somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে ৩ টি ফরমুলায় আলফ্রেড হিচকক মুভি বানিয়েছেন

৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মুভি বানানোর ব্যাপারে ৩ টি ফরমুলার বাইরে আমরা প্রায় যেতেই দেখি না মাস্টার অব সাসপেন্স খ্যাত পরিচালক আলফ্রেড হিচকককে।

ফরমুলা-১

হিচককের ছবিতে কমন যে ব্যাপারটি আসে সেটি হল, অপরাধী হিসেবে এমন একজনকে চিহ্নিত করা যে আসলে নিরাপরাধ ৷এর কারণটা খুব সহজ। হিচককের মতে, "নিরপরাধ মানুষের ঘাড়ে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিলে দর্শকের মধ্যে বিপদের অনুভূতিটা খুব সহজে সঞ্চারিত করা সম্ভব ৷ওই নিরপরাধ মানুষটার সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারে দর্শক ৷কিন্তু পালিয়ে বেড়ানো কোনও আসল অপরাধীর সঙ্গে কখনওই দর্শক একাত্মবোধ করে না।" অর্থাত্‍ দর্শককে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া, হিসেবের মধ্যে রাখা, এই ছিল হিচককের মূল উদ্দেশ্য ৷ এই উদ্দেশ্য সাধন করার প্রথম পদক্ষেপ হল, নিরপরাধ মানুষের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপিয়ে দেওয়া ৷দর্শককে সিনেমার প্রতিটা মুহূর্তের অংশীদার করে তোলাটাই হিচককের লক্ষ্য ছিল৷ আর এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ফরমুলা-২ ৷

ফরমুলা-২

ধরা যাক, সিনেমার একটা দৃশ্যে কাহিনির মূল চরিত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে স্টেশনে চলেছে ট্রেন ধরতে ৷খুব সাধারণ দৃশ্য। কিছুই ঘটছে না, বরং পর্দায় এই দৃশ্য বেশিক্ষণ থাকলে দর্শক হাই তুলতে পারে ৷অথচ দৃশ্যটা দেখাতেই হবে ৷হিচকক এই সাধারণ দৃশ্যটাই অসাধারণ করে তুলতে পারেন ৷কীভাবে?

ট্যাক্সিতে ওঠার আগে হাতঘড়িতে চোখ রেখে শুধু লোকটি বলবে, "এই রে, আমার মনে হচ্ছে ট্রেনটা বোধহয় পাব না!" ট্যাক্সি চলতে শুরু করল ৷কোথাও ট্রাফিক জ্যাম, কোথাও রেড সিগন্যাল, হঠাত্‍ই গাড়ির সামান্য বিগড়ে যাওয়া- আর এই সব কিছুর মাঝে-মাঝে বারে বারেই লোকটির ঘড়ি দেখা ৷এর ফলে চাপা উত্তেজনার স্রোত বয়ে চলবে দর্শকের মনের ভিতরে প্রতিনিয়ত - লোকটা ট্রেন ধরতে পারবে তো? যে দৃশ্যটা এক মিনিট লম্বা হলেই লোকের বিরক্তি ধরে যেত, সেই দৃশ্যটাই পাঁচ মিনিট লম্বা করে দিলেও পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারবে না দর্শক, কারণ সে ততক্ষণে জড়িত হয়ে পড়েছে গোটা ঘটনার সঙ্গে ৷হিচককের মতে এটাই হল 'সাসপেন্স'৷দর্শককে নিরন্তর দোদুল্যমান রাখা 'হবে' কি 'হবে না'-র মধ্যে ৷এই সাসপেন্স থেকে মুক্ত হবে দর্শক তখনই যখন প্রায় ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তে লোকটি ট্রেনে উঠে পড়বে ৷আর কী আশ্চর্য চাপ মুক্ত দর্শকের মনের মধ্যে একটিবারের জন্যেও তখন প্রশ্ন তৈরি হবে না, 'লোকটার কীসের এত তাড়া'? অথচ, 'পরের ট্রেনে গেলেই বা ক্ষতি কী ছিল'?

