somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৪ বছর: সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৪ বছর:
সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অতি সুখবর, কারণ দীর্ঘদিন যাবৎ বিরাজমান একটি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল এটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার বয়স অনেক দিনের। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, যেদিন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন এ সমস্যার সৃষ্টি। কিছু সংখ্যক চাকমা নেতৃবৃন্দ সেদিন পাকিস্তানের পতাকা তোলার বদলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সদর রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন স্থানে ভারতের পতাকা তুলেছিল। অর্থাৎ সেই ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে পার্বত্য উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য ভূ-খন্ডটিকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়াকে মেনে নিতে পারেন নি। তাই তারা ভারতের পতাকা তুলে প্রতিবাদ করেছেন। ফলে অনেক দিন যাবৎ তাদের ভারতমুখীতার জন্য সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের বৈরী সম্পর্ক ছিল। তারপর অনেক পানি গড়িয়েছে, ভাল-মন্দ অনেক কিছুই ঘটেছে। এই কলামে সেই দীর্ঘ বিবরণ দেয়ার সুযোগ নাই। তাই এক লাফে ১৯৭১ সালে চলে আসি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জন রাজার মধ্যে দুই জন রাজা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন, এক জন রাজা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং ভারতের মাটিতে গিয়ে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি ছিলেন খাগড়াছড়ির সন্নিকটে অবস্থিত মানিকছড়ির রাজা তথা মং রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী। যে দু’জন রাজা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রচন্ড বিরোধীতা করেছিলেন তাদের একজন হচ্ছেন রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়। রাজা ত্রিদিব রায়ের সন্তান হচ্ছেন বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। চাকমা সার্কেলের রাজা ত্রিদিব রায়-এর অনুপ্রেরণায় তখন পুরো চাকমা সার্কেল তথা রাঙ্গামাটি জেলা এবং খাগড়াছড়ি জেলার উত্তর-পূর্ব অংশের শত-সহস্ত্র তরুণ তখন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর পর তথা বিজয় দিবসের পর পর চাকমা স¤প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নাম শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বা সংক্ষেপে এম এন লারমা। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় তিনি পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের একজন স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উনার অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ; তিনি তখন বলেছিলেন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধ হলে আমাদের কি? যুদ্ধের শেষদিকে রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি সংক্ষেপে জেএসএস নামক একটি দল গঠন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭০-এ গঠিত আরেকটি দল রাঙ্গামাটি কমিনিস্ট পার্টি-এর উত্তরসূরী ছিল এই পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি। ১৯৭৩ সালে জেএসএস-এর একটি সশস্ত্র শাখা খোলা হয়, যার নাম শান্তিবাহিনী। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান যখন রচিত হয় তখন সমগ্র বাংলাদেশের জনগণকে বাঙালি ভূষিত করা হয়। চাকমা উপজাতির প্রতিনিধি জনাব এম এন লারমা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হন এবং একই বছরের ডিসেম্বর ও ১৯৭৬-এর জানুয়ারীতে একাধিক বড় ধরণের ঘটনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি তথা এম এন লারমা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যাকে ইংরেজীতে বলা হয় ইন্সার্জেন্সী।

ইনসার্জেন্সীর বিপরীতে সরকার কর্তৃক পরিচালিত অভিজানের নাম কাউন্টার ইন্সার্জেন্সী। সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে ১৯৭৮ থেকে ৮১ সালে সরকার বহু সংখ্যক বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাস জমি বন্দবস্তি প্রদান করেন এবং তাদের আবাস নির্মাণ করে বসবাসের জন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে আবাস গড়ে তোলায় অনেক উপকার হয়েছে। আবার বাঙালিগণ অনেক বিপদের সন্মুখীনও হয়েছে।

