somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বোকা মানুষ বলতে চায়
বোকা মানুষের কথায় কিই বা আসে যায়

অটিস্টিক শিশু আর একজন ভীরু মানুষের গল্প

৩০ শে মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মইন সকাল বেলাটা ভালোভাবে শুরু করতে চায়। কারণ সকাল বেলা কোন কারনে মেজাজ খিচড়ে গেলে সারাটা দিন খারাপ যায়। কিন্তু কল্যাণপুরের এই বাসা থেকে বের হলে মেজাজ ভাল থাকেনা। একদিনও রিকশা পাওয়া যাবেনা। হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে হবে। সকালবেলা মইনের হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। তিন বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে পায়ে আঘাতের পর যখন সুস্থ হয়ে উঠে, তখনই মইন লক্ষ্য করে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর পা ব্যাথায় আঁকড়ে আসে।

মইন ঢাকা শহরে এসেছে প্রায় পাঁচ বছর। প্রথম কয়েক মাস চাচাতো ভাই রুহুলের বাসায় কাটিয়ে তারপর থেকে কল্যাণপুরের একটি দোতালা বাড়ির মেসে এসে উঠেছে। সাধারনত ব্যাচেলর ভাড়া কেউ দিতে চায় না, কিন্তু তার এই বাড়ীওয়ালা ব্যাতিক্রম। তিনি বাড়ির দোতালায় থাকেন আর একতলাটা ভাড়া দেন ব্যাচেলরদের কাছে। তার কাছে মইন একদিন জানতে চেয়েছিল এর রহস্য কি? উত্তরে যা জেনেছিল তা এইরকম, বাড়ীওয়ালা সদিরুদ্দিন আজ থেকে ২৫ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। তখন তিনি ছিলেন অবিবাহিত, ব্যাচেলর মানুষ। ফুটপাতে কাটা কাপড়ের ব্যাবসা করে রুটি-রুজির ব্যাবস্থা করতে পারলেও কষ্ট হয়েছে মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজে পেতে। তখন ঢাকা শহরে একমাত্র প্রাইভেট টিউটরদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাই পাওয়া তুলনামূলক সহজ ছিল। কেননা তখন ঢাকা শহরে লজিং মাষ্টারদের কদর ছিল। তাই সদিরুদ্দিন যখন তার বাসা ভাড়া দিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখনই তিনি ঠিক করেছিলন শুধু একতলা ভাড়া দিবেন এবং তা ব্যাচেলরদের জন্য।

মইন একটা সিগারেট ধরিয়ে বিরক্তিমাখা মুখ করে হাঁটছিল। আজ যদিও তেমন কোন কাজ নেই তবুও ঘরে বসে থাকতে তার ভাল লাগে না। সে মোহাম্মদপুরের দিকে হাঁটছিল। সেখান থেকে মতিঝিলের বাস ধরে যাবে কাকরাইল, তার কলেজ জীবনের বন্ধু রশিদের অফিসে। রশিদ রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসা করে আঙ্গুলফুলে বটগাছ হয়েছে। রশিদ গতরাতে ফোন করেছিল, কি একটা কাজে নাকি তাকে দরকার। মইন ভেবে পায়না তার মত হাফ বেকার মানুষের সাথে রশিদের কি কাজ থাকতে পারে।

মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে একটা ছোটোখাটো জটলা দেখে মইন এগিয়ে যায়। একটি টেম্পুকে ঘিরে জটলা। মইন উৎসাহ নিয়ে সামনে যেতেই চোখে পড়ল একটি সাত-আট বছরের বাচ্চা ছেলে টেম্পুতে বসে আছে, চালক তাকে ধমকাচ্ছে।
“ঐ কনা তর বাড়ি কই? তুই কইত্তে আইছত?ঐ পিচ্চি কথা ক...”

মইন আগ্রহ নিয়ে কাছে এগিয়ে যায়। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখতে পায় বাচ্চাটি একটি শারীরিক প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক চাইল্ড। টেম্পুচালককে জিজ্ঞাসা করল ঘটনা কি? উত্তরে ঘটনা যা জানল আজ সকালবেলা যখন সে মহাখালী থেকে প্যাসেঞ্জার তুলে মোহাম্মদপুর আসে তখন ছেলেটি তার টেম্পুতে উঠে বসে, হেল্পার ছিলোনা বলে বাচ্চাটি কিভাবে উঠল সে জানেনা। মোহাম্মদপুর এসে যখন একজন প্যাসেঞ্জার, যে যাত্রীদের সবার ভাড়া তুলে দিয়েছে, জানালো একজন ভাড়া দেয়নি, একটা বাচ্চা, কথাও বলে না। তখন সে এই ছেলেটিকে দেখে। তখন থেকে বাচ্চাটি তার টেম্পুতে আছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু হাসে, আর বলে, “পাপা কোক খাবো”।

মইনের কাছে চেহারাটা কেমন পরিচিত লাগছে। সব প্রতিবন্ধী বাচ্চার চেহারায় একটা কেমন যেন মিল থাকে। এই বাচ্চাটাকেও মনে হয় কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে। কিন্তু আসলে এইরকম মনে হচ্ছে চেহারার সাদৃশ্যতার জন্য।

“তুমি আসেপাশে খোঁজ করছ” – মইন টেম্পু চালককে জিজ্ঞাসা করল।

“আরে ভাই, তিন ঘণ্টা ধইরা অরে নিয়া ঘুরতাছি। এইখানে, মহাখালীতে সব জায়গায় খোঁজ করছি, কেউ চেনেনা। কনতো কি করি ভাই?”

