একাত্তরের গণহত্যা এবং কয়েকটি জনপ্রিয় প্রোপাগান্ডা
যেসব পাগলাটে মানুষগুলো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তোয়াক্কা না করে দিন-রাত্রির বালাই না রেখে আন্তর্জালে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির অপপ্রচারের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে - এই সামবাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা।বাঙালির সবচেয়ে গর্বের ধন এটাই,সবচেয়ে বড় আবেগও।'সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি' জাতীয় কয়েকজনকে বাদ দিলে বাঙালির সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটিও সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।হাজার বছরের ইতিহাস বলে,একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ কমই এসেছে বাঙালির,তার উপরে প্রত্যাশিত অথবা অপ্রত্যাশিত ভাবে আঘাত এবং আক্রমণ এসেছে পৌনঃপুনিক ভাবে।আঘাত এসেছে তার অর্থনীতির উপরে,এসেছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নের উপরে।আক্রমণ এসেছে তার সংস্কৃতির উপরে,আক্রমণ এসেছে তার আবেগকে আহত করতে।১৯৭১ সালের গণহত্যা সেই আঘাতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ,তবে চূড়ান্ত নয়।
১৯৭১ এ,বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য যখন চলছিল আন্তর্জাতিক ভাবে সমর্থিত পরিকল্পিত গণহত্যা,তখন একই সাথে এসেছিল ভিন্ন আক্রমণ।বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে বাঙালির এই সংগ্রামকে খাটো করার,প্রশ্নবিদ্ধ করার।বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আদৌ কোন গণহত্যা হচ্ছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছে বারবার।সেগুলো সাথেই সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল,বিবেচনাবান সাংবাদিকেরা।স্বাভাবিকভাবেই সরকারি ভাবে প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়া ছাড়া এইসব সাংবাদিক এবং অন্যান্য ব্যক্তিত্বের বক্তব্যের কোন শক্তিশালী প্রতিবাদ করতে পারেনি গণহত্যা পরিচালনাকারী পাকিস্তান সরকার।এইসব প্রোপাগান্ডা যখন ব্যর্থ হয়েছে,তখন চেষ্টা করা হয়েছে গণহত্যাকে জায়েজ করার।দেশের প্রয়োজনেই সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে,বাঙালিরাই পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ করেছে প্রথমে - এসব বলা হয়েছে।বলা বাহুল্য,যুদ্ধকালীন সময়ে এসব প্রোপাগান্ডা কিছু দিন হাওয়া গরম করে রাখা ছাড়া অন্য কোন কাজে লাগেনি।বাঙালিদের প্রয়োজন হয়নি,এসব প্রোপাগান্ডা তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকেরা,রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা এবং সারা পৃথিবীর জনগণের এক বিশাল অংশ।
স্বাধীনতার পরে এই প্রোপাগান্ডা নতুন করে শুরু হয়।শুরু হয় একটি জাতির জন্মযন্ত্রণাকে অপমান করার চেষ্টা,বাঙালির আবেগকে আহত করার।ক্রমাগত অস্বীকার করা হতে থাকে ১৯৭১ এর গণহত্যাকে,নিহতের সংখ্যা নিয়ে চলতে থাকে নোংরা নাম্বার গেম।বাঙালি নারী ধর্ষণের দায় বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে সমতাকরণ এবং লঘুকরণ প্রচেষ্টা চলে।যদি ভাবেন এটা শুধু পাকিস্তানে চলেছে,ভুল করবেন।এই চেষ্টা চলেছে বাংলাদেশেও।এই তালিকায় ছিল হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট।বাংলাদেশে পাকিস্তানি হাই কমিশনার ইরফান রাজা বলেছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বড়জোর ছাব্বিশ হাজার শহীদ হতে পারে।হালে এই তালিকায় যোগ হয়েছে শর্মিলা বোসের লেখালিখি।আর একেবারে আনকোরা সংযোজনা ইয়াসমিন সাইকিয়া।এরা ধর্ষণের দায় চাপাতে চান বাঙালির ঘাড়ে।এই তালিকায় সবচেয়ে দুঃখজনক সংযোজনা অলি আহমেদ।
প্রোপাগান্ডার ধরণটি বোঝা খুব সহজ - বাঙালিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল,তাদের আন্দোলন সহিংস ছিল,পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বিহারি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের উপরে তারাই আগে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে,যার ফলে সামরিক ব্যবস্থাগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে।এর পরে স্বাভাবিকভাবে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যা কোনভাবেই গণহত্যা নয়,যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যেসব টার্মস রয়েছে সেগুলো এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।এই প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে পাকিস্তান সরকার,মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি প্রচার মাধ্যম,আর এখন শর্মিলা-সাইকিয়ারা।পাকিস্তানের তরুণ সমাজ এসব বিশ্বাস করেছে কোন যাচাই বাছাই চাড়াই,বিশ্বাস করেছে আমাদের দেশের কিছু তরুণও।আন্তর্জালে এইসব প্রচারণা যথেষ্ট শক্তিশালী,ফেসবুক,ব্লগ এবং বিভিন্ন পাকিস্তানি ফোরামে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
২.
