somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হঠাৎ, একাকী, প্রথম এক ঝটিকা সফর - Panam City & Others

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



৩ দিন পর প্রফেশনাল এক্সাম। তাই অফিস থেকে ফিরে পড়তে বসার চেষ্টা করি। দিন কয়েক আগে রাতের বেলা হাতে একটা ফটোকপি শিট নিয়ে বসে বসে টেলিভিশন দেখছিলাম। পরদিন ছুটি, ভেবেছিলাম সারাদিন পড়ব। কিন্তু মনে পড়ল আগামীকাল অফিসের এক কলিগের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে হবে সেই নারায়ণগঞ্জ। মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হল। প্রতিবার এক্সামের আগেই আমার কোন না কোন একটা ঝামেলা আসবে। এই সব ভাবছি আর চেয়ে আছি টিভি স্ক্রিনের দিকে। হঠাৎ মনে হল আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? যেহেতু পড়া হচ্ছেইনা, কাল সকালে খুব আর্লি বের হয়ে কেননা চলে যাই সোনারগাঁ পানাম সিটি আর লোকশিল্প জাদুঘর দেখতে। যেই ভাবনা সেই কাজ। নোট রেখে মোবাইল ফোনটা হাতে নিলাম। বাল্যবন্ধু, চির ভবঘুরে (ভ্রমণ পিপাসু অর্থে) মনাকে ফোন দিলাম। তার সাথে কথা বলে ঠিক হল ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক করলাম। জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ একা কোন ট্যুরে বের হব। ঠিক করলাম প্রথমে পানাম সিটি দেখে ঢুকে পড়ব লোকশিল্প জাদুঘরে। সেটা দেখে চলে যাব হাজীগঞ্জ দুর্গ’র উদ্দেশে। হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখে যাব বিখ্যাত বোস কেবিনে চা খেতে। চা খেয়ে হাজিরা দিব কলিগের প্রোগ্রামে। রাত এগারোটার দিকে মনার বাসায় গিয়ে তার লুমিক্স ক্যামেরাটি নিয়ে আসলাম। সে বলল প্রায় নব্বইভাগ চার্জ আছে ব্যাটারিতে, তারপরও ব্যাটারিটা পূর্ণ চার্জ করার নিমিত্তে ব্যাটারিটা ক্যামেরা হতে খুলে চার্জারে ভরে দিয়ে ঘুমুতে গেলাম। ও হ্যাঁ, সাথে মোবাইলটাকেও চার্জে দিলাম। কারন একাকী এই ট্যুরে গান শুনতে শুনতে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলব এই হল প্ল্যান।

পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ একা কোন ট্যুরে যাচ্ছি। আমি মূলত দলপ্রিয় মানুষ, সর্বদা দলে ঘুরতে পছন্দ করি। প্রায় একযুগ আগে একবার সর্বনিম্ন তিনজন মিলে ট্যুর দিয়েছিলাম মহাস্থানগড়-পাহাড়পুর। সেই ট্যুরের গল্প খুব শিঘ্রই একদিন লিখব আশা করি। যাই হোক ব্যাকপ্যাকে ক্যাপ, সানগ্লাস, পানির বোতল, ক্যামেরা, হেডফোন ইত্যাদি ভরে নিয়ে যখন ঘর থেকে বের হলাম ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে আটটা। রিকশা নিয়ে গুলিস্তান পৌঁছে রাজধানী হোটেলে দ্রুত নাস্তা শেষ করে যখন চায়ের কাপ শেষ করলাম তখন বাজে সোয়া আটটা। ইচ্ছে ছিল আটটার গাড়ী ধরার। যাই হোক মাওলানা ভাসানি হকি স্টেডিয়ামের কাছ হতে স্বদেশ পরিবহনের গাড়ীতে রওনা হলাম মোগড়াপাড়ার উদ্দেশে। টিকেটের মূল্য ৩৫ টাকা নিল। (পরিচিত একজন আমার ভ্রমণ বিষয়ক লেখা পড়ে অভিযোগ করল যে, আমার লেখায় রুটের বিবরণ, থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের খরচ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য থাকেনা। তাই টাকার হিসেবগুলো এবং পরিবহণের কথা উল্লেখ করা)।