সমস্যা সৃষ্টি হলে তার সমধানও তালাশ করতে হয়। পার্বত্য সমস্যার সমাধান তালাশে অনেক ব্যক্তি ঐতিহাসিকভাবে জড়িত। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের দুই দিনপর নিহত হন। এর তিন বছর পর চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন আবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং তার উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিবাহিনীর একটি অংশ যাকে প্রীতি গ্রুপ বলা হয় তারা অস্ত্র সমর্পণ করেছিল রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে। তারপরেও শান্তিবাহিনীর কার্যক্রম চলতেই থাকে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। এক পর্যায় খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক উপরস্থ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন। তখনকার আমলের জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। এবং তার নেতৃত্ব ও নির্দেশে কর্নেল ইবরাহিম নিয়মিত এবং দায়িত্ব-তালিকার অতিরিক্ত অনেক পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে কর্নেল ইবরাহিম নিজ মেধা এবং আগ্রহে অনেক পদক্ষেপই গ্রহণ করেন। তখন একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন এরশাদ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী (এখনো বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী) মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার বীর উত্তম। শান্তাবাহিনীর পাশাপাশি তখন খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের সাধারণ জনগণের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, সামাজিক তথা আধা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জাতীয় কমিটির আলাপ-আলোনা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে শান্তিবাহিনী শান্তি আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ালে বাংলাদেশ সরকারের সামনে তখন এক মাত্র রাস্তা খোলা ছিল যে, উপজাতীয় সামাজিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করতঃ শান্তির প্রক্রিয়া চালু রাখা। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনটি জেলায় সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এই সমঝোতার আলোকে ১৯৮৯ সালের শুরুতেই বাংলাদেশের পার্লামেন্টে আইন পাস করা হয়। একই বছরের জুন মাসের ২৫ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় আলাদা আলাদা স্থানীয় সরকার পরিষদ স্থাপনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
অর্থাৎ এরশাদ সরকারের আমলের উল্লেখযোগ্য সর্বাধিক শান্তি প্রক্রিয়ায় জেনারেল আব্দুস সালামের সার্বিক নেতৃত্বে কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যুক্ত ছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের পর তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী জনাব অলী আহমেদ বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে শান্তিবাহিনী তথা জেএসএস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। কিন্তু তাদের আলোচনায় দৃশ্যমান কোন ফল লাভ হয় নাই। এর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা লাভের পর একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়, যার প্রধান ছিলেন জনাব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। জনাব আবদুল্লাহ’র নেতৃত্বে সে কমিটি জেএসএস প্রতিনিধি দলের সঙ্গে খাগড়াছড়ি এবং ঢাকায় একাধিকবার গোপন আলোচনায় মিলিত হন। সেই আলোচনায় জেএসএস-এর পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন জনাব জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা তথা সন্তু লারমা। আলোচনার শেষে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে জেএসএস সভাপতি জনাব সন্তু লারমা। সেই চুক্তির ১৪ তম বর্ষপূর্তি আজ।

এই চুক্তিতে অনেকগুলো ভাল দিক আছে কিন্তু তারচেয়েও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ বা বিতর্কিত দিক আছে। তাই চুক্তি এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয় নাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বার বার বলছেন যে, আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি এবং বাস্তবায়নের অগ্রগতিও ভাল। অপর পক্ষে জন সংহতি সমিতির নেতা জনাব সন্তু লারমা বলে যাচ্ছেন চুক্তি বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে এখনো আনেক বাকি। জেএসএস-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তবে ইতোমধ্যে জন সংহতি সমিতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একভাগ রয়েগেছে জনাব সন্তু লারমার নেতৃত্বে, আরেক ভাগ সংস্কারপন্থী নাম দিয়ে নতুনভাবে সংগঠিত হয়েছে। তাছাড়া ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তৎকালীন জেএসএস-এর অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন প্রসীত বিকাশ খীসা। কিন্তু তিনি পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা করেন এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউপিডিএফ নামের একটি সংগঠন। যা আজ পর্যন্ত পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে স্বীকৃতি দেয় নাই। অপর পক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিক অঙ্গনের অর্ধেকের বেশি অংশ এ চুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেন নাই বা সমর্থন দিচ্ছেন না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিতর্কিত দিক হলো চুক্তিতে কিছু মৌলিক বিষয় শুভঙ্করের ফাঁকির মত উহ্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একনম্বর ফাঁকি হলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জমির মালিক কে হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নাই। এবং কবে জরিপ হবে কিভাবে জরিপ হবে সে কথাও উল্লেখিত নাই। বলা আছে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে হবে। কিন্তু সেই ভূমিকমিশনের কার্যপ্রণালী এমনভাবে রাখা হয়েছে এবং তার গঠন এমনভাবে করা হয়েছে যেন সেটা সর্বাবস্থাতেই বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বাস্তবেও তা-ই হচ্ছে।

