিন সকালে, এমনকি পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরাও । কত অপরিচিত লাশ পরিচিত নদীতে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় ।
০২.০৭.১৪২১ বঙ্গাব্দঃ
অন্যায় যেন আজ সংক্রামক । সর্বত্র শুধু অন্যায়েরই জয়জয়কার ! মেধার জায়গায় টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে অন্যায় জেতে । সুবিচারের জায়গায় একইভাবে অন্যায় জেতে । সততার গালে থাপ্পর মেরেও অন্যায় জেতে । অন্যায়, অবিচার,নিকেশ কালো আঁধার, হিংস্রতা, উন্মত্ততা , লোভাতুর জিভ, কালচে সাপের ছোবল অনেক বেশী শক্তিশালী । (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:০৪