গণহত্যা ঘটেছে কি ঘটেনি সেই আলোচনায় যাবার আগে গণহত্যার সংজ্ঞা ও পরিধি সম্পর্কে একটু পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।জানা প্রয়োজন আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক ভাবে গণহত্যাকে কীভাবে দেখা হয় সে সম্পর্কে।এই অংশটি অনেকের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতে পারে,বিশেষ করে যারা গণহত্যার মৌলিক ধারণা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন।সেজন্য আগেই দুঃখ প্রকাশ করছি।
১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহিত রেজ্যুলেশন ২৬০(৩) অনুসারে যেসব কর্মকাণ্ড গণহত্যার হিসেবে বিবেচিত হয় সেগুলো হল -
ক)পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ
খ)তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন
গ)পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধন কল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়
ঘ)এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাতে একটু জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন ধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নয়,সেই সাথে তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেয়া হয়
ঙ)একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্ম পরিচয় ও জাতিগত পরিচয়কে মুছে ফেলাকেও গণহত্যা বলা হয়
গণহত্যার দায়ে কারা শাস্তিযোগ্য সে সম্পর্কেও বলা আছে।শুধু গণহত্যা সাধনই নয়,গণহত্যা পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ যারা এ কাজে উদ্বুদ্ধকরণে সম্পৃক্ত থাকবে তারাও এই অপরাধের কারণে বিচারাধীন হবে।এই উদ্বুদ্ধকরণের ব্যাপারটি সরাসরি হোক,নিভৃতে হোক কিংবা জনসমক্ষে উত্তেজক বক্তব্যের মাধ্যমেই হোক তা সমভাবে গুরুতর অপরাধ।গণহত্যা সাধনে ব্যর্থ প্রয়াস বা এ জাতীয় প্রচেষ্টার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও বিচারযোগ্য অপরাধী।
এটা গণহত্যার মৌলিক সংজ্ঞা।বাস্তবে,সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে গণহত্যা কীভাবে সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে আলাদা ভাবে জানা প্রয়োজন।গণহত্যা বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন গণহত্যা সংঘটনের একটি ধারণা দেন,যেখানে আটটি ধাপে গণহত্যা সংঘটনের কথা বলা হয়েছে।ধাপগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো -
প্রথম ধাপ শ্রেণীকরণ,এই ধাপে গণহত্যার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়,গণহত্যার উদ্যোগ গ্রহণকারীরা যে তাদের থেকে আলাদা এবং উন্নত - সেটা বলা হতে থাকে বারবার।একাত্তরে কী হয়েছিল?পাকিস্তানিদের ভাষায় বাঙালিরা ছিল infidel।প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী এই পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে সেইভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছিল যেভাবে হিটলার করেছিল ইহুদিদের।মেজর বশীরের জবানীতে এন্থনি ম্যাসকারেনহাস জানাচ্ছেন,
The people here may have Muslim names and call themeselves Muslims.But they are Hindus at heart.You won't believe that the maulavi ( mulla ) of the cantonment mosque here issued a fathwa ( edict ) during the Friday prayers that the people would attain janat ( paradise ) if they killed West Pakistanis.We sorted the bastard out we are sorting our the others.Those who are left will be real muslims.We will even teach them Urdu.
নিয়াজির একটি চিঠিতে সে বলেছে,কমপক্ষে দশবছর বাঙালিদের মগজ ধোলাই করা উচিৎ।চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে সুপারিশ ছিল,
There must be more killing,more mopping up and more witch hunting
শ্রেণীকরণটা কতখানি মারাত্মক এবং ঘৃণাপ্রসূত ছিল সেটা এখান থেকে পরিস্কার।
দ্বিতীয় ধাপ চিহ্নিতকরণ,এই ধাপে গণহত্যার লক্ষ্যবস্তুতে থাকা জনগোষ্ঠীকে বিশেষ কিছু পরিচয়ে চিহ্নিত করা করা হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদিদেরকে মানুষ হিসেবে না দেখে ধর্মীয় পরিচয় ইহুদি হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল,নাৎসিদের কাছে তারা ছিল নিতান্তই অপমানের বস্তু।একাত্তরে বাঙালিদেরও হিন্দু,আধা মুসলমান,ইনফিডেল ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল,যেটা উপরের উদ্ধৃতিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
তৃতীয় ধাপ বিমানবিকীকরণ।এই ধাপে গণহত্যার ভিকটিমদের মানবিক মর্যাদার অবমাননা করা হয়।বিভিন্ন পশুর সাথে তুলনা করা হয়,হেট ক্যাম্পেইন চালানো হয়।স্ট্যান্টন বলেছেন,
One group denies the humanity of the other group. Members of it are equated with animals, vermin, insects or diseases. Dehumanization overcomes the normal human revulsion against murder. At this stage, hate propaganda in print and on hate radios is used to vilify the victim group.
