somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদেশি বন্ধুর চোখে কর্নেল তাহের

২১ শে জুলাই, ২০১০ রাত ৩:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্মরণ
বিদেশি বন্ধুর চোখে কর্নেল তাহের

কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদিন আজ। ১৯৭৬ সালের এই দিনে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
নেদারল্যান্ডের সাংবাদিক পিটার কাস্টার্স সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। পেশাগত কারণেই তাহেরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। ৭ই নভেম্বরের ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেকেই লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশি সাংবাদিকেরাও আছেন। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ তাঁর আনফিনিশড রেভ্যুলেশন বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ পরিবর্তনে তাহেরের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। পিটার কাস্টার্স ছিলেন তাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাহেরকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি।
বাংলাদেশের সমাজবদলের কর্মীদের প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে হতাশা আর আশাভঙ্গের বেদনা ফুটে ওঠে পিটার কাস্টার্সের চোখেমুখে। নতুন স্বাধীন হওয়া দেশ বাংলাদেশে সাংবাদিকতা সূত্রে এসে অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। সবার মধ্য থেকে কর্নেল তাহেরকে তাঁর আলাদা মনে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সময় বাংলাদেশি বন্ধুদের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধে এক পা হারানো এই কর্নেলের বীরত্বের গল্প অনেক শুনেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে আসার পর তাহেরের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ খুঁজছিলেন পিটার। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কোনো একদিন কর্নেল তাহের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পায়ের চিকিৎসা নিতে এসেছেন শুনে তাঁকে দেখতে ছুটে যান তিনি। হাসপাতালে বসেই তাহেরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় পিটারের। বাংলাদেশের সমাজবদলের পথ কী হবে, সমাজ কোন স্তরে আছে, কী ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন—এসব বিষয় নিয়ে সমাজবদলের দুই তরুণ কর্মীর মধ্যে চলে তর্কবিতর্ক।
পিটার আগে থেকেই জানতেন কর্নেল তাহেরের নানা তৎপরতা সম্পর্কে। কুমিল্লা সেনানিবাসের দায়িত্বে থেকে কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীকে উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাহেরকে নদী খননবিষয়ক কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হলো।
তাহের মনে করতেন, বাংলাদেশের সমাজবদলের কাজ শহর থেকে শুরু করতে হবে। পিটারের মত ছিল, গ্রামের মানুষের মধ্যে জাগরণ নিয়ে আসতে হবে। এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন ব্রাজিলের সমাজবদলের তাত্ত্বিক পাওলো ফ্রেইরির কাছ থেকে। তাহের তাঁর মতাদর্শ অনুযায়ী সমাজবদলের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে। পিটার গ্রামের মানুষকে জাগরণের শিক্ষা দিতে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করলেন। একই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য দুজন দুই পথে হাঁটা দিলেও তাঁদের বন্ধুত্বে কোনো চিড় ধরেনি।
সাংবাদিকতার সূত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ থাকায় ১৯৭৫-এর আগস্টের শুরুতেই পিটার টের পাচ্ছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। সরকারের ভেতরে অসন্তোষ রয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর একটি অংশ দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। এই সংবাদগুলো পিটার জানতেন। ১৫ আগস্ট সকালে কর্নেল তাহেরের ভাই আবু ইউসুফের সঙ্গে পিটারের দেখা হলে তিনি তাঁকে শাহবাগের রেডিও স্টেশনে নিয়ে গেলেন। তখন গণমাধ্যম তেমন বিকশিত হয়নি। ক্ষমতা দখলের প্রধান পূর্বশর্ত ছিল রেডিও স্টেশন দখল করে সেখান থেকে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেওয়া।
রেডিও স্টেশনে গিয়ে পিটার দেখতে পান, কর্নেল তাহের উত্তেজিত ভঙ্গিতে খন্দকার মোশতাককে কী যেন বলছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছিল। এরপর তাহের রেডিও স্টেশন ছেড়ে চলে আসেন। ১৫ আগস্টের পর কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা হয়েছিল। তাহের যে আরেকটি বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা ভাবছেন তা বোঝা যাচ্ছিল। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে ঢাকা গুজবের শহরে পরিণত হলো। পুরো দেশের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই তা বোঝা যাচ্ছিল। ১ নভেম্বর শোনা গেল, আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসছে। বিমানবাহিনী ঢাকার ওপর বিমান চালিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।
‘২ নভেম্বর ভোরে মিরপুর রোডের বাসা থেকে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি হাজার হাজার সৈনিক খোলা ট্রাক ও জিপে করে রাস্থায় গুলি ছুড়তে ছুুড়তে সারি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রাস্তায় জাসদের কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেছে।’ বললেন পিটার। এ সময় পিটারের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের দেখা হয়।
৭ নভেম্বরের পটপরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে পিটার বললেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় বোঝা গেল, জাসদ যেভাবে পরিবর্তনের কথা ভাবছে, বিষয়টা অত সহজ নয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী অবস্থা থেকে তাহেরের নেতৃত্বে মুক্ত করার পর দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করল। তিনি একটি জিপগাড়িতে করে ঢাকা শহর চক্কর দিচ্ছেন। পিটারকে দেখে বললেন, বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে আসেন। বড় সমাবেশ হবে। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানও সেখানে বক্তৃতা করবেন। এর আগে রেডিওতে সৈনিক বিদ্রোহের ঘোষণা দেওয়া হলো। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় জাসদের কর্মীরা মিছিল করছেন। ঢাকার বাইরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ আসছিল। জিয়া রেসকোর্স ময়দানে গেলেন না। রেসকোর্সে কোনো সমাবেশও হলো না। জিয়া দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। ধীরে ধীরে ক্ষমতা নিজের আওতায় নিতে শুরু করলেন তিনি। বোঝা গেল, ক্ষমতার লড়াইয়ে তাহের হেরে যাচ্ছেন। এ ধরনের পরিবর্তনের সময় যে ধরনের জনসমর্থন ও বিক্ষোভ হওয়া প্রয়োজন ছিল, জাসদ তা অর্জন করতে পারল না। কর্নেল তাহেরও গ্রেপ্তার হলেন।
পঁচাত্তরের ৮ ডিসেম্বর এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পিটারকে গ্রেপ্তার করেন। জেলখানায় নিয়ে আমদানি সেলে নেওয়ার পর সেখানে সপ্তাহখানেক কাটে। সেখান থেকে নিরাপত্তা সেলে নেওয়া হলো। আগস্টে পিটারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হলো। বলা হলো, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই তরুণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ২১ জুলাই পিটার জেলে বসেই জানতে পারেন কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সেই রাতে পিটার ঘুমাতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছে, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে সমাজবদলের একজন কর্মীকে হারাল।


ইফতেখার মাহমুদ | তারিখ: ২১-০৭-২০১০

১.http://prothom-alo.com/detail/date/2010-07-21/news/80304

২. Click This Link
-------------------------------

পিটার কাস্টার্স বাংলাদেশ বন্ধু
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১০ ভোর ৪:১৫
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×