
৭ নভেম্বর বিএনপি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। বিএনপির পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, এই দিনে সিপাহি-জনতার উত্থানের মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ফলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং সার্বভৌমত্ব-স্বাধীনতা রক্ষা পায়। অথচ ৭ নভেম্বর সংঘটিত করার অপরাধে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ও তাঁর রাজনৈতিক দল জাসদের নেতৃবৃন্দকে এক প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করে তৎকালীন সামরিক সরকার। বিচারে কর্নেল তাহেরকে বেআইনিভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। সূর্য সেনের পর কর্নেল তাহের হলেন দ্বিতীয় বিপ্লবী, যাঁকে এভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁর ফাঁসির রায় দেওয়া হয় ইংরেজি ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সাল। আর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ২০ জুলাই দিবাগত রাত ৪টায়। ফাঁসির শেষ সময় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে একই কারাগারে তাঁর আরো তিন ভাই ছিলেন। ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা কমরেডরা। আর বাইরে তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী লুৎফা এবং হতভাগ্য বাঙালি। কর্নেল তাহেরের চিঠি এবং তাঁর স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে এই প্রতিবেদনটি
৭ নভেম্বরের পরই জিয়াউর রহমান ভোল পাল্টে ফেলেন। জাসদ ও তার অঙ্গসংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বকে জেলে পুরতে শুরু করেন। কর্নেল তাহেরকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর চারপাশে জড়ো করতে থাকেন পাকিস্তান প্রত্যাগত প্রতিক্রিয়াশীল সেনা কর্মকর্তাদের; এর সঙ্গে যুক্ত হয় খোদ জিয়াউর রহমানকে যারা বন্দি করেছিল তারা। এরই ধারাবাহিকতায় কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর। সামরিক এক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি করা হয় ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মূল নেতৃত্বকে। কারাগারের অভ্যন্তরে আদালত বসায় তৎকালীন সরকার। আদালতের চেয়ারম্যান করা হয় ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে। ইউসুফ হায়দার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশেই ছিলেন। তবে পাকিস্তান আর্মির ব্যারাকে। তিনি বাংলাদেশে থেকেও মুক্তিযুদ্ধ করেননি। এ রকম একজনকে আদালতের চেয়ারম্যান করার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এত সংগঠক ও কর্নেল তাহেরের মতো সেক্টর কমান্ডারের ভাগ্য প্রথম থেকেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বলে তৎকালীন ক্যাঙ্গারু কোর্টে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান।
কোনো আইন মানা হয়নি
একদিকে জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের বিপ্লবকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে প্রচার করছেন, ৭ নভেম্বরের চেতনা ঊধর্ে্ব তুলে ধরছেন। অন্যদিকে ৭ নভেম্বরের মহানায়কদের বিপ্লব সংঘটনের দায়ে বিচার করছেন। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্নেল তাহের, হাসানুল হক ইনু, মেজর জিয়াউদ্দিনসহ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল_জাসদের নেতা-কর্মীদের যে ভুয়া বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, সেখানে নূ্যনতম আইনের তোয়াক্কা করা হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে আইনে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ওই অপরাধে আইনের বিধানে কোনো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধানই তখন ছিল না। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২১ (ক) ধারা এবং ১৯৭৫ সালের ১ নং সামরিক আইনের ১৩ নং বিধি মোতাবেক অভিযুক্তদের বিচার করা হয়। যেখানে কোনোভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না।
