কিছু কিছু মানুষের নাকি স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর হয়, আমিও বোধহয় সেই দলে। কেননা সেই ছোট্ট বেলার অনেক খুঁটিনাটি স্মৃতিও আমার মনে আছে। এটা ভালো না মন্দ জানিনা, কিন্তু আমি খুব এনজয় করি ব্যাপারটা। এরকম বিষয়ভিত্তিক একটি ব্যাপার হল শৈশবের খেলাধুলা যা আমি আগের একটি লেখায় লেখেছি ডানপিটে ছেলেদের হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলো...। আজ যে বিষয়টি নিয়ে লেখার অবতারনা তা হল আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মজার সব খাবারগুলো। যে সব খাবারের কথা মনে হল ঘিরে ধরে নস্টালজিয়া, হারিয়ে যাই সেই হারানো শৈশবে। মনে মনে গেয়ে উঠি,
“ফুচকা পেয়াজু ডালপুরি
পোয়া মোয়া হায় ঝালমুড়ি
আজো জিভে জল এনে যায়
ঘোলা ঘোলা নীড়ে......
কবে যাব ফিরে... .... .....”
আসুন ফিরে যাই আমার হারানো শৈশবের মজার খাবারগুলোতে –
১. হজমীঃ আমাদের স্কুলের গেটে দীর্ঘদিন একটা লোক “হজমী” বিক্রি করত। চারটি ভিন্ন ভিন্ন কৌটা হতে চার রকমের গুঁড়া (যা মিশিয়ে হজমী তৈরি করত) বের করে একটি টুকরো কাগজের উপর রেখে ছোট্ট চামচ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে ছোট্ট পুরিয়া করে হাতে ধরিয়ে দিত। তারপর সাবধানে সেই পুরিয়া খুলে হাতের তালুতে করে নিয়ে জিহবা দিয়ে চেটে চেটে খেতাম সেই হজমী। মনে আছে চারধরনের কৌটার মধ্যে একটাতে থাকত কালো রঙের মূল হজমী যা ছিল অত্যন্ত টক, একবার শুধু এই হজমী খেয়েছিলাম। ইয়াক! দেখতে ছিল কালো কয়লা গুঁড়ার মত। আরেকটা ছিল সাদা গুড়া দুধের মত, ঠিক কালোটার বিপরীত, তীব্র মিষ্টি। সম্ভবত সেকারিন হতে তৈরি হত। বাকি দুটো ছিল একটি লালচে রঙের আর অন্যটি ধুসর বর্ণের। আমি খুব মিস করি এই “হজমী”।
২. হাওয়াই মিঠাইঃ অপার বিস্ময়ে ছোটবেলা চেয়ে থাকতাম গোলাকার ঐ থালার ন্যায় বাক্সের দিকে, যার মাঝখানের গর্ত দিয়ে মাকড়শার জালের মত বের হত হাওয়াই মিঠাইয়ের জালিগুলো। বেশ কিছুটা জমলে হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা লোকটা একটা চিকণ কাঠিতে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তুলে আনতো সেই তুলতুলে মিষ্টি হাওয়াই মিঠাই। এখনো বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশে হাওয়াই মিঠাই পাওয়া যায়, সুন্দর ট্রান্সপারেন্ট পলিপ্যাকে মোড়ানো। কিন্তু যা পাওয়া যায় না তা হল হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতার চারিদিকে বাচ্চাদের গোল হয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থেকে হাওয়াই মিঠাই তৈরি করা দেখার মজা।
৩. আমসত্ত্বঃ শৈশবে আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল এটি। প্রতিদিন স্কুলে ঢোকার আগে বুক পকেটে করে নিয়ে ঢুকতাম একগাদা আমসত্ত্ব। আমরা বলতাম “আমোট”। টক, মিষ্টি, টক-মিষ্টি এই তিন রকমের স্বাদের আমসত্ত্ব বিক্রি হত আমার স্কুল গেটের সামনে। বেশী করে ঝাল লবন দিয়ে মেখে এই আমসত্ত্ব কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে ঢুকতাম স্কুলে। টিচারের চোখ এড়িয়ে অল্প অল্প করে খেতাম এই আমসত্ত্ব সারাক্ষন। যদিও স্কুলের বন্ধুরা খুব ক্ষ্যাপাত আমাকে এই “আমোট” নিয়ে। বহুদিন খাই না আমার প্রিয় “আমোট”। আই মিস উই “আমোট”, রিয়েলি মিস ইউ।
