somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রহণকালের দুঃস্মৃতি (একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প)

১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লাল ফুটবলটা গড়াতে গড়াতে বড় টানা হলঘরের মত এই পরিত্যাক্ত বিশাল একচালা ঘরটার শেষ প্রান্তে যেতে যেতে যেন ছোট একটা বিন্দু হয়ে যাবে। অন্তু হাঁপাচ্ছে। স্কুল শেষে স্কুল মাঠে তারা ফুটবল খেলছে। স্কুল মাঠে না ঠিক, স্কুলের পেছনে পরিত্যাক্ত এক মোটর গাড়ীর গ্যারেজের সামনে খোলা অংশটায়। স্কুল মাঠ এখন বড়দের দখলে। রিপন এত্ত জোরে কিক মারলো যে বল গিয়ে ঢুকেছে ঐ গ্যারেজের লাগোয়া এই বিশাল ঘরটায়। অন্তু ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাঁটছে। ঘরটির ছাদ টিন আর বেড়ার বাঁশের তৈরি, দেয়াল ইটের; কিন্তু দেয়ালের পলেস্তার সব খসে পড়েছে। কয়েক জায়গায় গাঢ় সবুজ রঙের শ্যাওলা ধরেছে দেয়ালের ইটগুলোর খাঁজে খাঁজে। ঘরটা কেমন যেন!

বলটা গড়াতে গড়াতে ঐ টানা ঘরটার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ডান দিকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অন্তু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল শেষ প্রান্তের ঐ দেয়ালটার দিকে। আগে কখনো এইখানটায় আসেনি অন্তু, স্কুলের পেছনের ঐ ছোট মাঠটায় তারা প্রায় সময়ই খেলে কারণ বড় মাঠটা ফাঁকা পাওয়া যায় না। দূর থেকে গ্যারেজের পেছনের এই ঘরটা দেখেছে সে আগে, কিন্তু কখনো এখানে ঢুকে নাই। দেয়ালের কাছে পৌঁছে দেখলো ডানে আরেকটা ছোট্ট লাগোয়া ঘর আছে। বলটা গিয়ে সেখানে ঢুকেছে। অন্তু ঘরে ঢুকে বলটি হাতে নিতেই কে যেন কথা বলে উঠলো।

‘এই ছেমড়া, এইখানে আইছস ক্যান?’

‘এই যে, এই যে বলটা নিতে’

অন্তু তোতলাতে তোতলাতে বলল। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে, হঠাৎ এই ঘরের এতো ভেতরে কোন মানুষ থাকবে তা তার কল্পনার বাইরে ছিল। বলে হাত দেয়া মাত্রই তার কানে মানুষের আওয়াজ ঢুকলে সে এতো ভয় পেয়েছে যে চিৎকার করে উঠতো। কিন্তু লোকটি চোখে পড়তেই সে কেমন জমে গেল, অজানা এক ভয়ে। লোকটি একটি ময়লা স্কাইব্লু জিন্স আর লাল রঙের একটা ঢোলা জামা পড়ে আছে। চোখ রক্তের ন্যায় টকটকে লাল, চোখের কোনে ময়লা জমে আছে। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বড় বড় চুলগুলো কেমন লালচে ময়লাটে। ঘরটির ভেতর কেমন একটা ভারী বিশ্রী গন্ধ। কয়েকটি কাঁচের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে এখানে সেখানে, সিগারেটের টুকরো দিয়ে পুরো ঘর সয়লাব। কয়েকটা ইনজেকশন সিরিঞ্জ দেখা যাচ্ছে লোকটার পাশে পড়ে আছে। অন্তু ভয়ে ভয়ে বল হাতে নিয়ে ছোট ঘরটির দরজার দিকে এগিয়ে গেল, যে দরজা দিয়ে বড় হলঘর হতে সে এই ঘরে ঢুকেছিল। লোকটা দরজাটা যে দেয়ালে সেখানে বসে আছে।

‘এই পোলা খাড়া, এই দিকে আয়’

অন্তু ভয়ে ভয়ে এগুলো লোকটার দিকে।

‘এইখানে আইছস ক্যান?’

‘এই যে বল নিতে’

‘বল? বল খেলানোর জায়গা এইটা?’

‘না... আমরা... ঐ মাঠে খেলছিলাম... বলটা চলে আসলো...’

‘চইলা আইলো মানে? ঐ ব্যাটা বলের কি পাও আছে?’

বলে লোকটি অন্তুর হাত হতে বলটি নিয়ে নিল এবং অন্য হাতে অন্তুর ডান হাতটি ধরলো।

‘এই দিকে আয়’

বলে অন্তুকে তার পাশে মাটিতে ফেলে দিল। ফেলে অন্তুর গালে হাত বুলালো।

‘কিরে ভয় পাইছস’

‘হুম... আঙ্কেল আমি আর কক্ষনো এখানে আসবো না, কসম’

‘আরে ছেমড়া ভয়ের কি আছে। আইবি না ক্যান, বল আসলে অবশ্যই আসব...’

বলে লোকটি অন্তুকে তার কাছে টেনে নিল। অন্তু এবার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল।

‘কিরে ভয় পাস ক্যান? আয় তরে একটু আদর করুম’

‘আঙ্কেল আমরা বল খেলছি, বলটা... দেন... আমি যাবো...’

