আমি নিজেকে একজন ভাল দর্শক বলেই মনে করি।আমার বহু প্রতিক্ষিত প্রথম বিমান ভ্রমনের অর্ধেকটা মানে,শুধু ঢাকা-দুবাই যাওয়ার অংশটুকু'র বর্ণনা করবো।ভয়াবহ কষ্টের দীর্ঘ বর্ণনা তবে যাহা বলেছি সত্য বলেছি,আমার বিশ্বাস অন্য কেউ আপনাকে এই সত্য কথাগুলো লজ্জায় বলিবে না।
পরদিন সকাল ১০টায় জীবনের প্রথম গ্ল্যামারাস বিমান ভ্রমন করবো, এই উত্তেজনায় সারারাত ঘুম আসে নাই।
সকালে বিমান বন্দরটাও অন্য সব সময়ের মত ছিল না। বাসার কাছে'র বিমানবন্দরে পৌছেই ভেতরে ঢুকে গেলাম।ইমিগ্রেশনের অফিসার ঝামেলা করলো যে ওয়ান ওয়ে টিকেট কেন।আমি ওদেরকে আইনের ব্যাখ্যা দিলাম কিন্তু ফলাফল অনেকক্ষন ধরে প্যাচালো, আর সত্যি কথা আমি বুঝিই নাই যে ওরা টাকা চাচ্ছে। পরে যখন এমিরেটসের কেবিন ক্রু দের চিফ মহিলা পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো যে, এই যাত্রীকে রেখে চলে যাব কি না? তখন বেশ উঁচু গলায় একটা ধমক বের হয়ে গেল যে, আমার টিকেট টাকা আছে,আমি তোমার সামনে দাড়ানো,আমার ফ্লাইট ক্যানসেল হলে আমি এর জন্য চুড়ান্ত ঝামেলা করবো।
পরে এক বড় অফিসার এগিয়ে আসলে তাকে জানাই যে, আমি স্টুডেন্ট এবং আগামী ১ বছরে দেশে ফিরবো না সুতরাং আমার রিটার্ন টিকেট কেনার কোন প্রয়োজন নাই। লোকটা আমাকে কিছু না বলে শুধু মহিলা অফিসারটাকে বললো, আপনি ফারদার আর এমন কাজ করবেন না!
হাসিমুখে প্লেনে উঠলাম, কিন্তু ঐ বদ্জাত মহিলার কারনে শুরুটা খুবই খারাপ হলো।আর মর্নিং শো'স দ্যা ডে।
বিশালাকায় এমিরেটস বিমানে আমার সিট পড়লো মাঝের সাড়ি'র ৪ জনের সিটগুলোরও মাঝে।খুবই বিশৃঙ্ক্ষল পরিস্থিতি।বাচ্চা কয়েকটা কান্না শুরু করছে, এক ভদ্রলোক উঁচু গলায় বলে চলছে, আই কিচ্চি,আই কিচ্চি! আমার মাথার উপর কম্পার্টমেন্টে ব্যাগ রাখতে যাবো হঠাৎ চোরের মত মোচওয়ালা একলোক ক্ষিপ্রগতিতে ওনার হাত দিয়ে "ক্রস" টাইপের চিন্হ বানিয়ে বললো, এই জায়াগার মাল আসতেছে।আরেক হাতে ও কোন এক ধরনের প্লাস্টিকের বস্তায় ডিব্বা জাতীয় কিছু একটা দ্রুততার সাথে কম্পার্টমেন্টে রাখতে যেয়ে আমার মাথায় লাগিয়ে দিল। মেজাজটা চুড়ান্ত খারাপ হয়ে গেল,কোন কথা না বলেই ধাপ করে ওর কলারটা ধরলাম সাথে সাথে আমার পাশের সিটের লোকটা উঠে ঐ লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আর ওর বস্তাও নিচে ফেলে দিল। আমার পাশের সিটের লোকের এই আচরনে কিছুটা শান্ত হয়ে বসে পড়লাম।ঐ মোচওয়ালা একটা কথাও না বাড়িয়ে কই যেন চলে গেল।
