somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ মুজিবুর রহমান : বন্দি থেকে বাদশা / টাইম সাময়িকী ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২

১৫ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'আপনারা কি মুজিবের মুক্তি চান?' করাচিতে লক্ষাধিক সমর্থকের এক সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রশ্নটি ছুড়ে দেন। জনতা ভুট্টোর জোরালো বক্তব্যকে সচরাচর যেভাবে সমর্থন জানায়, একইভাবে তারা গগনবিদারী স্লোগানের মাধ্যমে এতে সম্মতি জানাল। তখন মাথা নাড়িয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন : 'আপনারা আমার মাথা থেকে বিরাট একটা বোঝা নামিয়ে দিলেন।' গত সপ্তাহে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির
সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে ঘোষণার আগে তিনি এই একই কথা টাইমসের সাংবাদিক ড্যান কগিনের কাছে বলেছিলেন। এর পাঁচ দিন পর, ভুট্টো তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পাকিস্তানের একটি চার্টার্ড বিমানে মুজিবের লন্ডনের উদ্দেশে পাকিস্তান ত্যাগের আগে ভুট্টো তাকে দেখতে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে যান। অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে মুজিবকে বহনকারী বিমানটি পাকিস্তান সময় ভোর ৩টায় ইসলামাবাদ বিমানবন্দর ত্যাগ করে। মুজিবের এই পাকিস্তান ত্যাগের খবরটি প্রায় ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের জন্য ছয় ঘণ্টার এক সফরে ইরানের শাহ একই বিমানবন্দরে এসে নামার আগ দিয়ে মুজিবের পাকিস্তান ত্যাগের খবরটি প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে মুজিব লন্ডন গিয়ে পেঁৗছেন। তাকে সে সময় ক্লান্ত, তবে সুস্থ দেখাচ্ছিল। মুজিব তার কাঠের তৈরি তামাক সেবনের পাইপ থেকে হালকা মেজাজে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে ওঠেন, আপনারা তো দেখছেন আমি এখনও বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি। তবে এখন আমি দেখছি মাত্র, কিন্তু শোনা হয়নি।
নয়াদিলি্লতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ঢাকায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর মুজিব ক্লারিজ হোটেলের বলরুমে সংবাদ সম্মেলন করেন। হোটেলের বাইরে তখন বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল বাঙালিদের মুহুর্মুহু স্লোগানের শব্দ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় এখন অপরিবর্তনীয় সত্য। তিনি তার দেশকে জাতিসংঘের স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানান।
তিনি যখন তাকে পাকিস্তানের মরু অঞ্চলের তপ্ত গরমের মধ্যে পরিবার-পরিজন থেকে দূরে একাকী এক কনডেম সেলে ৯ মাস বন্দি করে রাখার কথা বর্ণনা করছিলেন, তখন তার কণ্ঠে তীব্র উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। আর একজন মানুষ যখন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত থাকে, তখন তাকে কেউই হত্যা করতে পারে না বলে মুজিব জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন। যুদ্ধের কথা জানতেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুদ্ধবিমানের ওঠানামা ও ব্ল্যাকআউট চলার কারণে বিষয়টি তার পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয়েছিল। একমাত্র ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলার পরই তিনি জেনেছিলেন যে, বাংলাদেশ নিজেদের সরকার গড়েছে। তার জনগণের ওপর যেভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, এ ঘটনার সময় হিটলার বেঁচে থাকলে লজ্জিত হতেন।
ভুট্টো সম্পর্কে তিনি ভালো বললেন। তবে ভুট্টো যেমনটা চেয়েছেন, সেভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ রাখার ব্যাপারে তিনি তাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেননি বলে মুজিব জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি দেশে জনতার কাছে ফিরে গিয়ে এ ব্যাপারে উত্তর দিতে পারবেন বলে ভুট্টোর কাছে উল্লেখ করেছেন। কেন ঢাকা বা কাছাকাছি কোনো নিরপেক্ষ পয়েন্ট না বেছে নিয়ে লন্ডন আসার সিদ্ধান্ত নিলেন_ প্রশ্ন করা হলে তিনি ফট করে বলেন, 'আমি যে একজন বন্দি আপনারা কি তা জানেন না? আসলে এটা পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছাতেই হয়েছে, আমার নয়।' বিজয়ীবেশে বাংলাদেশে রওনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
তাকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়াটা যত না আশ্চর্যজনক ছিল, তার চেয়েও বেশি তাজ্জবের ব্যাপার ছিল তাকে বহনকারী বিমানের ঢাকা না গিয়ে লন্ডন আসা। এ ব্যাপারে অবশ্য তার তেমন কিছুই করার ছিল না। বাস্তবে ভুট্টোর মুজিবকে মুক্ত করে দেওয়া ছাড়া কিছু করারও ছিল না। মুজিবকে বন্দি করে রাখলে পাকিস্তানের কোনো লাভ নেই, বরং মৃত ও শহীদ মুজিব পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের ঘৃণাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করবে। মুজিবকে তার জনগণের কাছে ফিরে যেতে দিলে এটা একসময় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ঢিলেঢালা সংযোগ প্রতিষ্ঠায় কাজ দেবে বলে মনে করতেন ভুট্টো। পাকিস্তানের ব্যাপারে লন্ডনের সংবাদ সম্মেলনে মুজিবের ত্রুক্রদ্ধ কথাবার্তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পুনঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভুট্টোর স্বপ্ন অবাস্তব ছিল। তবে এক ধরনের সংযোগের বিষয়টি তখনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। কিছুটা সময়ের জন্য বাংলাদেশ ভারতের ওপর সামরিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতার জন্য নির্ভরশীল থাকবে। ভুট্টো মনে করতেন, বাংলাদেশে ভারতের সামরিক বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতি নিয়ে একদিন আগে হোক আর পরেই হোক, বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ হাঁপিয়ে উঠবেন। তখন বাংলাদেশিরা তাদের এই মুসলিম ভাইদের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করবে। এমনকি বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে পুরনো কিছু বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও চিন্তা করতে পারে বলে মনে করতেন ভুট্টো। তার মতে, বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি ভবিষ্যতের স্থায়ী নির্ণায়ক নয়।
স্বাধীনতার পর বাঙালিদের মধ্যে নিজেদের সুখ-সমৃদ্ধির ব্যাপারে যে আনন্দদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি হবে, সে সম্পর্কে ভুট্টোর কোনো ধারণাই ছিল না। মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে মর্মে খবরটি ঢাকায় পেঁৗছার পর বাংলাদেশে জাতীয় বীরের বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। সপ্তাহজুড়ে রাজধানী প্রতীক্ষার উত্তেজনায় কাঁপছিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা এসে পেঁৗছবেন, এ খবর জানার পর বাঙালিরা ঢাকার রাস্তায় নেমে এলো হাজারে হাজারে। কেউ নাচছে, কেইবা গাইছে, কেউ শূন্যে বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছে এবং কারও কণ্ঠ থেকে গগনবিদারী 'জয়বাংলা' স্ল্নোগান প্রকম্পিত করছে চারদিক। আনন্দ উৎসবরত বাঙালিদের অনেককেই দেখা গেল তাদের প্রিয় নেতার ছোট্ট বাড়ি দর্শনে যেতে। এই বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় শেখ মুজিবের সহধর্মিণী ও ছেলেমেয়েরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। বেগম মুজিব তখন রোজা রাখছিলেন। শুভানুধ্যায়ীদের বেগম মুজিব অশ্রুসজল চোখে বললেন, মার্চে গুলির শব্দটা ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙালিদের হত্যা করার। আর এখন এই গুলিতে বাঙালিদের আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে।
গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ টিম কিছু শহর প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, ওগুলোকে দেখতে ভুতুড়ে নগরী মনে হয়। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এহেন ধ্বংসলীলার ক্ষান্তি নেই। ৬০ লাখ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের কাছে জমি চাষের মতো গরু বা উপকরণও নেই। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুল-কালভার্টের চিহ্নও নেই এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগেও অনেক বাধাবিঘ্ন। এক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত দেশের ওপর নির্বিচার বলাৎকার চলেছে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (কার্যত প্রতিটি ব্যবসা ক্ষেত্রই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল) তাদের সব অর্থ-সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তান বিমানের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি জমা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার প্রকট সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেটকারগুলো তুলে নেওয়া হয়, গাড়ির ডিলারদের কাছে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নেওয়া হয় এবং এগুলো নৌবন্দর বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস পাট আনা-নেওয়া করা অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ধ্বংসপ্রাপ্ত চা বাগানগুলো আবার উৎপাদনে যেতে পারছিল না। এগুলোর উৎপাদিত অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের চা বাজার ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তান। এখন