somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাকরাইন - জীবনের উৎসব, প্রাণের উৎসব, ঐতিহ্যের উৎসব

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জীবনের নীলাকাশে স্বপ্নঘুড়ি ওড়ানোর সাধ সবারই থাকে... কারো ঘুড়ি সীমাহীন আকাশে পাখা মেলে স্বপ্ন ছোঁয় দিগন্ত রেখায়... কারো স্বপ্ন ঘুড়ি গোত্তা খায় বাস্তবতার দেয়ালে... কেউ কেউ স্বপ্নঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সুতোর ঢিল ছেড়ে ছেড়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে... আবার কারো কারো স্বপ্নঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে বাকাট্টা হয়ে গেলে জীবনের শুন্য নাটাই হাতে থেমে যেতে হয়... দুইদিন পর সাকরাইন উৎসব শুরু হবে পুরোনো ঢাকায়। আপনার "জীবনের সাকরাইন" উৎসব কতটা রঙ্গিন হল...



প্রতিবছর ১৪ বা ১৫ই জানুয়ারী পৌষের শেষ দিনে পৌষ সংক্রান্তিকে ঘিরে লোকজন ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠে। সাকরাইন পৌষ মাসের শেষ দিন নতুন ধানের চালের পিঠাপুলি খেয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করার রেওয়াজ বহু পুরনো। ঢাকায় এই উৎসব হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। বাংলাদেশের পুরানো ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো বিনোদন শুরু হয়েছিল মুঘল আমলে। কথিত আছে, ১৭৪০ সালে নবাব নাজিম মহম্মদ খাঁ এই ঘুড়ি উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই ঘুড়ি উৎসব পশ্চিম ভারতের গুজরাটেও পালিত হয়। সেখানে মানুষ সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে সূর্যদেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা ও আকুতি প্রেরণ করেন। উত্তর ভারতীয় এ ঘুড়ি উৎসবটিকে স্থানীয়রা 'সাকরাইন' নামে অভিহিত করে।



ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। মুঘল আমল থেকে এই উত্সব পালিত হয়ে আসছে। তবে পুর্বে এই উৎসব হতো খোলা মাঠে এবং এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মাঠে প্রচুর লোক সমাগম ঘটত। বর্তমানে মানুষ বাসাবাড়ীর ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়ায়। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, মিল ব্যারাক, হাজারীবাগ, সদর ঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া ও পোস্তগোলা এলাকার মানুষ এখনও এ উৎসব পালন করে থাকে। তারা তাদের এলাকার সবচেয়ে বড় ভবনকে বেছে নেয় ঘুড়ি উড়ানোর জন্য। সেখানে বন্ধু ও আত্মীদয়রা মিলে ১২-১৫ জন ঘুড়ি উড়ায়, কিন্তু বাড়ীর নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই ছাদে উঠে তাদেরকে উৎসাহ দেয়।



এ উৎসবে তারা চিকন সূতা দিয়ে পাতলা কাগজের ঘুড়ি উড়ায়। এ উৎসবে সাধারণত ঘুড়ি উড়ানোর চাইতে অন্যের ঘুড়ির সাথে প্রতিযোগিতা করা হয় বেশী। এ প্রতিযোগিতা হয় মূলত সূতায় সূতায় প্যাচ লাগিয়ে। স্থানীয় ভাষায় একে বলে কাটাকাটি। কাটাকাটির পর বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে দুরে মিলিয়ে যায়। আর ভাগেটটা হওয়া ঘুড়ি পেতে এলাকার অপেক্ষাকৃত ছোটরা লগি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। তারা চিকন মুলিবাঁশ দিয়ে ঘুড়ির সূতা পেঁচিয়ে ঘুড়ি নিচে নামিয়ে আনে। এই চিকন বাঁশকে লগি বা লগগি বলে। তারা প্রথম দিন ঘুড়ি ধরে জমায় এবং দ্বিতীয় দিন এ ঘুড়িগুলো উড়ায়।