কয়েকজন হুজুরটাইপের লোক অতিরিক্ত মাল নিয়ে দাঁত কেলিয়ে দাড়িয়ে আছে,রাখার জায়গা নেই।সানগ্লাস পড়া কতগুলো ছেলে কম্বল খুজতেছে।এক মহিলা সিটে আসতে পারতেছে না কারন সামনের প্যাসেজটাতে ভীড়।কয়েকজন মোবাইলে আখেরী বিদায় ভাষন শুরু করছে।পেছনের সারি থেকে এক মহিলা সামনের সারিতে বসা কাউকে ডেকে চলছে কিন্তু কোন সাড়া নাই,মহিলাও দমে যাচ্ছে না।
পুরো বিমানে হৈচৈ হচ্ছে, কেবিন ক্রু'রা সদ্যে শেখা বাংলায় বোসো বোসো বলে যাত্রিদের ধমকাচ্ছে আর আমি বেল্ট কিভাবে লাগাবো বুজতে পারতেছি না
বুঝলাম যে, চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ
পরে এক এয়ারহোস্টেজ এসে লাগিয়ে দিয়ে গেল কোমরের বেল্ট আর আমি চোখ বন্ধ করেই পড়ে থাকলাম।
টেক অফ :
প্লেন উড়বে, আমি প্রথম মাটি থেকে উপড়ে উড়বো এই মুহুর্তের জন্য শৈশব থেকেই অপেক্ষা করে এসেছি।কিন্তু টেক অফের আগেই মজা নষ্ট হয়ে গেল।
কারন:
হঠাৎ করেই নিরব হয়ে গেল চারদিক, চোখের সামনে যত টিভি পর্দা সবগুলো থেকেই একসাথে নিরাপত্তাবাণী দেয়া শুরু হলো আবার কেবিন ক্রু'রাও মুকাভিনয় করে দেখানো শুরু করলো যে, অক্সিজেনের সমস্যা হলে কি করতে হবে এমনকি নিজের শিশু বাচ্চার আগে নিজের জান বাঁচাতে হবে, প্লেন যদি জরুরী ল্যান্ড করে কিভাবে হাত-পা মুড়ে বসতে হবে, সাগরে পড়লে কোন দরজা দিয়ে বের হতে হবে
এমন অলক্ষী টাইপ কথা শুনলে কারোই মুড ঠিক থাকে না। সবাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো।আমার পাশের যাত্রী দুরুদ পড়া শুরু করলো।প্লেনটাও একটু নড়ে উঠার পর কুকুরের আওয়াজের মত ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে উঠে, আর আকাশা উড়ার আগে নিশ্চুপ প্লেনটা অনেক সময় নেয়াতে সাবধান বাণীগুলো মাথায় এফেক্ট ফেলে।
উড়ার আগে প্লেন অস্বাভাবিক গতিতে ছুটে।আপনি টের পাবেন যে জীবনে এত গতিতে আগে কোনদিন অভিজ্ঞতা হয় নাই।সব কিছু মিলিয়ে কেমন যেন একটা চুড়ান্ত মুহুর্তের স্তব্ধতা! তখনই আমার খুব ইচ্ছা হলো, প্লেন থেকে নেমে যাই
বুঝেনই তো , আতংকিত মন ফ্যান্টাসি আক্রান্ত!
আকাশে :
আমিতো বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না শুধু আকাশ দেখা যাচ্ছে।কিন্তু হঠাৎ করেই দেখলাম যখন প্লেনটা বাঁ দিকে পুরো কাত হয়ে গেল।প্লেন যখন কাৎ হয় তখন মনে শংকা জাগে, এই কাত হওয়া যদি না থামে? এটা যদি এমন কাৎ হতেই থাকে? তাই কাৎ হওয়া প্লেনের জানালা দিয়ে যখন নিচের দৃশ্য দেখলাম তখন ভাল লাগার বদলে, বুকটা ফেটে গেল ঐ মাটিতে নামার জন্য!