শুধু দেশীয় আইনই নয়, আন্তর্জাতিক আইনও লঙ্ঘন করেছিল তৎকালীন সরকার। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী কোনো পঙ্গু লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান নেই। বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনের ওই ধারায় স্বাক্ষর করার পরও কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেন তৎকালীন ক্যাঙ্গারু আদালতের বিচারক।
কর্নেল তাহের ও তাঁর রাজনৈতিক দলের অন্যান্য কমরেডকে মামলা শুনানির পর আইনজীবী নিয়োগ করার সুবিধা দেওয়া হয়। তবে প্রত্যেক আইনজীবীকে সরকার একটি লিখিত চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করে। ওই লিখিত চুক্তিতে বলা হয়েছিল, মামলার তিন বছর পর্যন্ত আইনজীবীরা এই আদালতের ব্যাপারে বাইরে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন না। যদি তাঁরা এই শপথ ভঙ্গ করেন তাহলে তাঁদের তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। ফলে বিশেষ আদালতে কী হচ্ছিল তা বাইরের লোক কিছুই জানতে পারেনি। দেশের মধ্যে সংবাদপত্রের ওপর সামরিক বাহিনী থেকে কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।
একমাত্র ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউর বিদেশি সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎসের মাধ্যমে কিছু খবর বিশ্ববাসী জানতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই মার্কিন সাংবাদিককেও জোর করে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয় তৎকালীন সরকার।
কর্নেল তাহেরের জবানবন্দি
কর্নেল তাহের আদালতে ৬ ঘণ্টার এক দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যে তিনি ৭ নভেম্বর বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন এবং বিপ্লব সংঘটনের প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। লরেন্স লিফশুলৎসের 'অসমাপ্ত বিপ্লব' গ্রন্থ থেকে জানা যায় তাহেরের সে দীর্ঘ বক্তব্য। বক্তব্য অনেক দীর্ঘ হওয়ায় আমরা উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে প্রকাশ করলাম।
জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ, আপনাদের সামনে দণ্ডায়মান এই মানুষটি, যে মানুষটি আদালতে অভিযুক্ত, সেই একই মানুষ এই দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পণ করেছিল। এটা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। একদিন সেই মানুষটির কর্মকাণ্ড আর কীর্তির মূল্যায়ন ইতিহাস অতি অবশ্যই করবে। আমার সব কর্মে, সমস্ত চিন্তায় আর স্বপ্নে এ দেশের কথা যেভাবে অনুভব করেছি, তা এখন বোঝানো সম্ভব নয়।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! যে সরকারকে আমিই সরকারে বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই নতুন জীবন দান করেছি, তারাই আজ এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদের ধৃষ্টতা এত বড় যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো আরো অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে।
এই ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডকৃত দলিলপত্রেই দেখা যায় যে উনিশ শ পঁচাত্তরের ৬ ও ৭ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে সিপাহি অভ্যুত্থান হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আর এ দেশের সার্বভৌমত্বও থাকে অটুট। এই যদি হয় দেশদ্রোহিতার অর্থ তাহলে হ্যাঁ, আমি দোষী। আমার দোষ আমি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। সেনাবাহিনীপ্রধানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছি।
এরপর কর্নেল তাহের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাঁর মতভিন্নতা নিয়ে বিস্তারিত বলেন। এরপর আবার তিনি চলে যান ৭ নভেম্বর বিপ্লবের সময়ে। কর্নেল তাহেরের বর্ণনায়_
সেদিন আমি অসুস্থ, আমার নারায়ণগঞ্জের বাসায় বিছানায় পড়ে ছিলাম। ভোর চারটার দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। ওপারে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। আমার সাহায্য তাঁর খুব দরকার। কিন্তু কথা শেষ হলো না, লাইন কেটে গেল। সেদিন বেশ কিছু সিপাহি, এনসিও এবং জেসিও আমার নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসে হাজির হন।