এ প্রতিযোগিতায় সুতাটাই প্রধান। এ সুতাকে মজবুত ও ধারাল করার জন্য যে ব্যবস্থা করা হয় তাকে মাঞ্জা বলে। সুতা ২-৩ ঘণ্টা লেইতে ভিজিয়ে রাখা হয়। লেই বা ল্যাদ্দি তৈরী করা হয় শিরিষ (যা ল্যাদ্দি কে আঠালো করে), রঙ (সুতা কি রঙ এর হবে সেই গুড়া রঙ), বার্লি, ডিম, বিভিন্ন ডালের কষ, ভাতের মাড় ইত্যাদির সংমিশ্রন ঘটিয়ে। ২-৩ ঘণ্টা পর রিল থেকে সুতা নাটাইয়ে প্যাচিয়ে রাখা হয়। শিরিষের আঠার জন্য সুতার সঙ্গে সুতা যেন না লেগে যায় তার জন্য রিল থেকে নাটাইয়ে সুতা যাওয়ার মধ্যপথে দুই জন সুতায় চূর লাগিয়ে দেয়। এ চূর তৈরী করা হয় কাচের গুরা দিয়ে। মাঞ্জা দেয়া শেষ হলে এ সুতা শুকানোর জন্য সমস্ত সুতা ছেড়ে দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। এ সময় তারা কারো সঙ্গে কাটাকাটি খেলে না। তাই তারা সাকরাইনের ৩-৪ দিন পূর্বে মাঞ্জা দেয়। মাঞ্জার গুনাগুনের উপর নির্ভর করে প্রতিযোগিরা একজন আরেকজনকে টানে অথবা ছোড়ে (ঢিল), কোন পদ্ধতিতে পরাজিত করবে।



ঘুড়ি তৈরী করা হয় পাতলা কাগজ বা পলিথিন দিয়ে। ছোটরা পলিথিনের ব্যাগ কেটে নারকেল পাতার শলা দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করে। আর বড়দের জন্য দোকানিরা পাতলা কাগজ দিয়ে ঘুড়ি তৈরী করে এবং এর আকৃতি দেয়া হয় বাঁশের পাতলা চটি দিয়ে। ছেলেরা আগের দিন রাতে সকল ঘুড়িতে দান্তারা বেঁধে রাখে, যাতে একটা কাটা খাওয়ার পর আর একটা উড়াতে সময় ক্ষেপণ না হয়। এদিন আকাশে উড়ে চোখদ্বার, মালাদ্বার, পঙ্খীরাজ, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চাপালিশ, চানদ্বার, এক রঙা ইত্যাদি ঘুড়ি। এমনকি জাতীয় পতাকার রঙেও ঘুড়ি তৈরি করা হয়। তবে ঘুড়ির চেয়েও সুন্দর হয় এর লেজ। লেজ অনেক আকৃতির ও রঙ বেরঙ এর হয়ে থাকে। ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে নাটাইগুলোর নামও বেশ মজাদার। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়া ইত্যাদি। পাতলা ঘুড়ি ভালো হলেও নাটাই যত ভারী হবে ঘুড়ি উড়াতে তত ভালো হয়।



পুরান ঢাকার ঘুড়ি প্রেমীরা সারাদিন ঘুড়ি উড়িয়ে সন্ধ্যায় সকল ঘুড়ি, নাটাই, সুতা, লগি সকল উপকরণ দিয়ে আগুন জ্বালায়। এসময় তারা আতশ বাজী পোড়ায় ও মুখে কেরোসিন তেল নিয়ে আগুন দিয়ে চমৎকার এক ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরী করে, যা গোল হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যায়।

অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অবশ্য পালনীয় অংগ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আত্নীয়-স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে। নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। পুরান ঢাকার আদি বসবাসকারী সকল মানুষ এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন। নতুন প্রজন্মকে শোনান সেই সব মুখরিত দিনের কথা। মনের খুব গভীরে পরম মমতায় লালন করেন ঐতিহ্যের পরম্পরা। স্বপ্ন দেখেন এই সকল প্রাণময় ঐতিহ্যগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হবে।

উইকিপিডিয়া
দৈনিক কালেরকণ্ঠ
দৈনিক প্রথম আলো
ফ্লিকার
http://www.shobdoneer.com/horbola/22112

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১:৩৮
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×