জার্মানীকে কেন্দ্র করে ইউরোপের মানচিত্রই বদলে গেল এবং পরিবর্তনের ধারায় ইউরোপ আজকে সমৃদ্ধ ইউরোপ হয়ে উঠলো।
আসুন প্রথমেই একনজরে দেখে নেই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয়ান দেশগুলোর কি অবস্থা ছিল।এই দিন তো আর সব সময় ছিল না অন্যদিনও ছিল
ফ্রান্স : যুদ্ধে বিজয়ী হলেও উদযাপন করার অবস্থা ছিল না কারন যুদ্ধে দেশটা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।সাথে ইন্দোচীন ও সুয়েজ খালে জোড় দেখাতে গিয়ে পরাজিত হয় এসবের চেয়ে বড় চিন্তা ওদের ছিল যে, জার্মানী ভাগ্যে কি নির্ধারন হবে।
জার্মানী :পরাজয়ে লজ্জিত,দখলকৃত এবং বিভক্ত একটি দেশ।যাদের কাছে পরাজিত হলো এখন ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য তাদের কৃপা লাভের আশায় ওদের দলে যোগ দিল। ফিরে আসার সুযোগ মারিয়া।
ব্রিটেন:জার্মানী এবং ফ্রান্সের তুলনায় ভালো কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য হারাচ্ছে (এশিয়ায়)।সেদেশের সরকারও নিজেদের জনগণের উন্নয়নের জন্যই বেশী আগ্রহী এবং ইউরোপীয়ানদের ঝামেলায় নিজেদের যুক্ত করতে আগ্রহী না ( ব্রিটেন কখনোই নিজেদের ইউরোপীয়ান মনে করে নাই)
ইটালী :পরাজিত দেশ কিন্তু জার্মানীর চেয়ে বেশী রাজনৈতিকভাবে অস্থির।একমাত্র ইউরোপীয়ান ইন্টগ্রেশনই এদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে সেই অপেক্ষায় আছে।
বেনেলুক্স : (বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ড-লুক্সেমবার্গ) এরা সবকয়টা জার্মানী দ্বারা দখল হয়েছিল।তাই নিজেদের বাঁচাতে একতাই বল নীতি অনুযায়ী ১৯৪৮ সালেই নিজেদের মাঝে ইউনিয়ন গঠন করে নেয়।
আয়ারল্যান্ড : ব্রিটেনের অর্থনীতির সাথে এদেরটাও যুক্ত।তাই ব্রিটেন যা করে এরাও তাই করতে বাধ্য কিন্তু ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বড় সমর্থক যাতে ব্রিটেনের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমে।
অস্ট্রিয়া : পুরো দেশটাই জার্মানীর মত কয়েক টুকরো করে ভাগাভাগি করে নেয় বিজয়ীরা।জার্মানীর সাথে একত্রিত হয়েছিল হিটলারের সময় কিন্তু পরাজয়ের পরেই ১৮০ ডিগ্রি পল্টি! ১৯৫৫ সালে নিজেদের চিরস্থায়ী নিরপেক্ষ ঘোষনা করে।
নরডিক রাষ্ট্রসমুহ : ( ডেনমার্ক,ফিনল্যান্ড,আইসল্যান্ড,নরওয়ে আর সুইডেন) নরডিক কাউন্সিল গঠন করে নিজেদের মাঝে।পাসপোর্ট ছাড়া চলাচল এবং শ্রমিকদের ফ্রি মুভমেন্টের মত পদক্ষেপ নেয়। *** অনেকটা বেনেলুক্সের মত।
স্পেন আর পর্তুগাল :চরম দরিদ্র এবং রাজনীতিতে এখনায়কদের দখলে থাকা দেশগুলো নিজেদের গুটিয়ে রাখে অন্যান্য ইউরোপীয়ান দেশগুলো থেকে।
গ্রীস : ট্রুম্যান ডকট্রিনের সবচেয়ে বড় লাভবান।নইলে কম্যুনিস্ট হয়ে যেত।তারপরেও দারিদ্রতা এবং রাজনৈতিক সমস্যা এড়াতে পারে নাই দীর্ঘদিন।
পুর্ব ইউরোপ : সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রনে থাকা দেশগুলো এক দলীয় শাষনে পরিচালিত এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো থেকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন। ( ওদের নিয়ে আগামী পর্ব )
সুইজারল্যান্ড ছিল নিরপেক্ষ দেশ।ওরা নিজেদের ভালটা খুব ভাল ভাবেই বুঝে সবসময়। আর নাৎসি বাহিনীর জমাকৃত টাকা পয়সা পুরোটাই ওদের পেটে চলে যাওয়ায় ওদের অবস্থা ছিল খুবই ভাল।
