somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“আমার সাঁওতাল বন্ধু ও আমি”

৩১ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“আমার সাঁওতাল বন্ধু ও আমি”

আমার ছোট বেলার বেশির ভাগ কেটেছে গ্রামের সবুজ শ্যামল প্রকৃতির সংস্পর্শে। আমার প্রাথমিকের পড়াশুনা হয়েছে গ্রামের স্কুলে। গ্রাম হতে আমাদের স্কুল ছিল ১.২ কিমি দূরে। আঁকা বাঁকা মেঠো পথ বেয়ে গ্রামের অন্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে হই হুল্লু করে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। আবার স্কুল হতে ঐ ভাবে একসাথে বাড়ি ফিরতাম।
আমাদের গ্রামের পর ৫০০ মিটার বা হাফ কিলো পর ছিল একটি সাঁওতালদের পাড়া। স্কুলে যাবার রাস্তা এই পাড়ার মধ্য দিয়েই। এই সাঁওতাল পাড়ার বেশ কজন আমাদের স্কুলে পড়ত। আমরা একসাথেই একই সময়ে স্কুলে যেতাম। দেখা যেত সব সময় ওরা আমাদের আগে আগে বা পরে পরে বেশ ব্যবধান রেখে স্কুলে যেত। আমরা যেমন নিচু জাত বলে ওদের সঙ্গে মিশতাম না , ওরাও বোধহয় বুঝত ওদের আর আমাদের ব্যবধান টা। স্কুলেও দেখতাম ওরা সকলের পেছনে বেঞ্চে বসতো। কেও ওদের সঙ্গে বেঞ্চে বসতে চাইত না। আর শিক্ষকরাও দেখতাম ওদের অবহেলার পাত্র হিসেবে গণ্য করত। ভাবখানা এমন: তোদের কেন বাপু পড়তে হবে? এই ভাবেই চলছিল সাঁওতাল ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আমাদের স্কুলে যাওয়া আসা ও পাঠদান।
এদের একজন পড়ত আমার ক্লাসে।আমার ক্লাস মেট বন্ধু “যতিন বাবু”। আর এই গল্পটা তাঁকে নিয়ে।
যতিন সব সময় পেছনের বেঞ্চে একা একা বসত, এভাবেই ২য়,৩য় শ্রেণী পার করলাম আমরা। ক্লাসের সকলে আমরা মুসলিম, আর ও একা অন্য ধর্মের। আর আশ্চর্যের ব্যাপার এত অবহেলার পরেও ও কেমন করে যেন টেনে টুনে পাশ করে যাচ্ছিল। ৪র্থ শ্রেণীতে ওর বাবা “বুদরাই” আমাদের বাড়িতে চুক্তি ভিত্তিক( মাসুড়া বা মাস চুক্তির পাট বা কাজের শ্রমিক) কাজ নেয়। আর ওর বাবার কারনে তখন আমার সাথে ওর টুক টাক কথা হয়, টিফিনে এক সাথে ফুটবল খেলা হয়। এভাবে বেশ কাটছিল। কিন্তু মনের মধ্যে ব্যবধানটা রয়েই গেছে। ৫ম শ্রেণীতে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। কারণটা হল ওর বাবা। মাঝে মাঝে ও ওর বাবার সঙ্গে বা ওর মার সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসত। আর আমার মা ওর মার সাহায্যে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিত।( আর তখনই আমার মাঝে এই খেয়াল আসে যে: ওদের সাহায্যে মোটা মুটি সব কাজ করিয়ে নেয়া যাবে আর ওদের সঙ্গে, ওদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা, খেলা ধুলা, স্কুলে যাওয়া যাবে না কেন) আমরা সকলে একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করি। সাঁওতাল পাড়ার ওরা এখন আমাদের জন্য ওয়েট করে এক সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য। যদিও আমাদের (মুসলিম) কেও কেও বিষয়টা পছন্দ করত না। কিন্তু আমার জন্য, আমার ভয়ে আবার কেও কিছু বলতেও পারতো না। এভাবে সাঁওতালদের সঙ্গে আমরা বেশ হই হুল্লু করে স্কুলে যাচ্ছি , আসছি। আর ক্লাসে যতিনের সঙ্গে এক বেঞ্চে শুধু আমি বসি। এ নিয়ে প্রথম দিন এক ছার( শিক্ষক) কিছু যেন বলতে চেয়েও বললেন না। আর ছাত্ররা তো কানা ঘুষা শুরু করছিল। যদিও তা পরে স্তিমিত হয়ে যায়।
একদিন স্কুলে যাবার পথে দেখি যতিন অপেক্ষমাণ দলে নেই। আমি ওদের একজনকে জিঙ্গেস করলাম যতিন কই? ওরা বলল আমরা জানিনা। তো আমি আমার কাজিন জুয়েল কে নিয়ে ওকে খোঁজ করতে ওর বাড়িতে গেলাম।{এর আগেও বাবার সঙ্গে বেশ কবার ওদের বাড়ি এসেছি আমি। যখন যতিন এর বাবা “বুদরাই” কাজে যেত না , তখন বাবার সাথে খোঁজ নিতে আসতাম। দেখতাম মদ্দ( পুরুষ) বাংলা( তাড়ি- মদ) খেয়ে পড়ে আছে আঙ্গিনায় বা কখন বা রাস্তার ধারে।}
বাড়িতে ঢুকে দেখলাম যতিন খুব তাড়াতাড়ি ভাত খাচ্ছে। আমি বললাম কিরে এত দেরি কেন তোর? ও বলল ভাত হতে দেরি হল যে, এই খেয়ে নেই একটু দাড়া। আমাদের কথা শুনে ওর মা ঘর হতে বাইরে এসে আমাকে দেখে মুখ ভরা হাঁসি নিয়ে বলল ওমা ছোট গেরস্থ( গিরাস্থ বলতে ধনী কৃষকদের বুঝায়, বা ওরা যার বাড়ি কাজ করে ওদের কে গিরাস্থ বলে ডাকে) যে, বস বস। আমাদের পিড়ি( এক ধরনের কাঠের বসার টুল বিশেষ) এগিয়ে দিলেন। যতিন এর পর ওর মাকে উদ্দেশ্য করে সাঁওতালি ভাষায় কি যেন বলল। আমরা এক বর্ণ বুঝতে পারলাম না। এর কিছুক্ষণ পর ওর মা দুই প্লেটে করে ভাত নিয়ে আমার আর জুয়েলের সামনে দিয়ে বলল খাও গেরস্ত। আমরা তো না না করে উঠলাম। জুয়েল তো পারলে দৌড় মারে। যতিন আমাদের অবস্থা দেখে বলল কি ঘেন্না পাচ্ছে খেতে নারে?
আমরা তো তোদের বাড়িতে খায়, তা হলে তোদের খেতে অসুবিধা কোথায়?
কথাটা আমাকে বেশ আঘাত করে। আমি প্লেট টেনে খেতে শুরু করি। জুয়েল কিছুতেই খাবে না। আলুভর্তা আর গরম ভাত। মেরে দিলাম বিসমিল্লা বলে। এর পর সকলে স্কুলে গেলাম আমরা।
বিকেলে স্কুল হতে ফিরে জুয়েল হারামি মার কাছে এসেছে কম-প্লেন করতে। মা কে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছেন আমি কি ভাবে সাঁওতালদের(যতিন) বাড়িতে ভাত খেয়েছি। আমার তো যান নাই নাই অবস্থা। কপালে কি খারাবি আছে এই ভেবে। সব শুনে মা জুয়েল কে কি বলেছিল জানেন। মা জুয়েল কে বলছিল, “তো এমন কি হয়েছে, ওরাও তো মানুষ। খেলে এমন কি হবে।“
আমার এই বন্ধু ৫ম শ্রেণীর পর আর পড়েনি। ওর বাবা ওকে পরিবারের সচ্ছলতার জন্য অন্য পাড়ার এক গেরস্থের বাড়িতে গরু চরানোর( তখন একটা কৃষকের ১০-১৫ টা করে গরু থাকতো, আর এই গরু গুলি খোলা মাঠে ছেড়ে দিয়ে ঘাস খাওয়ানোই হল গরু --- চরানো) কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। যতিনের সঙ্গে এখন বাড়ি গেলে প্রায় দেখা হয়, কথা হয়। বিয়ে সাধি করে ৩ ছেলে মেয়ের বাবা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বাংলা খেয়ে চুর হয়ে পাড়া ময় ঘুরে আর বক বক করে। আমার সাথে দেখা হলেই বলেঃ মাওলা বাবু ঢাকায় আমারকে একটা চাকরি ঠিক করে দেওনা। আমিও বলি: ঠিক আছে যতিন বাবু, তুমি চলে আস ঢাকায়। তোমার জন্য ভাল একটা চাকরির ব্যবস্থা করব।
মরালঃ মানুষ সে, যে ধর্মের হক, যে যাতের হক, তাঁকে ঘৃনা করা উচিত নয়।