“এক কাজ করো, একে থানায় দিয়ে আস, পুলিশ একটা ব্যাবস্থা করবে”

“কি যে কন না ভাই। থানায় গেলে পুলিশ ভাববো আমি চুরি কইরা আনছি এরে। তহন পরুম আরেক ঝামেলায়”

মইন একটু ভাবল, তারপর টেম্পু চালককে বলল চলো, আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।

থানায় এসে মইন পড়ল মহা যন্ত্রণায়। ডিউটি অফিসার তাকে জেরা আরম্ভ করা শুরু করে দিল। ভাবখানা এমন সে বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে। মইন থাকে কোথায়, কেন মোহাম্মদপুর এসেছিল। টেম্পু চালককে সে চেনে কিভাবে, না চিনলে সে কেন তার সাথে এলো ইত্যাদি ইত্যাদি। একবার জবাবদিহিতা শেষকরে তাদের বসিয়ে রাখল ওসি সাহেব আসা পর্যন্ত।

টেম্পুঅলা লোকটি দেখা যাচ্ছে বাচ্চাটিকে নিয়ে ভালই যন্ত্রণায় পড়েছে, কিন্তু এই যন্ত্রণায় সে বোধহয় মজা পাচ্ছে। এই পর্যন্ত তিনবার কোক এনে খাইয়েছে, একবার বাচ্চাটিকে হিসি করিয়েছে। ওসি সাহেব আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার ডিউটি অফিসারের কাছে গেল মইন।

“ভাই, এখনো ওসি সাহেব এলেন না। আমার একটু তাড়া ছিল”

“আমরা কি শুইয়া আছি? আপনারা থানারে কি মনে করেন? থানা কি এইসব ঝামেলা দেখার জন্য?”

“না মানে, একটা কাজে বের হয়েছিলাম......”

“ঠিক আছে, এই নেন, এই কাগজে আপনার নাম-ঠিকানা, ফোন নাম্বার দিয়ে সাক্ষর করে বাচ্চাকে নিয়ে চলে যান, আমরা এর বাবা-মাকে খুঁজে পেলে আপনার সাথে যোগাযোগ করব।”

“ভাই, আমি একজন ব্যাচেলর মানুষ, থাকি মেসে। আমি এই বাচ্চাকে কোথায় রাখবো বলেন?”

“তো আমরা কোথায় রাখব বলেন? থানা কি শিশু আশ্রম? যত্তসব। বসেন একটু, হাতের কাজটা শেষ করি, তারপর আপনি মুচলেকা দিয়ে একে নিয়ে যান।”

মইন একটা সিগারেট কিনতে বের হল থানা কম্পাউনন্ড থেকে। থানার লাগোয়া সিগারেটের দোকান। সিগারেট খেতে খেতে দেখল টেম্পু চালক বাচ্চাটাকে কোক কিনে দিতে পাশের দোকানে যাচ্ছে। হঠাৎ করে বুদ্ধি খেলে গেল মইনের মাথায়। সিগারেটের দোকান ঘেসে বাঁয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা ধরে দ্রুত পা চালাল মিরপুর রোডের দিকে। এই উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতে পারলে হয়। উহ, কি দরকার ছিল ঝামেলায় জড়ানোর। মইন দ্রুত পা চালাল।

তিনদিন পর, মইন আগারগাও হয়ে শ্যামলীর দিকে হাঠছিল, হঠাৎ শব্দ করে একটা টেম্পু এসে থামল তার কাছে।

"ভাই ভাল আছেন? বাচ্চাটার বাবা মারে খুইজা পাইছি কাইলকা সন্ধ্যা বেলায়, ডিওএইচের ভেতোরে। এই কয়দিন পিচ্চিরে আমার লগে টেম্পু কইরা ঘুরাইছি। জানেন ভাই অর বাপে না আমারে পাঁচশো টেকা সাদে। কন ভাই, কি ছোটলোক? আমি কি টেকার লেগা অর বাচ্চারে নিয়া ঘুরছি। আরে পুলিশরেই দিছি পাঁচশো টেকা ঐদিন। কি যে ঝামেলা করলোরে ভাই ওসি আয়া। আর আপনেতো ভাই ডরে পালায়া গেলেন...... হে...হে...”

যাত্রীদের চেঁচামেচিতে টেম্পু ছেড়ে দিল। মইন হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইল। তার কানে শুধু বাজছে, “আপনেতো ডরে পালায়া গেলেন...... হে...হে...”
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:৪৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×