এই অবস্থায় সকল আলোচনার কেন্দ্রেই ছিল জার্মানী।তাদের নিশ্চিন্হ করা যাবে না এবং সামাজিক ও আর্থিক স্থিতিও ফিরিয়ে আনতে হবে আবার জার্মানীকে সুযোগ দিলে সে যে আগামীতে আবার কোন ঝামেলা করবে সেটা সবার বিশ্বাসে ছিল।
এরপর খুবই গুরুত্বপুর্ণ যাকে প্রথম বলা হয়।তেমনই একটি পদক্ষেপ ছিল জার্মানী ও ফ্রান্সের কয়লা এবং স্টীল শিল্প একত্রিত করে ফেলা।
কারন,কয়লা এবং স্টিল শিল্পই হলো অর্থনীতির প্রাণ হেভি ইন্ডাস্ট্রির আত্মা যেটার উপর নির্ভর করে দেশের সামরিক শক্তি ও যুদ্ধ ক্ষমতা।
কয়লা এবং স্টিল খাত একত্রিত করে মুলত ফ্রান্স এবং জার্মানীর যুদ্ধ করার সম্ভাবনা একদম নাকচ করে দেয়া হলো।কারন যেহেতু ২ দেশই একই খাতে নিভরশীল তাই কেউই যুদ্ধাবস্থায় এর উপর আঘাত করতে পারবে না।
তবে একটা কথা যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশসমুহের জন্য যে কোন সিদ্ধান্তই হয় একমাত্র চুক্তি দ্বারা এবং বিভিন্ন কনফারেন্সেই চুক্তিগুলো সম্পন্ন হয়ে থাকে।তাই স্বীকৃত রাজনৈতিক ইতিহাস জানার জন্য এসব কনফারেন্স ও চুক্তিগুলো আনুসরন করলেই হয় এবং এর বাইরে কোন স্বীকৃত মাধ্যম নেই যা আপনার জানাকে বৈধতা দিবে।
এই পদক্ষেপের ( কয়লা এবং স্টিল একত্রিতকরন) সাথে সাথে ইউরোপ একটি ফেডারেশনের পথে পা বাড়ায়।এরপর ১৯৫৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয়ান অর্থনীতি ও সমাজকে একীভুত করার লক্ষ্যে অনেক চুক্তিই হয় তাছাড়াও মোটামুটি সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেই অনেক অনেক চুক্তি সম্পাদন করেছে যার মুল টার্গেটই ছিল নিজেদের ভেতরের সব পার্থক্য কমিয়ে আনা এবং আজো করে চলছে ইউরোপীয়ান দেশগুলো ।যাদের নাম এখানে দেয়ার গুরুত্ববোধ করছি না।
৭০ এর দশকে বেশ কিছু যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবার ফলে ইউরোপ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং মুলত এই কারনেই ইউরোপের একত্রীকরন ত্বরান্বিত হয়।ওরা বুঝতে পারে যে "একতাই বল"।নয়তো আরো দীর্ঘ হতো এক হবার এই যাত্রা।
ব্রিটেন শুরুতে ইউরপীয়ান ইন্টিগ্রেশনে আগ্রহী ছিল না।পরে যখন দেখলো যে ওরা মোটামুটি সফল তখন ব্রিটেন আগ্রহী হয় কিন্তু ২ বার প্রত্যাখান করা হয় ওদের এবং তৃতীয় দফায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
এরপর ইন্টিগ্রেশনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৯৮৬ সালে "সিঙ্গেল ইউরোপীয়ান এ্যাক্ট" নামে।যার লক্ষ্য ছিল ১৯৯৩ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পুরো ইউরোপকে একটি একক বাজারে পরিনত করা।যার জন্য নতুন করে ৩০০টি আইন পাশ করা হয় যার ফলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের ব্যাবসা-বানিজ্যের পথে সকল অফিসিয়াল বাধা দুর হয়ে যায় ।এটিই ইউরোপকে একটি ইকোনোমিক জোনে একত্র করে ফেলে।
ততদিনে ইউরোপ পুর্বোক্ত পদক্ষেপের সুফল হিসেবে আর্থিকভাবে ফিরে এসেছে এবং অর্থনীতি একত্রিত করে ফেলেছে।এবার তাদের প্রয়োজন হলো ইমিগ্রেশন,ভিসা এবং এবং এসাইলামের মত বিষয়েও এক হয়ে গিয়ে নিজেদেরকে ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে আরো সংগঠিত করা।তাই ১৯৮৫ সালে হল্যান্ডের স্কেংগেনে "Schengen চুক্তি" করে। যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ড এখনো এর বাইরে থাকলেও ২০০৮ সুইজারল্যান্ডও যোগ দেয়।