তবে যখন কিছুটা উপরে উঠে যায় তখন চুড়ান্ত ভয় থেকে একটা সাহস জন্ম নেয়। যা হবার হবে আমার আর কিছুই করার নেই ভাবটা এসে মনকে একটু হাল্কা করে ফেলে।
কিন্তু বেশিক্ষন না, বাংলার আকাশের ভারী মেঘগুলো ভেদ করে উঠার সময় প্লেনটা যখন ট্রেনের মত একটু ঝাকি দেয় তখন পাশের যাত্রীর গলার ভেতর থেকে স্বশব্দে দুরুদ ঠেলে উঠে আর ঐ আতংকে আপনার মাঝেও সংক্রমন হতে পারে।
তবে, এরপরই শুরু বিনোদন,প্লেনটা বোধহয় টাঙ্গাইলও পার হয় নাই তখনই আমার প্রথম যাত্রায় আমার বাঁ পাশে বসা যাত্রী খাবারের জন্য অস্থির হয়ে গেল।ভদ্রলোক ফুড ফুড বলে এয়ারহোস্টেসকে বেশ গরম চোখ দেখালো। ডান দিকের যাত্রী বলে, ভাই কি শুরু করছেন?
বাঁ দিকের লোক বলে, আরে এরা খুব খারাপ এখন না বললে পরে আরো দেরী করবে।
বুঝলাম এরা নিয়মিত যাত্রী।
আকাশে প্লেনের ভেতরের বিনোদন :
ভয়ে আতংকে আর এমন বিনোদন দেখে মনটা চুড়ান্ত ভোঁতা হয়ে যায়।বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটগুলোও হয় একটু চুপচাপ বিষন্ন সবার মন।
তবে আমার পাশের সিটের লোক দেখলাম খাবার নিয়ে খুবই চিন্তিত।মনে হয় অতীতে তাগাদা না দেয়ার কারনে কোন এক ফ্লাইটে ওনার খাবার মিস হয়ে গেছিল। পাশে দিয়ে কোন এয়ারহোস্টেস গেলেই তিনি গায়ে হাত দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করে আর হাতের ঘড়ি উঁচু করে ধরে ঘড়িতে আঙ্গুল দিয়ে বাড়ি দিয়ে কি যেন ইশারা করে।
এয়ারহোস্টেজদের সম্পর্কে অনেক কথাই শুনা যায় তবে আমি প্রথম ফ্লাইটে যাদের দেখলাম তাদের সবাইকেই প্রাণরসহীন এবং বয়স্ক মহিলা মনে হচ্ছিল। বাঙ্গালদের ফ্লাইট বলে কি না জানি না তারাও দেখলাম সার্ভিসের ব্যাপারে অনাগ্রহী শুধু দেখলাম বিভ্রান্তের মত দৃষ্টি নিয়ে এদিক সেদিক ছুটতেছে কিন্তু কারোই চাহিদা পুরন করতে পারতেছে না কারন সবাই একসাথে কিছু না কিছু আব্দার করতেছে।সানগ্লাস পরা যুবকগুলো সিটের উপর হাটুতে ভর করে মাথা উঁচু করে ওদের দেখতেছে আর আমার সিটের ৩ জন যাত্রীই ওদের বেয়াদবী নিয়ে উচ্চকন্ঠ!
আর আমার তো প্রথম যাত্রা তাই আমার জন্য সবকিছুই অপরিচিত এবং আতংকজনক লাগছিল।এরই মাঝে তলপেটে নিন্মচাঁপ!
ভয়ে ভয়ে টয়লেটের সামনে গেলাম, কিন্তু দরজা খুলতে পারতেছিনা , এই পরিস্থিতিতে একজন পুরুষ কেবিন ক্রু এগিয়ে আসুক চাইছিলাম কিন্তু দেখি এক এয়ারহোস্টেজ আসতেছে।একবার ভাবলাম, হাসিমুখে কেটে পড়ি,আবার ভাবলাম, নিজের শরীরের ভালমন্দ আমি না দেখলে কে দেখবে?