যাত্রাবাড়ীর ঐতিহাসিক জ্যামে পড়লাম যথারীতি। গাড়ী যখন কাঁচপুর পার হচ্ছে তখন হঠাৎ মনে হল আচ্ছা আমি কি ক্যামেরায় ব্যাটারিটা ভরেছিলাম? দ্রুত ব্যাকপ্যাকটা খুলে ক্যামেরার ব্যাগ হতে ক্যামেরাটি বের করে চেক করলাম, বিধিবাম! ব্যাটারি আনি নাই! মেজাজটা খারাপ হল, কেমন লাগছিল বুঝতেই পারছেন। দ্রুত মোবাইল হতে হেডফোন খুলে ফেললাম। মোবাইলের চার্জ অর্ধেকের একটু বেশী আছে। মাত্র ৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা মোবাইলে, রেজুলেশনও খুব কম। এখন এই ক্যামেরাই ভরসা। মোগড়াপাড়া নেমে হাতের বাম দিকের রোড হতে একটি রিকশা নিলাম সরাসরি পানাম বাজারের উদ্দেশে, ভাড়া নিল ত্রিশ টাকা। রিকশা যখন পানাম নগরী পার হচ্ছিল খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। সারি সারি একতলা, দ্বিতল প্রাচীন ভবন তার প্রত্নতাত্ত্বিক অবকাঠামো নিয়ে দারিয়ে আছে জনমানুষহীন হয়ে। পানামনগরীর আগে পরে লোকালয় রয়েছে। পানাম বাজারে রিকশা হতে নেমে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম, অর্থাৎ এইমাত্র যে পথ দিয়ে এসেছি সে পথে।


পানাম নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার, সোনারগাঁতে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা। প্রায় ঐসময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দির (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। মূলত পানাম ছিলো হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল (বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানামনগর সেতুর অবস্থান ও তিনদিকের খাল-বেষ্টনী থেকে বোঝা যায় পানাম, সোনারগাঁর একটা উপশহর ছিলো।


পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর অধিকাংশই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তি স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এই কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতূল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর সাথে আছে সিরামিক টাইল্সের রূপায়ণ। প্রতিটি বাড়িই অন্দরবাটি এবং বহির্বাটি -এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে উন্মুক্ত উঠান।


পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পরের থেকে সম্মানজনক দূরত্বে রয়েছে। নগরীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এপাশ-ওপাশ।
নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর। এছাড়া আছে ৪০০ বছরের পুরোন টাকশাল বাড়ি।


লাল ইট-মাটির সংমিশ্রণে তৈরি প্রতিটি দালানের নিকট যখন দারিয়ে দেখছিলাম, ছবি তুলছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিল এই বাড়িগুলোতে একসময় কত মানুষের কোলাহল ছিল, কিছু বাড়ির নকশা এবং অবকাঠামো দেখে বুঝা যায় কোন এককালের কোন এক সন্মভ্রান্তের আবাসালয় এটি। কল্পনায় বারবার দেখার চেষ্টা করেছি সেই সময়কার পানামনগর। প্রায় ঘণ্টাখানেক পানামে কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলাম সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের উদ্দেশে। এই ফিরতি পথে হাতের বাম দিকে পড়ল জাদুঘরের দুই নম্বর গেটটি। ১৫ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। হাতের ডানদিক দিয়ে এগিয়ে গেলাম মূল জাদুঘরের দিকে। আশেপাশে কিছু কপোত-কপোতীকে দেখলাম নিজেদের ভুবনে হারিয়ে যেতে। তাদের নির্জন ভুবনে ব্যঘাত না ঘটিয়ে চলে এলাম এক নাম্বার গেটের কাছে। পুরানো জাদুঘর বিল্ডিংয়ে দেখলাম সংস্কার কাজ চলছে। এক যুগ আগে এসেছিলাম এখানে, তখন এই ভবনে ছিল জাদুঘর।


শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, বাংলাদেশের প্রাচীণ ঐতিহ্য রক্ষার্থে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গঠিত একটি জাদুঘর, যা ঢাকার অদূরে সোনাগাঁতে অবস্থিত। আবহমান গ্রাম বাংলার লোক সাংস্কৃতিক ধারাকে বিকশিত করার উদ্যোগে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ১৫০ বিঘা আয়তনের কমপ্লেক্সে খোলা আকাশের নিচে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশে গ্রামীণ রূপকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকান্ডের পরিচয় তুলে ধরতে শিল্পী জয়নুল আবেদীন এই জাদুঘর উন্মুক্ত পরিবেশে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সটি প্রায় ১০০ বছর পুরোন সর্দার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়।


সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এলাকায় রয়েছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরটি। এখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের অবহেলিত গ্রাম-বাংলার নিরক্ষর শিল্পীদের হস্তশিল্প, জনজীবনের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী। এসব শিল্প-সামগ্রীতে তৎকালীন প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের রূপচিত্র প্রস্ফুটিত হয়। সর্দার বাড়িতে মোট ১০টি গ্যালারী রয়েছে। গ্যালারিগুলোতে কাঠ খোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, তামা-কাসা-পিতলের নিদর্শন, লোহার তৈরি নিদর্শন, লোকজ অলংকারসহ রয়েছে বহু কিছু। ভবনটির সামান্য পূবে রয়েছে লোকজ স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ আধুনিক এক ইমারতে প্রতিষ্ঠিত জয়নুল আবেদীন স্মৃতি জাদুঘর। এই ভবনটিতে মাত্র দু'টি গ্যালারি। এই দুইটি গ্যালারির মধ্যে একটি গ্যালারি কাঠের তৈরি, যা প্রাচীন ও আধুনিক কালের নিদর্শনসমৃদ্ধ। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, বৈশিষ্ট্য কাঠ এবং কাঠ থেকে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি এবং সর্বশেষ বিক্রির সামগ্রিক প্রক্রিয়া, অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর মডেল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই দুটি ভবনের বাইরে রয়েছে পাঠাগার, ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সেমিনার হল, ক্যান্টিন, কারুমঞ্চ, গ্রামীণ উদ্যান ও বিভিন্ন রকমের বৃক্ষ, মনোরম লেক, লেকের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌ বিহার, মৎস্য শিকারের সুন্দর ব্যবস্থা ও পংখীরাজ নৌকা।


হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেলাম জাদুঘরের দিকে, ভেতরে একতলা এবং দুইতলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে প্রাপ্ত সংগ্রহ সমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে। আমার ভয়াবহ মোবাইলে ছবি তুলে নিলাম প্রতিটি আইটেমের। ভাল লাগলো মেইন গেটের বাইরের একটি মাটির কারুশিল্প। এরপর দুপুর ১২টা নাগাদ চলে এলাম মোগড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ড। এবারের গন্তব্য হাজীগঞ্জ দুর্গ। যেতে হবে নারায়ণগঞ্জ চাষারা কলিগের অনুষ্ঠানে। লোকাল লোকদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম দুইটা পথ রয়েছে হাজীগঞ্জ যাওয়ার। প্রথমটি হল বাস ধরে চিটাগাং রোড হয়ে নারায়ণগঞ্জ দিয়ে হাজীগঞ্জ, আর অন্যটি হল মোগড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ড হতে যে রাস্তাটি পানামের দিকে গেছে তার উল্টো দিকের রাস্তার সম্মুখ হতে সিএনজি করে নবীগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে নদী পার হলেই হাজীগঞ্জ। সময় ২য় পথে কম লাগবে বলে সেটি বেছে নিলাম। শেয়ারে সিএনজি করে রওনা দিলাম নবীগঞ্জের দিকে। এই পথের রাস্তাটা ভাঙ্গা এবং সরু বলে কিছুটা সমস্যা হল যদিও তা আমার মতে ধর্তব্য নয়। আধঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছলাম নবীগঞ্জ। দুই টাকা দিয়ে টোকেন কেটে উঠলাম ইঞ্জিনচালিত নৌকায়, ঘাটে সাধারন নৌকাও ছিল। যাই হোক ভালো লাগলো বোট অপরপ্রান্তে পৌছার পর যখন শুনলাম ঐ দুই টাকার টোকেনই নৌকার ভাড়া, আলাদা কোন ভাড়া দেয়া লাগে না। ভাল উদ্যোগ, মনে দাগ কাটল। অপরপ্রান্তে হাজীগঞ্জ ঘাট হতে বের হয়ে বাম দিকে মিনিট দুয়েক হাঁটলে হাতের ডানদিকে চোখে পড়বে একটা সরু গলি, এই গলির ভেতরেই রয়েছে হাজীগঞ্জ দুর্গ। গলির মুখে একটি সাইনবোর্ড রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের।


