somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুরাঃ পাপমোচনের সময় এখনই

২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লজ্জায় মুখ ঢেকে আছেন একজন বীরাঙ্গনা। আসলেতো লজ্জিত হওয়ার কথা আমাদের। ছবিঃ নায়েব উদ্দীন আহমেদ।

(আকার আকৃতিতে এই লেখাটি নীল তিমির মতই দীর্ঘকায়। কারো যদি অসীম ধৈর্য্য এবং অফুরন্ত অলস সময় থাকে তাহলেই শুধুমাত্র এই দীর্ঘপথে পা বাড়াবেন। না থাকলে আগে ভাগে সরে পড়াটাই হবে উত্তম কাজ। পাঠকদের ধৈর্য্য এবং অলস সময়ের উপর অযাচিত চাপ না ফেলে একাধিক পর্বে ভাগ করে দিতে পারতাম ইচ্ছে করলেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিরতির বিঘ্নতায় পাঠকদের লেখাটির সাথে আবেগগত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। যেটা কোনভাবেই কাম্য নয় আমার কাছে। সে কারণেই অসীম সাহসের সাথে অনেক সংশয়কে পাশ কাটিয়ে এক পর্বেই পোস্ট করলাম লেখাটি।



এই লেখাটির জন্য বীণা ডি’কস্টার লিখিত বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুদের উপর প্রবন্ধসমূহের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছি আমি। অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো বাংলাদেশের সন্তান এই গুণী, মেধাবী এবং পন্ডিত ব্যক্তিটির প্রতি। সেই সাথে অন্য যাদের লেখা থেকে তথ্য ব্যবহার করেছি তাদের প্রতিও আমার সবিশেষ কৃতজ্ঞতা।



একজনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার দায়মোচন থেকে লিখিত এই প্রবন্ধটি। বাহুল্য বিধায় তার নামটি উহ্য রাখা হলো। অন্তরালের সেই একজনের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত আমার এই লেখাটি।)




২০০২ সালে মন্ট্রিয়লবাসী ক্যানাডিয়ান পরিচালক রেমন্ডে প্রভেনচার যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে ‘War Babies’ নামে একটি ডকুমেনটারি তৈরি করেন। সেই ডকুমেন্টারিতে তিনি ওয়াটারলু, ওন্টারিওতে বসবাসকারী এক ক্যানাডিয়ান যুবক রায়ানের পিছু নেন। এই যুবক তার ধূসর অতীতকে ছুঁয়ে দেখার জন্য যাত্রা করেছিল বহু বহু বছর আগে তার জন্ম হওয়া এক অজানা দেশের উদ্দেশ্যে। বাবা মায়ের গভীর ভালবাসায় জন্ম নেয়ার সৌভাগ্য রায়ানের হয়নি। প্রেমবিহীন নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় ভালবাসাহীন পৃথিবীতে অনিচ্ছুক এবং অবাঞ্চিত আগমণ তার। রায়ান একজন যুদ্ধ শিশু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের করুণতম পরিণতি সে। একাত্তর সালে পাকিস্তানী এক সৈনিকের অজ্ঞাত কোন বাঙালী রমণীকে বর্বরভাবে ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে তার জন্ম। বাহাত্তর সালে বাংলাদেশ থেকে তাকে দত্তক নিয়েছিল এক ক্যানাডিয়ান দম্পতি। সেখানেই তার বেড়ে উঠা। অতঃপর পরিণত বয়সে নিজের জন্মকালীন সময়কে অনুধাবন করা এবং মাকে খুঁজে পাবার জন্য রায়ানের বাংলাদেশ যাত্রা শুরু ।



তার নিজের লেখা এক কবিতায় রায়ান তার নিজের জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘আমার নাম রায়ান বাদল। আমার দুইজন মা। একজন আমাকে ডাকে রায়ান বলে। আরেকজন আমাকে ডাকতো বাদল বলে। রায়ান বলে যিনি আমাকে ডাকেন, তাকে আমি আমার সারা জীবন ধরে চিনি। কিন্তু যিনি আমাকে বাদল বলে ডাকতেন তাকে আমি কখনো দেখিনি। তিনি আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সেই জন্মের তিন সপ্তাহ পরে আবার আমি জন্মেছিলাম আমার রায়ান নামে ডাকা ক্যানাডিয়ান মায়ের কোলে। বাদল নামে ডাকা আমার জন্মদাত্রী মাকে ১৯৭১ সালে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানী এক সৈন্য। আমি একজন যুদ্ধ শিশু’।