হিউম্যানিটি ডিনাইয়ের ব্যাপারটি আগেই দেখা গেছে।আরো একটি উদাহরণ দিচ্ছি।আর জে রামেল জানাচ্ছেন
Bengalees are often compared with monkeys and chickens.It was low lying land of low lying of low lying people.The hindus among the bengalees were as Jews to nazis,scum and vermins that should be exterminated.
As to the muslim bengalees,they are to live on the sufferance of the soldiers,any infraction,any suspicion cast on them need for reprisal could mean their death.And the soldiers were free to kill at will.
The journalist Dan Coggin,quoted one Punjabi Captain as telling him - " We can kill any one for anything,we are accountable to none.This is arrogance of power."
চতুর্থ ধাপ সংগঠন।গণহত্যা সবসময়ই পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত হয়ে থাকে।বাঙালিদের বংশ পরম্পরায় নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা শুরু হয় একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে,২০ মার্চ যা অপারেশোন সার্চলাইট নামে অনুমোদিত হয়।এর পর ২৫ মার্চ এই অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয় ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস গণহত্যা যা চলেছে পরবর্তী নয় মাস ধরে।
পঞ্চম ধাপ মেরুকরণ।এই ধাপে গণহত্যার পক্ষে বিপক্ষে দু'টি সুস্পষ্ট বিভাজন দেখা যায়।এবং গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থানকারীদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়।একাত্তরের গণহত্যা চলাকালে গণহত্যার বিপক্ষ গোষ্ঠী বলতে একমাত্র বাঙালিরাই ছিল,এর বাইরে প্রায় প্রতিটি পাকিস্তানি নাগরিক এই গণহত্যার পক্ষে সরব অথবা নীরব সমর্থন দিয়েছে।পাকিস্তানে অল্প কিছু সাংবাদিক,সাহিত্যিক ছিলেন যারা এই গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন,তাদেরকেও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে।বিদেশে যেসব সাংবাদিক,কূটনীতিক গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন তাদেরকেও প্রোপাগান্ডিস্ট এবং এসব প্রতিবাদকে ভারতের লবিং বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে যখন চলছে বীভৎস গণহত্যা,পাকিস্তানে তখন সর্বত্র চলছে হেট ক্যাম্পেইন।নিউজউইকের খবরে জানা যায় -
নানারকম উত্তেজক শিরোনামে ভরা থাকে পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকা।যেমন একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে - "সম্মিলিতভাবে দিল্লিকে আক্রমণ কর,বুঝিয়ে দাও পাকিস্তান কী চীজ";অন্য একটি পত্রিকার শিরোনাম "ভারতকে ধ্বংস কর"।
'CRUSH INDIA','HIT INDIA','HATE INDIA' - এধরণের নানান বাক্য লেখা স্টিকারে ভরে গেছে সারা পশ্চিম পাকিস্তান।স্কুটারের পেছনে,ঘোড়ার গাড়ির পেছনে,বাসে ট্রেনে সর্বত্র ভারত বিধ্বংসী এসব স্টিকার এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার"
ঁঁ
ষষ্ঠ ধাপ প্রস্তুতি।এই ধাপে হত্যার উদ্দেশ্যে তালিকা বানানো হয়,নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়।একাত্তরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের,বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছে।মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের তালিকা করে হত্যা করা হয়েছে বেছে বেছে।নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়ে সামর্থ্যবান যুবকদের ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে।জহির রায়হানের একটি সাক্ষাতকারে জানা যায় সিআইএ এজেন্ট ডুসপিককে সাথে নিয়ে রাও ফরমান আলী প্রায় তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা তৈরি করে।
সপ্তম ধাপ হত্যাযজ্ঞ।গণহত্যা বা জেনোসাইডের এটিই মুখ্য ধাপ।স্ট্যান্টন এই ধাপটিকে ম্যাস কিলিং বা ম্যাসাকার না বলে বলছেন এক্সটার্মিনেশন।এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় পোকামকড় দমন বা এই জাতীয় ক্ষেত্রে।গণহত্যা পরিচালনার সময়ে হত্যাকারী পক্ষ প্রতিপক্ষকে পোকামাকড় জাতীয় কিছুই মনে করে থাকে।
It is “extermination” to the killers because they do not believe their victims to be fully human.
সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে প্রত্যাখ্যান বা গণহত্যা অস্বীকার।এই ধাপে গণহত্যাকে জায়েজ করার জন্য বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করানো হয়,নিহতের সংখ্যা কমিয়ে প্রচার করার প্রোপাগান্ডা চালানো হয়,হত্যাকাণ্ড অপরিহার্য ছিল এবং যা হয়েছে সেগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়েনা - এই ধরণের প্রচার চালানো হয়।
৩.
