somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রন্তু'র কালো আকাশ - ৩ (ধারাবাহিক)

২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শায়লা ছেলের পাশে বসলো। রন্তু এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শায়লা রন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। জানালা দিয়ে দূরে ঐ আকাশে একটুকরো চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু আকাশে প্রচুর মেঘ থাকায় চাঁদ বারবার হারিয়ে যাচ্ছে মেঘেদের আড়ালে। শায়লার কাছে তার ছেলে রন্তু ঐ চাঁদের মত দামী। ঠিক হল কি ভাবনাটা? শায়লা নিজেকেই প্রশ্ন করে। ঐ চাঁদের জীবনে অমাবস্যা আছে, কলঙ্ক আছে। রন্তুর জীবনে সেগুলো আসুক শায়লা তা চায় না। কিন্তু না চাইতেও ঐ কালো মেঘের দল যেমন চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে, তেমনি রন্তুর জীবনেও না জানি কতশত কালো মেঘের দল ধেয়ে আসছে। ভাবতেই দুফোঁটা অশ্রুজল শায়লার চোখ হতে আবার ঘুমিয়ে পড়া রন্তুর গায়ে গিয়ে পড়ল।

-------------------

'রন্তু'র কালো আকাশ' এর গত পর্ব এখানেই শেষ হয়েছিল। কিন্তু গল্পটা লেখার পর থেকেই মনে হচ্ছিল না এই গল্পের শেষতো এখানে হয় নাই। এই গল্পের শেষ হয়েছিল আরও কঠিন কোন সময়ে। আর সেই সময়টা খুঁজে পেতেই 'রন্তুর কালো আকাশ' ছোটগল্প থেকে ধারাবাহিক হিসেবে লেখার এই অপপ্রয়াস। যারা আগের দুটি পর্ব মিস করেছেন তাদের জন্য লিংক দিয়ে গেলামঃ
রন্তু'র কালো আকাশ - ১
রন্তু'র কালো আকাশ - ২

------------------- 

৩.
শায়লাদের এই বাড়িটা একতলা। শায়লার বাবা সরকারী কেরানী ছিলেন, তাই পৈত্রিক এই ভিটায় তিনি কোন দালান তুলতে পারনে নাই। একতলা এই পুরানো আমলের বাড়ী’র মাঝখানে উঠান রেখে চারিদকে ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল। উঠোনে এখনো একটা নারিকেল গাছ আছে, যা শায়লার দাদী নিজ হাতে লাগিয়েছিল। মোট চারটে ঘর চারদিকে রেখে মাঝখানে উঠোন। পূবপাশের ঘরটা শায়লার, বিয়ের আগে শায়লা এই ঘরটাতেই থাকতো। জাভেদের সাথে বিয়ের পর থেকে ঘরটা ফাঁকাই ছিল, শায়লার বড় ভাই ভাড়া দিতে চেয়েছিল কিন্তু মা দেয় নাই। শায়লার বিয়ের মাস ছয়েক আগেই তার বাবা মারা গেলেন। শায়লা কলেজে যাওয়া আসার পথে জাভেদের সাথে দেখা হত, জাভেদ কলেজের রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিত। সেই থেকে কখন কীভাবে পরিচয়, পরিণয় এবং দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। সব আজ কেমন ঝাপসা লাগে শায়লার কাছে।

রন্তু এখনো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে, কাল রাতে জ্বর আরও বেড়েছিল, সারারাত মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়ে পার করেছে। ছেলেটা যে কার মত হল আল্লাহ্‌ই মালুম। শায়লা বা জাভেদ কারো সাথেই ছেলের স্বভাব চরিত্র মিল খায় না। জাভেদের কথা মনে পড়তেই শায়লার মুখ ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠে। জাভেদ একটা মানুষ নয়, মানুষ নামের হিংস্র পশু সে শায়লার কাছে। বিয়ের আগে কতশত ভালোবাসার গান...! বিয়ের পর একে একে বের হয়ে আসলো তার আসল রূপ। অল্পতেই রেগে যাওয়া আর রাগলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে শায়লার গায়ে হাত তোলা... এ ছিল নিত্যকার ব্যাপার।