৪. গোলা আইসক্রিমঃ গোলা আইসক্রিম ইদানিং আবার ঢাকা শহরে দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে হারিয়ে গিয়েছিল এই গোলা আইসক্রিম। গোলা আইসক্রিম আসলে কি? একটি কাঠের ফ্রেমে বাঁধা ধারালো লোহার ছাঁচের উপর দিয়ে একটি বরফের টুকরো ক্রমাগত ঘষে ঘষে বরফ কুঁচি করে তা একটি কাঠি সমেত হাতের মুঠোয় নিয়ে বরফের গোলা তৈরি করে তাতে রঙ্গিন মিষ্টি দ্রবণ দিয়ে কালারফুল করা হয়। যদিও এই দ্রবণগুলো কতটা হেলদি অ্যান্ড হাইজেনিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এই আইসক্রিমটা আমাকে তেমন একটা না টানলেও অন্যান্য ছেলেমেয়েদের দেখাতাম ভীষণ প্রিয় ছিল।
৫. মটকা আইসক্রিমঃ আমার পছন্দের আইসক্রিম ছিল এই মটকা আইসক্রিম। বিশাল মাটির মটকার মাঝে বরফ ঠাণ্ডা পানিতে একই রকম সাইজের দুটো প্লাস্টিকের কাপ একটি মোটা রাবার ব্যান দিয়ে আটকে জমানো হত দুধ, চিনি আর নারিকেলের দ্রবণ। জমাট বেঁধে যে গোলাকার আইসক্রিমটি তৈরি হত তা বিক্রেতা একটি কাঠির মাথায় আটকে দিত। অসাধারন সেই স্বাদ, অতুলনীয়; এখনো জিভে পানি চলে আসে। পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সা আর এক টাকা দামের সেই আইসক্রিম তখনকার বাচ্চাদের কাছে ছিল তুমুল জনপ্রিয়। গত দশ বছরে মাত্র দুবার আমি রাস্তায় এই মটকার আইসক্রিম বিক্রি করতে দেখেছি।
৬. চারকোনা কাঠি আইসক্রিমঃ এই আইসক্রিমটার এখনো মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চলার পথে। ক্রমশ সরু হয়ে নেমে আসা চারকোনা ছাঁচে দুধ, চিনির সংমিশ্রন দিয়ে জমানো আইসক্রিমটি আগে খুবই মজার ছিল। এখন কেমন স্বাদ হবে জানিনা। চিকণ এই আইসক্রিমের মতই স্বাদ এখনকার ইগলু মালাই আইসক্রিমটির। ইগলুর এই প্রোডাক্টটি মূলত আগেকার সেই চারকোনা কাঠি আইসক্রিমটিরই অনুকরণে তৈরি।
৭. মালাই আইসক্রিমঃ লম্বা সরু ড্রাম আকৃতির একটি পাত্রে দুধের মালাই যুক্ত আইসক্রিমটির স্বাদ আজো জিহবায় লেগে আছে। আসল দুধের মালাই দিয়ে তৈরি হত এই আইসক্রিম। ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে করে দেয়া হত। অনেক বিক্রেতা আবার ছোট ছোট প্লাস্টিকের চামচও দিত। পরে এই আইসক্রিম ছোট্ট পলিব্যাগেও বিক্রি হত। তার সাথে যোগ হয়েছে ছোট্ট কোনের খোল। বহুদিন খেয়েছি এই আইসক্রিম। মজার ব্যাপার গত বিজয় দিবসে ছোট্ট মামাতো ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম রমনার ভেতরে ঘুরিয়ে আনতে, সেখানে পেলাম এই মালাই আইসক্রিম। তাকে কিনে দিলাম, সে মুখে দিয়ে বলল, “থু”। আমি একটু ছেখে দেখতে মুখে দিতেই গা গুলিয়ে উঠল। আমিও বললাম, “থু”।