অনেকদিন আগের ঘটনা। তাই নাম ধাম সব ভুলে গিয়েছি আমি। অষ্টাদশী এক তরুণী যুদ্ধ শিশু বুক ভরা আশা নিয়ে ক্যানাডা থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিল তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের খোঁজে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মায়ের হদিস পায়নি সেই তরুণী। না দেখা সেই মাকে খোঁজার হৃদয় বিদারক যন্ত্রণা থেকে মর্মস্পর্শী একটি কবিতা লিখেছিল সে। যা ছাপা হয়েছিল ইংরেজী দৈনিক অবজার্ভারে।



এরও বছর দুয়েক আগে হবে হয়তো ঘটনাটা। কোন এক সাময়িকীর চিঠিপত্র কলামে ছাপা হয়েছিল এক কিশোর যুদ্ধ শিশুর চিঠি। বাংলাদেশের কোন এক মাদ্রাসার ছাত্র ছিল সে। সেখানে তাকে ‘জাউরা’, ‘পাকিস্তানীর পুত’সহ নানাবিধ টিটকারী শুনতে হতো সহপাঠীদের কাছ থেকে। সেই কিশোর যুদ্ধ শিশু করুণ আর্তিতে জানতে চেয়েছিল, এই দেশে কি তার কোনই অধিকার নেই। সে কি পাকিস্তানী কোন লম্পট ধর্ষক সৈনিকের ঘৃণ্য সন্তান, নাকি এই দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা এক নির্যাতিতা মায়ের গর্বিত সন্তান? কোন পরিচয়টা তার আসল পরিচয়?



বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়ায়ন ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকতায় নিয়োজিত ডঃ বীনা ডি’কস্টা বিভিন্ন এডোপশন এজেন্সী, বাংলা ওয়েবসাইট এবং সংবাদপত্রে আবেদন জানিয়েছিলেন যুদ্ধ শিশুদের সাথে কথা বলার জন্য। খুব অল্প কয়েকজনই তাদের জীবন কাহিনী জনসম্মুখে প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিল। বীনা ডি’কস্টাকে লেখা ই-মেইলে এক যুদ্ধ শিশু লিখেছিল,



‘আমার দত্তক বাবা ছিল মহা বদমাশ এক লোক। সারাক্ষণই আমাকে অপমান করার চেষ্টা করতো সে…..আমি বছর চারেক আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম……..আমি সবসময়ই ভাবি যে আমি কেন এই ক্যানাডিয়ায়ান দম্পত্তির কাছে দত্তক হয়েছিলাম, যারা আমাকে দত্তক নেয়ার তিনমাসের মধ্যেই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল…….আমার শৈশব ছিল বিভীষিকাময়। আমার যখন খুব প্রয়োজন ছিল তখন আমার নিজের দেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার দিক থেকে। আর সে কারণেই আমি বাংলাদেশকে ঘৃণা করি। আমি মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে কাঁদি, কারণ আমার কোন শিকড় নেই। একারণেই আমি চেষ্টা করছি যেখানে আমি জন্মেছি সেই দেশ সম্পর্কে কিছুটা জানতে’।



সদ্য প্রয়াত খ্যাতিমান লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের কোন এক যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে করা হোম ভিডিও দেখার অভিজ্ঞতা থেকে তার নিজের ব্লগে লিখেছিলেন একটি হৃদয়স্পর্শী প্রবন্ধ। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘একটি ভিডিওঃ ব্যক্তিগত বিজয়ের গল্প’। এই প্রবন্ধে তিনি একজন যুদ্ধ শিশুর তার মায়ের সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা তুলে ধরেছেন এভাবে।



ভিডিওর শুরুতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়ির একটি টেবিলে, ডাইনিং টেবিল বলে ধারণা হয়, দুটি চেয়ারে বসে আছে দু‘জন নারী। একজন বয়স্ক, চেহারায়, পোশাকে গ্রামীণ মানুষের ছাপ। কথা বলে বগুড়া শহর বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ভাষায়। এই মুহূর্তে তার বয়স অনুমান করা যায় না, ধারণা করা যাবে ভিডিও দেখার পরে আনুষঙ্গিক কাহিনীটি জানা হলে। অন্যজন বয়সে তরুণী, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলিই প্রথমে চোখে পড়ে। রং-চেহারায় পুরোপুরি বাঙালি ছাপ থাকলেও কথা বলে মার্কিনি ধাঁচের ইংরেজিতে। তার পরণের পোশাকটি অবশ্য কোনো তথ্য জানায় না, সূত্রও পাওয়া যায় না। আজকাল বাংলাদেশে শহরের অনেক মেয়েও এ ধরনের পোশাক পরে।


