somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ঙ্কর সুন্দরীতমা!..বান্দরবান (পরব-১)

২৬ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাঝে মাঝে আমরা এমন অনেক কিছুই চাই, যা সময় ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এমন অনেক চাওয়া থাকে যা পরবর্তীতে মনে হয় কেন এমন চেয়েছিলাম ? অথবা অনেক সময় চাওয়া আর পাওয়া’র মধ্যকার তফাৎটা পুরো ব্যাপারটাকেই বদলে দেয়। সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি আকাশটাকে ছুঁয়ে দেখব। যদি আকাশটাকে নাও ছুঁতে পারি, মেঘটাকে ছুঁয়ে দেখার শখ ছিল। কিন্ত সেই চাওয়া যদি এমন সময় পূরণ হয়, যখন তা বিষফোঁড় হয়ে দেখা দেয়; তবে তাঁর চাইতে নির্মম আর কি হতে পারে।

সকালবেলা যখন বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজারের উদ্দেশে রওনা হই, তখন পাহাড় আর মেঘের মিতালী দেখে প্রতিমুহূর্ত রোমাঞ্চিত হয়েছি। নীলাকাশে মেঘের ভেলা ডানা মেলে জড়িয়ে রেখেছে চিরহরিৎ পাহাড়ের দলগুলোকে। সর্পিল বাঁক নেয়া পাহাড়ি পথ বেয়ে, কখনো খাঁড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠেছে “চাঁন্দের গাড়ী”, আবার কখনোও বা ১৫০-১৬০ ডিগ্রি বাঁকানো পথে ছুটে চলেছে তেরজন পর্যটকের দল নিয়ে। সেই সময়ে মনের গভীরে একটি কামনা জেগে উঠেছিল, “যদি মেঘগুলো আমাদের গাড়ী যে পাহাড় দিয়ে ছুটে চলেছে সেই পাহাড়টাকে ঐভাবে জড়িয়ে ধরত! আমরা থাকতাম মেঘের আলিঙ্গনে!

২০ তারিখ রাতে ঢাকার ফকিরেরপুল হতে “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর আয়োজনে আমরা ১১জনের দলটি যাত্রা শুরু করি বান্দরবানের উদ্দেশে। উল্লেখ্য, পর্যটন ও অ্যাডভেঞ্চার জগতে সুপরিচিত “ভ্রমণ বাংলাদেশ” প্রায় প্রতি মাসেই এরকম প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করে থাকে। যাই হোক, আমাদের সাথে গাড়িতে পরিচয় হয় আরও এক দম্পতির এবং পরবর্তীতে তারা আমাদের দলে যোগ দেয়ায় আমরা হয়ে যাই টীম লাকি থার্টিন। দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা সকাল ৮টায় পৌছাই বান্দরবান শহরে। আগে থেকে বুকিং দেয়া রেস্ট হাউজ অনিবার্য কারনে বুকিং বাতিল করাতে নতুন হোটেলে শিফট হতে কিছুটা সময় নষ্ট হয়। হোটেলে ব্যাগ-এন্ড-ব্যাগেজ রেখে একটি ল্যান্ডক্রুজার জীপ ওরফে চাঁন্দের গাড়ী ভাড়া করে যখন রওনা হই রুমার উদ্দেশে, তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা অতিক্রম করেছে। সেখান থেকে যাব রিজুক ঝর্ণা দেখতে।

পাহাড়ি পথে যখন আমাদের “চাঁন্দের গাড়ী” ছুটে চলেছে, আমরা তখন ব্যাকুল হয়ে উপভোগ করছি দিগন্ত জোড়া পাহাড়ের সারির সাথে সাদা মেঘের ভেলার মিতালী, উপরে স্বচ্ছ নীলাকাশ। আমি বসেছিলাম গাড়ির সামনের সিটে, ড্রাইভারের পাশে। জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টি দিয়ে লুটেছি প্রকৃতির রুপ। Y জংশনে চেক পোস্টে আমাদের গাড়িটি থামলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি কামেরার মেমোরিতে প্রকৃতির এই অপার্থিব রুপকে ধরে রাখতে। সেখান থেকে পরবর্তী যাত্রাবিরতি ছিল পিক সিক্সটি-নাইনে। পিক সিক্সটি-নাইন হল বাংলাদেশের স্থলযান চলাচল যোগ্য সর্বোচ্চ স্থান। সেখানে আবারও ফটোসেশন। এবার পাহাড়ের মাঝে রুপোলী ফিতের ন্যায় যোগ হয়েছে সাঙ্গু নদী। আবার যাত্রা শুরু করে যখন পৌঁছলাম রুমা, তখন সূর্য মধ্যরেখা পার করে পশ্চিমের দলে। দুপুর ২.৩০ নাগাদ আমরা শ্যালো-ইঞ্জিন চালিত বোটে করে রওনা হলাম রিজুক ঝর্ণার উদ্দেশে।

