প্রথম পর্বের লিংকঃ নবী ইব্রাহিমের মিথলজিকাল ভ্রমণঃ পর্ব ১
O you who have believed, if there comes to you a disobedient one with information, investigate, lest you harm a people out of ignorance and become, over what you have done, regretful. (৪৯ঃ৬)
ওল্ড টেস্টামেন্টে নবী ইব্রাহিমের যে কাহিনী বর্ণনা করা আছে, আমাদের মুসলিম ট্র্যাডিশনেও প্রায় একি কাহিনী আছে, কিছুটা কাটছাট করে। যদিও কোরআন এই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত বেশিরভাগ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরব, তাই এইখেত্রে আমরা দেখব মুসলিম ট্র্যাডিশন এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে কি বলা আছে এবং এর সত্যতা কতটুকু।
নবী ইব্রাহিমের দেশ ত্যাগের ঘঠনা কে আমরা প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করতে পারি,
১। প্রথম অংশ হচ্ছে তথাকথিত মেসপ্টামিয়া থেকে হারান হয়ে জেরুজালেম হয়ে ইজিপ্টে গমন এর পর আবার জেরুজালেম প্রত্যাবর্তন
২। জেরুজালেম থেকে দক্ষিণ হিজায তথা আরবে রেগুলার গমন
আমরা দ্বিতীয় অংশ থেকে শুরু করব।
জেরুজালেম থেকে আরবে যাতায়াতঃ
আমরা হঠাত করেই আরবের মধ্যে নবী ইব্রাহিমের উপস্থিতি দেখতে পাই। উনি উনার ১০০ বছরের বেশি বয়সে তার স্ত্রী এবং পুত্রকে তথাকথিত জেরুজালেম থেকে ১২০০ কিলোমিটারের বেশি দুরত্বে জনবিহীন নির্জন আরব উপত্যকায় নির্বাসন দিতে আরবে আসেন। তাদেরে কে নির্বাসন দিয়ে তিনি আবার ১২০০ কিলোমিটার দুরত্ব ভ্রমণ করে জেরুজালেমে ফিরে তার পরিবারের সাথে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকেন। মুসলিম ট্র্যাডিশন আমাদের বলে যে নবী ইব্রাহিম এর পর প্রায়ই আরবে তার ফেলে যাওয়া স্ত্রী এবং পুত্রকে দেখতে জেরুজালেম থেকে আরবে রেগুলার যাতায়াত করেন। ট্র্যাডিশন থেকে আমরা দেখতে পাই উনি কমপক্ষে ৬ বার এই দীর্ঘ ভ্রমণ করেছেন। আসেন ম্যাপ দেখিঃ
মক্কা থেকে জেরুজালেমের যদি একটা সরলরেখা টেনে এর ভৌগলিক দুরত্ব মাপি (উপরের ম্যাপ অনুযায়ী) তা হলে এর দুরত্ব হবে প্রায় ১২৩৫ কিমি। এখানে গুগল ম্যাপের সাহায্যে দুরত্ব মেপে দেখানো হয়েছে। কারও সন্দেহ হলে একটু কষ্ট করে মেপে দেখতে পারেন। যাতায়াত পথের দুরত্ব আরও বেশি হবার কথা। যদি উনি কমপক্ষে ৬ বার জেরুজালেম থেকে আরবে আসা যাওয়া করে থাকেন, তাহলে তিনি প্রায় ১৫০০০ কিমি পাড়ি দিয়েছিলেন।এই দুরত্ব শুধুমাত্রে জেরুজালেম থেকে আরব পর্যন্ত, যার মধ্যে উনার ওরিজিনাল ভ্রমণ (উর-হারান-জেরুজালেম-ইজিপ্ট-আরাবিয়া-জেরুজালেম) অন্তর্ভুক্ত না। বিখ্যাত তফসিরকারক “ইবনে কাছির” বলেছেনঃ
“… and Ibraheem (P) would travel repeatedly to visit his son and the mother of
his son in the Pharan country (another name they claimed belonged to the Ḥijāz mountains around present day Makkah) to check up on them.”
যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে, যদি তাদের মাথার মস্তিস্ক এখনো অনু পরিমাণ সচল থাকে তবে কিভাবে এই গল্প বিশ্বাস করে যে, একজন ১০০ বছর বয়সের বৃদ্ধ মরুভূমিতে পায়ে হেটে বা গাধার পিঠে চড়ে কমপক্ষে ১২ বার (৬*২=১২) প্রতিবারে ১২০০ কিলোমিটারের অধিক (মোট প্রায় ১৫০০০ কিমি) দুরত্ব অতিক্রম করে এবং কি উদ্দেশ্যে? এর কোন ব্যাখ্যা আছে? মাথা কাজ করছেনা? মুসলমানদের বোধশক্তি ত অনেক আগেই বিসর্জন দেওয়া হয়ে গেছে। এর কোন যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেবার সামর্থ্য আসবে কোথা থেকে? এই জন্য “ইবনে কাছির” মুসলমানদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে একটা অসাধারন সমাধান দিয়েছেন। তিনি আরও উচ্চ সোর্স থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
“And it was reported that he (Ibraheem) would ride the Pegasus (winged horse)
to there, and Allah knows best”
(পেগাসাস= বোরাক= পঙ্খীরাজ- এই ধারনার উৎপত্তি কোথায় জানেন? এইটাও একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়, তবে এখানে অ-প্রাসঙ্গিক)
সত্যি, আল্লাহই ভাল জানেন। প্রবলেম সল্ভড। হাত তালি দেন।
এই রকম পিকিউলিয়ার ধারনা খুব ভালভাবে মুসলমানদের মাথার ভিতরে সেট করে দোয়া আছে। মুসলমানরা এই নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন তুলে না কারন বর্ণনার উৎসকে তারা মনে করে ডিভাইন বা ঐশ্বরিক (আল্লাহ বলেছেন)। প্রায় ৯৯.৯৯% মুসলমান এই ধারনা পোষণ করে।
সুতরাং কোনখান থেকে শুরু করব? আমার মনে হয় কিছু ক্ষুদ্র বিষয় ছাড়া নবী ইব্রাহিম সম্পর্কে মুসলমানদের এবং ইহুদীদের বিশ্বাস প্রায় একি রকম। তার জন্ম, দেশত্যাগ, তার দুই স্ত্রী, দুই পুত্র, জেরুজালেমে গমন, ইজিপ্টে গমন, ইজিপ্টে অবস্থান কালে তার স্ত্রী সম্পর্কিত কাহিনী প্রায় সবি একি রকম। এই বিষয়গুলিতে, কিছু ক্ষুদ্র বিষয় ছাড়া ইহুদীদের বিশ্বাসের সাথে মুসলমানদের বিশ্বাসের কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু একটা বিষয়ে ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের একটা বিরাট পার্থক্য আছে যা মুসলমানরা বিশ্বাস করে কিন্তু ইহুদীরা করে না আর তা হচ্ছে আরব (আরব বা আরাবিয়া বলতে শুধুমাত্র বর্তমান সৌদি আরবকে বুঝাচ্ছিনা) আরও স্পেসিফিক ভাবে দক্ষিণ হিজায যেখানে মক্কা নগরী অবস্থিত- ঐ এলাকার সাথে নবী ইব্রাহিমের জীবনের একটা গুরত্বপুর্ন অংশ জড়িত।
তথাকথিত মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী নবী ইব্রাহিম মেসপ্টমিয়াতে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, যাত্রা পথে তিনি তার স্ত্রী এবং পুত্র সন্তান কে জনশূন্য আরব উপত্যকায় এক ফেলে রেখে ১২০০ কিমি ভ্রমণ করে জেরুজালেমে ফিরে গিয়েছিলেন। এর পরে উনি সেখানে বেশ কিছু বার ভ্রমণ করেন, শেষে যখন তার পুত্র আরেকটু বড় হল তখন সেখানে গিয়ে তার ছেলের সাথে মিলে কাবা ঘর নির্মাণ করেন। তার পর সেখান থেকে তার ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার জেরুজালেমে তার আগের পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তারপর তার পুত্র (ইসমাইল) থেকে আরব জাতির জন্ম হয়, এর মধ্যে নবী মুহাম্মদও অন্তর্ভুক্ত। (অর্থাৎ নবী মুহাম্মদের পূর্বপুরুষ ছিলেন নবী ইব্রাহিমের ফেলে যাওয়া পুত্র ইসমাইল।) আর নবী ইব্রাহিম জেরুজালেম তার আসল পরিবারের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন। সেখানেই তিনি মারা যান এবং তাকে বর্তমান প্যালেস্টাইনের হেবরনে সমাহিত করা হয়।
এই গল্প মুসলমানদের প্রশ্নাতীত ভাবে গ্রহণ করতে হয় কারন আমাদের যারা এই ঘঠনা বর্ণনা করেছেন তাদের কথাকে আমরা আল্লাহর কথা বলেই বিশ্বাস করি (আল্লহা বলেছেন)। কিন্তু এর প্রায় সবই ইহুদীদের বানানো গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে এবং মুসলমানরা তাদের সুবিধা অনুযায়ী কাস্টমাইজড করেছে। আরও পরিষ্কার ভাবে বললে বলতে হয় এই গল্প মুসলমানদের মাথার ভিতরে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারন একটাই, যা কিছু ঘঠেছে, নবী মুহাম্মদের আগে যত নবী রাসুল এসেছে সব জেরুজালেমে বা প্যালেস্টাইনে এসছে, সুতরাং নবী রাসুল সংক্রান্ত সব ঘঠনার মঞ্চ জেরুজালেমে এবং প্যলেস্টাইনে সঙ্ঘঠিত হয়েছে- এই ধারনাটা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি ছিল। এটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কিন্তু এটা আরকিওলজি দ্বারা প্রমানিত সত্য যে বর্তমান জেরুজালেম বা প্যালেস্টাইন কোন রকম ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে না। যাইহোক আমরা মুল আলচনায় ফিরে যাই।
কিন্তু যে মুসলমান স্কলাররা এই গল্প ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ইহুদী ট্র্যাডিশন থেকে কপি করেছেন তারা ওল্ড টেস্টামেন্টের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিষ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে এড়িয়ে গেছেন, আর সেটা হচ্ছে নবী ইব্রাহিমকে সমাহিত করার ঘঠনার বর্ণনা।
তাঁর দুই পুত্র ইসহাক আর ইশ্মাযেল মিলে তাঁর মৃতদেহ মক্পেলার গুহাতে কবর দিল। সোহরের পুত্র ইফ্রোণের জমিতে ঐ গুহা। জায়গাটা ছিল মম্রির পূর্ব দিকে। (জেনেসিস ২৫:৯)
জেরুজালেম থেকে ১২০০ কিমি দূরে হিজাযে বসবাস করে ইসমাইল কিভাবে নবী ইব্রাহিমের মৃতদেহ দাফনের জন্য জেরুজালেমে উপস্থিত থাকতে পারে? নাকি ইসমাইলও বোরাকে চড়ে জেরুজালেমে যেত। অথবা এমনকি হতে পারে যে নবী ইব্রাহিমের দুই পরিবার দুই জায়গায় থাকার ঘঠনা সম্পূর্ণ বানানো, বরং নবী ইব্রাহিম স্ব পরিবারে সবসময় একসাথেই ছিল? যদি তাই হয়, তবে প্রশ্ন থাকে তার বাসস্থান কোথায় ছিল। মনে রাখতে হবে কোরআনের কোথাও আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের কোন স্ত্রী বা সন্তান কে নির্বাসনের কথা বলেন নাই, এইটা এসেছে মুসলিম ট্র্যাডিশন থেকে এবং এই মুসলিম ট্র্যাডিশনের উৎস ওল্ড টেস্টামেন্ট।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৮