তাদের জন্য নতুন বাজার খুঁজে বের করা বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের নতুন মুদ্রা ছাপানোরও দরকার হয় এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই টাকা ছাপানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্বর্ণের জোগান নিশ্চিত করা। ঢাকার এক ব্যাংক কর্মকর্তা বললেন, 'আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন।' এর অর্থ হলো বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারী ও মিলে মজুদ হয়ে থাকা পাটের রফতানিকে সম্ভব করে তোলা জরুরি। ভারতীয় রুপির বিনিময় বা পূর্ব ইউরোপীয় মেশিনারির জন্য এ নগদ বিদেশি মুদ্রা দরকার তা কিন্তু নয়। বিদেশি সাহায্য, খাদ্য ত্রাণ ও যাতায়াত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এসবই একসঙ্গে প্রয়োজন। একইসঙ্গে আমদানি হ্রাসও প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবটা আরও স্পষ্ট। তাদের হিসাবমতো, দেশকে ১৯৬৯-৭০-এর পর্যায়ে (তখন মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ৩০ ডলার) নিয়ে যেতে হলে ৩০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কঠোর নিয়ম-কানুন আরোপ করেছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল : পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের সঙ্গে রুপির অবমূল্যায়ন, সব বেতনের ওপর মাসে ১৪০ ডলার সিলিং নির্ধারণ ও বাঙালিদের ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের ওপর সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া। এ ব্যবস্থা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অথচ এরাই আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছিল। কিন্তু তখন এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। বাঙালিরা সরকারের গৃহীত মাঝারিগোছের সমাজতান্ত্রিক পথকে সানন্দে মেনে নিয়েছিল তখন। গত সপ্তাহে নজরুল ইসলাম ঘোষণা করেন যে, শিগগিরই সরকার শোষণমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাংক, বীমা, বিদেশি বাণিজ্য ও মৌলিক শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করবে।
এদিকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করা এক কোটি মানুষকে দেশে ফিরিয়ে আনাও কম ঝামেলার কাজ নয়। ভারতীয় কর্মকর্তারা গত সপ্তাহেই ঘোষণা করেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আসা ১০ লাখ শরণার্থী স্বদেশে ফিরে গেছে। এদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়। শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে উৎসাহী হয়, সে জন্য ভারত সরকার প্রত্যেক স্বদেশ গমনেচ্ছু বাংলাদেশি পরিবারকে অ্যালুমিনিয়ামের এক সেট হাঁড়ি-পাতিল ও বাসন-কোসন, কিছু তেল, কাঠ-কয়লা, চকোলেট, চাল-আটার দুই সপ্তাহের রেশন প্রদান করে। ফিরে আসা লোকজনের রাতে ঘুমানোর জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হলো ট্রানজিট ক্যাম্প। তখন সরকার এ কাজে বিদেশি সাহায্য ও জাতিসংঘ সহায়তা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করল। বন্দরে ইতিমধ্যেই কিছু সাহায্য এসে পড়েছিল। অপেক্ষা করা হচ্ছিল বিতরণ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ছিল সমানভাবে অনিশ্চিত। সে মুহূর্তে মুজিবের কথা ও উক্তির প্রতি মানুষের গভীর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কত দ্রুততার সঙ্গে সংস্কার সাধনের মাধ্যমে জনগণের প্রতি তার সমর্থনকে ধরে রাখতে সক্ষম হন, সেটা ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগের মধ্যবয়সী রাজনীতিবিদরা যে মাঝারিগোছের কোর্স নির্ধারণ করেছেন, তাতে রেডিক্যাল তরুণ গেরিলারা বাদ সাধবেন বলে মনে হয় না। অধিকন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারের ক্ষমতার হাত প্রসারিত হয়নি। সেসব স্থানে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় ক্যাডারদের কর্তৃত্ব।
ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক সুনন্দা দত্ত রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, গেরিলারা ইতিমধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিবের নামে প্রতিষ্ঠিত 'মুজিব বাহিনী' নিজেদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করছে। আশরাফ চৌধুরী নামে এদেরই ২২ বছরের এক কমান্ডার দত্ত রায়কে বলল, 'আমাদের সামাজিক আদর্শ বাস্তবায়িত হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা কখনই অস্ত্র ত্যাগ করব না।' আরেক গেরিলা তাদের উদ্দেশ্যটি আরও চাঁচাছোলাভাবে তুলে ধরতে গিয়ে বলল, 'আমাদের কাছে বিপ্লব এখনও শেষ হয়নি। এটা শুরু হয়েছে মাত্র।' পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করায় বিহারিদের ওপর বাঙালিদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। এই বিহারিদের মুক্তিবাহিনী রক্ষা করার মাধ্যমে একটি প্রশংসনীয় কাজ করে। কিন্তু সরকার এই মুক্তিবাহিনী সদস্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ব্যাগ্র হয়ে ওঠে। তারা এদের দিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গড়ার পরিকল্পনা করে, যারা পুলিশ ও মিলিশিয়ার দায়িত্ব একইসঙ্গে পালন করবে।