মজার ব্যাপার ছিল, রাগ কমে আসলে জাভেদের হাস্যকর আচরণগুলো। কতশত পাগলামি যে করতো, কানে ধরা, নিজেকে নিজে চড় মারা আরও কত কি। প্রথম প্রথম শায়লা খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলো ব্যাপারগুলোকে। অনেকের খুব রাগ থাকে, রাগ কমলে আনুশোচনা হয়; জাভেদকেও শায়লা তেমনই ভেবেছিল। কিন্তু দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যেতে লাগলো, জাভেদের মধ্যে নতুন রোগ দেখা দিল সন্দেহ বাতিকগ্রস্থতা। অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে গেল যে, একরাতে জাভেদ কুকুর-বেড়ালের মত পেটালো শায়লাকে, তুচ্ছ এক সন্দেহের কারণে। অমানুষিক প্রহারে শায়লা অচেতন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ চেতনা ফিরতে দেখে ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জাভেদ নিজে নিজের হাত থেতলে দিয়েছে। শায়লা দৌড়ে কাছে যেতেই তাকে হাসি মুখে বলল, ‘শায়লা দ্যাখো, এই হাত...এই হাত তোমার গায়ে তুলেছি আমি! তাই এই হাতকে শাস্তি দিলাম...’। এই বলে কেমন অপ্রকৃতস্থ মানুষের ন্যায় হাসতে লাগলো।

সেদিন সকালের আলো ফুটতেই শায়লা রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। জাভেদ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে তাকে বুঝিয়ে ফেরত নিয়ে যেতে, কিন্তু শায়লা রাজী হয় নাই। সেই রাতে জাভেদের চোখে যে পশুর চাহনি দেখেছে সে, সেই চাহনিকে শায়লার বড্ড ভয়। বছর খানেকের মাথায় মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়েছে তাদের, জাভেদ কোনরকম ঝামেলা করেনি। মাঝে মাঝে স্কুলের গেটে এসে রন্তুকে দেখে যায়, কখনো-সখনো বাসার গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়।

শায়লা দ্রুত নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রন্তুকে এক নজর দেখে নিয়ে বাসা হতে বের হল, গত আট মাস হল সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পারসোনাল এসিস্টেণ্ট এর চাকুরী করছে। কলেজের গণ্ডি না পেরুতেই বিয়ে, একাডেমীক কোয়ালিফিকেশন না থাকায় এর চেয়ে ভালো কিছু সে আশাও করে নাই। এই যবটাও পেয়েছে তার এক কাজিনের বাবার অফিসে, ঐ আঙ্কেলেরই পিএ হিসেবে। শায়লাদের বাসাটা একটু গলির ভেতরের দিকে, বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে রিকশা নিতে হয়। আজ লেট হয়ে গেছে, শায়লা দ্রুত পা চালাল।

রন্তু’র ঘুম ভাঙ্গলো বেলা দশটার পরে, এখন তেমন জ্বর নেই, কিন্তু কাশছে সমানে। ঘড়ির কাটা দশটা পেরুনো দেখে রন্তু চিৎকার করে নানুকে ডাকতে লাগলো। রন্তুর নানু ছিলেন রান্না ঘরে, দৌড়ে আসলেন...

‘এই ছাগল কোথাকার, এত চেঁচাচ্ছিস কেন?’

‘এখন কয়টা বাজে তুমি দেখনি? আমার যে স্কুল মিস হয়ে গেল...’

‘হয়েছে আমার স্কুলওয়ালা, এতোই যখন স্কুলের চিন্তা তখন বৃষ্টিতে ভেজার সময় মনে ছিল না? জ্বর বাঁধিয়ে উনি এখন স্কুলগিরি ফলাচ্ছেন’

রন্তুর মনে পরে গেল কাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে বাসায় ফিরেছে এবং জ্বর এসে হানা দিয়েছে তার শরীরে।

‘নবাবজাদা এখন কি জ্বর আছে?’ বলে নানু এগিয়ে এসে কপালে হাত দিলেন।

‘হুম, খুব অল্প। নে, এখন বিছানা থেকে ওঠ। দাঁত ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে আয়’