৪ নভেম্বর বিকেলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর এক আত্দীয়র মাধ্যমে আমার কাছে খবর পাঠান। জিয়ার অনুরোধ ছিল, আমি যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আমার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে মুক্ত করি এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করি। আমি তাঁকে শান্ত থাকতে ও মনে সাহস রাখতে বলেছিলাম। আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে ও সব ধরনের অপকর্মের অবসান ঘটানো হবে।
সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ, আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। ৬ নভেম্বর আমি সৈনিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রাখলাম। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়, ৭ নভেম্বর রাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে।
এরপর কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদের সাতটি উল্লেখযোগ্য কর্মপদ্ধতি আদালতে বলেন। কর্নেল তাহের বন্দি জিয়াকে মুক্ত করার আরো বর্ণনা দেন। বর্ণনায় তিনি বলেন, সব কিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়। ভোরে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আমি ভোর তিনটার দিকে সেনানিবাসে যাই। সঙ্গে ছিলেন ট্রাকভর্তি সেনা।
জিয়াকে আমি তাঁর নৈশপোশাকে পেলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতসহ আরো কয়েক অফিসার ও সৈনিক ছিলেন। জিয়া আমাকে আর আমার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। পানিভর্তি চোখে তিনি আমাদের তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁর জীবন রক্ষার জন্য জাসদ যা করেছে তার জন্য জিয়া আমার ও জাসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আমরা যা বলব, তিনি তা-ই করবেন।
এরপর কর্নেল তাহের মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কিভাবে তাঁর কথা রাখেননি তার বর্ণনা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী সময়ের সামরিক ক্যু সম্পর্কে তিনি বলেন,
জিয়া শুধু আমার সঙ্গেই নন, বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে, ৭ নভেম্বরের পবিত্র অঙ্গীকারের সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
আমাদের জাতির ইতিহাসে আর একটাই মাত্র এ রকম বিশ্বাসঘাতকতার নজির রয়েছে, তা হচ্ছে মীরজাফরের। বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে গোটা উপমহাদেশকে ২০০ বছরের গোলামির পথে ঠেলে দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা ১৭৫৭ সাল নয়, ১৯৭৬ সাল। আমাদের আছে বিপ্লবী সিপাহি-জনতা, তারা জিয়াউর রহমানের মতো বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে নির্মূল করবে।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি বৈধভাবে ক্ষমতা লাভকারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য যড়যন্ত্র করেছি। কিন্তু মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করেছিল কারা? কারা সেই সরকারকে উৎখাত করেছিল? মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কে ক্ষমতায় এসেছিল? মুজিবের পতনের পর সেনাবাহিনী প্রধান কে হয়েছিল? এখানে অভিযুক্তদের কেউ কি এসব ঘটিয়েছিল? নাকি উপবিষ্ট আপনারা এবং তারা_যাদের আজ্ঞা আপনি পালন করে যাচ্ছেন, তারাই কি মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে লাভবান হয়নি?
এ জন্যই আমি ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করেছিলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াব, জেনারেল এম এ জি ওসামানী ও বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করার জন্য। তাঁরা যদি এখানে আসতেন, ট্রাইব্যুনালের যদি ক্ষমতা থাকত তাঁদের এখানে আনার, তাহলে আমি নিশ্চিত যে তাঁরা এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে সাহস পেতেন না। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আমার সঙ্গে এ মামলায় অভিযুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে আমার কিছু বলার আছে। তাঁদের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। যদি তাঁরা কোনো অপরাধ করে থাকেন তাহলে এঁদের বিচার করা উচিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর আইন অনুযায়ী এবং সার্ভিস রুলসের আওতায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শুরুর দিকে আমি তার একজন অন্যতম উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলাম। বড় দুঃখ হয়, এই সামরিক জান্তা তাদের জঘন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে এভাবে সেনাবাহিনীর এই গুরুত্বপূর্ণ সৈনিকদের বিসর্জন দিচ্ছে। এতে করে সেনাবাহিনী পঙ্গু হয়ে যাবে। এই যুবকরা সত্যিকারের বীর। তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জাতি মরতে পারে না। বাংলাদেশ বীরের জাতি। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান থেকে তাঁরা যেই শিক্ষা, দিকনির্দেশনা পেয়েছেন তা ভবিষ্যতে তাঁদের সব কাজে পথ দেখাবে। জাতি আজ এক অদম্য প্রেরণায় উদ্ভাসিত। যা করে থাকি না কেন, তার জন্য আমি গর্বিত। আমি ভীত নই। জনাব চেয়ারম্যান, শেষে শুধু বলব, আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালোবাসি। এ জাতির প্রাণে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করবে। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক
দীর্ঘজীবী হউক স্বদেশ
৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি অবস্থা থেকে তাঁরা মুক্ত করেন। জিয়াউর রহমানকে যারা বন্দি করেছিল মুক্ত হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করেননি জিয়াউর রহমান। উল্টো জিয়াউর রহমানকে যিনি মুক্ত করলেন সেই কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মধ্যে এক প্রহসনের বিচার শুরু করেন।
কর্নেল তাহের ও তাঁর সতীর্থদের বিরুদ্ধে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় তাকে কোনোভাবেই ট্রাইব্যুনাল বলতে নারাজ আইন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছিল কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য। আর এ কারণে তাহেরের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কোনো আইনজীবীর পরামর্শ নিতে দেওয়া হয়নি।
স্বজনদের কাছে লেখা তাহেরের চিঠি
কর্নেল তাহের কারাগার থেকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। সেই সব চিঠি গোপনে আইনজীবী জিনাত আলী শরীফ চাকলাদার তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরের কাছে পেঁৗছে দিতেন। লুৎফার কাছে লেখা তাহেরের শেষ চিঠি। এ চিঠি যেন নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠি। চিঠিটির অংশবিশেষ এখানে ছাপানো হলো।
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল
১৫ জুলাই, '৭৬
আমার আদরের লুৎফা,
তোমার পত্র পেয়েছি। আমার পূর্বপত্রখানা পড়ে তুমি হয়তো হেসেছ। তোমার কবিতাটি জলিল রেখে দিয়েছে। ও সবাইকে দেখায়। জিয়ার পত্র ও জলিলের কবিতা পেয়েছ নিশ্চয়ই। এরা সবাই আমাকে বিশেষভাবে ভালোবাসে। গত কয়েক দিন কাটল আমার জবানবন্দিতে। আনোয়ার শুরু করেছে ও আমি শেষ করেছি। আনোয়ারের জবানবন্দি সবাইকে সম্মোহিত করেছিল। মেজর জলিল আড়াই ঘণ্টাকালীন বক্তব্যে যে শক্তি ও অনুরাগ প্রকাশ করে, তা কেবল একজন বিপ্লবীর কাছ থেকেই আশা করা যায়। ইনু ও মান্নার বক্তব্য অপূর্ব, ভাষাতত্ত্ব ও নৈতিকতার দিক থেকে সালেহা সবাইকে অবাক করে। ভাইজান তাঁর গোছানো কথার শেষে বলেন।
বেলাল ছোট কথায় বেশ সুন্দরভাবে তার মূল কথা তুলে ধরে। ট্রাইব্যুনালের নানা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা যাবৎ আমি আমার জবানবন্দি বলি। নানা বাদানুবাদে অপ্রিয় কথাও আসে। তোমাকে কয়েকটি শোনাই। ৭ নভেম্বরে আমার ভূমিকা বর্ণনা শেষে-
ওভ ঃযরং রং ধহ ধপঃ ড়ভ ঃৎবধপযবৎু ও ড়িঁষফ পড়সসরঃ ঃযধঃ ধপঃ ধমধরহ ধহফ ধমধরহ.
একপর্যায়ে কোর্ট আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ঞযরং ঃৎরনঁহধষ হবরঃযবৎ ধপয়ঁরঃ সব হড়ৎ ঢ়ঁহরংয সব. ও ফড়হ'ঃ পধৎব ভড়ৎ ঃযরং ঃৎরনঁহধষ.
ট্রাইব্যুানালের কার্যকলাপ প্রসঙ্গে 'ঃযরং ঃৎরনঁহধষ যধং ঢ়ঁঃ ংযধসব ঃড় যিধঃ ধষষ যঁসধহ পরারষরুধঃরড়হ ধপযরবাবফ ঃযৎড়ঁময পড়হংঃধহঃ বহফবধাড়ৎ ভৎড়স ঃযব নবমমরহম ঃড় ফধঃব.
