(প্রথমেই বলে রাখি "মেটাল" একটি বিশাল বিষয়। এটি কেবল এক ধরনের গান নয়, এটি একটি না না দর্শনের প্রতিষ্ঠানও বলা যায়। তাই ক্ষুদ্র পরিসরে মেটাল নিয়ে আলোচনা বেশ কঠিন। আরেকটি কথা, এই পোস্ট টি মেটালকে আমি কিভাবে বুঝি সেটাই উপস্থাপনের চেষ্টা করবো। তাই জানরা ডেফিনেশনে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে, কারন অনেক জানরার সঠিক ডেফিনেশন নেই। আবার ঐক্যমত্যও নেই। তাই আমি যেভাবে বুঝি সেটাই উল্লেখ করবো। আর ইচ্ছাকৃত ভাবে পার্টিকুলার গান বা ব্যান্ড কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা করেছি কারন যারা মেটাল শ্রোতা নন, তারা হোচট খাবেন। আর আমি চাই আরো বেশী সংখ্যক মানুষ মেটালকে বুঝুক)
মেটালের সাথে আমার পরিচয় অষ্টম শ্রেনীতে । মেটালিকার এন্টার স্যান্ডম্যান। গানটি শুনেই আমি অবাক হয়েছিলাম। কারন গান বলতে যা বুঝতাম তার কিছুই এখানে ছিল না। কিন্তু এমন কিছু ছিল যা আমি আগে কখোনো কোন গানে পাইনি। পরবর্তীতে অসংখ্য মেটাল গান শুনেছি এবং এই মিউজিকটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। যতই বুঝেছি ততই এই মিউজিক সম্পর্কে আমার অনুভুতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছে। বুঝেছি এই কর্কশ সুরের পেছনের অনন্ত হতাশার বিভ্রান্ত তরুন মনের কথা।
মেটালের জন্ম এমন একটি সময়ে যখন পৃথিবী যাচ্ছিল এক ভয়াবহ সংকট কালের মধ্য দিয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোল্ড ওয়ার, কালোদের উপর নির্যাতন, সবমিলিয়ে বছরের পর বছর নতুন প্রজন্মকে বাবা মারা যে মিথ্যা রুপকথা শুনিয়ে এসেছে তার লজ্জাজনক বস্রহরন। পতিত সময় সবসময়ই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে নতুন কিছু গড়তে। তবে এ গড়া সৃষ্টির গড়া নয়, এ গড়া সর্বাধিক সৃষ্টিছাড়া গড়া।
যখন নতুন প্রজন্মের সামনে একের পর এক আসতে থাকল প্রতিশ্রুত তথাকথিত সত্যের মিথ্যা রুপ , তখন জন্ম নিলো মেটালের গভীরতম মোটিভেশন। "অস্বীকার"। হ্যা ডিনায়েল ছিল মেটালের প্রাথমিক উৎসাহ। চিরকালের সুন্দরস্তব , অসংখ্য সুন্দরতম উপমা, আর সুলেল সুর হঠাৎই পরিণত হল এক নিদারুন ভন্ডামিতে। এই পৃথিবীতে সুন্দর কিছু নেই, সবই কুৎসিত আর ভন্ডামিতে পরিপূর্ন। যদিও টেকনিক্যালী মেটালের জন্ম বলতে বিখ্যাত ডেথ নোটের(আমার স্মৃতি যদি আমার সাথে প্রতারনা না করে থাকে, যদি এই তথ্য ভুল হয় পাঠক আমাকে ঠিক করে দেবেন)জন্ম বোঝায়। কিন্তু মেটালের জন্ম কেবল একটি নতুন উপায়ে গীটার বাজানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সুর, এর কথা সবকিছুই জন্ম দিতে সক্ষম একটি নতুন দর্শনের।
মেটালের জন্ম থেকেই জীবনের অন্ধকার দিক গুলো প্রকট হয়ে উঠে। ডিয়ো কিংবা ডিপপার্পেলকে এ হিসেবে স্যাম্পল হিসেবে দেখা যায়। যে পৃথিবী শুদ্ধ এবং সুন্দর কিছু জন্মদানে ব্যার্থ তাকে পরিত্যাগ করে মেটাল। গানের বিষয় হিসেবে উঠে আসে মানুষের ক্রোধের কথা, হিংসার কথা, লোভের কথা, যৌনতার কথা। মানুষকে যে ভুল যুগযুগ ধরে বোঝানো হয়েছে সেই ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করে যেন প্রাথমিক মেটাল গান গুলো। গানে অন্ধকার জীবনের কথা উঠে আসে, আসে পতিত শহরতলীর কথা। এর সাথে তুলনা করা যায় কবিতা যখন রোমান্টিক শুদ্ধতা ছেড়ে আধুনিকতার রাস্তায় নেমেছিল, কবিতার বিষয়ে ফুলের চেয়ে আস্তাকূড় প্রাধান্য পেয়েছিল। ফুল শুকিয়ে যায় দুদিনেই। কিন্তু পরম প্রত্যাদেশের মত রাস্তার কোনের আস্তাকূড়টা টিকে থাকে। এই জীবনের পথে তাই আস্তাকূড়ের বাস্তবতাই বেশী "মূলগত"। মেটালের মাঝেও তাই ঢুকে পরে এই বিষয়গুলো।
