somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সত্ত্বার ছায়ার আর্তনাদ (ছোট গল্প)

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বড় ভাইয়া অল্পতেই রেগে যায়। টেম্পার লুজ করা তার একটা নিত্যদিনের ঘটনা। যেনতেন বিষয়ে রেগে অস্থির। এখন বাবার সাথে তার প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কুলখানির তবারকের মিষ্টির আইটেম সিলেকশন নিয়ে দুজনের মাঝে বাক-বিতণ্ডতা চলছে।

“বুঝলাম না বাবা, কুলখানির মিষ্টিতে এত আইটেম দেয়ার দরকার কি?”

“তোর বুঝতে হবে না, এত বুঝিস বলেইতো আজ এই দশা...”

“বাবা তুমি কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বল।”

“আমি যা বলতে চাচ্ছি তা তুই ভালো মতই জানিস। আমি যা বললাম তাই ফাইনাল। কালোজাম, ছানা, আমিত্তি, সিঙ্গারা আর সমুচা। তুই বিকেলে গিয়ে “যাদব ঘোষ”এ গিয়ে অর্ডার করে আয়।“

“আমি পারবো না, তুমি যাও। কুলখানির নামে ভুঁড়িভোজ, আমি এতে নাই। তুমি ধর্মের কোথায় পেয়েছ কুলখানির নামে রাজ্যের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ডেকে খানাপিনায় মত্ত হওয়ার এই রীতি।”

“চোপ হারামজাদা, তোর কাছ থেকে আমার ধর্ম শিখতে হবে না। জুম্মাবারেও যে নামাজ পরে না, সে আসছে আমাকে ধর্ম শেখাতে।”

“ও তাই নাকি, জুম্মাবারে যারা নামাজ পড়ে, শুধু তারাই বুঝি ধর্ম’র কথা বলবে, ধর্ম শেখাবে। আচ্ছা বাবা, নামাজতো প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত পড়া ফরজ, তো সবসময় তুমি জুম্মাবারের কথা বল কেন? তুমি শুধু জুম্মা নামাজ পড় বলে...”

“চোপ হারামজাদা......”

বাবার চিৎকারে আমার কানে তালা লাগার যোগাড়। যদিও এমন হওয়ার কথা না, তারপরও আমি দ্রুত ঘর হতে বেরিয়ে এলাম, ড্রইং রুমে কিছু আত্মীয়-স্বজন বসে আছে, আমি সেদিকে না গিয়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

“আপা একটু কাছে আসতো, তোমার মাথায় হিমরাজ তেল দিয়ে দেই।”

ছোট খালা এখন আছেন। কালকে ঘটনার পর থেকে আর বোধহয় বাসায় যাননি, যদিও তার বাসা আমাদের বাসা থেকে পাঁচ-ছয় বিল্ডিং পরেই।

“না বাদ দে, আমার কিছু লাগবে না” – মা শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছলেন।

কাল থেকে এই ভদ্রমহিলা কেঁদেই চলেছেন। মা’র জন্য খুব মায়া লাগছে, কিন্তু আমি কি করতে পারি?

“আপা দেখেছো তোমার বেয়াইনের রুচি। মরা বাড়িতে এটা কি খাবার পাঠাল? দোকান থেকে কিনে পাঠানো বিরিয়ানি।”

“প্লিজ এসব বাদ দে...” মা’কে খুব কেমন বুড়োটে লাগছে। মা’র চেহারা দেখে খুব মায়া লাগছে। কিন্তু আমার কিইবা করার আছে?

“কেন বাদ দেব? তোমরা কি ফকির? টাকা দিয়ে এই বিরিয়ানি আমরা কি কিনে খেতে পারিনা? মরা বাসায় চুলা জ্বলবে না বলেই তো আত্মীয়রা রেঁধে খাবার পাঠাবে।”

আমার খুব হাসি পাচ্ছিল, মাত্র একদিনে মৃত্যুর শোক কত ফিকে হয়ে আসে। শোক ঢাকা পড়ে যায় দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা চাওয়া-পাওয়ায়। আমি আমার ঘরে পা বাড়ালাম। সেখানে আমার বড় দু-বোন বসে আছে, মুখ থমথম। আমি বুঝার চেষ্টা করলাম ঘটনা কি? বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হল না। মেজপা মুখ খুলল।

“দ্যাখো বড়পা, এই মরাবাড়িতে এসব আলোচনা না করাই ভালো। লোকে শুনলে কি বলবে?”