হিচকক বার-বারই বলতেন 'সারপ্রাইজ' নয়, 'সাসপেন্স' ৷একটা টেবিলের দু'প্রান্তে দু'জন কথা বলছে ৷হঠাত্‍ই সেই টেবিলের তলায় রাখা একটা বোমা ফেটে গেল ৷এটা মুহূর্তের 'সারপ্রাইজ' ৷ কারণ বোমাটা ফাটার আগে পর্যন্ত দৃশ্যটা ছিল অত্যন্ত মামুলি ৷অথচ দর্শককে যদি আগে দেখানো হয় ওই টেবিলের তলায় দু'জন সন্ত্রাসবাদী বোমা লাগিয়ে চলে যাওয়ার পর দু'জন এসে বসল সেই টেবিলে, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সঞ্চারিত হবে দর্শক মানসে 'বোমাটা কখন ফাটবে' বা 'বোমা ফাটার আগেই দু'জন টেবিল ছেড়ে চলে যাবে কি না' এই সব নিয়ে ৷পনেরো সেকেন্ডের একটা মামুলি দৃশ্যকে পনেরো মিনিটের একটা সাসপেন্সময় দৃশ্যে রূপান্তর করাটাই হল হিচককের মুন্সিয়ানা ৷আর এটা করতে গিয়ে 'অপরাধ'-এর খুঁটিনাটি আগে দেখিয়ে দিতেন দর্শককে, যাতে ছবির আগাগোড়া দর্শক সাসপেন্স-আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে ৷এখন ওই যে লোকটা, যে ট্রেনে উঠল, যার তাড়া নিয়ে টেনশন দর্শকের মনে - এই তাড়াটাই হল এই দৃশ্যের পূর্বকথন বা প্রি-টেক্সট ৷অথচ এই তাড়াটা কাহিনিতে না থাকলেও লোকটা ট্রেনে উঠত, কারণ ট্রেনে উঠে অন্য জায়গায় যাওয়াটাই হল গল্প ৷ অথচ ওই তাড়ার প্রি-টেক্সটটা না থাকলে দৃশ্যটা জমত না ৷এটাই হল হিচককের গল্প বলার ফরমুলা-৩ ৷

ফরমুলা-৩

এটাকে হিচকক বলছেন 'ম্যাক গাফিন (MacGuffin)' ৷কিন্তু 'ম্যাক গাফিন' বস্তুটা কী? হিচকক একটা গল্প শুনিয়েছেন এটা বোঝাতে গিয়ে ৷দু'জন চলেছে একটা ট্রেনে চেপে ৷একজন লক্ষ্য করলেন, অন্যজন একটা বড় প্যাকেট নিয়ে চলেছেন যেটা রাখা আছে বাঙ্কের ওপরে ৷কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন,
-আপনার ওই প্যাকেটে কী আছে?
-ম্যাক গাফিন!
-সেটি আবার কী বস্ত্ত?
-স্কটিশ হাইল্যান্ডে সিংহ ধরার এক ধরনের যন্ত্র!
-কিন্ত্ত স্কটিশ হাইল্যান্ডে তো সিংহ নেই!
-তাই বুঝি! তাহলে ম্যাক গাফিন বলেও কিছু নেই!

একটা বাংলা সিনেমা থেকে উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে ৷ছবির নাম সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' ৷ছবির শেষে ফেলুদা বলে, 'গুপ্তধন নেই ৷জন্মান্তর থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই!' এই 'জন্মান্তর'টাই গোটা সিনেমার ম্যাক গাফিন, যেটা হল গল্পের প্রি-টেক্সট, যার জন্যে দর্শকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়, যার জোরে গল্প এগিয়ে চলে ৷ অথচ মূল গল্প তো নকল হাজরা ধরা পড়ল কি না তাই নিয়ে ৷

ছবির শেষে তাই কেউ প্রশ্ন করে না পূর্বজন্ম বলে কিছু কি আছে? করে না তার কারণ, সেটা অবান্তর ৷অথচ কাহিনির প্রাথমিক ড্রাইভিং কোর্স এটাই ৷মজাটা এখানেই ৷ঠিক যেভাবে 'জয়বাবা ফেলুনাথ' সিনেমায় গণেশ-এর বদলে রত্ন খচিত উট হলেও গল্পটা একই থাকত৷এটাই 'ম্যাক গাফিন', যা হিচককের অন্যতম হাতিয়ার ৷

হিচককের সিনেমা মূলত দাঁড়িয়ে আছে এই তিনটি ফরমুলার ওপরেই ৷
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:২২
১১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×