০১.
প্রথমে আমরা কবিতাটি পড়ি। কবিতাটির শিরোনাম:
জরিপ এবং নির্ণয় অভিলেখ
কবিতাটি নিম্নরূপ:
হাড়ের পাশে বেড়ে উঠছে লীন অনুতাপ
মুখের ছায়ায় সরে সরে যায় পতনের মালিকানা
খোঁপে নড়ে চড়ে ঘুঁটি মন্তব্যহীন
প্রাথমিক সংক্রমন গারদ বন্দিপরস্পর
ঠোঁটের কষ ততোক্ষণ ভেজা ক্রিয়াশীল আঙুলে ছোঁয়া-ছুঁয়ি পর্যবেক্ষণ
মাঝবেলার সরাসরি অন্যায় নিরাপদ ঘেরাটোপ কারিগর
বিভাগটান মিশে মিশে নির্ণয়মান ভুল হয়
০২.
আমি কখনোই বলছি না যে কবি কী বলতে চেয়েছেন তা আমি জানি। সেটা কবিও জানেন কিনা সংশয়। তবে সেটা অবশ্যই সাহিত্যের অধ্যাপক জানেন। কেউ সত্যি সত্যি কবির মনের কথা জানতে চাইলে সাহিত্যের অধ্যাপকের কাছে যান।
আমি সাধারণ পাঠক। আমি কবিতাকে নিজের মতো পাঠ করবো। এবং নিজস্ব ব্যাখ্যান প্রকাশ করবো।
০৩.
কবিতা কী? কিংবা পদ্য আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী? এটা সাধারণ প্রশ্ন। এবং আমি কী মনে করি?
আমি মনে করি পদ্য হলো পদ্যকারের সৃষ্টি করে দেয়া একটি জগত। যেখানে পাঠক বিচরণ করবে। বিচরণ করা আর প্রস্তুতকৃত রস আস্বাদন করা ছাড়া পাঠকের আর কোনো কাজ নেই। যেমন, আমাদের ছোটোনদী চলে বাঁকে বাঁকে শোনার সাথে সাথেই আমরা নদীর বাঁকে চলে যাই এবং পদ্যকারকৃত দৃশ্যে ঘুরাঘুরি করি। নিজে কিছু বানাই না। অন্যেরটা খাই, অন্যেরটা পরি।
আর কবিতা হলো একটা অন্তহীন অভাবনীয় জগতের দরজা। যেটা কবি তৈরি করেন। তারপর তিনি মৃত। পাঠক সেই দরজা দিয়ে ঢুকে নিজের মতো করে জগৎটাকে তৈরি করেন এবং বিরচরণ করেন এবং নিজের সৃষ্ট গাভীর দুগ্ধ পান করেন মানে রস আস্বাদন করেন।
০৪.
মনে করেন কবিতা একটি। দরজাও একটি। কিন্তু পাঠক অনেক। তাহলে কি পাঠক একই জগৎ তৈরি করবে? না, পাঠকের অভিজ্ঞতা আর চিন্তার ভিন্নতার কারণেই পাঠক একই দরজা দিয়ে ঢুকে বিভিন্ন জগৎ তৈরি করবে। পাঠক বেরিয়ে এসে পুনর্বার প্রবেশে তার জগৎ পাল্টেও যেতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পাঠক জানবে না, কবি কী বলতে চেয়েছেন। সোনারতরী কবিতা সম্পর্কে রবিঠাকুর কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন তিনি এইখানে বর্ষার চিত্র ছাড়া কিছুই বিস্তার করেন নি। অথচ সাহিত্যের অধ্যাপকরা এই কবিতা নিয়ে ইহকাল পরকাল একাকার করেছেন।
০৫.
আমি এইখানে কোনো তত্ত্ব বলবো না। কেননা আমি তত্ত্ব জানি না।
০৬.
অনেকেই কবিতাকে শব্দের খেলা মনে করেন। মনে করেন হাজার হাজার শব্দ, রূপ, অলঙ্কার, মতো মতো মতো ইত্যাদি।অনেকে আবার শব্দমোহে ডুবে থাকেন; শব্দের মায়া কাটাতে পারেন না। চমকপ্রদশব্দ(যথা: যোনি, শিশ্ন, স্তন, পোঁদ, মূত্র, ভগাঙ্কুর, রজঃ, বীর্য, সঙ্গম, শীৎকার, মাস্টারবেট) সহযোগে অসার্থক শব্দবন্ধ তৈরি করে পুরা কবিতার ভারসাম্যকে নষ্ট করে আলোচিত হতে পছন্দ করেন। দাদা, ইহাকেই স্টান্টবাজি বলে।
অনেকেই মনে করেন বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি হেতু তার কবিতাও আবেগে টলটলে দিঘি জলাশয় বাদামক্ষেতবহুল প্রমূখ। অনেকেই আবার ঐতিহ্যের কথা বলে আটশোবছরের ভিনদেশি শব্দ এবং তারও আগের পৌরাণিক শব্দে ফিরে যেতে চান। অনেকেই দশপাতা ভাবালুতা করে বলেন ইহা কবিতা লিখেছি, দাদা; হাহাহাহাহাহ...
কবিতায় ইতিহাস-পুরাণ যাবতীয় কিছু থাকবে। কেবল ওই সময়কে অভ্যাসে ধরবো না আমি। ভাই, ইহা আমার মত।
কবিতা হবে সমস্ত বাহুল্যবর্জিত, ধনুকের ছিলার মতো টানটান। এবং পরিচ্ছন্ন।
কবিতাকে আমি বৈশ্বিক মনে করি। যেহেতু আমাদের অবিমিশ্র সংস্কৃতির কোনো ইতিহাস নেই।
কবিতা ধরবে সময় এবং সমসাময়িক প্রকরণ। যা প্রথাকে ছিন্ন করে। নতুন প্রকরণ তৈরি করে।
০৭.