৮. মিঠাই খেলনাঃ এই খাবারটির নাম একজ্যাক্টলি মনে করতে পারছিনা। মনে আছে একজন লোক একটি ইয়া মোটা তৈলাক্ত বাঁশে রঙ্গিন মিষ্টি জাতীয় রাবারের মত মিষ্টান্ন পেঁচিয়ে নিয়ে আসত। বাঁশের মাথায় থাকত রঙ্গিন কাগজের টুকরো আর নিচের দিকে থাকত পেতলের ঘণ্টা। বাঁশটি দিয়ে মাটিতে বাড়ি দিত আর তাতে ছোট্ট পেতলের ঘণ্টাগুলো বেজে উঠত; সাথে থাকত ভরাট দরাজ কণ্ঠের হাঁক। দুঃখের ব্যাপার কি বলে হাঁক দিত তা আজ আর মনে পড়ছে না। সেই রাবারের ন্যায় ইলাস্টিক মিষ্টান্ন দিয়ে হরেক রকম খেলনা বানিয়ে দিত বিক্রেতা। ঘড়ি, আংটি, চশমা, হাত পাখা, লকেট আরও কত কি। এই জিনিশ গত দুই দশকে আমার চোখে পড়েনি।
৯. কটকটিঃ ছোট বেলায় এই খাবারটি বেশ মজা লাগত। অনেকটা বাদাম পাপড়ির মত; গুঁড় জ্বাল দিয়ে খাবার সোডার সংমিশ্রণে কিছুটা ফাঁপা এই মিষ্টি দ্রবটি তৈরি হত। মুখে দিল মিষ্টি কিন্তু মৃদু ঝাঁঝালো একটা স্বাদ পেতাম। খাবার সোডার আধিক্যের কারণে এই ঝাঁঝটি হত। এই কটকটি পুরানো-ভাঙ্গা জিনিশপত্রর বিনিময়ে পাওয়া যেত। বাসায় কোন কাঁচের জিনিশ ভেঙ্গে গেলে বা পুরানো কৌটা পেলে আমরা বাচ্চারা তা তুলে রাখতাম কটকটি খাবো বলে। আহ! কি আনন্দেরই না ছিল শৈশবের সেই দিনগুলো।
১০. পাঁপড়ঃ বড় বড় পাঁপড় করকর শব্দে খেতে বড়ই মজা লাগত শৈশবে। বাসার কাছেই এক বাসায় ছিল পাঁপড় বানানোর কারখানা। রুটির মত বেলে সেই পাঁপড় শুকানো হত টিনের ছাঁদে। তারপর তা তেলে ভেজে ইয়া বড় এক আকার ধারণ করত। সেই পাঁপড়ে বিট লবন ছিটিয়ে দিত পাঁপড় বিক্রেতা। তারপর...... চলত করমর করমর করে কামড়ে খাওয়া। এখনো অনেক দোকানে পাঁপড় মোড়কজাত করে বিক্রি হয়, তা বাসায় নিয়ে শুধু ভেঁজে নিলেই হল। তবে, এখনও মাঝে মাঝে পাঁপড় ভাঁজা বিক্রেতার দেখা মেলে এখানে সেখানে।
১১. চালতার বিরিয়ানিঃ আমাদের এলাকায় বড় একটা হাড়িতে করে হরেক রকমের আঁচার নিয়ে আসত ইয়া মোটা এক লোক ঠিক সন্ধ্যা বেলায়। হাঁকত “এয়্য চালতার বিরিয়ানি......” বলে। চালতার আছারের নাম কেন চালতার বিরিয়ানি হল তা কখনো চিন্তা করিনি। খুবই সুস্বাদু সেই আঁচার বয়সের বিভেদ ভুলে ছোট-বড় সকলের কাছেই সমান প্রিয় ছিল। বড়রা চালতার টক-ঝাল আঁচার পছন্দ করত আর আমাদের ছোটদের প্রিয় ছিল মিষ্টি চালতার আঁচার। অনেক জায়গায় অনেক ধরনের চালতার আঁচার খেয়েছি, কিন্তু সেই আঁচারের স্বাদ কোথাও পাই নাই। আজো মনে পরে সেই ডাক, “এয়্য চালতার বিরিয়ানি......”।
১২. বাদাম পাপড়িঃ আমাদের পাড়ার আরেকটি মজার খাবার ছিল বাদামওয়ালার গুঁড় ও বাদাম দিয়ে তৈরি বাদাম পাপড়ি। প্রতিটি বাসার ছোট্ট শিশু আর তার মায়েরা বিকেল হলে অপেক্ষায় থাকত বাদামওয়ালার হাঁকের জন্য। জমাট সেই গুঁড়ের তৈরি বাদামের পাপড়ি খুবই সুস্বাদু ছিল। এখনও মাঝে মাঝে ফুটপাথে পাপড়ি বিক্রি করতে দেখা যায়, কিন্তু তা মোটেও সেই স্বাদের নয়। ও হ্যাঁ, ঘিয়ে ভাঁজা পাপড়ি আরও মজার জিনিশ যা এখনো পুরানো ঢাকার চকবাজারের “বোম্বে সুইটস”এ পাওয়া যায়। একবার কিনে খেয়ে দেখতে পারেন, অসাধারণ জিনিশ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২১