কোর্টের অনেক কথা শোনালাম। চাকলাদারের কাছে আনোয়ার, ভাইজান ও আমার পুরো জবানবন্দি আছে।
গতকাল ছিলাম ছয় সেলে। আনোয়ার, বেলাল ও রবিউল আমার পাশের সেলে ছিল। ভাইজান ছিলেন ২৬ সেলে। ভাইজানকে সরানো হয়েছে। আমাদের কয়েকজনকে প্রতিদিনই এমনিভাবে সরানো হয় যাতে বাইরে থেকে কেউ এলে সহজে আমাদের খুঁজে পাওয়া না যায়। কি বুদ্ধি! জেলখানার ভেতর আর্মড পুলিশ আনা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে। সেলের সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সরকার ভীতসন্ত্রস্ত। ফল হয়েছে সবাই আমাদের আরো সম্মান করে ও ভালো চোখে দেখে।
আমাদের ভাগ্য জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এসো, আমরা সেদিনের দিকে তাকাই, যেদিনের চিত্র গাঁথা আমাদের চিন্তায়, ভাবনায়। জনগণের জয়যাত্রা তো শুরু হয়ে গেছে ৭ নভেম্বর থেকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েও কেউ আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।
জিয়াকে আঁস্তাকুড় থেকে তুলে এনে দিয়েছিলাম সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান, কিন্তু সে আঁস্তাকুড়ে ফিরে গেছে। ইতিহাস আমার পক্ষে।
আমাদের জীবনে নানা আঘাত-দুঃখ এসেছে তীব্রভাবে। প্রকাশের অবকাশও নেই। ভয়, যদি সেই প্রকাশ কোনো সহকর্মীকে দুর্বল করে, ভয়, যদি কেউ আমাকে সমবেদনা জানাতে আসে, আমাকে, আমার জাতিকে ছোট করে। তাই মাঝে মাঝে মন ব্যাকুল হয়। তোমাকে পেতে চাই নিবিড়ভাবে, তোমার স্পর্শ, তোমার মৃদু পরশ আমাকে শান্ত করুক।
আমার আদর নিও।
তোমারই তাহের।
লুৎফাকে লেখা এটাই ছিল তাহেরের শেষ চিঠি। দুই আজন্ম চিরযুগলের সঙ্গে আর কোনো পত্রালাপ হয়নি। বিপ্লব মাঝপথে ছিনতাই হয়ে যায়, বিপ্লবের সঙ্গে ভালোবাসার মানুষও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ফাঁসি কার্যকর হওয়ার তিন দিন আগে কারাগার থেকে লেখা কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের পরিবারের কাছে লেখা শেষ চিঠি। ঐতিহাসিক এই চিঠির সংক্ষিপ্ত অংশ এখানে প্রকাশ করা হলো
শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান ও আমার ভাইবোনেরা_
গতকাল বিকালে ট্রাইব্যুনালের রায় দেওয়া হলো। আমার জন্য মৃত্যুদণ্ড। ভাইজান ও মেজর জলিলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। আনোয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়াউদ্দিনের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড, দশ হাজার টাকা জরিমানা। সালেহা, রবিউলের পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ড. আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্নাসহ ১৩ জনকে মুক্তি দান। সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মতো তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করল।
হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে তিনি বললেন, 'আমার কান্না এ জন্য যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করতে পারল!' বোন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে গিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম_'তোমার কাছ থেকে দুর্বলতা কখনোই আশা করি না।' সালেহা বলল_'আমি কাঁদি নাই, আমি হাসছি।' হাসি-কান্নায় এই বোনটি আমার অপূর্ব। জেলখানায় এই বিচারকক্ষে এসে প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কোন জাতি এর মতো বোন সৃষ্টি করতে পারে!