রন্তু বিছানা থেকে নামলো।

‘আর শোন নাস্তায় দুধ পাউরুটি... কোন ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না খবরদার, নাইলে পিটিয়ে তক্তা করে দিবো।’

দুধ পাউরুটির কথা শুনেই রন্তুর গা গুলিয়ে উঠলো। ইয়াক, এসব মানুষ খায়? উহ... নানুকে নিয়ে আর পারা গেল না। রন্তুর জ্বর হলেই তাকে এই বিচ্ছিরি খাবারটা খেতে দেয়, ধুর ভাল্লাগে না। রন্তু বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো।

ফ্রেশ হয়ে নাস্তা শেষ করার পর রন্তুর হাতে কোন কিছু করার ছিল না, শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগে না। এখনো হালকা হালকা শীত লাগছে, কিন্তু কেমন আরামও লাগছে। একবার ভাবলো ড্রইং খাতাটা নিয়ে বসে, কিন্তু মন টানলো না। সে চলে এলো ছাদের উপরে চিলেকোঠার ঘরে, ছোট মামার ডেরায়। শায়লারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাইয়ের পর শায়লা, আর শায়লার বছর তিনেকের ছোট আরেক ভাই। রন্তুর ছোট মামা শিবলি, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পরে, রন্তুর খুব পছন্দের মানুষ ছোট মামা। ছোট মামার ঘরে ঢুকে দেখে মামার দুই বন্ধুকে নিয়ে দাবা খেলায় মশগুল। গুটি গুটি পায়ে মামার ঘরে ঢুকলো রন্তু।

‘আরে রন্তু সাহেব যে, কি খবর? জ্বর সাহেব কি আছেন না গেছেন?’

রন্তুর ছোট মামাটা না খুব মজার, রন্তুকে সব সময় সাহেব বলে ডাকেন। মামার বন্ধুগুলোও তাকে রন্তু সাহেব বলেই ডাকে।

‘গেছেন...’ বলেই রন্তু একটা হাসি দিল।

‘তো, ভালই চালাকি শিখেছিস তাই না? জ্বর বাঁধিয়ে স্কুল কামাই...’

‘মোটেও না, আমি স্কুল কামাই দিতে চাই নাই। মা-নানু কেউ আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয় নাই।’

‘আহালে... আর তুই যে কাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালি’

রন্তু কোন উত্তর দিল না, সে একমনে মামাদের দাবা খেলা দেখতে লাগলো। কিছুদিন হল রন্তু ছোট মামার কাছ থেকে দাবা খেলা শিখেছে। মামা যখন একা থাকে, বিকেল বেলা, তখন মাঝে মাঝে রন্তুকে নিয়ে দাবা খেলা শেখায়। রন্তু সবসময় তিন চালে মামার কাছে হেরে যায়। মামাটা না খুব পচা, প্রতিবার তাকে তিন চালে হারিয়ে দেয় শুধু। তবে মামার দোষ না, মামা প্রতিবার তাকে শেখায় কোন ঘুটি প্রথমে চাললে কখনো কেউ তিন চালে হেরে যায় না। কিন্তু রন্তু প্রতিবারই ভুলে যায় আর তিন চালে হেরে যায়।

মামার এক বন্ধু হঠাৎ বলল, ‘রন্তু সাহেব, কাল তোমার বাবাকে দেখলাম সকাল বেলা, বৃষ্টিতে এক দোকানে দাঁড়িয়ে’। বাবার কথা উঠতেই রন্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল, বাবার উপর খুব অভিমান হল। রন্তু যদি ভিজে ভিজে বাসায় ফিরতে পারে, বাবা কি ভিজে ভিজেই রন্তুর সাথে দেখা করতে আসতে পারলো না। রন্তু ছোট মামার ঘর থেকে ছাদে চলে এলো। সকালের রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ, কিছু ধবধবে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কোন এক বাসা হতে কেউ লাল রঙের একটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঘুড়িটাকে দেখে রন্তুর মনে হল, সে যদি ঐ ঘুড়িটার মত উড়ে উড়ে ঐ সুদূর আকাশে হারিয়ে যেতে পারতো। অনেক দূরে, কোথায় তা রন্তুর জানা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×