দ্বিতীয় বড় ফাঁকিটা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যে বাঙালি জনসংখ্যা আছে তারা শান্তি চুক্তি মোতাবেক সেখানে থাকতে পারবে কি পারবে না এরকম কোন বিষয় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় নাই। বরঞ্চ এমন বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে যাতে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চল থেকে ক্রমান্বয়ে চলে যায়। চুক্তিতে উল্লেখ আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী নাগরিকদের জন্য একটি ভোটার তালিকা হবে, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য। এবং আরেকটি ভোটার তালিকা হবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য। স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে হলে তাকে স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হলে তার নামে জায়গা-জমি থাকতে হবে। তাই বাঙালিগণকে যদি জায়গা-জমি না দেওয়া হয় তাহলে তারা স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে না, তাহলে তারা ভোটার হতে পারবে না, অতএব তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অথচ এটি একটি শুভঙ্করের ফাঁকি। বাংলাদেশের কোটি কোটি লোক আছে যাদের কোন জায়গা-জমি নাই কিন্তু তারা বাংলাদেশের ভোটার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এরকম একটি শর্ত রাখা হয়েছে, যেটি মন্দ উদ্দেশ্য মূলক। এর জন্য দায়ী বর্তমান বাংলাদেশ সরকার তথা তৎকালীন সময়ে যারা চুক্তি করেছিলেন তারা এবং বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ রাঙ্গামাটির নেতৃবৃন্দ তথা জেএসএস নেতৃবৃন্দ। উল্লেখ্য যে, ১৯৮৮-৮৯ সালের সমঝোতা বা শান্তি চুক্তি ও তৎপরবর্তী আইনগুলির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা তাদের অনেক রাজনৈতিক অধিকার-ত্যাগ স্বীকার করেছে। ১৯৯৭ সালের চুক্তির কারণেও পরিস্থিতিগতভাবে বাঙালিগণ অনেক রাজনৈতিক ছাড় দিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, এতদাঞ্চলের শান্তি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হলো এই যে, শান্তি তো আসেইনি বরঞ্চ এখন বাঙালিদেরকে বিতাড়ন করার পাঁয়তারা চলছে।