সশস্ত্র বাহিনীর অভিযুক্তদের শুধু একটি কথা, কেন আমাদেরকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো না। মেজর জিয়া বসে আমার উদ্দেশে একটি কবিতা লিখল। জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, 'তাহের ভাই-লাল সালাম।' সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। জেলখানার উঁচু দেয়াল এই ধ্বনিকে কি আটকে রাখতে পারবে? এর প্রতিধ্বনি কি পৌঁছবে না আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়?
রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা এসে আমাকে বললেন, যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না, তবুও তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন। কারণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন। আমি তাঁদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা চলবে না। এই রাষ্ট্রপতিকে আমি রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছি, এই দেশদ্রোহীদের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না।
সবাই একে একে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। অশ্রুসজল চোখ। বেশ কিছু দিন সবাই একত্রে কাটিয়েছি। আবার কবে দেখা হবে। সালেহা আমার সঙ্গে যাবে। ভাইজান, আনোয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের তো আমি জানি। আমাকে সাহস জোগানোর জন্য তাদের অভিনয়; বেলালের চোখ ছলছল করছে। কান্নায় ভেঙে পড়তে চায়। জলিল, রব, জিয়া আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। এই আলিঙ্গন অবিচ্ছেদ্য। এমনিভাবে দৃঢ় আলিঙ্গনে আমরা সমগ্র জাতির সঙ্গে আবদ্ধ। কেউ তা ভাঙতে পারবে না।
সবাই চলে গেল। আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম। সালেহা চলে গেল তার সেলে। বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি ও রাজবন্দিরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বন্ধ সেলের দরজা-জানালা দিয়ে। মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যরা দেখালেন আমাকে বিজয়চিহ্ন। এই বিচার বিপ্লবীদের তাঁদের অগোচরে এক করল।
ফাঁসির আসামিদের নির্ধারিত জায়গা ৮ নম্বর সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো। পাশের তিনটি সেলে আরো তিনজন ফাঁসির আসামি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই, তাতে লজ্জার তো কিছুই নেই। জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর চাইতে বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে?
এ দেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব যা আমার জাতিকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে_এর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে? আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত। আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে। কোন শক্তি তা করতে পারে? কেউ পারবে না।
আজকের পত্রিকা এল। আমার মৃত্যুদণ্ড ও অন্যদের শাস্তির খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায়। মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আতাউর রহমান ও অন্যদেরকে বলবে সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে যদি তাঁরা ব্যর্থ হন ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।
তোমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আদর নিও। বিচার ঘরে বসে জিয়া অনেক অনেক কবিতা লেখে, তারই একটি অংশ_
তোমাদের তাহের
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল
১৮ জুলাই, ১৯৭৬ সাল