দুই নারী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। একজন মহিলা দোভাষী, যাঁকে ক্যামেরায় দেখানো হচ্ছে না, একজনের কথা সাবলীলভাবে অনুবাদ করে জানাচ্ছেন অন্যজনকে। এই কথোপকথন থেকে অবিলম্বে জানা যায়, ইংরেজি-বলা তরুণীটি ওই বয়স্কার কন্যা।


বিবরণের সুবিধার জন্যে এদের একটি করে কাল্পনিক নাম দেওয়া যাক। আমরা বয়স্কাকে আমিনা এবং তরুণীকে সামিনা নামে চিনবো। তিরিশ বছর পরে, সামিনার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর, এই তাদের প্রথম সাক্ষাত। ভিডিওতে ধরা ছবিতে দেখা যায়, একজন আরেকজনকে ক্রমাগত স্পর্শ করে, অনুভব করার চেষ্টা করে। পরস্পরের অজানা অসম ভাষায় হৃদয়ের যে আর্দ্রতা-ভালোবাসার পূর্ণ প্রকাশ ঘটতে পারে না, স্পর্শে তা সঞ্চারিত হতে থাকে। বস্তুত, প্রথমবারের সাক্ষাতে আজীবনের বিচ্ছেদ ও অদেখার তৃষ্ণা আর কিছুতেই মেটে না বলে বোধ হয়।


একসময় সামিনা ক্রমাগত চোখের পানি মুছতে থাকলে তার মা বলে ওঠে, ‘ওঙ্কা কর‌্যা চোখ মুছপার থাকলে চোখ বিষ করবি রে মা…‘। অনূদিত হয়ে কথাটি মেয়ের কাছে পৌঁছুলে কান্নাচোখেই হেসে ফেলে সে, ‘আমার চোখ সত্যিই ব্যথা করছে, মা‘। মায়ের মাথায়, কপালে, চুলে, গালে হাত বুলিয়ে মেয়ে একবার হাসে, একবার কেঁদে ওঠে, ‘এতোদিন পর সত্যি তোমার দেখা পেলাম, মা গো! এই দিনের জন্যে আমি অপেক্ষা করেছি আমার সারাটা জীবন ধরে!‘ মেয়ের তুলনায় মায়ের আবেগ খানিকটা নিয়ন্ত্রিত মনে হলেও তার চোখও ভিজে ওঠে।






সামিনাকে শিশুকালেই রেডক্রসের লোকেরা যুদ্ধ শিশু হিসাবে নিয়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। সেখানে তাকে দত্তক নিয়েছিল আমেরিকান এক পরিবার। বড় হওয়ার পর সে জেনেছে যে সে আসলে একজন যুদ্ধ শিশু। আর তখন থেকেই তার শুরু হয় মাতৃপরিচয় উদঘাটনের অনুসন্ধান। অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক বছরের চেষ্টার পর মায়ের নাম ঠিকানা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় সে। বার বার খবর পাঠানোর পরেও তার জন্মদাত্রী মা আমিনা রাজী হয়নি মেয়ের সাথে দেখা করার। এমনকি স্বীকারও করেনি পুরো বিষয়টিকে। নাছোড়বান্দা সামিনা শেষমেষ এসে হাজির হয় বাংলাদেশে। তিরিশ বছর পর মুখোমুখি হয় তার জন্মদাত্রী মায়ের ।



সামিনার মত মাকে ছুঁয়ে দেখার, মায়ের চোখে চোখ রাখার, মায়ের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য বেশিরভাগ যুদ্ধ শিশুরই হয়নি। তাদের বীরাঙ্গনা মায়েরা যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের সমাজের অতল অন্ধকারে, যুদ্ধ শিশুরাও তেমনি হারিয়ে গেছে এই বিশাল পৃথিবীর সুবিশাল ব্যপ্তিতে। কেউ মনে রাখেনি তাদের কথা। অগণিত দুর্ভাগা মা আর তাদের হতভাগ্য সন্তানদের কথা মনে রাখার সময়ই বা কোথায় আমাদের।



বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে বাঙালি রমণীরা। ঠিক কতজন যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। বীণা ডি’কস্টা তার “Bangladesh’s erase past’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে, সরকারী হিসাব অনুযায়ী একাত্তরে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল দুই লক্ষ নারীকে। একটি ইটালিয়ান মেডিক্যাল সার্ভেতে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা বলা হয়েছে চল্লিশ হাজার। লন্ডন ভিত্তিক International Planned Parenthood Federation (IPPF) এই সংখ্যাকে বলেছে দুই লাখ। অন্যদিকে যুদ্ধ শিশুদের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সমাজকর্মী ডঃ জিওফ্রে ডেভিসের মতে এই সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। সুজান ব্রাউনমিলারও ধর্ষিতার সংখ্যা চার লাখ বলে উল্লেখ করেছেন।



পাকিস্তান আর্মি যে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি মহিলা এবং মেয়েদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০২ সালের মার্চ মাসের বাইশ তারিখে ডন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে। যেখানে গণধর্ষণের বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের মন্তব্যকে কোট করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে সরাসরি বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান আর্মিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যশোরে ছোট্ট একদল সাংবাদিকের সাথে কথা বলার সময় তিনি এয়ারপোর্টের কাছে জড়ো হওয়া একদল বাঙালির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন যে, ‘আগে এদেরকে মুসলমান বানাও’। এই উক্তির তাৎপর্য সীমাহীন। এর অর্থ হচ্ছে যে, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে বাঙালিরা খাঁটি মুসলমান নয়। এই ধারণার সাথে আরো দুটো স্টেরিওটাইপ ধারণাও যুক্ত ছিল। বাঙালিরা দেশপ্রেমিক পাকিস্তানী নয় এবং তারা হিন্দু ভারতের সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ট।



ইয়াহিয়া খানের এই উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদেরকে মুসলমান বানানোর সুযোগ লুফে নেয়। আর এর জন্য সহজ রাস্তা ছিল বাঙালি মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদেরকে দিয়ে সাচ্চা মুসলমান বাচ্চা পয়দা করানো। পাকিস্তানী সৈন্য এবং তার এদেশীয় দোসররা শুধু যত্রতত্র ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। জোর করে মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধর্ষণ ক্যাম্পে। দিনের পর দিন আটকে রেখে হররোজ ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের। পালাতে যাতে না পারে সেজন্য শাড়ী খুলে নগ্ন করে রাখা হতো তাদেরকে। আত্মহত্যা যাতে করতে না পারে তার জন্য চুল কেটে রাখা হতো, যাতে করে সিলিং এ ঝুলতে না পারে।



পাকিস্তান আর্মির দোসর রাজাকার এবং আলবদরেরা জনগণকে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত করে দেশছাড়া করে তাদের সম্পত্তি এবং জমিজমা দখলের জন্য ধর্ষণকে বেছে নিয়েছিল।



প্রথম আলো ব্লগে আইরিন সুলতানা তার প্রবন্ধ ১৯৭১: বীরাঙ্গনা অধ্যায় এ সুজান ব্রাউনমিলারের গ্রন্থ Against Our Will: Men, Women and Rape থেকে অনুবাদ করেছেন এভাবেঃ



Brownmiller লিখেছিলেন, একাত্তরের ধর্ষণ নিছক সৌন্দর্যবোধে প্রলুব্ধ হওয়া কোন ঘটনা ছিলনা আদতে; আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানী-দাদীর বয়সী বৃদ্ধাও স্বীকার হয়েছিল এই লোলুপতার। পাকসেনারা ঘটনাস্থলেই তাদের পৈচাশিকতা দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ; প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো সৈন্যদের জন্য। রাতে চলতো আরেক দফা নারকীয়তা । কেউ কেউ হয়ত আশিবারেও বেশী সংখ্যক ধর্ষিত হয়েছে ! এই পাশবিক নির্যাতনে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, আর কতজনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা হয়ত কল্পনাও করা যাবে না । (Brownmiller, p. 83)




পাকিস্তান আর্মির উচ্চ পদস্থ অফিসাররা যে ব্যাপকহারে ধর্ষণের ব্যাপারে জানতেন এবং তাদের যে প্রচ্ছন্ন সম্মতিও ছিল তাতে সেটা বোঝা যায় নিয়াজীর এক মন্তব্য থেকে। নিয়াজী একাত্তরে সংগঠিত র্ধষণের ঘটনা স্বীকার করার সাথে সাথে একটি অসংলগ্ন উক্তি করেছিলেন - আপনি এরূপ আশা করতে পারেন না যে, সৈন্যরা থাকবে, যুদ্ধ করবে এবং মুত্যু বরণ করবে পূর্ব পাকিস্তানে আর শারীরবৃত্তিয় চাহিদা নিবৃত্ত করতে যাবে ঝিলামে !



