আমাদের নবীর জন্ম আরবে, কোরআনের ভাষা আরবী। মক্কা, মদীনা, কাবা, নবীর কবর, অসংখ্য সাহাবেদের কবর, অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে এই আরবে। এই আরব দেশ আমাদের মুসলমানদের মধ্যে একটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে। সেই জন্য আমাদের মধ্যে অনেকের মধ্যে আরব প্রীতি দেখা যায়। অনেক মোল্লা অন্ধ ভাবে আরবদের অনুসরণ করেন। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যখন কোন বিষয় নিয়ে মোল্লাদের মধ্যে মতের অমিল হয়, তখন অনেক সময় মোল্লারা তাদের যুক্তির পক্ষে আরব দেশের উদাহরণ টানেন। এতে দোষের কিছু নেই। এটা মানুষের স্বভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু সমস্যা হয় যখন এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। এই বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ের তা কল্পনাতীত। মানুষের প্রবৃত্তি যাই হোক না কেন, আল্লাহর আইনে কোন জাতি, বর্ণ, ভাষা বা বংশ ধারাকে একটির উপরে অন্যটিকে প্রাধান্য দেন নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ যেমন এই আরবদের তার দ্বীনের সোল এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ করেন নি, এবং এই আরবদের শুধু মাত্র আরব বলেই যেমন অন্য জাতির উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি অন্য জাতির শুধুমাত্র অন্য জাতি বলে আরবদের উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি কোন জাতি নয়, বরং ত্বাকওয়া। এই কথা স্বয়ং আমাদের নবী বিদায় হজ্বের ভাষণে বলে গেছেন।
কিন্তু সমস্যা হল, এইগুলি আমরা জানি, বুঝি, সবাইকে এই কথাই বলি, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে মানি না। এর কারন কি? অন্ধ ভালবাসা নাকি অন্য কিছু?
সাধারন মুসলমানদের নিয়ে কিছু বলব না, কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের পূজনীয় পূর্ব পুরুষদের (মোল্লা, উলামা, ইমাম, পীর ইত্যাদি) অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু যারা জ্ঞানী হিসাবে সমাজে স্বীকৃত, যাদেরকে মানুষ কোন প্রশ্ন ছাড়াই অনুসরণ করেন, তারা তাদের আরব প্রীতির জন্য কোরআনের শব্দের অর্থের পরিবর্তন করতেও পিছপা না, তাদের কে কি বলব?
উদাহরণ দেবার আগে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। আপনারা যারা বাংলা অথবা ইংরেজীতে কোরআনের অনুবাদ পড়েন (যেহেতু আমার মত অনেকেই আরবী ভাষা জানেন না) তারা আরবদের সম্পর্কে কোরআনে কিছু পেয়েছেন কি? আরবদের সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ কিছু বলেছেন এমন কোন আয়াত মনে করতে পারছেন কি? সম্ভবত না। কারন, যদিও মুল ভাষায় এই “আরব” শব্দটা এসেছে, কিন্তু কোন আনুবাদেই এই “আরব” শব্দটা আসেনি। আপনার বিশ্বাস না হলে আপনার বাসায় রাখা কোরআন খুলে অনুবাদ দেখুন।
الاعراب বা আল- আরাবী/ আল- আরাবু এই শব্দটার অর্থ the Arabs বা আরব জনগণ কে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু যখন এর অনুবাদ করা হয়েছে তখন এই الاعرابএর ইংরেজী অর্থ করা হয়েছে “Bedouin”, “wandering Arabs”, “dwellers of the desert”, “Arabs of the desert”, “The nomads” ইত্যাদি। বাংলায় অর্থ করা হয়েছে “বেদুইন”, “মরুবাসী”। আরেক বাংলা অনুবাদে দেখছিলাম এই শব্দের অর্থ করা হয়েছে “গ্রামবাসী” (এই অনুবাদ টা খুজে পাচ্ছিনা) । এই সহজ একটা আরবী শব্দের (الاعراب )এই রকম ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করার কারন কি?