আমরা অনেকেই এখনো ন্যারেটিভই লিখি কবিতায়। কবিতাকে যদি বৈশ্বিক ধরি তবে পশ্চিমা কবিরা ন্যারেটিভ ভেঙে দিয়েছে ষাট/ সত্তরের দশকে। এবং প্রতিটি লাইনের পরে যে শূন্যস্থান তৈরি করেছে তা পাঠক পুরণ করার জন্যে।
আসেন আলোচ্য কবিতায় প্রবেশের আগে গ্লোরিয়া গার্ভিজের একটা কবিতা পড়ি:
Immoderate begger
empty-handed hostess
barren mother
the light dims
insidious
as a gadfly
I'm not permitted to understand
-----------------------------------------------------------------------------
(Gloria Gervitz was born in 1943 in Mexico City, where she still lives).
০৮.
আলোচ্য কবিতার আমি এগারোটা ভিন্ন ব্যাখ্যা একটানে লিখতে পারি। কিন্তু তা আমি করবো না। প্রিয় পাঠক, আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, আমি এর একটা ব্যাখ্যাও দিবো না। আপনারা আমার সাথে আরেকবার পাঠ করবেন। এবং প্রবেশ করবেন। এবং নিজের মতো জগৎ তৈরি করবেন। এবং তারপর চাইলে হুর পরিবেষ্টিত হতে পারেন কিংবা ইনফার্নো সাজাতে পারেন।
০৯.
আলোচ্য কবিতার প্রতিটা লাইনকে আমরা অলাদা করে পাঠ করবো। যেহেতু কবি এইখানে ন্যারেটিভ ভেঙে দিয়েছেন। সবশেষে আপনারা নিজেরাই সব মিলিয়ে একএকটা ডিসকোর্স তৈরি করবেন। আমি করবো না।
প্রথম লাইন:
হাড়ের পাশে বেড়ে উঠছে লীন অনুতাপ
হাড় আর লীন অনুতাপ। বাকিটা ক্রিয়া। হাড় কেনো? কেনো রক্তমাংস নয়? লীন অনুতাপ মানে কী? কেনো অনুতাপ বিলীন। তারমানে অনুতাপ ছিলো এখন নেই? আর হাড় একদা রক্তমাংস ছিলো...
দ্বিতীয় লাইন:
মুখের ছায়ায় সরে সরে যায় পতনের মালিকানা
মুখের ছায়া আর পতনের মালিকানা। মুখের ছায়া কী? ছায়াকে যদি আমরা বাইনারি অপোজিশন (আলো-ছায়া) না ধরি। যদি ধরি সদর্থক। তাহলে পতিত তার পতনের মালিকানা কি হারায় না?
তৃতীয় লাইন:
খোঁপে নড়ে চড়ে ঘুঁটি মন্তব্যহীন
খোঁপ আর ঘুঁটি। খোঁপ হলো সময়ের গোলকধাঁধা। গোলকধাঁধা প্রথম তৈরি হয় ক্রিটে। তৈরি করেন ইকারুসের বাবা। ঘুঁটি হলেন আপনারা মানুষ। তারা ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক তাই মন্তব্যহীন। তারপর কী হবে...
চতুর্থ লাইন:
প্রাথমিক সংক্রমন গারদ বন্দিপরস্পর
প্রাথমিক অবস্থায় আমরা পরস্পর নিজেদের বন্দি করছি। তারপর...
পঞ্চম লাইন:
ঠোঁটের কষ ততোক্ষণ ভেজা ক্রিয়াশীল আঙুলে ছোঁয়া-ছুঁয়ি পর্যবেক্ষণ
এই লাইনের আগে কবি একটা স্পেস রেখেছেন। এটাও পাঠকের জন্যে।
মাটির মূর্তি ততোক্ষণ ভেজা থাকে যতোক্ষণ ভাস্কর সেটা গড়েন ক্রমে। শেষে শুকাতে থাকে।
ষষ্ঠ লাইন:
মাঝবেলার সরাসরি অন্যায় নিরাপদ ঘেরাটোপ কারিগর
মধ্যবয়স। অন্যায়। নিরাপদ। ঘেরাটোপ। কারিগর।
মাঝবয়েসিকে কেউ কি সন্দেহ করে নাকি?
সপ্তম লাইন:
বিভাগটান মিশে মিশে নির্ণয়মান ভুল হয়
বিভাগটান। মিশে। ভুল। নির্ণয়।
জমিনের আইল ভেঙে দেন। আপনার জমি কোনটা আর বুঝতে পারবেন না।
এইটা গেলো শেষ লাইল। আবার সমস্ত কবিতা:
হাড়ের পাশে বেড়ে উঠছে লীন অনুতাপ
মুখের ছায়ায় সরে সরে যায় পতনের মালিকানা
খোঁপে নড়ে চড়ে ঘুঁটি মন্তব্যহীন
প্রাথমিক সংক্রমন গারদ বন্দিপরস্পর
ঠোঁটের কষ ততোক্ষণ ভেজা ক্রিয়াশীল আঙুলে ছোঁয়া-ছুঁয়ি পর্যবেক্ষণ
মাঝবেলার সরাসরি অন্যায় নিরাপদ ঘেরাটোপ কারিগর
বিভাগটান মিশে মিশে নির্ণয়মান ভুল হয়
১০.
কবি দীপঙ্কর সেন গুপ্ত।
জন্ম: আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত। কাকশালিখচড়াইগাঙচিল, তার ব্লগিয় নাম। তার অন্যলেখা পড়ুন এইখানে:
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ২:০৬