মেটালের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সম্ভবত অস্বীকার করার প্রবনতা। মেটাল অস্বীকার করে সব প্রচলিত প্রথার আর সমাজযন্ত্রের পাতানো কাঠামোকে। পতিত সময়ে এই অস্বীকার করার প্রবনতাই সবচেয়ে বেশীবার দেখা গেছে মেটালের মাঝে। আমি বারবার এর উদাহরন দেখতে পাই, "আই ওন্ট ডু হোয়াট ইউ টেল মি টু ডু"(আর্টিস্টের নাম ভুলে গেছি) সম্ভবত মেটালের এই প্রবনতার সাড়বস্তু। এই অস্বীকার প্রবনতা এসেছে পূর্ববর্তী জেনারেশনের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেটে ১৮ বছরে তখন ভোট দেয়া যেত না, কিন্তু ভিয়েতনামে বাধ্যতামূলক যেতে হত। জমে থাকা এই অবিশ্বাস ই মূলত তৈরী করেছে সমাজকাঠামোর সকল উপাদান কে অস্বীকার করানোতে।
যেকোন যুগসন্ধির শিল্প আঘাত করে প্রচলিত বিশ্বাস আর প্রবনতা গুলোকে। এমনটা করেছে আধুনিক কবিতাও। করেছে আধুনিক উপন্যাসও। এমিল জোলার পতিতাপল্লীর সেই নির্মম ইতিহাস কিংবা জেমস জয়েসের ইউলিসিস অথবা ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাস গুলি। সুধীনদত্তের নির্বান দেখি আমরা "উটপাখী" তে। বালুতে মুখ গুজে রাখা উটপাখী কে চিত্রিত হয় অন্ধ সমাজ। ঈশ্বর তার কবিতায় পরিনত হন "আরন্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দু:স্বপ্নে"। এই আঘাত কে অন্য একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছে মেটাল। যে ঈশ্বরের সৃষ্ট মহাবিশ্বে এত দু:খ, কষ্ট , আর অমানবিকতা, সেই মহাবিশ্বে ঈশ্বর হয়ে পড়েন তীব্র এখরোখা এক স্বৈরাচারী। তাই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত স্যাটান হয়ে পরেন যুগের ট্র্যাজিক হিরো। যার স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্যেই স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হয়। তাই মেটাল গানেও একটি ইমেজ শয়তানের আদলে তৈরী হয়। তবে সেটিকে সরাসরি স্যাটান হিসেবে যেমন ব্যাবহার করা হয়েছে তেমনি এন্টিগড হিসেবেও উপস্থাপিত হয়েছে। আসলে এই উপস্থাপন ছিল এক ধরনের প্রতীকি প্রতিবাদ। কিছু মানসিক বিকার গ্রস্ত শিল্পী ছাড়া স্যাটানকে আসলেই ক্ষমতার অধিকারী ভাবেন নাই মেটাল শিল্পীরা। ডিয়ো, আয়রন মেইডেন, জুডাস প্রীস্ট, এলিস কুপার সহ অনেকেই গ্রহন করেন এই তীব্রতম প্রতিবাদের ভাষা। ডিয়ো তার সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারটিও ভুলভাবে ইন্টারপ্রেট হয় স্থুলবুদ্ধির সমাজের রক্ষাকর্তাদের কাছে। তারা মেটাল কে দেখা শুরু করেন শয়তানের উপাসনার উপায় হিসেবে। অজি অসবোর্ন এর এলবাম পুড়াতে থাকেন ক্যাথলিক রা। সানডে স্কুলে বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়া হয় যে মেটাল শয়তানের কারসাজি। আয়রন মেইডেনের "নাম্বার অফ দ্যা বিস্ট" সম্ভবত অন্যতম বিতর্কিত গান। এই গানের অসংখ্য কপি পোড়ানো হয় বিভিন্ন যায়গায়। তবে মেটালে আসল শয়তানের উপাসনা যে পরবর্তীতে হয়নি তা ঠিক নয়। নরওয়ের কুখ্যাত ব্ল্যাকমেটাল ব্যান্ড গুলির কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মুলধারার মেটালে এরকম আবালীয় ধারনা তেমন দেখা যায় না।
মেটালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য যা প্রায় সকল মেটাল ব্যান্ড গ্রহন করেছে সেটি হচ্ছে পরাবাস্তবতা। অসংখ্য মেটাল গানে অন্ধকার আলোর মিশেলে তৈরী হয়েছে নানা অবাস্তব দৃশ্যকল্প। এর উৎপত্তিও এই নষ্ট পৃথিবী থেকে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবেই আমি দেখতে চাই। কাফকার লেখা বা সমসাময়িক ফরাসী কিছু লেখকের লেখায় আমরা সাহিত্যে পরাবস্তবতার সফল প্রয়োগ দেখি। মেটালও তার নিজস্ব উপায়ে পরাবাস্তবতা কে ব্যাবহার করেছে। নানা পরাবাস্তব দৃশ্যকল্পে রুপকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে অনেক গভীর সত্য। মেটালের এই বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে সহজে চোখে পরে। আয়রন মেইডেনের অসংখ্য গানে আমরা এর সফল প্রয়োগ দেখতে পাই।
মেটালের অন্যতম প্রিয় বিষয় মৃত্যু। মেটালের মৃত্যু নিয়ে প্রায় বাড়াবাড়ি রকম উৎসাহ পশ্চাৎপটে জীবনের ব্যার্থতাকেই প্রকাশ করে। তাই মেটাল ঘেটেছে মৃত্যুকে অন্য যেকোন শিল্পমাধ্যম থেকে বেশী। মৃত্যুকে রোমান্টিসিজমেও পরিণত করেছে কোন কোন শিল্পী। মৃত্যু হয়ে উঠেছে আকাঙ্ক্ষেয়। পার্থিবতার প্রতি অপরিসীম ঘৃণাই মৃত্যু, এবং আত্নহত্যার বিষয়গুলোকে প্রকট করে তুলেছে মেটাল গানে।
ব্যার্থ জীর্ন পৃথিবীতে যখন নতুন প্রজন্মের বিশ্বাস ভঙ্গের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তখন প্রতিবাদ, অস্বীকার, ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছা সর্বপরি এই পৃথিবী থেকে দুরে যাওয়ার আকুল ইচ্ছাই প্রাথমিক মেটাল যুগের প্রধান উপজীব্য ছিল। পার্থিব জীবনকে সোজাসুজি বাতিল করে দিয়ে মেটাল খুজেছিল এক নতুন জগৎ। কিন্তু ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সাময়িক হলেও শান্তি এসেছে। মানুষের মনের অস্থিরতাও কমে এসেছে। যদিও বিশ্বের প্রতিকূলতা এখনও নতুন প্রজন্মকে করে বিভ্রান্ত, কিন্তু তা প্রকট ছিল না মেটালের জন্মলগ্নের মত। মেটালের মাঝেও আসে বিবর্তন। মেটাল আরো এক্সট্রিম হয় মিউজিকের দিকদিয়ে, কিন্তু বিষয় নির্বাচন, সুরে মৌলিক পরিবর্তন আসে। যুদ্ধের ভয়াবহতা, রাজনীতি, শান্তির আকুতি ইত্যাদি বিষয় হয়ে উঠে অনেক মেটাল ব্যান্ডের। উল্লেখ করব মেগাডেথের "পীস সেলস হু ইজ বায়িং" কিংবা "সিম্ফোনী অফ ডেসট্রাকশন"। অথবা "স্করপিয়ন্সের" "উইন্ড অফ চেন্জ"। মেটালের এই বাস্তবতার দিকে ফিরে আসা সকল মেটাল ব্যান্ড গ্রহন করেনি। আসলে হাজার জানরায় বিভক্ত মেটালকে নির্দিষ্ট কিছু ভ্যরিয়েবল দ্বারা মাপাও কঠিন।
মেটালের বিষয়, ভাবে, ইন্সট্রুমেন্টস এ ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে গত চার দশকে। আমরা এখন ইভালুয়েট কিংবা ইকুইলিব্রিয়ামের গানে দেখি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান লোকসঙ্গীতের সুর। সেপালচুরাও ব্রাজিলের হেরিটেজ একাধিক বার ইউজ করেছে। আমরা দেখতে অধিকতর ধীর লয়ের ব্যাক মেটালের উথান। দেখতে পাই পাওয়ার মেটালের পতন(যা একসময় সর্বাধিক জনপ্রিয় জানরা ছিল)। কিন্তু সৃষ্টির শুরু থেকে মেটাল যেই প্রতিবাদের সুর, পৃথিবীতে মানিয়ে নিতে না পারার ক্ষোভ, আর সামাজিক "আউটসাইডার" দের শিখিয়েছে স্বাধীনতার শিক্ষা, তা আসলেই অতুলনীয়। মেটালের অসংখ্য নিন্দার পরও মেটাল সবসময়ই স্বাধীনতা আর সামাজিক পশ্চাৎপদ বৃদ্ধতন্ত্রের বিরোধীতা করে এসেছে।
পাপারোচের চিৎকার(যদিও পাপারোচ ঠিক মেটাল জানরায় পরে না তবুও লিরিকটি খুব এপ্রোপিয়েট মনে হল) ভালোভাবে বিষয়টিকে প্রকাশ করে
ফাক ইয়োর মানি
ফাক ইয়োর পজেশন
ফাক ইয়োর অবসেশন
আই ডোন্ট নিড দ্যাট শীট(বিটুইন এন্জেলস এন্ড ইনসেক্টস)