######সাঁওতালদের কিছু ইতিহাস#########
@@উৎপত্তিঃ সাঁওতালরা পূর্বভারত ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির একটি। সাঁওতালরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে যে ভাষাটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক উপজাতির মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয়। সাঁওতালদের মধ্যম গড়নের আকৃতি, শরীরের গাঢ় রঙ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট এবং কোঁকড়ানো চুল তাদের অস্ট্রো-এশিয়াটিক নৃতাত্ত্বিক উৎস নির্দেশ করে যে গোষ্ঠীর মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল দ্রাবিড়দেরও আগে অস্ট্রেলিয়া এবং সন্নিহিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপমালা থেকে।

@@ভাষাঃ সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের সাঁওতালি উপপরিবারের একটি ভাষা। হো এবং মুন্ডারি ভাষার সাথে এর মিল আছে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের প্রায় ৬০ লক্ষ লোক সাঁওতালি ভাষাতে কথা বলে। বেশির ভাগ বক্তা ভারতের ঝাড়খণ্ড, আসাম, বিহার, ওড়িশা, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাস করে। সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি আছে, যার নাম অলচিকি লিপি, তবে সাঁওতালি ভাষাভাষীদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার খুব কম।
@@ সান্তাল হুলঃ সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণ সংগ্রাম। তাদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, চাঁদ প্রমুখ। ১৮৫২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সোচ্চার হয়েছিল।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×