somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রন্তু'র কালো আকাশ (ছোট গল্প)

২৮ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রন্তু বারবার জানাল দিয়ে বাহিরের খোলা মাঠের দিকে তাকাচ্ছে, তার দৃষ্টি মাঠের শেষ প্রান্তের যে নারিকেল-সুপারির গাছের সারি তার উপরে ঐ আকাশের দিকে। না কোন সুতো কাটা ঘুড়ির দিকে নয়, সে বারবার আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। আজো কি বৃষ্টি হবে, আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা এখন জটলা পাকিয়ে ঘন হয়েছে। আজো কি বাবা আসবে না!

বাবা! লোকটাকে বাবা বলে ডাকতে কেমন সংকোচ হয়ে। কেমন যেন খুব চেনা কিন্তু বড় অচেনা মনে হয় তাকে। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি মনের আনাচে কানাচেতে উঁকি দিয়ে যায়, কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো জোড়া দিয়ে একটা গল্প হয় না। শুধু কিছু আবছা আবছা স্মৃতি।

হঠাৎ পাশের জনের খোঁচায় রন্তু সম্বিৎ ফিরে পেল যেন, ছেলেটার দিকে তাকালো সে। ছেলেটি ইশারায় সম্মুখে ম্যাডামের দিকে তার দৃষ্টি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। নাসরিন ম্যাডাম কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কতক্ষণ তাকে ডেকেছেন আল্লাহ্‌ই জানেন। রন্তু ভয় পেল, নাসরিন ম্যাডাম খুবই ভালো একজন টিচার, ক্লাসের প্রতিটি বাচ্চাকে খুবই স্নেহ করেন। রন্তুকে কেন জানি ম্যাডাম খুব বেশী আদর করেন, সেই নাসরিন ম্যাডাম কেমন রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। রন্তু শুনলো ম্যাডাম তাকে কি যেন বললেন। সে ভয়ে কখন কেঁদে দিয়েছে নিজেও টের পায় নাই। শার্টের হাতায় চোখ মুছতেই ম্যাডামের গলার আওয়াজ তার কানে এল,

‘এই রন্তু কাঁদছিস কেন?’
‘না ম্যাডাম কাঁদছি না তো’
‘তাহলে চোখ মুছছিস কেন?’ বলে ম্যাডাম রন্তুর দিকে এগিয়ে এলেন
‘কি হয়েছে রন্তু? জানালা দিয়ে বাইরে কি দেখছিলি?’
‘আ...কা...শ...’
‘আকাশ! তুই আবার আকাশ দেখা শুরু করলি কবে থেকে?’

এই বলে নাসরিন ম্যাডাম জানাল দিয়ে বাইরের পানে চেয়ে দেখলেন আকাশে প্রচুর মেঘ জমেছে, ঝুম বৃষ্টি হতে পারে। দ্রুত বাচ্চাদের ছেড়ে দেয়া দরকার, তার ক্লাসই শেষ পিরিয়ড; তাই তিনি ছেড়ে দিলেই বাচ্চাদের ছুটি।

‘কিরে আকাশ দেখে কান্না করতে হয়?’
অন্তু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।
‘বাবা আসবে আজ?’ বলে নাসরিন ম্যাডাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন রন্তুর।

রন্তুর চোখে এবার যেন জলের বাণ ডাকলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ম্যাডাম তাকে বসিয়ে ডেস্কে গিয়ে বাচ্চাদের আগামী দিনের হোম টাস্ক দিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। আর ক্লাস হতে বের হবার সময় রন্তুকে গিয়ে বললেন,

‘তোর বাবাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবি। ঠিক আছে? এবারো ভুলে যাস না যেন...’। রন্তু ঘাড় নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিল।
‘আর হ্যাঁ, কথায় কথায় এতো কাঁদিস কেন? ছেলে মানুষদের এত কাঁদতে হয় না বোকা ছেলে, বুঝলি?’।

এবারো রন্তু ঘাড় নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দিল। রন্তু নিজেও কাঁদতে চায় না, কিন্তু কোথা থেকে জানি শুধু কান্নারা চোখে চলে আসে।

আসলে রন্তুর ঠিকই মনে ছিল, গতবার বাবা যখন এল, সে ইচ্ছা করেই বলে নাই। তার লজ্জা করে, স্কুলের প্রতিটি টিচার, প্রতিটি ছেলে মেয়ে তার সমস্যার কথা জেনে গেছে। জেনে গেছে যে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। সবাই কেমন দৃষ্টিতে যেন তার দিকে তাকায়, ম্যাডামরা কেমন যেন একটু বেশী বেশী আদর করেন এখন তাকে। রন্তুর খুব লজ্জা লাগে, খুব। সবাই কেমন করে যেন তাকায়, আর সেই তাকানো দেখলেই তার কান্না পায়। রন্তু তার বেঞ্চে বসে রইল, ক্লাসের সব ছেলে মেয়ে বের হয়ে গেলে পরে সে বের হলো।