ইউরোপীয়ন ইউনিয়নকে বলা হয় একটি "সুপ্রান্যাশনাল স্টেট"। মানে এর সদস্য দেশগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন/ "সভরেইন", কিন্তু প্রত্যেকেই সম্মতিক্রমে নিজেদের বেশ কিছু বিষয়ে ইউনিয়নের আইন মানতে বাধ্য এবং যেসব সেক্টরে ইউনিয়নের আদেশ / উপদেশ রয়েছে সেসব মানতেও বাধ্য। এর মুল লক্ষ্যই হচ্ছে ইউরোপীয়ন ইউনিয়নের ভেতরের দেশগুলোর ভেতর সকল পর্যায়ে একই নীতি গ্রহন করা।ইতিমধ্যেই অনেক এগিয়েছে কিন্তু লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য এখনো কাজ চলছে।তাহলে বুঝেন কি পরিমান একত্রিত হবার আশা এদের।
রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পরে ন্যাশন স্টেট ব্যাবস্থায় ইউরোপ ছিল একটি নিয়মিত যুদ্ধক্ষেত্র।নিজেদের মাঝে নিরন্তর হানাহানি করেই তাদের চলছিল।কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ওরা সাম্রাজ্য হারিয়ে এবং আন্তকোন্দলে শক্তি হারিয়ে বুঝতে সক্ষম হয় যে এভাবে চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া,জাপান ও চীনের উপস্থিতিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানে টিকে থাকা যাবে না।তাই যুদ্ধের পর পরই ওরা একটি সংযুক্ত ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।দীর্ঘ সময় পার করে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আজও সেই কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।আজকে ইউরোপের আইন এবং জীবনযাত্রার মান সমান।পুর্ব ইউরোপের দেশগুলোও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে।
সবাই যে এমন একত্রিত হবার পক্ষে তা নয়,মুলত "হারু পার্টি" জার্মানী,অস্ট্রিয়া এবং ইটালীর আগ্রহই বেশী কারন বৃহৎ ইউরোপীয়ান মডেলের কারনেই ওদের অবস্থান ফিরে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একতাবদ্ধ পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস গঠনমুলক এবং খাঁদের কিনারা থেকে ফিরে আসার সাফল্যে দৃষ্টান্তমুলক।
একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখবেন, ইউরোপ কিন্তু হঠাৎ করেই এমন এক হয়ে যাওয়া শুরু করে নাই। সুইজারল্যান্ড আগে থেকেই একটি সফল ইউনিয়ন ছিল, বেনেলুক্স ও নরডিক ইউনিয়নের সফলতাও তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে ব্যাপকভাবে।
সবশেষে, ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিম ইউরোপের লক্ষ্য ছিল নিজেদেরকে আভ্যন্তরীন সংগঠিত করা যা করতে তারা সক্ষম হয়েছে বলা যায়।
চলবে...........
ইইউ'র পতাকা
আর অপর দিকের চিত্র হিসেবে আগামী পর্বে দেখবো কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুর্ব ইউরোপ ভাল অবস্থানে থেকেও ধীরে ধীরে ধ্বংসে মুখে এগিয়ে গেল।যার পরিনতি সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি ইতিহাস আর পুর্ব ইউরোপ আজকে পশ্চিম ইউরোপের কৃপায় ফিরে আসার স্বপ্নে মগ্ন।
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
গত পর্ব :সহজ ইতিহাস: ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইউরোপ
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৩৭