somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনে পড়ে রুবি রায় (ছোট গল্প)

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ঘটনা এমন ঘটবে আমি তা বুঝতে পারিনি। ধানমণ্ডি দুই নম্বরের স্টার হোটেলে আমি চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছি। চায়ের কাপে প্রথমেই হুট করে লম্বা চুমুক দেয়া ঠিক হয় নাই। গত দুই ঘণ্টা ধরে আমি ঢাকা শহরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে এখানে এসেছি এক কাপ চা খেতে, স্টারের চা আমি খুব পছন্দ করি। চায়ের উপরে স্বর পরে থাকায় আমি আন্দাজ করতে পারি নাই, প্রথমে চুমকেই জিহবা পুড়িয়ে আমি বোকা হয়ে গেলাম। শ্বাসনালীও বোধহয় পুড়েছে, চা যে কখনও এত গরম হতে পারে আমি তা কল্পনা করতে পারছি না। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, আজকে সন্ধার টিউশনিটা মিস হল, এই নিয়ে এ মাসে চার দিন মিস হল। বন্ধুর বোনকে ইমারজেন্সি রক্ত দিতে এসে আটকে গেছি, এক ব্যাগ রক্ত দিতে এসে গত দুই ঘণ্টা ধরে আমি আটকে আছি।

মেজাজ খারাপ করে হোটেল থেকে বের হয়ে এসে আমি সিটি কলেজের দিকে পা বাড়ালাম। অবাক কাণ্ড, আকাশে বিশাল একখানি চাঁদ উঠেছে, আজ পূর্ণিমা নাকি? অনেকদিন চাঁদের হিসাব রাখিনা। আমি চন্দ্রপ্রেমিক ছিলাম কোন এক কালে, আজকের এই সন্ধ্যারাতে আমাকে তা কাছে টানছে না। শরীর নিকোটিনের চাহিদা জানান দিচ্ছে, একটা সিগারেট ধরাবো কি না বুঝতে পারছিনা, এখনই আবার হাসপাতালে ঢুকতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ধানমণ্ডি পাঁচ নম্বরে পৌঁছে রাস্তা পার হলাম। লম্বা গাড়ির সারি সিগন্যাল পয়েন্টে অপেক্ষা করছে। গাড়িগুলোর ফাঁক গলে সর্পাকারে নিজেকে এপারে নিয়ে এসে সবুজ কাঁচ ঘেরা হাসপাতালে ঢুকে ওয়েটিং জোনের একেবারে কোনার দিককার একটি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়লাম। বাইরে আকাশে বিশাল থালার ন্যায় একখানা রুপালী চাঁদ। ঝিম ধরে বসে বসে ভাবনার নানান ডালা মেলে দিলাম।

কতক্ষণ বসে আছি মনে নেই, হঠাৎ বাহির হতে ভেতরে দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি কালচে সবুজ রঙের শাড়ি পরা ছিপছিপে লম্বা এক মেয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে নিশিত হলাম মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়ে। আমি নড়েচড়ে বসলাম, আমার মত ছন্নছাড়া, ম্যাড়ম্যাড়ে কোন মানুষ কোন অচেনা কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে ভেবে পুলকিত হলাম। মেয়েটির দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতেই মেয়েটি মিষ্টি একটি হাসি দিল। আমি কি প্রতিত্তর দেব ভেবে না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার বাইরের পানে তাকালাম। আমি হাসি দেখে এক লহমায় চিনতে পারলাম, আমার হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ করে আটকে গেল। শাড়ি পরিহিত থাকায় প্রথমে চিনতে পারি নাই, এ যে লুবনা, সেই লুবনা যার জন্য আজো মন কাঁদে।

