উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই ১৩৫০ বঙ্গাব্দ তথা ইংরেজি ১৯৪৩ সনে বাংলায় দুর্ভিক্ষের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় । শহুরে ব্যবসায়ীরা মজুদ করে করে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে আংগুল ফুলে কলাগাছ । ক্ষুধার তাড়নায় যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, নানা জায়গায় মাথা কুটে মরে সামান্য সাহায্যও পায় না । এরকমই এক ভাগ্য-বিড়ম্বিতা নারী জয়গুণ, যিনি এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ।
জয়গুণ তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন হাড়-সর্বস্ব চেহারায় । সন্তানদের বাঁচানোর তাগিদে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ভিটে বাড়িটিও । কিন্তু মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো লাগবে ! জয়গুণ বাধ্য হন সূর্য-দীঘল বাড়িতে উঠতে ।
সূর্য-দীঘল বাড়ি । জানা গেল, যেসব বাড়ি পূর্ব-পশ্চিম দিকে অর্থাৎ, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দিকে প্রসারিত সেগুলোই সূর্য-দীঘল বাড়ি হিসেবে পরিচিত । আর এসকল বাড়ি সম্পর্কে গ্রামে প্রচলিত একটা কুসংস্কার আছে যে, এসব বাড়িতে মানুষজন টিকতে পারে না । বংশ নির্বংশ হয়ে যায় । তাই পারতপক্ষে কেউ এরকম বাড়িতে থাকতে চায় না, এমনকি থাকার কোনো জায়গা না থাকলেও । জয়গুণের আপত্তিটাও ছিল সেটা নিয়ে । কিন্তু শেষমেশ এক ভণ্ড পীরের আশ্বাসে, উপযুক্ত উপঢৌকন দেয়া সাপেক্ষে তাবিজ-কবজ নিয়ে জয়গুণ আর জয়গুণের ভাবী, শফির মা তাঁদের তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সে সূর্য-দীঘল বাড়িতে ওঠেন ।
জয়গুণ অবশ্য পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, বাড়ির ওপর অভিশাপ লাগা, ওসব বাজে কথা । বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবন সংগ্রামে অংশ নিয়ে এই গ্রাম্য অশিক্ষিত মহিলাটিও জেনে গিয়েছিলেন জীবনের একটি অপরিহার্য সত্যের কথা, কুসংস্কারকে না বলা ।
পরবর্তীতে উপন্যাসের পরতে পরতে এরকম নানা রকম কুসংস্কারের ঘটনার উল্লেখ দেখা যায় । আবু ইসহাকের লেখনীতে সামাজিক অসংগতির কথা ব্যাঙ্গাত্বকভাবে ফুটে উঠে এসেছে সবসময়ই । এই উপন্যাসেও দেখা যায় সেসময়কার প্রচলিত সকল কুসংস্কারের পরিচয়, বর্ণনা এবং পরিণতি ফুটে উঠেছে দারুণ বিদ্রুপ নিয়ে । তাছাড়া লেখক কেন্দ্রীয় চরিত্রে জয়গুণকে রাখলেও তার পরিধির মধ্যে টেনেছেন সে সমগ্র অঞ্চলের মানুষজনের নানা চিন্তা-চেতনা , আর সম্প্রসারিতভাবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মাধ্যমে তথাকথিত স্বাধীন হওয়া একটা দেশের প্রতি গণমানুষের আকাংক্ষা আর তার বিন্দুমাত্রও বাস্তবায়ন না দেখে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া । লেখক এই বিষয়টা তুলে ধরেছেন সূক্ষ্ণ কিছু ঘটনা দিয়ে, যেমন – ফুড কমিটির সেক্রেটারির ঘুষ নেয়া, ধনীদের সংকীর্ণ মনোভাব, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কোনো দুর্ভিক্ষ ছাড়াই হু হু করে চালের দাম বাড়তে থাকা ।
এছাড়াও লেখক বিভিন্ন সময়ে সেই সময়টাকে দেখিয়েছেন কখনো হাসু , কখনো মায়মুন (জয়গুণের দুই সন্তান) এর চোখে আবার কখনো দেখিয়েছেন জয়গুণের প্রাক্তন স্বামী করিম বকশের দৃষ্টিতে । এছাড়াও পার্শ্ব চরিত্রের মত শফির মা, গদু প্রধান এরা গল্পের প্রয়োজনে এসেছে , কখনো বড় ধরণের প্রভাবও ফেলেছে । ছোট কিন্তু শক্তিশালী একটা চরিত্র হিসেবে রমেশ ডাক্তারের চিন্তাভাবনা পাঠকদের চিন্তার খোরাক জাগায় নিঃসন্দেহে । কে বলবে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে !
মোটকথা, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সমসাময়িক বঙ্গদেশে চলমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, পরিচয় – এসবকিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রামীণ এক পরিবেশকে কেন্দ্র করে কিন্তু একইসাথে তাতে ফুটে উঠেছে সমগ্র দেশ ! খুব কমসংখ্যক লেখকই তাঁদের লেখায় দেখাতে পারেন এমন সমগ্রতা, এতো সীমিত পরিসরে থেকেও । আবু ইসহাক কতখানি শক্তিশালী লেখক ছিলেন, তা সহজেই টের পাওয়া যায় তার এই বইটির মাধ্যমে, বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর ধারে ।
লেখক আবু ইসহাক ১৯৬২-৬৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পেয়েছিলেন । ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটিও আন্তর্জাতিক ছয়টি পুরষ্কারের পাশাপাশি ১৯৭৮ সালে ‘শ্রেষ্ঠ ছবি’ হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৫ ভোর ৬:৩৭