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল স্কুলের মাঠ পেরিয়ে মূল ফটকের দিকে। মূল ফটক দিয়ে বের হয়ে সেই প্রতি দিনকার ঘুঘনিওয়ালা, আমসত্ত-আচার বিক্রেতা, মালাই আইসক্রিমওয়ালা বুড়ো চাচা আর চানাচুররর... বলে চেচাতে থাকা সেই চানাচুর মামা। সবার সামনেই ছেলেমেয়েদের ভীড়। সাথে রয়েছে বাচ্চাদের নিতে আসা বাবা-মা’দের ভীড়। এত্ত এত্ত ভীড় ঠেলে তার দু’চোখ তার বাবাকে খুঁজতে লাগলো।

রন্তু এখন ক্লাস টু’তে পড়ে। সে যখন স্কুলে ভর্তি হল, তার কিছুদিন পর থেকে সে তার মা’র সাথে নানাবাড়ী’তে থাকতে লাগলো। প্রথমে রন্তু ভেবেছিল তারা বেড়াতে এসেছে, কিন্তু কয়েকদিন পর যখন সে মাকে জিজ্ঞাসা করলো তারা বাড়ী কবে যাবে? মা তাকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলেছিল, ‘এটা কি বাড়ী না? এটা কি বস্তি? বদ ছেলে কোথাকার?’। রন্তু চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, সে কিছুই বুঝতে পারে নাই মা তাকে কেন চড় মারলো। ধীরে ধীরে রন্তু বুঝতে পেরেছে তারা আর তাদের বাসায় ফিরে যাবে না। বাবা-মা’র ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু কেন তা রন্তু জানে না। সেই তখন থেকে রন্তু নানাবাড়ী’তেই আছে।

এই ক্লাস টু’তে উঠার পর থেকে হঠাৎ করেই বাবা মাসে দুয়েকবার রন্তু দেখতে স্কুল ছুটির পর স্কুল গেটে আসতে লাগলো। নানু তাকে একদিন ডেকে বলল, ‘শোন তোমার বাবা স্কুল গেটে আসবে আজ, তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। সে তোমাকে বাসায় দিয়ে যাবে’। সেই থেকে মাসে একবার কি দু’বার বাবা তার সাথে দেখা করতে আসে। বাবা আসলে রন্তুর কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, সে চুপচাপ থাকে। বাবা কেমন গম্ভীর হয়ে তাকে প্রশ্ন করতে থাকে, পড়ালেখা করে কি না, দুষ্টুমি করে কি না, মা তাকে মারে কি না... আরও কত হাবিজাবি প্রশ্ন। রন্তু মিনমিন করে সে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়।

বাবাকে দেখলে রন্তুর কেমন অস্বস্তি শুরু হয়, বাবা তার হাত ধরে যখন হাঁটতে থাকেন রাস্তা ধরে তার খুব ভালো লাগে তখন। সবচেয়ে মজা হয় বাবা যখন বড় রাস্তার খাবার হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাকে পরাটা-মিষ্টি-দই খেতে দেয়। পরাটা তার খুবই পছন্দের খাবার, কিন্তু বাবার সামনে সেগুলো নিয়ে সে বসে থাকে। নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ, কিন্তু মুখে দেয় না। বাবা তখন খুব রাগী রাগী মুখে ধমকে উঠেন, তারপর নিজ হাতে তার মুখে সেগুলো তুলে দেন। রন্তুর লজ্জা করে এত্ত মানুষের মাঝে এভাবে খেতে আবার কেমন এক ভালো লাগাও কাজ করে।

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, রন্তু কি করবে ভেবে না পেয়ে দৌড়ানো শুরু করলো বড় রাস্তাটার দিকে। প্রায় আধঘণ্টা হবে রন্তু স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে ছিল, সারাক্ষণ তার খুদে চোখদুটি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বাবা নামের মানুষটিকে ইতিউতি খুঁজেছে। কিন্তু বাবা আজ আসেনি, গত মাসেও বৃষ্টির কারণে বাবা আসে নাই। পরপর দুমাস হল বাবা এলো না। রন্তু দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে সেই খাবার হোটেলে ঢুকে পড়ল। প্রতিটি টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে কোথাও বাবাকে না পেয়ে তার খুব কান্না পেল। চোখে হতে গড়িয়ে পড়া জল শার্টের ভেজা হাতায় মুছতে লাগলো। হোটেলে গেটে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝ হতে একজন বলল,

‘এই খোকা কাঁদছো কেন?’
‘কই? কাঁদছিনাতো...’

...বলে রন্তু সেই মানব জটলা ঠেলে রাস্তায় নেমে এল। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুর ছোট ছোট অশ্রুকে গ্রাস করে নিতে লাগলো তার বিশাল জলাধারে। রন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন? সে নিজেও জানে না। এতো কান্না নয়, এ হল রন্তুর কালো আকাশ হতে ঝরে পরা বৃষ্টিকণা। রন্তুর জীবনের কালো আকাশে যে অনেক মেঘ জমেছে এই ছোট্ট সময়েই।


-------------------
ছবিঃ http://www.untitledrecords.com/http://www.helpnyf.wordpress.com

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩০
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×