বাংলার মোগল স্থাপত্যের এক অনুপম নির্দশন নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ দুর্গ। শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় এর অবস্থান। মোগল আধিপত্য বিস্তার ও সুদৃঢ় করার ব্যাপারে সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত দুর্গটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। হাজীগঞ্জ দুর্গটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে। এক সময় দুর্গটি খিদিরপুর দুর্গ নামে পরিচিত ছিল। কথিত আছে শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী_ তিনটি নদীর মিলনস্থল ছিল দুর্গটির খুব কাছে। সেকালে সামরিক কৌশলের দিক দিয়েও দুর্গটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই দুর্গ স্থাপনের জন্য এটি ছিল উপযুক্ত স্থান। পাঁচ কোণাকারে নির্মিত এ দুর্গের বাহুগুলো এক মাপের নয়। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট। দুর্গের কোণগুলোতে কামান বসানোর জন্য বুরম্নজ নির্মাণ করা হয়েছিল এবং সেগুলো এখনও টিকে আছে। দেয়ালগুলো বেশ উঁচু এবং প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত ব্যাপ্তি। সমতল প্রাঙ্গণটি ভূমি থেকে সম্ভবত ৫ ফুট নিচু। সৈন্যরা সম্ভবত এখানে তাঁবু ফেলে অবস্থান করত। এ বেষ্টনী দেয়ালের স্থানে স্থানে কামান দাগার জন্য ছিদ্র আছে। আছে দেয়ালসংলগ্ন তৈরি কয়েকটি উঁচু বেদি। দুর্গের এককোণে ইটের তৈরি বড় আকারের একটি চতুষ্কোণ বেদি আছে। দুর্গের ভেতরে কোন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ নেই এবং ছিল বলেও মনে হয় না। বিশেষ্ণজ্ঞদের ধারণা, দুর্গটিতে কেউ নিয়মিত বসবাস করত না। এটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। মুন্সি রহমান আলী তাঁর এক গ্রন্থে লিখেছেন, মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে আহম্মাদ হাসান দানি তার 'মুসলিম আর্কিটেকশ্চার ইন বেঙ্গল' গ্রন্থে বলেছেন, ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর এটি নির্মাণ করেন। তাছাড়া দুর্গে কোন শিলালিপি না থাকায় বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, মোগল সুবেদাররা তাদের চিরশত্রম্ন ও বাংলার বিদ্রোহী জমিদারদের দমন করার উদ্দেশে এ দুর্গ ব্যবহার করত। আরাকানি (মগ), পতর্ুগীজ জলদসু্যরা ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় আক্রমণ করে লুটতরাজ ও শানত্মি ভঙ্গ করত। তাদের আক্রমণ প্রতিহত করাও ছিল এ দুর্গের প্রধান উদ্দেশ্য।
দুর্গের দক্ষিণ কোণে একটি উঁচু মানমন্দির (অবজারভেটরি) ছিল। সেটা এখন চেনাই মুশকিল। ভেঙ্গে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। শত্রম্নপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এটি নির্মিত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উত্তর দিক থেকে একটি আয়তাকার ফটকের মধ্য দিয়ে বেশ ক'টি সিঁড়ির ধাপের ওপর দিয়ে দুর্গের প্রবেশপথ। দুর্গের ভেতরে উন্মুক্ত প্রানত্মরে নামার জন্য আট ধাপের সিঁড়ি রয়েছে। ঢাকা লালবাগ দুর্গ মসজিদের দরজার মতো হাজীগঞ্জ দুর্গের ফটক খিলান সংযোজিত অর্ধগম্বুজের অনত্মস্থলে অবস্থিত।


