ভদ্রলোক সম্ভবত কোনো এক এনজিও থেকে এসেছিলেন। অফিসে ঢোকার মুখে কে যেন আমার দিকে ইঙ্গিত করলেন। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। পরিচয়পর্ব সম্পন্ন হল, অতি বিনয় দেখাতে গিয়ে নেমকার্ড বিনিময়ও হল। ভদ্রলোক একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে চান, তবে এমনি-এমনি নয়, দিতে চান হাতে-হাতে, যেন মিস না হয়। তবে তাই হোক! কম্পিউটারে কম্পোজ করা দেড় পৃষ্ঠার বিজ্ঞপ্তি নিলাম। মানিকগঞ্জ কি নারায়ণগঞ্জে তাদের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার শাখা কার্যালয় পরিদর্শন সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি। মনে মনে বলি, কার্যালয় পরিদর্শনের আবার বিজ্ঞপ্তি কী? তাও এক মধ্যম সারির কর্মকর্তার পরিদর্শন! তবে সেটা মুখে বলার প্রশ্নই আসে না। আকার-ইঙ্গিতে তাকে বোঝাই যে, এটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিউজ! এর ফল হল বিপরীত। ভদ্রলোক প্রেস বিজ্ঞপ্তি তুলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলেন না, এবার হাতে ধরিয়ে দিলেন ছোট একটি অ্যালবাম। সাত-আটটি ছবি- সবগুলোই ঝাপসা। বোঝা যাচ্ছিল খুব সাধারণ ক্যামেরায় তোলা। আমি বললাম, ছবিগুলো তো ভালো হয়নি। বিজ্ঞপ্তিটিই রাখছি। ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা- ছবি যেতেই হবে। কিছুটা তার পীড়াপিড়ি আর বাকিটা ওঠার তাড়ায় একটি ছবি রাখি শেষমেশ। ভেতরে গিয়ে যথাস্থানে যথার্থ লোকের কাছে বিজ্ঞপ্তিটি দেই। ছাপা- না ছাপা তার এখতিয়ারে।
পরদিন ফোন। পরিচয় পেয়ে বুঝলাম, ফোনের অপরপ্রান্তে গতকালের সেই ভদ্রলোক। জানলাম, ছবি তো নয়ই, বিজ্ঞপ্তিটিও ছাপা হয়নি। আমি দুঃখ প্রকাশ করি। বুঝিয়ে বলি, বিজ্ঞপ্তির দায়িত্ব যার, তাকে আমি নিজের হাতে দিয়েছি। ভদ্রলোক কিছুতেই যেন বোঝেন না। রুক্ষ্ম কন্ঠ আরো রুক্ষ্ম হতে থাকে- আমার নিউজটা দিলেন না কেন? আমি এবারও বিনয়ের সঙ্গেই বলি, নিউজ দেওয়ার দায়িত্ব আমার নয়। ভদ্রলোকের স্বর চড়া হতে থাকে- আপনাদের তো ঠেলা না দিলে নিউজ দেন না। আমি কিন্তু অনেক উপর থেকে ঠেলা দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।
কথা শুনে অবাকই হলাম। খুব কম মানুষকেই পত্রিকা অফিসে ফোন করে এই সুরে কথা বলতে দেখি। তবু বিস্ময় গোপন করে বললাম, আপনি কতো ওপর থেকে ঠেলা দিতে পারেন? ভদ্রলোক বললেন, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পারি। তখন বিএনপি সরকার মাত্র ক্ষমতায় গেছে। ঠেলা দেওয়ার ক্ষমতা হয়তো ভদ্রলোকের থাকতেও পারে। আমার বয়স কম তখন। মেজাজও সেরকমই। অগ্রপশ্চাৎ ভাবা হয় না। হুট করেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বললাম, তাহলে আপনি ঠেলাই দেন। যতো ওপর থেকে পারেন, দেন। শুনে ভদ্রলোকের কণ্ঠও আরো চড়া হয়- আপনি কতোক্ষণ আছেন অফিসে? জানালাম, রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত থাকবো। ঠিক আছে বলে ঝটাং করে ফোন রেখে দিলেন।
সহকর্মী কাউকেই বলিনি কিছুক্ষণ আগের উত্তাপের কথা। সেই রাতে এগারোটা পর্যন্ত ছিলাম। ভদ্রলোক আর আসেননি।
সম্পাদকের 'জোর'
আরেক ভদ্রলোক কোন্ কুক্ষণে কাকে যেন কী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। যথারীতি সেটি ছাপা হয়নি। এবারও ভদ্রলোকের রোষের শিকার আমি। এর পেছনে সহকর্মীদের কারো "সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র" আছে কিনা- ভেবেছি বারদুয়েক। নইলে শ্লার আমিই কেন বারবার! অবশ্য বিড়ি টানার জন্য ঘন ঘন বাইরে যেতে হলে প্রবেশপথে আগন্তুক কর্তৃক পাকড়াও হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই।
যা হোক একথা-সেকথার পর ভদ্রলোক হঠাৎ উত্তেজিত। বললেন, আসলে ভুল আমারই হয়েছে। আমি সরাসরি সম্পাদককে বলতে পারতাম। আমি কি উনাকে বলবো এখন?
এইবার আমার মাথা ঠাণ্ডা। ঘড়িটা একঝলক দেখে তাকে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, সম্পাদকের তো বের হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আপনি এখনই ফোন না করলে হয়তো উনাকে নাও পেতে পারেন।
কী যে হল, ভদ্রলোকের মুখের ভঙ্গি আচমকা কোমল হয়ে এল। আমি বুঝলাম, তিনি লাইনে চলে এসেছেন। রাজ্যের হতাশা নিয়ে অনুযোগের সুরে বললেন, এইগুলা ঠিক না ভাই। আমি বললাম, কোনগুলা? তিনি বললেন, এই যে নিউজ দিলে নিউজ ছাপা হয় না। আমাদের অফিসে আপনাদের পত্রিকা রাখি। অথচ আমাদের নিউজ আপনারা দেন না। আমি বললাম, আপনি তো ভাই এইটা বলতে পারতেন। বেশি জরুরি হলে অনুরোধ করতে পারতেন। কিন্তু আপনি সম্পাদককে ফোন করার কথা বললেন কেন?
মনে হল, বেশ লজ্জাই পেলেন তিনি। হাসলেন, হেসে ফেলি আমিও।
উপসংহার :
যে কোনো ঝুঁকি বা সাহস দেখানোর জন্য ব্যাচেলর জীবনের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ৩:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