অষ্টম ধাপটি নিয়ে আমাদের মূল আলোচনা।স্ট্যান্টন এই অস্বীকার বা ডিনায়াল পর্বের জন্য আবার বারটি পদ্ধতির কথা বলেছেন ।এগুলো প্রধানত যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য প্রযোজ্য।একাত্তরের গণহত্যা চলাকালে এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে অল্প কয়েকটি বাদ দিয়ে বাকি সবগুলো পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অস্বীকার করার জন্য।
এই পদ্ধতিগুলো খুব সংক্ষেপে একবার দেখে নেয়া যাক
## Question and minimize the statistics
## Attack the motivations of the truth-tellers
## Claim that the deaths were inadvertent
## Emphasize the strangeness of the victims
## Rationalize the deaths as the result of tribal conflict
## Blame “out of control” forces for committing the killings
## Avoid antagonizing the genocidists, who might walk out of “the peace process
## Justify denial in favor of current economic interests
## Claim that the victims are receiving good treatment
## Claim that what is going on doesn’t fit the definition of genocide
## Blame the victims
## Say that peace and reconciliation are more important that blaming people for genocide
একাত্তরে বাঙালিদের উপরে চাপিয়ে দেয়া গণহত্যা অস্বীকার করতে যেসব প্রোপাগান্ডা চালানো হয় সেগুলোর মূল ভাষ্যগুলো এরকম -
## তিরিশ লক্ষ নিহত হয়নি,এটি একটি মিথ।নিহত হয়েছে বড়জোর কয়েকলাখ,কারো কারো মতে সংখ্যাটা কয়েক হাজারের বেশি নয়।
## সাড়ে চার লক্ষ নারী ধর্ষণের ব্যাপারটিও একটি মিথ।
## যুদ্ধ চলাকালে কিছু হতাহত হবেই,এটাই স্বাভাবিক।এর বাইরে উইলফুল কিলিং বলতে যা বোঝানো হয় তা হয়নি।
## একই কথা ধর্ষণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য,কয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়া এরকম কিছু ঘটেনি।
## বাঙালিদের দ্বারাই বাঙালি মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছে।
## গণহত্যা বলতে যা বোঝানো হয় সেরকম কিছু ঘটেনি।
## সংবাদ মাধ্যমে যা প্রকাশ পাচ্ছে সেগুলো নিছক প্রোপাগান্ডা,সর্ববৃহৎ ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য প্রচারণা।
৪.
এবার একে একে এগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক।প্রথমে আসা যাক তিরিশ লক্ষ নিহত হওয়ার ব্যাপারে। মুক্তিযুদ্ধের পরপই সংবাদপত্রগুলোতে নিহতের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেগুলো এরকম -
দিনাজপুর - ৭৫,০০০
চাঁদপুর - ১০,০০০
বরিশাল শহর -২৫,০০০
ঝালকাঠি - ১০,০০০
রংপুর - ৬০,০০০
আখাউড়া - ২০,০০০
ঠাকুরগাঁ - ৩০,০০০
চট্টগ্রাম - এক লক্ষের উপরে
সেতাবগঞ্জ - ৭০০০
পার্বতীপুর - ১০,০০০
সৈয়দপুর - ১০,০০০
কুড়িগ্রাম - ১০,০০০
কুষ্টিয়া - ৪০,০০০
নওগাঁ - ২০,০০০
কুমিল্লা - ২০,০০০
নড়াইল - ১০,০০০
বগুড়া শহর - ২৫,০০০
জামালপুর - ১০,০০০
চৌদ্দগ্রাম - ১,০০০
স্বরূপকাঠি ও বানারীপাড়া - ৫০০০
মানিকগঞ্জ - ১০০০
নরসিংদী - ১০১৯
হাজিগঞ্জ - ৩০,০০০
এই অল্প কয়েকটি এলাকাতেই মোট নিহতের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ তিরিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।এবার কয়েকটি জেলাওয়ারি হিসাব দেখা যাক - আর জে রামেল জানাচ্ছেন -
The human death toll over only 267 days was incredible. Just to give for five out of the eighteen districts some incomplete statistics published in Bangladesh newspapers or by an Inquiry Committee, the Pakistani army killed 100,000 Bengalis in Dacca, 150,000 in Khulna, 75,000 in Jessore, 95,000 in Comilla, and 100,000 in Chittagong. For eighteen districts the total is 1,247,000 killed. This was an incomplete toll, and to this day no one really knows the final toll.