তবে পাকিস্তান আর্মির পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান স্বীকার করলেও সম্প্রতিকালে একজন বাঙালি গবেষক ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক বাঙালি রমণী ধর্ষণকে বিপুলভাবে অতিরঞ্জন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি হচ্ছেন হার্ভার্ড থেকে ডিগ্রিধারী ডঃ শর্মিলা বসু। তিনি তার Anatomy of Violence: Analysis of Civil War in East Pakistan in 1971 প্রবন্ধে এই উদ্ভট তথ্য প্রকাশ করেন। তার গবেষণা কর্ম ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং অনেকেই তার গবেষণার পদ্ধতিকে অগভীর, ত্রুটিপূর্ণ এবং পক্ষপাতময় বলে পালটা আক্রমণ করতেও দ্বিধা করেননি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন শর্মিলা বসুর গবেষণার সমালোচনা করে দৈনিক সমকালে একটি প্রবন্ধ লেখেন বাঙালি রমণীর পাকিস্তান সৈন্য প্রীতি নামে। নয়নিকা মুখার্জীও ওই প্রবন্ধকে সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছেন Skewing the history of rape in 1971 A prescription for reconciliation? নামে। এর বাংলা অনুবাদ করেছেন তানভীর, যা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তমনাতেই।



কতজন ধর্ষিতা নারী গর্ভবতী হয়েছিলেন এবং কতজন শিশু জন্মগ্রহন করেছিল তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। সামাজিক অপবাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক মা-ই করেছিলেন আত্মহত্যা। অসংখ্য গর্ভবতী মহিলা চলে গিয়েছিলেন ভারতে বা অন্য কোথাও গোপনে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। অনেক শিশু জন্মেছিল ঘরে যার কোন রেকর্ড নেই। দুঃখজনক হচ্ছে যে, নির্ভরযোগ্য এবং ত্রুটিহীন কোন পরিসংখ্যানই নেই আমাদের হাতে। ফলে, যুদ্ধ শিশুর সংখ্যা কত ছিল তার জন্য আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় মুলত অনুমান এবং ধারণার উপর। সামান্য কিছু দলিলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সরকারী এবং বেসরকারী সংগঠনের কাছে। কিছু কিছু আছে বিদেশী মিশন এবং মিশনারী সংস্থাগুলোর কাছে।



সরকারী এক হিসাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা বলা হয়েছে তিন লাখ। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ডঃ ডেভিসের মতে প্রায় দুই লক্ষ রমণী গর্ভবতী হয়েছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যা সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে করা, কোন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত নয়। সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ তার ‘সেইসব বীরাঙ্গনা ও তাদের না – পাক শরীর’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেনঃ



ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (ব্রাউনমিলার, ১৯৭৫ : ৮৪)। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির পুরোধা এমএ হাসান দাবি করেন, ‘এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ এদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস। যুদ্ধের পরপরই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে ‘নষ্ট‘ করেছে।



ডঃ এম এ হাসানের তার প্রবন্ধ ‘The Rape of 1971: The Dark Phase of History’ তে বলেন যে, সারা দেশের গর্ভপাত কেন্দ্র এবং হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দশ শতাংশের চেয়েও কম সংখ্যক ধর্ষিতা সেগুলোতে ভর্তি হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরেই গর্ভপাতগুলো ঘটানো হয়েছে এবং সামাজিক পরিস্থিতির কারণে তা গোপন রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যে সমস্ত মহিলারা সেপ্টেম্বরের পরে গর্ভবতী হয়েছেন বা ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে যাদের গর্ভাবস্থা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তারা কেউই গর্ভপাত কেন্দ্র বা হাসপাতালে যায়নি।



বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের আহবানে সাড়া দিয়ে ধর্ষিতা মহিলাদের গর্ভপাতের জন্য ঢাকায় পৌছায় ব্রিটিশ, আমেরিকান এবং অষ্ট্রেলিয়ান ডাক্তাররা। তারা বাংলাদেশে পৌঁছার পরেই প্রতিষ্ঠা করা হয় বেশ কিছু গর্ভপাত কেন্দ্র।। এই গর্ভপাতকেন্দ্রলো সেবাসদন নামে পরিচিত। সেখানে তারা বাংলাদেশি ডাক্তারদের সহযোগিতায় গর্ভপাত করানো শুরু করেন। সেই সময়কার সংবাদপত্রের ভাষ্য এবং বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ যেমন বিচারপতি কে, এম, সোবহান, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপারভাইজর মার্গারেট মেরি, ডঃ জিওফ্রে ডেভিসের সাক্ষাতকার থেকে জানা যায় যে ঢাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে দুই হাজার তিন শত গর্ভপাত করানো হয়েছে।