‘যাবি? আচ্ছা জাইস... এখন তর প্যান্টটা খোল...’ বলে কুৎসিত এক হাসি দিল লোকটা।

অন্তু ভয়ে জমে গেল। সে বুঝতে পারছে সে কোন ভয়াবহ বিপদে পড়েছে। তার বন্ধুরা কেউ কেন আসছে না এখনো তার খোঁজে।

‘খোল না, এই ছ্যাম্রা খোল। দেখ তরে অনেক আদর করুম। তর ভালা লাগবো’

এবার অন্তু কান্না শুরু করে দিল। এক অজানা ভয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে সে কান্না জুড়ে দিল। আর বলতে লাগলো, ‘আঙ্কেল আমায় ছেড়ে দেন, আমি আর আসবো না কখনো, আর বল খেলবো না কক্ষনো...’
হঠাৎই অন্তু অনুভব করলো তার হাতটা লোকটা ছেড়ে দিয়েছে। বলটা তার দিকে এগিয়ে ধরেছে। বলটা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্তুর ঐ ছোট ঘরটার দরজা দিয়ে বের হয়ে বড় হলঘরটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। তার মনে হল কোন এক নেকড়ের বাগানে সে কতকাল ধরে দৌড়াচ্ছে, চারদিকের দেয়ালের ইটগুলো মনে হয় শতশত নেকড়ে, খুবলে তাকে খেয়ে ফেলতে ধেয়ে আসছে। সে প্রাণপণ দৌড় দিয়ে মাঠ পেরিয়ে স্কুল গেট পেরিয়ে বাড়ীর দিকে দৌড়াতে লাগলো।

‘মা... মাগো... আমায় বাচাও মা...’

প্রচণ্ড ঘাম দিয়ে অন্তুর ভিজে গেছে, ঘুম ভেঙ্গে খাটে উঠে বসে দেখলো রিপা তার দিকে কেমন অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই এসিরুমে এমন ঘাম দেখে রিপা নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছে। দুই মাস হল অন্তু আর রিপার বিয়ে হয়েছে। অন্তু এক বেসরকারি ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। বারিধারার এই ফ্ল্যাটটা অন্তু গতবছর কিনেছে। আজ সেই প্রায় দুই যুগ আগে শৈশবের সেই ভয়াল ঘটনা কেন স্বপ্নে ফিরে এল?

‘দুঃস্বপ্ন দেখেছো?’ রিপা অন্তুর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল।

‘হুম’

‘পানি খাবে’

‘না...’

‘খুব ভয়ের ছিল? কোন দুর্ঘটনার?’

‘না...’

‘তবে? ভূতের...?’ রিপা মুখে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল।

‘হুম...’

অন্তু চেষ্টা করল স্বাভাবিক হতে। অন্তুর উত্তর শুনে রিপা হাসতে লাগলো। এই বুড়ো বয়সে ভূতের ভয়?

অন্তু রিপাকে স্বপ্নের কথা বলতে পারে না। যেমন পারে নাই দুই যুগ আগে মা’কে বলতে। সেদিন ছুটতে ছুটতে সে সোজা বাসায় চলে আসে বল হাতে। মায়ের ঘরে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মা যতই জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে, সে ততই কাঁদতে থাকে। একটু পরে তার বন্ধুরা বাসায় আসলো, সবাই জানতে চায় কি হয়েছে। বন্ধুদের কাছ থেকে মা সব শুনে বলল, ‘ঐ ঘরে কি কোন খারাপ কিছু দেখেছিলি... মানে কোন ভুত-প্রেত... মানে অন্যরকম কোন মানুষ...’। অন্তু হঠাৎ করেই বুঝতে পারে সে এই ঘটনা কাউকে বলতে পারবে না। তাই সে স্বীকার করে যে সে কোন খারাপ কিছু, মানে ভূত-প্রেত জাতীয় কিছু দেখেছিল।

এরপর অন্তুকে নানান ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, পড়াপানি দেয়া হয়, কারণ সেদিন রাতে অন্তুর প্রচণ্ড জ্বর আসে, বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়। তারপর থেকে অন্তু আর স্কুল মাঠে খেলতে যেত না, স্কুল থেকে সোজা বাসায় চলে আসতো। ঐ লোকটাকে স্কুলে যাওয়া-আসা’র সময় বেশ কয়েকদিন দেখেছে। তাকে দেখে কেমন একটা হাসি দিতো। অন্তুর পুরো শরীর ভয়ে জমে যেত ঐ হাসি দেখে। বাবার বদলীর চাকুরির কারণে সে বছর বার্ষিক পরীক্ষার আগেই অন্তুরা ঐ এলাকা ছেড়ে পাশের জেলায় চলে যায়।

কিন্তু অন্তুর হৃদয়ের গহীনে থেকে যায় সেই ভয়াল স্মৃতি, যা আজ এতো বছর পরেও ফিরে ফিরে আসে। আর যেটার কথা সে কোনদিন, কারো সাথে শেয়ার করতে পারবে না। অন্তু খাট থেকে নেমে শোবার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে আসে। বাইরে নিকষ কালো মধ্য রাতের আকাশ, এখন অমাবস্যা চলছে তাই আকাশে চাঁদ নেই। এমন কি কোন তারাও না। সামনে নিয়ন আলোয় জড়ানো অলস রাজপথ। অন্তুর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে... গ্রহণকালের দুঃস্মৃতিরা কেনো ফিরে ফিরে আসে।

(দুই যুগ আগের একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:১৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×