পঁচিশ মার্চ রাতেই ঢাকা শহরে হত্যা করা হয় সাত হাজারের বেশি মানুষকে।সাতাশ মার্চ দুপুরের মধ্যে তেইশ থেকে চব্বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা ঢাকায়।পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে টঙ্গী থেকে বুড়িগঙ্গা হয়ে জিঞ্জিরা এবং মিরপুর ব্রিজ থেকে আদমজী পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় নব্বই হাজার।মানুষ হত্যার এই হার এবং উপরের অল্প কয়েকটি এলাকার হিসাব মাথায় রেখে পুরো বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ২৬৭ দিনের জন্য বিবেচনা করলে তিরিশ লক্ষ সংখ্যাটি খুবই বাস্তব সম্মত বলেই মনে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে এবং তার পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত নিহতের হিসাবের দিকে একটু চোখ দেয়া যাক -
কয়েকজন গবেষকের দেয়া উপাত্ত -
এখানে সবচেয়ে বেশি যে সংখ্যাটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো ১৫ লক্ষ।যাদের হিসাবে এই সংখ্যাটা এসেছে তারা বলেছেন মাঠ পর্যায়ের গবেষণার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা।বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যে বধ্যভূমি রয়েছে,তার সবগুলোর হিসাব নেয়া সম্ভব হয়নি এখনো।তাছাড়া এই হিসাব গুলোর বেশিরভাগই আংশিক হিসাব,সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নয়।এই ব্যাপারটিকে মাথায় রাখলে পুরো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিরিশ লক্ষ সংখ্যাটি একেবারেই অবাস্তব নয় যার স্বীকৃতি মিলেছে তিরিশ লক্ষের পক্ষে যারা মত দিয়েছেন তাদের কথায়।এই পরিসংখ্যানের বাইরেও,ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এই গণহত্যা নিহতের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ বলেই ঘোষণা করেছে।
শর্মিলা,সাইকিয়া আরো অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন ইচ্ছাকৃত,পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড,ধর্ষণ হয়নি।এ ব্যাপারে তাদের মনোভাব বেশ কৌতূহল জাগায়।শর্মিলা এবং সাইকিয়া তাদের প্রবন্ধ গুলোতে বারবার মুক্তিযুদ্ধকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেন।কিন্তু তাদের বিশ্লেষণ দেখে সেটা প্রমাণিত হয় না।বাংলাদেশের ধর্ষিত নারীদের বিবৃতি শর্মিলার কাছে অসত্য মনে হয়।রাবেয়া খাতুন অশিক্ষিত কিন্তু তার ভাষা অনেক বেশি সুসংহত,কাজেই তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয় - এই হলো শর্মিলার যুক্তি।বাংলাদেশের গবেষকদের কাজ তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়,তবে পাকিস্তানি জেনারেলদের বক্তব্য তারা নির্দ্বিধায় সত্য বলে মেনে নিতে পারেন।এখানে আমরা কয়েকটি ঘটনার দিকে চোখ দেবো যার সবকটিই জানা গেছে বিভিন্ন বিদেশী সাংবাদিকের মাধ্যমে।এগুলো যেসব সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা সারা পৃথিবী জুড়ে একবাক্যে স্বীকৃত।
গণহত্যা যদি পরিকল্পিত না হবে,ইচ্ছাকৃত না হবে তাহলে ধরা পড়া বাঙালিদের কেন 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিতে বাধ্য করা হবে যাতে পালিয়ে থাকা বাঙালিরা বেরিয়ে আসে বাইরে?দেখুন নিউজউইকের ২৬ এপ্রিল ১৯৭১ এর প্রতিবেদন -
In the port city of Chittagong,Pakistani troops reportedly forced Bengali prisoners to ride in front of a truck shouting "Joy BANGLA" ( Victory for Bangla ) - an independence slogan.When other Bengalis emerged from their hiding places,the pakistanis opened fire with machine guns and in the cities of Sylhet and Comilla along the eastern borders West PAkistani firepower routed the followers of nationalist leader Mujibur Rahman and left the bodies of acores dead peasants to be picked apart by vultures and dogs.
গণহত্যা কতখানি পরিকল্পিত এবং সুগঠিত ছিল দেখুন এর পরে অনুচ্ছেদেই।বলা হয়েছে,বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শেষ করে দেবার জন্য হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে -
In city after city,in fact the soldiers were apparently determined to shatter the economic base of East Pakistan in order to crush the independence movement.On orders from the Islamabad high command,troops systematically gunned down students,engineers,doctors and any other person with a potential for leadership,whether they were nationalists or not.
সানডে টাইমসের ২০ জুন ১৯৭১ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে -
আর্মি ইন্টেলিজেন্স সদস্যরা প্রতিভাবান সরকারি কর্মকর্তা,শিক্ষক,সাংবাদিকদের ধরে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচাই করছে তাদের মধ্যে কারা আওয়ামীলীগ সমর্থক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল।
এই বাছাইয়ে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করেছে : প্রথম - সাদা,দ্বিতীয় - ধূসর,তৃতীয় - কালো
বাছাইয়ে যারা সাদা প্রমাণিত হচ্ছে তারা খালাশ।যারা ধূসর প্রমাণিত হচ্ছে তারা তাদের চাকরি হারাচ্ছেন বা বন্দি হচ্ছেন।আর যারা কালো প্রমাণিত হচ্ছেন তাদের জন্য ভয়ঙ্কর মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
সানডে টাইমসেই ১৩ জুন প্রকাশিত হয়েছিল এন্থনি ম্যাসকারেনহাসের সাড়া জাগানো প্রতিবেদন Genocide।এই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে -
The pogrom's victims are not only the Hindus of East Bengal - who constitute about 10 percent of the 75 million population - but also many thousands of bengali Muslims,These include university students,teachers,Awami league and Left-Wing political cadres and every one the army catch of the 176,000 Bengali militarymen and police who mutinied on March 26 in a spetacular,though untimely and ill-starred bid to create an independent Republic of Bangla Desh
What I saw and heard with unbelieving eyes and ears during my 10 days in East Bengal in late april made it terribly clear that the killings are not isolated acts of military commanders.