এই মুহুর্তে তথা গত আট থেকে দশ মাস যাবৎ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীগণের সামনে টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের আলোচনায় একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার নাম হলো আদিবাসী প্রসঙ্গ। আদিবাসী কারা এবং কারা না এ প্রসঙ্গে আমি যাব না। তবে আমি বলতে চাই ১৯৫৭ সালে আইএলও একটি কনভেনশন পাস করেছিল যার নম্বর ১০৭। আশির দশকে একই আইএলও আরেকটি কনভেনশন পাস করে যার নম্বর ১৬৯। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে ১০৭ নম্বর কনভেনশন রেটিফাই বা অনুমোদন করে। কিন্তু ১৯৮৯ সালের কনভেনশনটি রেটিফাই বা অনুমোদন করে নাই। ইতোমধ্যে ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি ঘোষণা গ্রহণ করতঃ প্রচার করে, তার নাম হচ্ছে আদিবাসী বিষয়ক জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের ঘোষণা-২০০৭ সাল। ১৯৮৯ সালের কনভেনশন এবং ২০০৭ সালের সাধারণ পরিষদের ঘোষণা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলি বাংলাদেশের মত যে কোন নবীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকী স্বরূপ। যেমন- বাংলাদেশ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়গণকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেন তাহলে সেখানের সমগ্র ভূ-খন্ডের মালিকানা চলে যাবে আদিবাসীদের হাতে। সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঢুকতেও পারবে না, কোন কার্যক্রমও পরিচালনা করতে পারবে না। সীমান্তের অপর পারের আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ততা দিতে হবে এবং এমনকি সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিতে হবে, গণভোটের মাধ্যমে সুযোগ দিতে হবে তাদের মতামত নিতে যে, তারা কি বাংলাদেশের অন্তুর্ভুক্ত থাকতে চায় না স্বায়ত্ব শাসন চায় নাকি স্বাধীন হতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৯ সালের আইএলও কনভেনশন অনুস্বাক্ষর বা রেটিফাই করে নাই এবং ২০০৭ সালের জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের ঘোষণা অনুমোদন করে নাই। আমরাও বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বিপক্ষে। যদিও জোড়ালোভাবে কামনা করি যে, বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে তাদের যাবতীয় দাবী-দাওয়া মিটানো হোক। কারণ আদিবাসী প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি হুমকী স্বরূপ। উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ তথা রাজা দেবাশীষ রায়-এর অধীনে নেতৃবৃন্দ পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরাঘুুরি করে, অনেক লোককে হাত করে, অনেক লোককে ভাগে এনে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রটির একটি চূড়ান্তরূপ দাঁড় করিয়েছে যে, সরকারের কাছ থেকে আদিবাসী ঘোষণাটি আদায় করবে আপতত। এবং সেই ঘোষণাটি আদায় করতে পারলেই বাংলাদেশ আগামীতে অতিবিশ্রী ও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে।


আজ বাংলাদেশ রাজনৈতিক অঙ্গন একটি যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক ইস্যুতে বিস্তর মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে এক নম্বর ইস্যু হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু। তাই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রকাশ্যে এখন কোন আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার সময় এসছে। আমরা যারা নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত বা নিরাপত্তা বিশ্লেষণের পিছনে কিছুটা সময় দেই বা আমরা যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরী করেছি তাদের মধ্যে এ প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের সময়, আমার জানা মতে, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান অথবা সাবেক চট্টগ্রামের জিওসি তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম অথবা ১৯৯৭ সালের চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন অথবা ওই আমলের আওয়ামী লীগ সরকারের এক জন মন্ত্রী এবং চট্টগ্রামের এক জন সাবেক জিওসি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক জন সাবেক প্রধান লে. জেনারেল নুরুদ্দিন খান এর মত পার্বত্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্মক অবহিত কোন ব্যক্তির সঙ্গেই তৎকালীন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটি কোন প্রকারের আলাপ-আলোচনা করেন নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মার্জিনালাইজ বা প্রান্তিককরণ করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের পরামর্শ না নেয়ার মত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফল কতটা নেতিবাচক হয়েছে তা দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে উভয় পক্ষের বাকবিতন্ডা থেকেই কিছুটা অনুধাবন করা যায়। অথচ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহু সংখ্যক সদস্য এবং হাজার হাজার বাঙালি দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য পার্বত্যাঞ্চলে প্রাণ দিয়েছে। বহু সংখ্যক দেশপ্রেমিক নীরিহ উপজাতীয়ও এই সংঘর্ষে প্রাণ দিয়েছে। তাদের সকলের আত্মার প্রতি এবং তাদের সকলের অবদানের প্রতি সম্মান জানানোর স্বার্থেই বলতে হয়, পার্বত্য চট্টগাম নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় অঙ্গনে প্রকাশ্য আলোচনা প্রয়োজন এবং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখন অবশম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং গবেষক ও নিরাপত্তাবিশ্লেষক।

সুত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ২ ডিসেম্বর ২০১১ইং।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:১১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×