এখন “wandering Arabs”, “dwellers of the desert”, “Arabs of the desert এই শব্দ গুলির সমস্যা হচ্ছেঃ
১। মুল ভাষায় wandering, dwellers of the desert, of the desert, “মরুবাসী”- এই ধরনের কোন শব্দ নাই, এবং কোন ভাবেই ঐ শব্দ গুলিকে বোঝানো হয়না। কোরআনের অন্য কোন আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে এই অতিরিক্ত শব্দ গুলিকে জাস্টিফাই করা যাচ্ছেনা।
২। الاعراب এইটার অর্থ কোনভাবেই Bedouin, The nomads , “বেদুইন”, করা যায় না। এটা বুঝার জন্য জ্ঞানী হওয়া লাগেনা। কোরআনের ৩৩:২০ আয়াতে এই بَادُونَ শব্দটা এসেছে।
৩। মরুভুমি বা desert শব্দটার আরবী শব্দ হচ্ছে صحراء (সাহারা)।
তাহলে কেন এই অনুবাদকারীরা কেন আরবী ভাষা থেকে যখন অন্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন তখন এই الاعراب শব্দের ইচ্ছাকৃত ভুল অর্থ করেছেন। এর কারন হল মোল্লাদের আরব প্রীতি। কারন আল্লাহ এই আরবদের সম্পর্কে যা বলেছেন তার বেশিরভাগই নেগেটিভ। উদাহরণ স্বরূপঃ
মুল আনুবাদ (৯:৯৭)
বেদুইনরা কুফর ও মোনাফেকীতে অত্যন্ত কঠোর হয়ে থাকে এবং এরা সেসব নীতি-কানুন না শেখারই যোগ্য যা আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলের উপর নাযিল করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ সব কিছুই জানেন এবং তিনি অত্যন্ত কুশলী।(৯:৯৭)
সঠিক অনুবাদ(৯:৯৭)
আরবরা কুফর ও মোনাফেকীতে অত্যন্ত কঠোর হয়ে থাকে এবং এরা সেসব নীতি-কানুন না শেখারই যোগ্য যা আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলের উপর নাযিল করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ সব কিছুই জানেন এবং তিনি অত্যন্ত কুশলী।(৯:৯৭)
মুল আনুবাদ (৯:৯৮)
আবার কোন কোন বেদুইন এমন ও রয়েছে যারা নিজেদের ব্যয় করাকে জরিমানা। বলে গন্য করে এবং তোমার উপর কোন দুর্দিন আসে কিনা সে অপেক্ষায় থাকে। তাদেরই উপর দুর্দিন আসুক। আর আল্লাহ হচ্ছেন শ্রবণকারী, পরিজ্ঞাত।(৯:৯৮)
সঠিক অনুবাদ(৯:৯৮)
আবার কোন কোন আরবএমন ও রয়েছে যারা নিজেদের ব্যয় করাকে জরিমানা। বলে গন্য করে এবং তোমার উপর কোন দুর্দিন আসে কিনা সে অপেক্ষায় থাকে। তাদেরই উপর দুর্দিন আসুক। আর আল্লাহ হচ্ছেন শ্রবণকারী, পরিজ্ঞাত।(৯:৯৮)
মুল আনুবাদ (৯:৯৯)
আর কোন কোন বেদুইন হল তারা, যারা ঈমান আনে আল্লাহর উপর, কেয়ামত দিনের উপর এবং নিজেদের ব্যয়কে আল্লাহর নৈকট্য এবং রসূলের দোয়া লাভের উপায় বলে গণ্য করে। জেনো! তাই হল তাদের ক্ষেত্রে নৈকট্য। আল্লাহ তাদেরকে নিজের রহমতের অন্তর্ভূক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময়।(৯:৯৯)
সঠিক অনুবাদ (৯:৯৯)ঃ
আর কোন কোন আরব হল তারা, যারা ঈমান আনে আল্লাহর উপর, কেয়ামত দিনের উপর এবং নিজেদের ব্যয়কে আল্লাহর নৈকট্য এবং রসূলের দোয়া লাভের উপায় বলে গণ্য করে। জেনো! তাই হল তাদের ক্ষেত্রে নৈকট্য। আল্লাহ তাদেরকে নিজের রহমতের অন্তর্ভূক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময়।(৯:৯৯)
যারা এতক্ষণ ধরে এই লেখা পড়েছেন, তারা আশা করি এই ইচ্ছাকৃত ভুল অনুবাদ ধরতে পেরেছেন এবং ধারনা করতে পেরেছেন এর কারন কি। যারা ধারনা করতে পারেন নি, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আল্লাহ এই আরবদের সম্পর্কে যা বলেছেন তা বেশিরভাগই নেতিবাচক। কিন্তু আমাদের মোল্লারা আল্লাহর বলা এই আরবদের উদ্দেশ্যে এই নেতিবাচক কথাগুলি অর্থ বিকৃতির মাধ্যমে বেদুইন, যাযাবর বা ম্রুবাসী অর্থ করে আরবদের উদ্দেশ্যে বলা নেতিবাচক শব্দগুলিকে আড়াল করে রাখার অপ্প্রায়াস চালিয়েছেন। এই অনুবাদ গুলি পড়লে মনে হবে এই নেতিবাচক কথা গুলি আরবদের উদ্দেশ্যে নয়, বরং ঐ বেদুইন বা ম্রুবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আর এটা করে তারা আরবদের দোষ ঢেকেছেন। এর ফলাফল কি তা একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন।
আরবদের সম্পর্কে আল্লাহ যা বলেছেন তা ৯:৯০, ৯ঃ৯৭-১০১, ৯:১২০, ৩৩:২০, ৪৮:১১, ৪৮:১৬ এই আয়াতগুলিতে আছে। আমি শুধু তিনটার অনুবাদ দেখালাম, আপনার ইচ্ছা করলে সবগুলি আয়াত পড়ে দেখতে পারেন এবং পড়ার সময় আরবী ভাষা এবং অনুবাদের দিকে খেয়াল রাখলেই বুঝতে পারবেন।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