টয়লেটে দেখি কমোড একদম শুকনা,একটু বিভ্রান্ত হলাম কারন কারো যদি বড় বাথরুম চাঁপে তাহলে ঘটনা পরবর্তী চিন্তায় প্রথম যাত্রায় ওখানে কিছু করা সম্ভব না । যাই হোক, নিন্মচাঁপ মুক্ত হবার পর ফ্লাস করার পর এক বিকট অভিজ্ঞতা! শোঁ শোঁ করে এমন এক আওয়াজ হলো, মনে হলো,ঐ বোতাম চাঁপ দিয়ে আমি প্লেন ফুটো করে ফেলছি।খুবই বিব্রত হলাম।কোন মতে বের হয়ে আসলাম কিন্তু তাড়াহুড়োয় দরজা লাগাই নাই,পরে দেখি সেই এয়ারহোস্টেজ আবার ঐদিকে যাচ্ছে।আমি তাড়াতারি সিটে এসে বসলাম।
এরই মধ্যে প্লেন হঠাৎ করেই লিফটের মত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল, ভাগ্য ভাল এক বন্ধু আগেই এয়ার পকেট নিয়ে আলোচনা করেছিল কিন্তু তবুও ঐ পকেটে যখন পড়ে প্রথম চিন্তাই আসে, এই পতন যদি না থামে?
আর পতন যত দ্রুত টের পাওয়া যায় এই পতন বন্ধ হওয়া টের পেতে তার চেয়ে বেশী সময় লাগে।
সবচেয়ে কষ্টের বিষয় এমন আতঙ্কের মাঝে সিগারেট টানতে পারলে একটু শান্তি পেতাম কিন্তু কোন উপায় নাই।নিকোটিনহীন দেহের সাথে এমন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আর সারাক্ষন কানে তালা লাগা এবং খোলা সব মিলিয়ে নিজেকে ক্যামন যেন এলিয়েন এলিয়েন ফিল হচ্ছিল।
এর মাঝে মাঝেই আবার ট্রেনের মত ঝাঁকি। প্লেন মানেই বাতাসে চলে মানে পুরো স্মুদ হবে তাই না? এর মাঝে ঝাঁকি লাগলে মনে খারাপ চিন্তা ছাড়া ভালটা আসবেই বা কেন? তাও প্রথম ভ্রমনের যাত্রী'র মনে?
এরই মাঝে আমি দুঃখে ও কষ্টে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।মাঝে একবার খাবারের জন্য ডাক শুনলাম কিন্তু নো বলেই ঘুম চালিয়ে গেলাম।
ল্যান্ডিং :
আবার আমার বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে গেল এয়ারহোস্টেজ যদিও আমি এর মাঝে বের করে ফেলেছি কিভাবে বেল্ট লাগায়।এনাউন্স হলো, ল্যান্ড হবে।
প্লেন আস্তে আস্তে নীচে নামছে, আমিও খুশী যে একটু পরই সার্কাস থেকে মুক্তি,নেমেই সিগারেট টানতে পারবো।কিন্তু প্লেন যতই নীচে নামে,কিসের জন্য যেন আতঙ্ক বাড়তে থাকে।একদম নীচে নামার পর, মনটা অপেক্ষা করে চাকা মাটিতে স্পর্ষ করবে কখন, কিন্তু চাক্কা মাটিতে লাগছে না।মনে হলো, চাঁকা ফেঁসে গেল কি? কিন্তু তখনই ধুম করে চাকা একটু রানওয়ে ছুয়ে দিয়ে আবার উপরে উঠে যায়,মনে হয় প্লেনটা বোধহয় ছিটকে গেল,পাশের সিটের লোক উচ্চস্বরে লা ইলাহা......আমারও হাত সিটের হাতল খাঁমচে ধরে আর তখনই আবার রানওয়ে টাচ করে।সেকেন্ডের মধ্যেই প্লেন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মাটিতে (প্রায় ৩৫০ কিঃমিঃ গতি) এবং ডানাগুলো থেকে ভয়বহ বিকট আওয়াজ বের হয়। তখন মনে হয় তীরে এসে তরী ডুবলো?
কিন্তু সব কিছুর পর যখন প্লেনটা থামে।তখন নিজের তো বটেই আশেপাশে সবার চেহারায় ছড়িয়ে পড়ে একটা স্বর্গীয় খুশীর আভা। প্লেন মাটি ছোবার সাথে সাথে কিছু দাড়িওয়ালা লোক দাড়িয়ে যায়,শব্দ করে বাক্স-পেটরা নামানো শুরু করে কিন্তু কেবিন ক্রু'রা আবার শুরু করে চিৎকার "বোসো বোসো"।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১১ রাত ১০:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