হত্যাকান্ডগুলো যে বিচ্ছিন্ন নয় সেটা বোঝা যায় স্পষ্টভাবে যখন আত্মসমর্পণ করার পরেও বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করা হয়।১২ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন -
Near Dacca's market place Urdu-speaking government soldiers ordered Bengali-apeaking townspeople to surrender,and then gunned them down when theyfailed to comply.Bodies lay in mass graves at the University,in the old city,and near the municipal dump.
এসব হত্যাকাণ্ড যে পরিকল্পিত ভাবে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা অর্থাৎ গণহত্যা তা প্রমাণিত হয় নিউজউইকের ২৮ জুনের প্রতিবেদনে,যা লিখেছিলেন টনি ক্লিফটন -
আমি দেখেছি সে শিশুকে,যে শিশু পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে নিহত তার মায়ের কোলে,আমি দেখেছি সে লোককে,যার পিঠের ছাল তুলে নেয়া হয়েছে বেয়নেটের আগা দিয়ে।আমি দেখেছি সে ভীতসন্ত্রস্ত পিতাকে,যে প্রত্যক্ষ করেছে যুবতী মেয়ে আর স্ত্রীর ধর্ষণের চিত্র।আমি দেখেছি সে বৃদ্ধ পিতাকে,যার সামনেই হত্যা করা হয়েছে তার ছেলে-মেয়ে,নাতি নাতনি সকলকে।
...আমি ভিয়েতনামের মাইলাই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিনি,কিন্তু শুনেছি।আমার ধারণ,বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি সৈন্যের বর্বরতা মাইলাই বর্বরতার চেয়ে অনেক বেশি।
ক্লিফটনের প্রতিবেদন থেকেই শুনুন কিশোরী ইসমত আরার কথা -
সেদিন রাতে আমি ঘুমিয়ে গেছি,এ সময় ঘরের ভেতর শোরগোল শুনে শোয়া থেকে উঠে দেখি যে,বসার ঘরে আমার যুবতী চারবোন ও মা মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে।রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে।আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি এ দৃশ্য দেখে।আমার চিৎকার শুনে এক পাকিস্তানি সৈন্য আমার গল বরাবর বেয়নেট চালিয়ে দেয়।আমি মাটিতে পড়ে যাই,তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
শর্মিলা বোস বার বার বলেছেন,পরিকল্পিত ধর্ষণ হয়নি,যা হয়েছে তা opportunistic cases of rape।বীভৎস নির্যাতনর ব্যাপারটি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন শর্মিলা।ক্লিফটনের বিবরণ দেখুন আবার,এটিকে কি শর্মিলার opportunistic rape মনে হয়?
আমি দেখেছি পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি বাঙালি কিশোরীকে বারবার ধর্ষণ করে তারপর তার যৌনাঙ্গে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে মেরে ফেলতে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৫৬৩ জন বাঙালি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছিল,তাদের যখন পাওয়া যায় তখন তারা তিন থেকে পাঁচ মাসের গর্ভবতী।দেখুন নিউইয়র্ক টাইমসের ২৫ অক্টোবরের রিপোর্ট -
One of the most horrible revelations concerns 563 young bengali women,some of 18,who have been held captive inside Dacca's dingy military cantonment since the first five days of the fighting,Seized from University and Private Homes and forced into military brohees,the girls are all three to five months pregnant.
কিংবা দেখুন নিচের প্রতিবেদনটি,এখানে পাকিস্তানি হারেম থেকে চার হাজার বাঙালি মেয়েকে পাওয়া যায় -

ধর্ষিতার সংখ্যা নিয়েও চলেছে মিথ্যাচার।বিভিন্ন মাধ্যমে দুই লক্ষ থেকে চার লক্ষ ধর্ষিতার যে তথ্য এসেছে তা সঠিক নয় বলছেন শর্মিলা।অথচ ডাঃ জিওফ্রে ডেভিস বলছেন এই সংখ্যা চার লাখ।ডেভিস বাংলাদেশে এসেছিলেন ধর্ষিতা গর্ভবতী নারীদের সাহায্য করতে।১৯৭২ সালে বাংলার বাণী পত্রিকার একটি সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে -
সিডনীর শল্য চিকিৎসক সম্প্রতি লন্ডনে বলেন যে,ন'মাসে পাক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিতা ৪ লাখ মহিলার বেশিরভাগই সিফিলিস অথবা গনোরিয়া কিংবা উভয় রোগেই আক্রান্ত
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় পাওয়া গেছে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা চার লক্ষ আঠারো হাজার।তাদের হিসাব বলছে আরো বড় পরিসরে গবেষণা করলে এই সংখ্যা সাড়ে চার লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে।
শর্মিলা বসু এবং ইয়াসমিন সাইকিয়া আরো চমৎকার সব তথ্য দেন আমাদের।বাঙালি নারীরা ধর্ষিত হয়েছে বাঙালিদের দ্বারাই।দেখুন শর্মিলার বক্তব্য
Who abducted the women? Four of the seven women were abducted by Bengali Muslims, one by Biharis (local non-Bengalis). The one taken from Dhaka states she does not know whether her abductors were Bengalis or non-Bengalis. Only one woman says that army personnel abducted her from her home,after shooting her parents. Several of the women knew their abductors – one was the father of her school-mate and a local “chairman”, three women were abducted by neighbours.Who raped the women? Three of the women were raped by their Bengali abductors first and one by her Bihari abductors,before being handed over or sold on to the army. One woman does not know whether her abductors, who raped her first before passing her on, were Bengalis or non-Bengalis, but they were civilians.