প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি রুমা জলপ্রপাত। সব মৌসুমেই সচল রুমা জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানি ঝরে পড়ে সরাসরি নদীতে। রিজুক, রেমাক্রি ওয়াহ এবং তেছরী প্রপাত-এই তিন অপরূপা অরণ্য কন্যাকে দেখতে প্রতি বছর ভিড় করেন হাজার হাজার পর্যটক। আমাদের লক্ষ্যস্থল রিজুক ঝর্ণা। বোট ছুটে চলছে পাহাড়ি নদীপথ ধরে। আমাদের দলের সবাই টুকটাক গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আকাশ মেঘলা হয়ে উঠতে শুরু করলো, আর আমাদের দলের সবাই একে একে বোটের ছাঁদে উঠতে শুরু করলাম। একে একে সবাই ছাঁদে উঠে লম্বা সারি করে বসে পড়ল। মেঘলা আকাশের নীচে আমাদের পাহাড়ি নদীর জল ফুঁড়ে ছুটে চলা! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। সবার সে কি আনন্দ ধ্বনি! এমন বৃষ্টিতে কে কবে ভিজেছি?

রিজুকে পৌঁছে সবার চক্ষু চড়কগাছ। ফুলে ফেঁপে বিশাল জলরাশি নিয়ে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ি জলধারা। প্রবল বেগে বিশাল জলরাশির এই পতন তলে যাওয়ার সাহস কেউই করে উঠতে পারি নাই। তাঁর উপর কিছুদিন আগে এমন বৃষ্টির সময় ঝর্ণার জলে গোসল করতে যেয়ে বিপদে পড়েছিল কয়েকজন পর্যটক। যাই হোক ঝর্ণার পাশে দাড়িয়ে সবাই ছবি তুললাম। অতঃপর যাত্রা শুরু করলাম রুমা বাজারের দিকে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড়ি স্রোতধারা যা মিনি ঝর্ণা বলে চালিয়ে দেয়া যায়। দুপুরের খাবার রুমা পৌঁছেই সেরে নেয়ায় এবং রুমা বাজারের কাছাকাছি রাস্তা খারাপ থাকায় আমরা রুমায় অবস্থিত ব্রিজের নীচে বোট হতে নেমে রাস্তার পথ ধরি। আগে থেকে ড্রাইভারকে বলে দেয়ায় সে গাড়ী নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। সবাই এক কাপ গরম চা খেয়ে ভেজা শরীরেই রওনা হলাম বান্দরবান শহরের উদ্দেশে।

গাড়ী যখন ফিরতি যাত্রা শুরু করলো তখন ঘড়িতে বিকাল ৫টা ছুইছুই। আমার মনে কেন জানি কু-ডেকে উঠলো। কারণ আসার সময় প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা ছিল। তারমানে ফিরতে ফিরতে রাত ৮তা-৯টা বেজে যাবে। আঁধারে এই বাঁকানো পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয়া, কেন জানি খানিকটা ভয় পেলাম। রুমা বাজার থেকে বান্দরবান শহরের দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। ১৫-২০ কিলোমিটার গাড়ী চলল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। তার পর নামল অন্ধকার। হঠাৎ সামনের কাঁচে ঘোলাটে ধোঁওয়া! ঘটনা কি, এই সময়ে কুয়াশা! ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এইটা কুয়াশা না, মেঘ! সেই মেঘ সকালে যেই মেঘ দেখে আফসোস করেছি কেন সে আমাদের এই পাহাড়ে নেই? এখন সেই মেঘ আমাদের পথ নিয়ে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে। দুই-তিন হাত সামনের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। ১৫০-১৬০ ডিগ্রি বাঁকানো পাহাড়ি পথ, ঘন কুয়াশার ন্যায় মেঘে ঢাকা সম্মুখ পথ, তার সাথে গোদের উপর বিষফোঁড় হিসেবে জুটল তুমুল বৃষ্টি। তরুন ড্রাইভার আমাকে আশ্বস্ত করতে লাগল এই বলে যে, আল্লাহ্‌ চাহে তো আমরা ভালয় ভালয় পৌঁছে যাব। প্রায় দুই ঘণ্টা দম বন্ধ অবস্থায় পাহাড়ি সেই বাঁকানো ঘন আঁধারি পথে হেডলাইটের আলো দিয়ে পথ ঠাউর করে এসে পৌছাই বান্দরবান শহরে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর সময়টুকু পার করলাম এই দুই ঘণ্টায়। প্রতিটি বাঁক পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি গাড়ী খাঁদের অতলে পড়ে হারিয়ে যাবে আমাদের নিয়ে। আমি যতবার জমাট মেঘের অন্তরাল ভেদ করে পথ ঠাওর করার চেষ্টা করেছি, ততবারই বিফল হয়েছি, দেখা গেছে আমি যেদিকে পথ বাঁক নিয়েছে ভেবেছি সে দিকে পাহাড়ি খাঁদ, পথ তার বিপরীতে! পাহাড়ি পথে মেঘের ভেতরে তুমুল বৃষ্টি, এই অবস্থায় যদি কেউ পথ পাড়ি দিয়ে থাকেন সেই বুঝবেন কি ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা। বার বার তখন মনে হচ্ছিল কেন সকালে মেঘের ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলাম? শখের সেই চাওয়া যে এত ভয়ঙ্করভাবে পাওয়া হবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।

অবশেষে রাত নয়টার কাছাকাছি সময়ে আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে সুস্থ অবস্থায় পৌঁছাই বান্দরবান শহরে।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৪ রাত ৯:২৪
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×