কর্নেল তাহেরের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে। জেল কোডের নিয়ম অনুযায়ী ফাঁসির রায় ঘোষণা পরে কোনো আসামির আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার 'পরের দিন থেকে ২১ দিনের আগে নয় আবার ২৮ দিনের বেশি নয়' সময়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। কর্নেল তাহের রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের কাছে জীবন ভিক্ষার কোনো আবেদন করেননি। কর্নেল তাহেরের স্ত্রী তাঁর স্বামীর প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেন রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি আবেদন নাকচ করে দেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় তাঁর একটি রায়ে স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন যে 'পর্যাপ্ত আত্দপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না।' কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, সায়েম যখন রাষ্ট্রপতি তাঁর হাত দিয়েই কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার যে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার এক দিনের মধ্যেই সায়েম তাঁর সিদ্ধান্ত দেন।
জেল কোড অনুযায়ী কর্নেল তাহেরের ফাঁসির সর্বনিম্ন কাছাকাছি তারিখ হওয়ার কথা ছিল ৭ আগস্ট। তবে ঘাতকরা সে সময়ও তাঁকে দেয়নি। ফাঁসির রায় ঘোষণার মাত্র চার দিনের মাথায় ২১ জুলাই তা কার্যকর হয়।
কর্নেল তাহেরের সঙ্গে শেষ দেখার মুহূর্তগুলো আজও অম্লান হয়ে আছে তাঁর অনুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের। আনোয়ার হোসেন ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবকালীন জাসদের ঢাকা শহরের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। জাসদের বিপ্লব জিয়াউর রহমান কুক্ষিগত করার পর কর্নেল তাহেরসহ জাসদের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীর প্রহসনের যে বিচার আরম্ভ হয়, সেই বিচারে আনোয়ার হোসেনের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। কর্নেল তাহেরের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার সময় আনোয়ার হোসেনও একই কারাগারে বন্দি ছিলেন। ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন শেষবারের মতো যখন দেখা করতে যান, তখন অন্য সেলে আটক জাসদের অন্যতম নেতা মেজর জলিল চিৎকার করে আনোয়ার হোসেনকে বলেছিলেন, 'কর্নেল তাহের যেন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়।' সে সময় আনোয়ার হোসেন মেজর জলিলকে বলেছিলেন, 'আমি তাঁকে এ কথা বলতে পারব না। আর বললেও তিনি তা কোনোদিনও করবেন না।'
কর্নেল তাহেরের সেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আনোয়ার হোসেন। সেলের ভেতরে তখন বাংলার সূর্য সেন, বাইরে দুঃখী বাংলাদেশ। গরাদের ওপার থেকে কর্নেল তাহের আনোয়ার হোসেনের কাঁধের ওপর হাত রাখলেন। আনোয়ার হোসেন মেজর জলিলের অনুরোধের বিষয়টি কর্নেল তাহেরকে বললেন। একই সঙ্গে মেজর জলিলকে আনোয়ার হোসেন কী উত্তর দিয়েছিলেন তাও জানালেন। এবার কর্নেল তাহের হাসলেন। বললেন, 'তুমি ঠিকই বলেছো। আমি কখনো আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইব না।'
ভাইয়ের সঙ্গে শেষ সময় যেন একটু বেশি সময় পাওয়া যায় এই কারণে নানা অজুহাত তৈরি করছিলেন একাত্তরের এই বীর সেক্টর কমান্ডার। সেন্ট্রিকে তিনি বললেন, আম কেটে আনোয়ারকে খেতে দেওয়ার জন্য। আম খাওয়া শেষ হলে বললেন চা দিতে। এভাবে ভাইয়ের সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটান আনোয়ার হোসেন।
ডেটলাইন ২০ জুলাই
এই দিন সকাল থেকে কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কোনো কয়েদিকে সেলের বাইরে যেতে দেওয়া হলো না। সকাল থেকে সামরিক কর্মকর্তারা দফায় দফায় কারাগার পরিদর্শন করতে থাকেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ফাঁসির মঞ্চ পরিদর্শন করতে জেনারেল মীর শওকত এলেন। তিনিও একজন সেক্টর কমান্ডার, তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা। তাঁর কিন্তু কোনো এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না কারাগার পরিদর্শন করা। কিন্তু এলেন।'
রাতে ফ্লাডলাইট জ্বেলে পুরো জেলখানা আলোকিত করা হলো। কারাগারে পিনপতন নীরবতা। কয়েদিরা বুঝতে পারছে আজ বিশেষ কিছু একটা ঘটবে। আজ বাংলার আরেক ক্ষুদিরাম কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হবে।