ইয়াসমিন সাইকিয়া অবশ্য বেশ সতর্ক।তিনি খুব কোমল ভাষায় স্বীকার করে নেন যে ধর্ষণ হয়েছে,প্রচুর পরিমানেই হয়েছে।সেই সাথে বটম লাইনে জানিয়ে দেন,ধর্ষণ একা পাকিস্তানিরা করেনি,বাঙালিরাও করেছে -
Pakistani soldiers and their Bihari supporters raped and killed to save a nation; Bengali men also raped and killed in the hope of making a new nation,
which they did.
এখানে বাঙালিদের দ্বারা ধর্ষণের দুটি প্রকরণ রয়েছে - বাঙালিদের দ্বারা বাঙালি নারী ধর্ষণ এবং বাঙালিদের দ্বারা পাকিস্তানি নারী ধর্ষণ।পাকিস্তানি নারী ধর্ষণের ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন।পাকিস্তানি আগ্রাসনের সেই সময় একজন পাকিস্তানি নারীও যদি ধর্ষিত হয়ে থাকেন সেটা কি যথেষ্ট তোলপাড় সৃষ্টি করার মত ঘটনা নয়?তাহলে সেই সময়ের কোন সংবাদ মাধ্যমে এর কোন উল্লেখ নেই কেন?সেই সময়ের যেসব মার্কিন দলিলপত্র পাওয়া যায় সেখানে এরকম ঘটনার একেবারেই উল্লেখ নেই এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?যুক্তরাষ্ট্র তো সেই সময়ে পাকিস্তানের পরম মিত্র ছিল।যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়া নাকের জলে চোখের জলে মিশিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে এ জাতীয় কোন ঘটনা উল্লেখ নেই কেন?
বরং নিয়াজির একটি মেমোতে জানা যায়,পাকিস্তানি সৈনিকেরাই বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি মহিলাদের ধর্ষণ করেছে।এই মেমোর উল্লেখ শর্মিলার প্রবন্ধেও আছে।
শর্মিলা এবং সাইকিয়া বলে যান বাঙালিদের দ্বারা বাঙালি নারী ধর্ষণের কথা অথচ বলেন না এই বাঙালি কারা ছিল।একইভবে বলা হয় বাঙালিদের হাতে বাঙালিদের নিহত হবার কথা।হ্যাঁ কথা মিথ্যে নয় - বাঙালি নারী বাঙালির হাতে ধর্ষিত হয়েছিল,বাঙালি রাজাকারের হাতে।কারা ছিল এই রাজাকার?গণহত্যা এবং ধর্ষণ চালানোর ক্ষেত্রে,পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রশ্নে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে তাদের আলাদা করে দেখার অবকাশ আছে কি?রাজাকার অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে -
১৯৫২ সালের পাকিস্তান আর্মি এক্ট ( এক্ট নং ৩৯/১৯৫২ ) এর ৫ নং ধারার ( ১ এবং ৩ উপধারা ) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় সরকার সন্তুষ্টির সাথে নির্দেশ প্রদান করিতেছি যে, (ক) উক্ত আইনের সমস্ত ধারা সমূহ,যতদূর সম্ভব,পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১ ( পূর্ব পাকিস্তান অধ্যাদেশ নং ১০/১৯৭১ ) এর অধীনে সংগঠিত রাজাকারদের প্রতি প্রযোজ্য।
রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনী সহযোগী একটি সশস্ত্র বাহিনী ছিল যারা গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে অংশ নিয়েছে।এই বাঙালি রাজাকারের ধর্ষণের দায় কেন বাঙালিদের ঘাড়ে পড়বে?