টাইমসের উইলিয়াম স্টুয়ার্টের মতে, অতীতের ধ্বংসযজ্ঞ ও ভবিষ্যৎ অশান্তির সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও দেখার মতো চমৎকার জায়গা। গত সপ্তাহে তিনি পাঠনো তার বার্তায় জানান, হাইওয়ে দিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা আসার পথে এখনও যুদ্ধের অনেক ক্ষতচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। কিছু এলাকায় এখনও কামানের গোলাসৃষ্ট গর্ত এবং পোড়াবাড়ির কালো কাঠামো দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় বাজারগুলোতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফল ও খাদ্যসামগ্রীর দোকানের দেখা মিললেও গ্রামগুলো এখনও বাঙালি মানেই ভুতুড়ে বলতে হবে।
প্রাদেশিক শহরের সেই বল্পুব্দভাব এখনও ঢাকা শহরে দেখতে পাওয়া যায়, রাস্তায় মানুষচালিত হাজার হাজার রিকশা নজরে আসে, যেগুলোর পেছনে রয়েছে ফুল-পাখি আঁকা, প্রত্যেক গাড়িতেই শোভা পাচ্ছে জাতীয় পতাকা। কোনো কোনো মোটরগাড়ির সামনের উইন্ডশিল্ডে মুজিবের ছবি শোভা পাচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় দেখা মেলে মার্কিন স্থাপত্যবিদ লুই কানের ডিজাইন করা বিল্ডিংসহ (সংসদ ভবন) অর্ধসমাপ্ত কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট। এসব প্রকল্প যখন বাস্তবায়িত হবে, তখন ঢাকাকে একদিন অনেক রাজধানীর কাছেই ঈর্ষণীয় মনে হবে। আপনি যদি ঢাকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানবন্দরে এসে পেঁৗছেন বা কলকাতা থেকে গাছের সারির মধ্য দিয়ে চলা রাস্তা দিয়ে রওনা দেন, তখন একটি শান্ত সমাহিত ভাব দেখবেন, যেটা আপনার দৃষ্টি কাড়বে। বাংলাদেশে ভ্রমণ করা কঠিন হয়ে উঠলেও সীমান্তের শুল্ক ও অভিবাসন কর্মকর্তারা বন্ধুভাবাপন্ন ও ভদ্র, একগাল হাসি তাদের মুখে লেগেই থাকে, আপনার অ্যান্ট্রি ফর্মটি তারাই আনন্দের সঙ্গে নতুন আইন-কানুনের সঙ্গে মানানসই করে দিচ্ছে। কোনো আমেরিকানের প্রতি শত্রু মনোভাব নেই। আমেরিকান হিসেবে আপনার পরিচয় পাওয়ার পর নিক্সন প্রশাসনের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে কেউ কেউ। তবে এখনকার মানুষ বিশ্বাস করে যে, মার্কিন সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষেই ছিল।
এই একই ভাবনার কথা প্রকাশ করলেন আমাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, 'নিক্সন প্রশাসন বিরাট আঘাত পেয়েছে। সময় ক্ষত ভরিয়ে দেয়, এর দাগ কিন্তু থেকে যায়। মার্কিন প্রেস, বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার ছিলেন, তাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। পাকিস্তান এই দেশকে নরকে পরিণত করে ছেড়েছিল। বাঙালি জাতির হত্যাকারীদের কিছু বল্পুব্দপ্রতিম দেশের প্রশাসন সমর্থন দেওয়ায় আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। নিক্সন প্রশাসনের কাছ থেকে যে কোনো ধরনের সাহায্য বাংলাদেশি জনগণের কাছে অপছন্দনীয় হবে। এটা কঠিন হলেও আমরা দীর্ঘকাল কোনো শত্রুতা পুষে রাখব না।'

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:১২
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন হাদিসই যদি মানতে হবে তবে আল্লাহ ফিকাহ মানতে বললেন কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৪৬




সূরাঃ ৫ মায়িদা, ৬৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬৭। হে রাসূল! তোমার রবের নিকট থেকে তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা’ প্রচার কর। যদি না কর তবে তো তুমি তাঁর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৯

তারেক রহমানের হঠাৎ ‘জামায়াত-বিরোধী’ উচ্চারণ: রাজনীতির মাঠে নতুন সংকেত, নাকি পুরোনো সমস্যার মুখোশ?

বিএনপি রাজনীতিতে এক অদ্ভুত মোড়—অনেক বছর পর হঠাৎ করেই তারেক রহমান সরাসরি জামায়াতকে ঘিরে কিছু সমালোচনামূলক কথা বললেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন থাপ্পড় খাবি!

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩৩



ঘটনাঃ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের পতনের সময়।
চৈত্র মাস। সারাদিন প্রচন্ড গরম। জামাই তার বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। সুন্দর গ্রামের রাস্তা। পড়ন্ত বিকেল। বউটা সুন্দর করে সেজেছে। গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×