লুবনা মেয়েটা আমার সাথে অনার্সে পড়ত, একই ক্লাসে আমরা সহপাঠী হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে তার তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি লাজুক বা মুখচোরা টাইপের ছেলে না হলেও কেন জানি মেয়েদের সাথে তেমন মিশতে পারতাম না। সেই আমি মাসখানেকের মধ্যে এই মেয়ের প্রেমে ডুবে রসগোল্লা হয়ে গেলাম, রসগোল্লা বলেল ভুল হবে, একেবারে স্পঞ্জ রসগোল্লা। বাস্তবিক অর্থেই আমার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম উবে গেল, চোখের নীচে কালি পড়ল নির্ঘুম রাতের ভালোবাসা জড়ানো বেদনাগুলোর কল্যাণে। দিনের দিনের পর দিন আমি দূর থেকে অপলক চেয়ে দেখতাম আমার স্বপ্নরানীকে। মাঝে মাঝে ধরা খেতাম যখন, লজ্জায় মাথা কাটা যেত আমার। লুবনাকে দেখতাম মুচকি হেসে কেমন করে একটা ভেংচি টাইপের মুখাবয়ব করতে।

প্রতি বছর আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষাসফরের নামে ভ্রমণে বের হত, যার উদ্যোক্তাদের অন্যতম একজন ছিল লুবনা। প্রতিবার আমার মন ব্যাকুল হত এই ভ্রমণের সঙ্গী হতে, কিন্তু অজানা কোন একটা কারনে কখনো যাইনি। ফোর্থ ইয়ারে এসে কিভাবে যেন সাহস করে, লজ্জার মাথা খেয়ে সঙ্গী হলাম ভ্রমণ দলের, লুবনার খুব কাছাকাছি কয়েকটা দিন থাকা যাবে ভেবে। সেই কয়েকটা দিন আমার জীবনের খুবই স্মরণীয় দিন ছিল। আমি সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে আড়চোখে দেখতাম আমার লুবনাকে।

কিন্তু ভ্রমণ শেষে ভার্সিটিতে ফিরে দেখি সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। প্রথম কয়েকদিন ঘটনা কি বুঝতে পারি নাই, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আবিস্কার করে ফেললাম ঘটনা। আমার লুবনার প্রতি দুর্বলতা সবাই বুঝে ফেলেছে। নানান টিপ্পনী, যার বেশীরভাগই অপমানজনক, আসতে লাগল আমার দিকে। আমি মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়লাম। কোনমতে অনার্স ফাইনালটা দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসি। সেই দিনগুলো কি যে অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে মনে পড়লে আজো হৃদয়ের কোন গোপন কুঠিরে রক্তক্ষরণ হয়। আজ এত বছর পর আমার কয়েক হাত দূরে আমার স্বপ্নরানী দাঁড়িয়ে!

“আপনি কি অনিক? মানে আপনার নাম কি অনিক?”

“জী না, আমার নাম অনিক নয়...” অবলীলায় মিথ্যা বলে দিলাম।

“আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

“জী না, কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”

“না, মানে, আপনাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।”

“হতে পারে, অনেক সময় অনেককে চেনা চেনা লাগেতে পারে...”

“সরি......” বলে লুবনা ওয়েটিং রুমের করিডোর ধরে মৃদু পায়ে পায়চারী করতে লাগল। আমি আগের মত রঙ্গিন কাঁচের ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার রুপালী চাঁদের দিকে চেয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরালে দেখতে পেলাম লুবনা থেকে থেকে আমার দিকে অবাক হয়ে আড় চোখে দেখছে। হয়ত ভাবছে পথ চলার কোথাও হয়ত আমাকে দেখেছে। চার বছরে একই ছাদের নীচে ক্লাস করেছি, চেতনে না হোক অবচেতনে হলেও হয়ত আমার ছবি মনে গেঁথেছে। কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে গেল রক্ত নেয়ার জন্য। রক্ত দিয়ে আমি নেমে এলাম ব্যাস্ত ঢাকার ফুটপাথে। রাস্তার অপর পাশের দোকান হতে গানের সুর ভেসে আসল কানে, নিজের মনে হেসে উঠলাম কাকতালীয়তা দেখে...

মনে পড়ে রুবি রায়
কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি......
আজ হায় রুবি রায়
ডেকে বল আমাকে
“তোমাকে কথায় যেন দেখেছি...”
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:২২
২৩টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×