রাজাকার বাহিনী সম্পর্কে একজন পাকিস্তানি লে. কর্নেল শামসুজ্জামানের মূল্যায়ন শুনুন সাংবাদিক মারি স্যালির মুখ থেকে।এই প্রতিবেদনটি ১১ জুলাই ১৯৭১ সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়।রাজাকারদের সম্পর্কে শামসুজ্জামানের মূল্যায়ন -
good chaps,good muslims and loyal Pakistanis
নিচের ছবিটি দেখুন।রাজাকার বাহিনী,শান্তিকমিটি এরা কাদের হয়ে কাজ করেছিল সেটা এখানে পরিস্কার -
রাজাকার বাহিনী,শান্তিকমিটি এরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে একই উদ্দেশ্যে একই কাজ করেছিল।রাজাকারদের বাঙালি হিসেবে ট্যাগ করে সেই দায় মোচনের বা লঘুকরণের কোন সুযোগ নেই।
এখানে যেসব হত্যা ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো কীভাবে গণহত্যার উপাদান হিসেবে কাজ করে?সংক্ষেপে বললে গণহত্যা হল জাতিনিধন প্রক্রিয়া।যেখানে হিন্দুকে হিন্দু বলে হত্যা করা হয়েছে,হিন্দু নারীর স্বামীকে হত্যা করে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে ,হিন্দুর জন্ম ঠেকানোর জন্য তখন তা গণহত্যা বলেই বিবেচিত হবে।বাঙালিকে যখন তার বাঙালি পরিচয়ের জন্য হত্যা করা হয়েছে তখন তা সুনির্দিষ্টভাবে গণহত্যা।অপারেশন সার্চলাইট শুরু অব্যবহিত পরে পরেই ক্যাপ্টেন চৌধুরি নামে এক পাকিস্তানি সেনাসদস্য বলেছে -
Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation
বাঙালি নারীকে যৌনদাসী হিসেবে আটকে রেখে একদিকে বাঙালি শিশুর জন্ম রোধ এবং বাঙালি নারীর মাধ্যমে পাকিস্তানি সন্তান উৎপাদনের চেষ্টা জাতিনিধনের একটি উপাদান এবং অবশ্যই উপাদান গণহত্যার।
৫.
ইতিহাসের প্রতিটি গণহত্যার নিয়েই পোপাগান্ডা চলেছে,অস্বীকার করার চেষ্টা হয়েছে মানবজাতির ইতিহাসের এইসব ঘৃণিত অধ্যায়কে।এসব প্রোপাগান্ডাকে প্রতিরোধও করা হয়েছে সাধ্যমত।সচেতন ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরা এগিয়ে এসেছেন সত্য ইতিহাস তুলে আনতে।এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে - মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে চর্চা এবং গবেষণা হয়েছে খুবই কম।আন্তর্জালে বিভিন্ন সাইটে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পাঁচটি গণহত্যার তালিকায় বাংলাদেশ নেই।এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে এই যুদ্ধকে সিভিল ওয়ার বলে চালিয়ে দেয়া হয়।লজ্জাজনকভাবে অনেক সময় এই দুঃসাহসটি দেখান অনেক বাংলাদেশিই।তারা ভুলে যান গত শতকে বাংলাদেশ সেইসব বিরল দেশগুলোর একটি যেটির নাগরিকেরা স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করেছে এবং যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।তাত্ত্বিক ভাবে এই যুদ্ধকে সিভিল ওয়ার বলা একেবারেই ভুল এবং অন্যায়ও বটে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য আরো তীব্র এই কারণে - একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে যদিও গবেষণা হয়েছে কম,তবে প্রোপাগান্ডা হয়েছে খুব বেশি,এই প্রোপাগান্ডা চলছে গবেষণার নামেও।এইসব প্রোপাগান্ডাবিদেরা তো বটেই,আমরাও অনেক সময় ভুলে যাই - এসব অপপ্রচার এবং সেগুলো বিশ্বাস করার মাধ্যমে একটি জাতির জন্মকে অপমান করা হয়।প্রতিবাদ করতে হবে এখনই,প্রতিটি কোণ থেকে।প্রতিবাদ করতে হবে বারবার।জবাব দিতে হবে প্রতিটি মিথ্যাচারের।
এর সাথে আরো একটি বিষয় ভাবার অবকাশ থেকে যায়।বাংলাদেশে দীর্ঘদিন পরে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে,ঠিক তখনই কেন শর্মিলাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রিকন্সট্রাক্ট করার দরকার হয়ে পড়লো?রুবাইয়াত কেন হঠাৎ করে ২০১১ তে এসে যুদ্ধ ও প্রেমের ছবি বানাবেন?কেন নাদির-ইমরান হঠাৎ করে এতদিন পরে এসে দুঃখিত হয়ে পড়ছেন?এসব একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ কি না সেটা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
বাঙালির শত্রুর অভাব কোনদিন ছিল না,এখনো নেই।চোখ এবং কান খুলতে বেশি দেরি করার খেসারতটা কিন্তু বাঙালিকেই দিতে হবে।
তথ্যসূত্র
১) যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ - ডা. এম এ হাসান
২) '৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ - ডা. এম এ হাসান
৩) মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র - মুনতাসীর মামুন
৪) মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ - মুনতাসীর মামুন
৫)বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে শত্রুমিত্র - সিরু বাঙালি
৬) Genocide - Anthony Mascarenhas,July 13,1971,The Sunday Times
৭)Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War,Sarmila Bose
৮)Beyond the Archive of Silence: Narratives of Violence of the 1971 Liberation War of Bangladesh,Sayeeda Yasmin Saikia
লিখেছেনঃ প্রীতম
http://amarblog.com/pritomdas/posts/145847

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