সারাদেশব্যাপী গড়ে তোলা বাইশটি সেবাসদনে প্রতিদিন তিনশ’ থেকে চারশ’ শিশু জন্ম নিতো। ক্যানাডিয়ান ইউনিসেফ কমিটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। রেডক্রস প্রতিনিধি এবং ইউনিসেফের লোকজনের সংগে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অটোয়ার মূল অফিসে জানান যে, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া যুদ্ধ শিশুর সংখ্যা আনুমানিক দশ হাজার। সুজান ব্রাউনমিলারের মতে সন্তান জন্ম দিয়েছিল এমন বীরাঙ্গনার সংখ্যা পঁচিশ হাজার।



বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এই শিশুরা সমাজে তৈরি করে ভয়াবহ সংকট এবং সমস্যা। কেউ কেউ এই শিশুদেরকে বলে ‘অবাঞ্চিত সন্তান’, কেউ বলে ‘অবৈধ সন্তান’, কেউ বলে ‘শত্রু শিশু’ আবার কেউ বা নিদারুণ ঘৃণায় উচ্চারণ করে ‘জারজ সন্তান’ বলে। ফলে, এই সংকট থেকে কী করে মুক্তি পাওয়া যায় সেটাই হয়ে উঠে সেই সময়কার আশু চিন্তার বিষয়। সেই চিন্তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়কেও ছুঁয়েছিল। শেখ মুজিব ধর্ষিতা নারীদেরকে বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত এবং তাদেরকে নিজের মেয়ে হিসাবে উল্লেখ করলেও সেই মেয়েদের সন্তানদের ব্যাপারে তার কোন আগ্রহই ছিল না। তিনি পরিষ্কারভাবে বলে দেন যে, পাকিস্তানীদের রক্ত শরীরে আছে এমন কোন শিশুকেই বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। যুদ্ধ শিশুদের বিষয়ে নীলিমা ইব্রাহিম তার সংগে দেখা করতে গেলেও তিনি একথাই বলেন। এ বিষয়ে ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেনঃ



‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মাদের একটা সুব্যববস্থা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী হবে, তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সম্মনের সঙ্গে মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না’। (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল।



শেখ মুজিবের এই বক্তব্যই হয়তো যুদ্ধ শিশুদেরকে দত্তকের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে বাংলাদেশি কোন শিশুকে ভীনদেশে দত্তক দেওয়ার বিধান ছিল না, যদিও বাংলাদেশি পিতামাতা দত্তক সন্তান নিতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত অনুরোধে জেনেভা ভিত্তিক International Social Service (ISS/AB) এর ইউএস ব্রাঞ্চ সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে যুদ্ধ শিশুদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সরকারী দু’টি সংগঠন Central-Organization for Women এবং Rehabilitation and Family Planning Association কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে থাকে ISS এর পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের পুরো পর্যায় জুড়ে।



বিদেশী নাগরিকরা যাতে সহজেই যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে পারেন সে জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রজ্ঞাপিত হয় The Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order। বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে সর্বপ্রথম যে দেশগুলো আগ্রহ দেখায় তাদের মধ্যে ক্যানাডা অন্যতম। মাদার তেরেসা এবং তার সহকর্মীদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের শ্রম এবঙ্গ সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের চেষ্টায় দু’টো ক্যানাডিয়ান সংগঠন দত্তক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল মন্ত্রিয়ল ভিত্তিক অলাভজনক আন্তঃদেশীয় দত্তক প্রতিষ্ঠান Families for Children. এবং অন্যটি ছিল একদল উৎসাহি ক্যানাডিয়ানের গড়া টরন্টো ভিত্তিক অলাভজনক দত্তক প্রতিষ্ঠান Kuan-Yin Foundation। ক্যানাডা ছাড়াও আর যে সব দেশ এগিয়ে এসেছিল যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে তার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অষ্ট্রেলিয়া। এছাড়াও আরো অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও এগিয়ে এসেছিল সেই সময়। যুদ্ধ শিশুদের প্রথম ব্যাচ ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ক্যানাডায় পৌঁছলে তা মিডিয়ার ব্যাপক মনযোগ আকর্ষণ করে।