রাত ২টার দিকে কর্নেল তাহেরের রুমে প্রবেশ করল জেল কর্তৃপক্ষ। কর্নেলকে জানানো হলো তাঁর ফাঁসি আজ কার্যকর করা হবে। কর্নেল বললেন, সময় তো আরো বাকি আছে। আপনারা যান, আমি ঘুমাব। তাঁকে গোসল করতে বলা হলো। তিনি বললেন, 'গোসল করা লাগবে না। আমি এমনিতেই পবিত্র আছি।' এরপর তওবা পড়তে বলা হলো। তিনি বললেন, 'আমি তওবা কেন পড়ব? আমি তো কোনো ভুল করিনি।'
সবাই ভেবেছিল কর্নেল তাহেরকে জোর করে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কর্নেল সটান চলে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে। তারপর উপস্থিত কারা কর্তৃপক্ষকে বললেন, 'ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে একটি কবিতা পড়তে চাই।' তারা বলল, 'কার কবিতা?' কর্নেল উত্তর দিলেন, 'পড়ার পরে বলব।' এরপর কর্নেল তাহের বিচার চলাকালে মেজর জিয়াউদ্দিনের লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন।
'জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে
কাঁপিয়ে দিলাম।
জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙব বলে
ভেঙে দিলাম।
জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে
করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটি বিশাল পাথর
রেখে গেলাম।
পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের কবর দিলাম।
পৃথিবী_অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।'
(এখানে কবিতাটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো)
জল্লাদ তাঁকে ফাঁসির রশি পরানোর জন্য এগিয়ে এল। তিনি বললেন, 'আমি চাই না কোনো বাঙালি আমার গলায় ফাঁসির রশি পরাক।' এর পর তিনি নিজেই ফাঁসির রশি পরলেন। যমটুপি পরতে অস্বীকার করলেন তিনি। কর্নেল ইংরেজিতে এরপর বললেন, 'ডু ইউর ডিউটি।' কাঠের পাটাতন সরে গেল। ভোর চারটায় কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপস্থিত ডাক্তারের কাছে ফাঁসির সময়কার ঘটনা জানতে চেয়েছিলেন। ডাক্তারের কাছ থেকে বিস্তারিত সে রাতের কথা জেনেছিলেন কর্নেল তাহের অনুজ আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেনের বর্ণনামতে, যমটুপি পরানোর জন্য এগিয়ে এলে তাহের তাঁকে নিবৃত্ত করেন। এরপর পাকা ৪২ মিনিট কর্নেলকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফাঁসির আসামির মৃত্যুর পর তাঁর জিহ্বা বের হয়ে আসে মুখ থেকে। কিন্তু কর্নেল তাহেরকে দেখে বোঝা যায়নি তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি ঘুমিয়ে আছেন।
ফাঁসি না পরিকল্পিত খুন?
কর্নেল তাহেরকে বিচারের নামে যেভাবে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেওয়া হলো তা দেখে মনে হবে বিচারের রায় আগেই কোনো এক জায়গা থেকে ঠিক করা ছিল। বিচারক শুধু রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। সেদিন আসামির কাঠগড়ায় থাকা কর্নেল তাহেরের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আদালতের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার রায় ঘোষণা করার পর একপ্রকার দৌড়ে আদালত ত্যাগ করেন। পরে শুনেছি, ওই দিন তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন মামলার কাগজপত্র নিয়ে। এ দেখেই বোঝা যায় কর্নেল তাহেরকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল জিয়াউর রহমান ও তাঁর সতীর্থদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা এই বিচারকে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা আবার পুনর্বিচারের জোর দাবি জানাচ্ছি।'
পুনর্বিচারের বিষয়টি ঘুরেফিরেই এসেছে। জেড আই খান পান্নাও মনে করেন, তাহেরের বিচারটি পুনরায় করা উচিত। বর্তমান সরকারের আমলেই তা শুরু করা উচিত। তা না হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ভুল আবারও ঘটতে পারে।
বাংলাদেশের মতো সমান দুঃখ নিয়ে কর্নেল তাহের ফাঁসির রশি নিজেই গলায় পরে নিয়েছিলেন। সেই দুখিনী বাংলায় আজও কর্নেল তাহেরের স্বপ্ন, একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম হয়নি। মাঝখান থেকে কর্নেল তাহেরের মতো বিপ্লবী স্বপ্নবাজরা চলে গেছেন আমাদের অপরাধী করে।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ২:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