“কি বলবে লোকে? বলুক, কিন্তু এখনি যদি একটা বিহিত না করা হয়, তবে ভাইয়ার বৌ মুন্নির লকেটসহ হারটা নিজের কাছে রেখে দেবে। আমি এটা হতে দেব ভেবেছিস। মুন্নির স্মৃতি, সেটা থাকবে মা’র কাছে, ভাবী কেন নিয়ে নিজের কাছে রাখলো।”

“আহ বড়পা, ভাবী কি বলেছে যে সেটা সে নিজের কাছে রেখে দেবে? মুন্নিকে গোসল দেবার সময় তা ভাবী খুলে নিজের কাছে রেখেছিল। পরে হয়ত মাকে দিয়ে দিবে। এসব বাদ দাও, একটু কোরআন তেলাওয়াত কর।”

“তা তো করবোই, আমি বসে বসে মনে মনে তজবি পড়ছি। কিন্তু বহ্নি তুই জানিস না, সব বাড়িতে এই হয়, মৃত মানুষের জিনিসপত্র হরিলুট হয় প্রথম দিকেই।”

আমার অসহ্য লাগছে। আমি বাড়ীর বাইরে বের হলাম। এখানেও কিছু মানুষের জটলা। ঐতো বড় দুলাভাই, লোকটাকে দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, গা গুলিয়ে যেন বমি হবে; যদিও তা হবার নয়। কারন আমি এখন এসবের ঊর্ধ্বে। গতকাল ভোররাতে আমি মারা গেছি, মারা গেছি বললে ভুল হবে, আমি আত্মহত্যা করেছি। আমার মৃত্যুযে আত্মহত্যা তা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা, আমি সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছি। হাসপাতাল রিপোর্টে এসেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। আমি কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ছিলাম বিঁধায় আমার জন্য সায়ানাইড যোগাড় করা খুব সহজ ছিল।

আমাকে মরতে হল কেন জানেন? কারন, আমি আমার পরিবার থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি এই পরিবারের ছোট মেয়ে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি হতে কেমিস্টিতে মাস্টার্স শেষ করে এম.ফিল. করছিলাম। বড় দুলাভাইকে আমার কলেজে পড়া অবস্থা থেকেই ভালো লাগত। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে এসে বাংলা নববর্ষে আমি আমার ভালো লাগা দুলাভাইকে জানাই। তিনি জানান আমাকেও তিনি ভালবাসেন। এরপর আমরা প্রায়ই ডেট করি। এভাবে একদিন আমি আমার চূড়ান্ত সর্বনাশ করে বসি, আমার সবকিছু বিলিয়ে দেই আমার অন্যায় ভালবাসায়। একসময় ভালবাসা শুধু বাহানা ছিল দুলাভাইয়ের নিকট আমি তা বুঝতে পারি, কিন্তু ততদিনে পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। একসময় আমি আমাকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলে দুলাভাই আমাকে ব্ল্যাকমেইলিং করা শুরু করে। সবশেষে আমি ভেবে দেখলাম এই পৃথিবী থেকে আমার সরে দাঁড়ানোই সব সমস্যার সমাধান। আপার কথা, ছোট দুই ভাগ্নের কথা, আমার পরিবারের কথা...... আরও কতজনার ভালোর চিন্তা করে আমি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই।

কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট হওয়ায় সুবিধা হয়েছে, নিখুঁত প্ল্যানিং করে আমি আত্মহত্যাকে একটি সাধারণ মৃত্যুতে রুপ দিতে পেরেছি। সায়ানাইড খেয়ে মরলে মৃত্যু যন্ত্রণা হবেনা জানতাম, কিন্তু সে ধারণা ভুল, মৃত্যু যন্ত্রণা যে কি ভয়াবহ তা আমি জেনেছি। আমি নিজেকে যে সীমাহীন কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম, তা পারিনাই। বরং অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আমি আটকে আছি, আমার দাফন হয়েছে ৩৬ ঘণ্টা আগে, কিন্তু দেহ কবরে চলে গেলেও আমি যে আটকে আছি আমার চেনা ভুবন জুড়ে। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে, কেউ কি আছেন আমায় মুক্তির পথ বলে দিতে? অজানার দেশে পাড়ি জমাতে আমাকে কেউ কি পথ দেখাবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪০
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×