আর এভাবেই রাষ্ট্র এবং সমাজের ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টায় আমাদের সন্তানেরাই মাতৃদুগ্ধ পান করার বয়সে মাতৃকোল ছেড়ে চলে যেতে থাকে অজানা দেশে, অচেনা মানুষজনের কাছে। এই অমানবিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত সবল কোন মানবিক শক্তি তখন ছিল না। মজার বিষয় হচ্ছে যে, নীলিমা ইব্রাহিম এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, মোল্লারাই বরং শুরুর দিকে এই দত্তক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। মোল্লাদের বিরোধিতার মূল কারণ ছিল যে, এই সমস্ত মুসলমান সন্তানদেরকে খ্রীস্টান দেশসমূহে পাঠানো হচ্ছে।



গীতা দাস তার মুক্তমনায় প্রকাশিত ‘তখন ও এখন’ ধারাবাহিকের ২৪তম পর্বে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক নির্যাতিতা তার কিশোরী মাসী প্রমিলার করুন পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন। সেই লেখায় আমি একটি দীর্ঘ মন্তব্য করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিধায় সেই মন্তব্যটি এখানে তুলে দিচ্ছি।



আমাদের মুক্তিযুদ্ধের করুণতম অধ্যায়ের নাম হচ্ছে বীরাঙ্গনা নারী। যুদ্ধে সকল পক্ষেরই শত্রুর পাশাপাশি কোথাও না কোথাও মিত্রও থাকে। কিন্তু এইসব অসহায় নারীদের মিত্রপক্ষ বলে কিছু ছিল না। সকলেই ছিল তাদের শত্রুপক্ষ, তা সে শত্রুই হোক কিম্বা মিত্র নামধারীরাই হোক। যুদ্ধের সময় নয়মাস তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আল বদর, আল শামস, রাজাকার আর বিহারীদের কাছে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে। আর যুদ্ধের সময় বা পরে যারা তাদের মিত্র হওয়ার কথা ছিল, পরম স্নেহে বা ভালবাসায় বুকে টেনে নেবার কথা ছিল, সেই বাপ-চাচা, ভাই বেরাদারেরাই তাদেরকে ধর্ষণ করেছে মানসিকভাবে, আরো করুণভাবে, আরো কদর্যরূপে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বীরাঙ্গনাদেরকে তাচ্ছিল্য করে এর কাছাকাছি উচ্চারণের চরম অবমাননাকর একটা নামেও ডেকেছে অনেকে। আমি একে বলি সামাজিক ধর্ষণ। সামাজিক এই ধর্ষণ শারীরিক ধর্ষণের চেয়ে কম কিছু ছিল না বীরাঙ্গনাদের জন্য।

আমাদেরই কারণে যে পঙ্কিলে তাদেরকে পতিত হতে হয়েছিল অনিচ্ছুকভাবে, মমতা মাখানো হাত দিয়ে তাদের গা থেকে সেই পঙ্কিল সাফসুতরো করার বদলে নিদারুণ স্বার্থপরতা এবং হিংস্রতার সাথে আমরা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছিলাম আরো গভীর পঙ্কিলের মাঝে। পাছে না আবার গায়ে কাদা লেগে অশুদ্ধ হয় আমাদের এই বিশুদ্ধ সমাজ। অনিচ্ছাকৃত যে গর্ভাবস্থা তারা পেয়েছিলেন শত্রুর কাছ থেকে, সমাজের রক্তচক্ষু এবং ঘৃণার কারণে তা লুকানোটাই ছিল সেই সময় সবচেয়ে বেশি জরুরী কাজ। সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে তাদের কেউ কেউ গর্ভনাশ করেছেন নীরবে, কেউ কেউ আবার নিজের জীবননাশ করেছেন সংগোপনে। আর যারা তা পারেননি, তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে সন্তান জন্ম দিয়ে চলে গেছেন অজানার পথে। জন্ম মুহুর্তেই চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে মা আর তার সন্তানের নাড়ীর টান। দেবশিশুর মত সেই সব যুদ্ধ শিশুরাও এখন কে কোথায় তার কিছুই জানি না আমরা। এর দায়ভার কার? আমাদের এই সমাজের নয় কি?

আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের জন্য, গণহত্যা চালানোর জন্য আমরা পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা দাবী করি। আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেইসব বীরাঙ্গনা এবং তাদের সদ্যজাত সন্তানদের উপর যে চরম অবিচার করেছি, যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়েছি কখনো? চাইনি। চাইনি বলেই যে চাওয়া যাবে না এমন কোন কথা নেই। এখন সময় এসেছে সেই সব বীর নারীদের এবং তাদের প্রসূত যুদ্ধ শিশুদের কাছে জাতিগতভাবেই আমাদের করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই বিজয় দিবসে সেই অঙ্গীকারটুকুই বা আমরা করি না কেন?




দেশ স্বাধীনের পরেই পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছিল বীরাঙ্গনা নারীরা। এই নিষ্ঠুর সমাজের কাছে কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না তাদের। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছিল তারা নিজেদেরকে। যে দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদেরকে একাত্তরে তার যাতনা ভুলে থাকা রীতিমত অসাধ্য তাদের জন্য। কিন্তু নিজের সমাজও তাদেরকে গ্রহণ করেনি সহজভাবে। বীরাঙ্গনা নামের উপাধি তাদের সম্মানের চেয়ে অসম্মান হয়ে এসেছিল বেশি। কোন কিছুর প্রত্যাশাই তারা আর করেনি আমাদের কাছ থেকে। তারপরও কি কোন এক দূর্বল মুহুর্তে মনের গহীন কোনে কোন আশা ঝিলিক দিয়ে উঠেনি তাদের মনে। আশা কি জাগেনি যে, যে দেশের জন্য তারা এতো অপমান আর যন্ত্রণা সয়েছেন সেই দেশের কেউ একজন সামান্য একটু সম্মান দেখাবেন তাদের। মমতা দিয়ে জানতে চাইবেন তাদের সুখ দুঃখের কাহিনী। নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থে বীরাঙ্গনা রীনা তার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ



কটি মুহূর্তের আকাঙ্খা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।



যে যুদ্ধ শিশুদেরকে আমরা আমাদের সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য বিতারিত করেছিলাম দেশ থেকে তারা কিন্তু বাংলাদেশেরই সন্তান। শুধু সন্তানই নয়, এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশও তারা। চোখ বন্ধ করে যতই আমরা তা অস্বীকার করি না কেন, বিবেক নামক কোন কিছুর যদি সামান্যতম অস্তিত্ব থেকে থাকে তবে সেখানে ঠিকই কিছুটা হলে রক্তক্ষরণ হওয়ার কথা। যদি কোনদিন ওই সমস্ত যুদ্ধ শিশুরা করুণ গলায় জিজ্ঞেস করে, বলো, কি আমাদের অন্যায় ছিল, যার জন্য তোমরা আমাদেরকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছো জন্ম মুহুর্তেই। বঞ্চিত করেছো আমাদেরকে মাতৃস্নেহ থেকে সারা জীবনের জন্য। এমনকি অপরিসীম ঘৃণায় দেশ থেকেও বিতারিত করেছো কিছু বোঝার আগেই চিরতরে। আর সে কারণে আজ আমাদের কোন শিকড় নেই। নেই কোন মমতা মাখানো হাত দুঃসময়ে বুকে টেনে নেয়ার জন্য। নেই কোন জন্মভূমি যাকে ভালবাসতে পারি প্রাণ ভরে। আমাদের জীবনকে এরকম দূঃসহ আর ছন্নছাড়া করে দেবার অধিকার কে তোমাদেরকে দিয়েছিল?

এর কি কোন জবাব আছে আমাদের কাছে?



জানি কোন জবাব নেই আমাদের। যে অন্যায় এবং অবিচার আমরা করেছি সাইত্রিশ বছর আগে তার প্রায়শ্চিত্ত এবং পাপমোচনের সময় এসে গেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির এখন উচিত তার হারিয়ে যাওয়া হতভাগ্য যুদ্ধ শিশুদের কাছে নতজানু হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। পূর্ণ মর্যাদায় তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা। গভীর ভালবাসা দিয়ে বলা, তোমরা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই আপনজন, এই দেশ তোমাদেরই দেশ।





আসুন, বীরাঙ্গনা নারী এবং যুদ্ধ শিশুদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মিছিলে সমবেত হই আমরা সবাই। অতীতের পাপমোচনের দায়ভার যে আমাদের সকলেরই।

লেখক : ফরিদ আহমেদ

(লেখকের অনুমতিক্রমে পুণঃ প্রকাশ করা হল)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×