গলির ভেতরে ঢুকতে একটু খারাপ লাগলো। দুর্গের বাইরের দিকে প্রাচীর ঘেঁষে ময়লার স্তুপ জমে আছে, বুঝলাম এটা ময়লার ভাগার। হাসবো, না কাঁদবো! যাই হোক মূল ফটকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। একটি গোলাকার মাঠের চারিদিকে অন্যান্য দুর্গসমূহের ন্যায় প্রাচীর রয়েছে, চারদিকে রয়েছে প্রহরী কাঠামো। (এইগুলোতে দেখলাম স্কুল কলেজের ছেলেদের আড্ডা, সাথে বিশেষ কিছু.........)। একপাশে রয়েছে একটি ছোট দেয়াল ঘেরা জায়গা, খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। চারপাশে কেমন নীরবতা, এর মাঝে ছবি তুললাম কিছু।


ঘড়িতে যখন দুপুর একটা তখন বের হলাম দুর্গ থেকে, বের হয়ে রওনা দিলাম নারায়ণগঞ্জ ১নং রেলগেটের দিকে রিকশা করে, উদ্দেশ্য বিখ্যাত “বোস কেবিন”। নারায়ণগঞ্জের ‘কফি হাউস’ খ্যাত বোস কেবিন, শহরের চেম্বার রোডে এর অবস্থান। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফলপট্টিতে। ১৯৮৮ সালে স্থানান্তরিত হয় নিজস্ব জায়গায় চেম্বার রোডে। কিন্তু বোস কেবিনের আড্ডাটা আজও আছে, এখনও এক প্রিয়নাম আড্ডাপ্রিয় মানুষের কাছে। গত একানব্বই বছর ধরে বোস কেবিন দাঁড়িয়ে আছে আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। প্রতিদিন ভিড় জমে আড্ডাপ্রিয় মানুষের। সময় কাটে ধূমায়িত চায়ের কাপের সঙ্গে তুমুল আড্ডায়।

১৯৩১ সালের ৭ নবেম্বর সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জে এসে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। থানায় বসে তিনি ভুলু বাবুর বোস কেবিনের চা পান করেন। কড়া লিকারের এক কাপ চা মুখে দিতেই তৃপ্তিতে তার মন ভরে যায়। ক্লান্তি মুছে যায় তার শরীর থেকে। সুভাষ বসু আশীর্বাদ করেন নৃপেন চন্দ্র বোস ওরফে ভূলু বাবুকে। এর পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হকের মতো নেতারা নারায়ণগঞ্জে আসলে বোস কেবিনের বিখ্যাত চা, কাটলেট কিংবা বাটারটোস্ট না খেয়ে কখনও ফিরতেন না। দেশবরেণ্য অনেক রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার- যাঁরা বিভিন্ন সময় নারায়ণগঞ্জে এসেছেন, তাঁদের পা পড়েছে বোস কেবিনে। কাটিয়েছেন কিছুটা সময়।

বোস কেবিনে পৌঁছে শুনি বিখ্যাত বোস কেবিনের চা এখন পাওয়া যাবেনা। কিছুই খাবো না তা কি করে হয়, শেষে মাটন কাটলেটের অর্ডার দিলাম। কাটলেটটি মোটেও ভালো লাগেনি। যাই হোক দুপুর দুইটার মধ্যে হাজির হলাম কলিগের অনুষ্ঠানে।

ও হ্যাঁ, কলিগের অনুষ্ঠানের খাওয়া ছিল অসাধারণ, বিশেষ করে বোরহানি আর ফিরনি!

তথ্যসূত্রঃ bn.wikipedia.org/wiki/উইকিপিডিয়া
Click This Link Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ১০:৫৪
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×